হিমি পর্ব-৩২+৩৩

0
950

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৩২.

সন্ধ্যা সাতটা বাজে। খাটে আধশোয়া হয়ে বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসেছিলেন মতিউর রহমান। ঘরে ছেলেরা আছেন এখনো। সারাদিন ধরেই তারা এ ঘরে ছিলেন। মাঝে মাঝে নিজেদের ঘরে গেছেন আবার‌ও ফিরে এসেছেন। মতিউর রহমান আপাতত সুস্থ বোধ করছেন। বিকেলে একবার জ্ঞান হারিয়েছিলেন। আবার জেগে উঠবেন তা তিনি ভাবেন নি। তবে জেগে উঠেছেন দেখে অন্যরকম শান্তি অনুভব হচ্ছে ওনার মনে। অস্বস্তিভাবটাও কেটেছে কিছু। একটু আগেই জাউ ভাত খেয়ে ঔষধ খেয়েছেন। এখন আবার‌ও শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমিনা বেগম ঘরে ঢোকে কাউকে ভেতরে আসতে ডাকলেন। মতিউর রহমান কপাল কুঁচকে ঘাড় উচালেন। ঘরে ঢোকলেন দুজন মাঝবয়সী মহিলা আর পুরুষ। মতিউর রহমান এদেরকে চেনেন। গত দিন দেখাও হয়েছিলো। হাশিম শরীফ আর ওনার স্ত্রী রোশন আরা। পেছন পেছন ঢোকলো গোলগাল চেহারার পিচ্চি করে দেখতে এক মেয়ে। গায়ে তার খয়েরি রঙের জামা। দেখতে ভারি মিষ্টি। মতিউর রহমান কৌতুহলী দৃষ্টিতে দেখলেন মেয়েটিকে। হাশিম শরীফ আর ওনার স্ত্রীর বলা কথা কিছুই কর্ণগোচর হয় নি মতিউর রহমানের। হাশিম শরীফ মেয়েটিকে ইশারা করতেই সে নম্র গলায় সালাম জানালো মতিউর রহমানকে। মেয়েটির শুদ্ধ উচ্চারণে মতিউর রহমানের চোখ উজ্জল হয়ে উঠলো। মৃদু হেসে সালামের জবাব দিয়ে ছেলে মুহিবের দিকে তাকালেন। মুহিব রহমান হাসি হাসি মুখে বললেন,

-হাশিম ভাইয়ের মেয়ে। মিশ্মি।

মতিউর রহমান মাথা দুলালেন। ঘাড় হালকা উচিয়ে বাইরে দৃষ্টি রেখে বললেন,

-হানিফ শরীফ আসেন নি?

হাশিম শরীফ অপ্রস্তুত হাসলেন। বললেন,

-আমরা যে আসছি, ভাইসাবকে জানাই নি।

-ওহ, তা কেনো এলে?

মতিউর রহমান বেশ স্বাভাবিক গলাতেই প্রশ্ন করলেন। হাশিম শরীফ মৃদু গলায় বললেন,

-আপনি অসুস্থ শুনলাম। তাই দেখতে এলাম। কুশলাদি করেই চলে যাবো।

-যাবে কেনো? বসো বসো। খেয়ে দেয়ে যেও! তা তোমার ছেলে মেয়ে কজন?

হাশিম শরীফ ঠোঁট চ‌ওড়া করে বললেন,

-আল্লাহ্‌র রহমতে এক মেয়ে।

-শুধু এক মেয়ে?

-জি আলহামদুলিল্লাহ, একজন‌ই!

হাশিম শরীফের কথায় মতিউর রহমানের মন প্রফুল্লিত হলো। ভদ্রলোক অতিশয় ভদ্র। আল্লাহ্ ভীরু। মেয়েটাও নিশ্চিত এমন হবে। রোশন আরা মতিউর রহমানের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,

-চাচার শরীর এখন কেমন?

-ভালো। এখন ভালোই। এই মেয়ে তোমাদের। না?

হাশিম শরীফ আর রোশন আরা দুজনেই মাথা নাড়লেন। মতিউর রহমান মাথা দুলিয়ে বললেন,

-নাম কি?

-মেহজাবিন জাহান মিশ্মি।

মতিউর রহমান হাতের ইশারায় মিশ্মিকে কাছে ডাকলেন। সে এগিয়ে এসে খাটের কোনায় দাঁড়ালো। মতিউর রহমান গলা কেশে বললেন,

-কিসে পড়ো?

-অনার্স সেকেন্ড ইয়ার।

-ওহ।

মিশ্মি নিজ থেকেই বললো,

-আপনি বিশ্রাম করুন দাদু। আমরা বরং বাইরে বসি!

হাশিম শরীফ মাথা নেড়ে সায় জানালেন। মুহিব রহমান তাদের নিয়ে বাইরে এলেন। আমিনা মতিউর রহমানকে খাটে শুইয়ে কাঁথা গায়ে জড়িয়ে দিতেই তিনি ফিসফিস করে বললেন,

-এই সেই মেয়ে? তোমার ভাতিজা যাকে চিঠি দিতো?

আমিনা বেগম অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে মাথা নাড়লেন। মতিউর রহমান খানিক দম নিয়ে বললেন,

-মেয়ে তো দেখতে শুনতে ভালোই। বেশি ছোট‌ও নয়, না?

আমিনা বেগম এবার‌ও মাথা নাড়লেন। মতিউর রহমান আবার‌ও কিছু জানতে চাইবেন তার আগে আমিনা আটকে দিলেন। বললেন,

-বাবা এখন আপনি ঘুমান। আর কথা না। বাকি কথা কাল সকালে হবে। কোনো দরকার হলে ডাক দিবেন। আমি এখানেই থাকবো।

মতিউর রহমান অনিচ্ছা সত্ত্বেও চোখ বুজলেন।

___________________

জায়নামাজ হাতে উঠে দাঁড়িয়েই ভাইঝি হৃদির হাতের দিকে দৃষ্টি গেলো মায়মুনা জামানের। রাগান্বিত স্বরে বললেন,

-নখে নেইলপলিস ‌কেনো?

হৃদি থতমত খেয়ে যায়। মোবাইল বন্ধ করে হাতের মুঠোয় রেখে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে। মায়মুনা কর্কশ গলায় বলেন,

-হাসার কথা বলি নি আমি। নামাজ পড়িস না কেনো তুই?

হৃদি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। আমতা আমতা করে বললো,

-আসলে ফুপি, ওই আমার না,,,,,

-অজুহাত দেবে না একদম। নখ পরিষ্কার করে এসে নামাজে বসো। যাও। কালকেও তোমাকে দেখেছি নামাজের সময় মুখে কিসব মাখছো। এসেছো থেকে সারাদিন তো এসব‌ই করতে দেখি। নামাজ পড়তে দেখি না কেনো? পারো না? পড়ো নি কখনো?

-পড়েছি ফুপি। আমি নামাজ পড়তে পারি।

-পারো তবে পড়ো না কেনো?

-সরি।

-সরি আমায় বলছো কেনো? যাও নামাজ পড়ে আল্লাহ্‌র কাছে মাফ চাও। এখন থেকে রোজ নামাজ পড়বে। এক ওয়াক্ত‌ও যেনো বাদ না যায়। আর গায়ের ওড়না এতো ছোট কেনো? বড় ওড়না পরবে এখন থেকে। মনে থাকে যেনো!

হৃদি মাথা দুলালো। মায়মুনা জামান বেরিয়ে যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শোবার ঘরে ঢোকলো। ড্রেসিং টেবিল থেকে নেইল পলিস রিমুভার নিয়ে নখে ঘষলো। ঘুম পাচ্ছে হৃদির। বিদেশে কেউ তাকে নামাজ পড়তে জোর করে নি বলেই সে পড়ে নি। কিন্তু এখানে পড়তে হচ্ছে। ব্যাপারটা মন্দ নয়। তবে মাঝে মাঝে ভীষন বিরক্তের মনে হয়।

সোফায় বসে কোলের উপর ল্যাপটপ রেখে কাজ করছিলো তাহির। মায়মুনা তসবি পড়তে পড়তে ঘরে ঢোকলেন। তাহির চোখ তুলে তাকালো না। মায়মুনা তাহিরের পাশেই বসে পরলেন। এবার কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো তাহির। পাশে একপলক তাকিয়েই বললো,

-কিছু বলবে মা?

মায়মুনা তসবি পড়া শেষ করলেন। তারপর কথা পাড়লেন,

-তোমার কাজ কি বেড়ে গেছে?

তাহির মৃদু হাসলো। বললো,

-ডাক্তারদের কাজ সব সময় বেশিই থাকে।

-আজকাল একটু বেশিই করতে দেখছি তাই জিজ্ঞেস করলাম।

তাহির ল্যাপটপ বন্ধ করে টেবিলে রেখে মায়ের দিকে ঘুরে বসলো। শান্ত গলায় বললো,

-কোথায় বেশি? প্রতিদিনের মতোই চেম্বার, হাসপাতাল, প্যাশেন্ট্স। এক্সট্রা কিছু তো না।

মায়মুনা মুখ কালো করে বললেন,

-যদি তাই হয়ে থাকে তবে মাঝরাতে থাকো কোথায় তুমি? তোমার ফিরতে দেরি হচ্ছিলো তাই রেজাকে ফোন দিয়েছিলাম কাল। বললো তুমি তাড়াতাড়িই বেরিয়ে গেছো। অথচ বাড়ি ফিরেছো রাত একটায়। কি করছিলে, কোথায় ছিলে কিছুই তো বললে না।

তাহির জবাব দিলো না। চুল পরিপাটি করে চশমা খোললো। নীল টি শার্টে চশমার কাঁচ মুছে চোখ রগরালো। মায়মুনা জামান অভিমানী গলায় বললেন,

-তুমি কি আমার উপর বিরক্ত তাহির?

তাহির চমকালো। বললো,

-এসব কি বলছো মা? বিরক্ত কেনো হতে যাবো?

-কেনো হবে না? আমি তোমার কাজের সময় বার বার ফোন করি, বাড়ি ফেরার পর তোমার ঘরে এসে বসে থাকি, বার বার এক‌ই প্রশ্ন করি। তুমি বিরক্ত হ‌‌ও না?

-না। আমার ভালো লাগে।

-কি ভালো লাগে?

-তোমার কল দেয়া, কথা বলা, প্রশ্ন করা। সব‌ই ভালো লাগে।

-তুমি আবার মিথ্যে বলছো?

তাহির ধীর স্থীর গলায় বলে,

-আমি মিথ্যে বলছি না মা।

মায়মুনা জামান তাহিরের কথা না শুনেই বলে উঠেন,

-তুমি তোমার বাবার মতো হয়ে যাচ্ছো। মিথ্যেবাদী।

তাহির কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে প্রশ্ন করে,

-বাবা মিথ্যেবাদী ছিলেন?

-হ্যা। তোমার বাবা ঘন ঘন মিথ্যে বলতেন। যে প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানাতে চাইতেন না সে প্রশ্নের জবাবে মিথ্যে বলতেন। কখনো আবার সত্য আড়াল করতে মিথ্যে বলতেন।

-তোমার কি মনে হয় আমি বাবার মতোই মিথ্যে বলি?

মায়মুনা ফিচেল গলায় বললেন,

-তোমার বাবার মিথ্যে কথা বলার পেছনের কারন আমি ধরতে পারতাম না। আর তোমার বলা মিথ্যে কথাটাই আমি বুঝতে পারি না। সব কেমন অগোছালো হয়ে যায়। আচ্ছা, তুমি কি তোমার বাবাকে পেয়েছো?

তাহির দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলে,

-তুমি মানা করেছিলে খুঁজতে।

-খুঁজো নি তার মানে।

-খুঁজবো?

মায়মুনার ভেতরটা কেঁপে উঠে। চেহারায় স্বাভাবিকতা প্রস্ফুটিত করে বলেন,

-খুঁজে কি হবে? না তোমার বাবা ফিরবে আর না তুমি ফেরাতে পারবে। যে চলে যাওয়ার ছিলো চলে গেছে। শুধু শুধু তার সাথে জড়িয়ে গিয়ে ভবিষ্যত ধ্বংস হবে। বাদ দাও।

কথা বলতে বলতেই উঠে দাঁড়ালেন মায়মুনা। দরজার কাছে গিয়েও ফিরে তাকালেন তিনি। গম্ভীর গলায় বললেন,

-মৃত্তিকার সাথে যোগাযোগ আছে তোমার?

তাহির যেনো হোঁচট খেলো। টেবিল থেকে চশমাটা উঠিয়ে নাকে বসিয়ে চোখের দিকে ঠেলে দিয়ে বললো,

-কে মৃত্তিকা? চিনলাম না!

তারপর ল্যাপটপ কোলে তোলে নিয়ে ব্যস্ততা দেখিয়ে কাজে লেগে পরলো। মায়মুনা কাঠ কাঠ গলায় বললেন,

-মিতাকে মনে আছে? তার মেয়ে। তোমার তো চেনার কথা!

তাহির প্রত্যুত্তর করলো না। কাঁপা কাঁপা হাতেই কি বোর্ড চাপতে লাগলো। মায়মুনা কিছুক্ষন সময় নিয়ে ছেলেকে দেখলেন। বুক ভরে নিশ্বাস টেনে বেরিয়ে গেলেন তারপর। তাহির এখনো কাজে ব্যস্ত। মায়ের প্রশ্নের বান থেকে বাঁচতে কাজ‌ই সম্বল তার।

চলবে,,,,,,,,

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৩৩.

শেষ রাতের ঝুম বৃষ্টির পর সকালের সূর্যের আলো ফুটেছে এই মাত্র। গাছের পাতাগুলো ঘন সবুজ দেখাচ্ছে। দূরে কোথায় থেকে থেকেই পাখি ডাকছে। বড় রাস্তাটা বৃষ্টির পানিতে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে আছে। হিমি গতকাল সন্ধ্যার পর মামার বাড়ি এসেছে। ছোটবেলায় এক নাগারে এক মাস এক জায়গায় থাকতো। কিছুটা বড় হ‌ওয়ার পর মাসের পনেরো দিন এ বাড়ি পনেরো দিন ওবাড়ি। তার থেকে স্কুলের গন্ডি পেরুনোর আগে সপ্তাহ হিসেবে থাকা হতো। এখন এক রাত এবাড়ি থাকলে পরের রাত ওবাড়ি থাকতে হয়। আসলে ব্যাপারটা হলো বাড়ির কর্তা তাকে একাধারে অনেক দিন অন্ন ধ্বংস করতে দিতে চান না। একে তো নেই মা তার উপর বাবাও তার কাজ ফাজ করেন না। আর যাই হোক টাকা পয়সায় তো তার থেকে সাহায্য পাওয়া যায় না তাই এই নীতি। যার মা নেই তার কিছুই নেই। এই কথাটা হিমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। সেই বিশ্বাসের কারনেই খুব রাগ হয় তার। মায়ের উপর রাগ হয়, নিজের উপর‌ও হয়। মাঝে মাঝে মায়ের অপারেশন কথা ডাক্তারের উপর‌ও রাগ হয়। ডাক্তার কি পারতো না তার মাকে বাঁচাতে? দরকার পরলে হিমিকে মরতে দিতো। মা তো বাঁচতো! পরে নিশ্চয় হিমির মতো বা তার চেয়েও ভালো সন্তান পৃথিবীতে আসতো। হিমির বাবা মা তাদের স্বপ্নের ছোট্ট সংসার সাজিয়ে নিতে পারতেন। বাবা অসুস্থ‌ও হতেন না। কেউ অখুশি হতো না। বরং দু পরিবারে‌ই ভালো সম্পর্ক হতো। মামানি হয়তো হিমির বাবা মাকে বাজে কথা বলতেন না। ভালোবাসতেন। সবকিছুই ঠিক থাকতো যদি না, হিমি বাঁচতো। ডাক্তারগুলোর কোনো সেন্স নেই। সবে দুনিয়ায় আসা বাচ্চাটাকে না বাঁচিয়ে সংসারী মানুষটাকে বাঁচানো উচিত ছিলো। ওই বাচ্চাটার জন্য হয়তো দিন দশেক কাঁদতো বাবা মা। পরে ভুলে যেতো। তা না করে জীবন যুদ্ধে মাকে হারিয়ে শিশুকে বাঁচালো। সেই শিশুকেও আবার তার বাবা চায় নি। কি অদ্ভুত! মা বাবা তো ছেলে বাবু চেয়েছিলো, উপর‌ওয়ালা মেয়ে পাঠালেন। মেয়েরা আল্লাহ্‌র নেয়ামত হলে হিমি কে কেনো সবাই অভিশাপ ভাবে? এমন হাজার‌ও চিন্তা হিমির মাথায় ঘুরপাক খায়। কখনো সে উত্তরগুলো খুঁজে, কখনো নিজ থেকে বানিয়ে নেয়। কখনো আবার আনমনে হাসে।

মুঠোফোনের বাজখাই রিংটোন শোনে গভীর ঘুমে ছেদ ঘটে হিমির। চোখ মুখ কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বালিশের নিচ হাতড়ে মুঠোফোন হাতে উঠায়। চোখ মেলে স্ক্রিনে তাকায়। চোখের সামনে ঝাপসা লাগছে সব। হিমি উঠে বসে। একহাতে চোখ কচলে আবার স্ক্রিনে তাকালো সে। বার কয়েক চোখ পিটপিট করে ফোন কানে ঠেকালো। চেহারায় হাসি ফুটিয়ে ঘুম ভাঙা গলায় বললো,

-কেমন আছো জ্যাঠুমনি?

অপর প্রান্ত থেকে মোজাম্মেল রহমান হেসে বললেন,

-দূর্দান্ত। তুই কেমন আছিস?

-ভালো।

হিমির জবাব পছন্দ হয় নি মোজাম্মেল সাহেবের। কিছুটা গম্ভীর গলায় বললেন,

-শুধু ভালো?

হিমি হাই তুলে বললো,

-হু শুধু ভালো। এতো সকালে ফোন করলে?

মোজাম্মেল সাহেব রহস্যের হাসি হেসে বললেন,

-তোর শুধু ভালো থাকাকে বাড়িয়ে দিতে।

-মানে?

-মানে হলো গিয়ে, তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। যদিও বাড়ির সবার জন্য‌ই সারপ্রাইজ তবে তোর জন্য একটু বেশিই।

হিমি উচ্ছল কন্ঠে বললো,

-সারপ্রাইজ? কি? বলো না!

-আমি বাড়ি ফিরছি।

হিমি যেনো কথাটা শুনলো না। অতি স্বাভাবিক গলায় বললো,

-আচ্ছা। এবার সারপ্রাইজটা কি সেটা বলো?

মোজাম্মেল সাহেব থ হয়ে গেলেন। ওনার দেশে ফেরাটা যে সারপ্রাইজ সেটা হিমি বুঝলো না? কেনো বুঝলো না? তার তো উচিত ছিলো ‘সারপ্রাইজ’ শব্দটা শুনেই লাফিয়ে বলে উঠা, ‘তুমি দেশে ফিরছো জ্যাঠুমনি?’ সেসব না করে জ্যাঠুমনির দেশে ফেরার কথাটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দিব্যি কথা বলছে? সারপ্রাইজ জানতে চাইছে? এটা কেমন কথা? হিমি তার জ্যাঠুমনির ফিরে আসায় খুশি নয়? না থাকার‌ই কথা। জ্যাঠুমনিই বা কে তার? তার সবকিছু তো তার বাবা, বড়মা আর পরিবারের বাকি সদস্যরা।

হিমি অনেকক্ষন যাবত মোজাম্মেল সাহেবের আওয়াজ না শুনে বললো,

-জ্যাঠুমনি? বলবে তো!

মোজাম্মেল সাহেব অভিমানী গলায় বললেন,

-যাহ বলবো না তোকে কিছু। কোনো সারপ্রাইজ টারপ্রাইজ নেই। আমি এমনি বলেছি। রাখ এখন।

হিমি ভড়কে গেলো। উত্তেজিত গলায় বললো,

-তুমি রেগে যাচ্ছো?

-হ্যা তুই তো আমার রাগ দেখবি। আর কিছু তো দেখবি না!

-কি হয়েছে বলো তো তোমার? ‌এই সকাল বেলা ফোন করে ঘুম ভাঙিয়ে এখন আভোল তাবোল বকছো কেনো?

-তোর ঘুম ভেঙেছে বলে তুই ঠিক করে কথা বলছিস না আমি বুঝতে পেরেছি। রাখ তবে। ঘুমা।

হিমি ভ্রু কুঁচকালো। মোজাম্মেল সাহেব ফোন কেটে দিলেন। হিমি বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হলো। চুল আঁচড়ে মোটা বেল্ট দিয়ে উপরে ঝুটি করতে করতে জ্যাঠুমনির বলা কথাগুলো রিপিট করলো। তারপর চোখ ঝাপটিয়ে তুমুল উৎসাহ নিয়ে মোজাম্মেল সাহেবকে ফোন লাগালো। প্রথম বারেই রিসিভ হলো ফোন। তবে মোজাম্মেল সাহেব কোনো কথা বললেন না। হিমি কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে কৌতুহলী গলায় জানতে চাইলো,

-তুমি সত্যি দেশে ফিরছো?

-জেনে কি করবি? ঘুম নষ্ট হলো তো। এখন না ঘুমিয়ে জেগে আছিস কি করতে?

হিমি সেসব কথা পরোয়া না করেই বললো,

-তুমি কাল‌ই আসবে?

মোজাম্মেল সাহেব জবাব দিলেন না। তীব্র অভিমান হয়েছে তার। হিমি দু সেকেন্ড মতো থম মেরে থেকে লাফাতে লাগলো। উত্তেজিত গলায় বলতে লাগলো,

-ইয়েএএ,,,,জ্যাঠুমনি দেশে ফিরছে! মামু? জ্যাঠুমনি দেশে ফিরছে। ইয়েই! আমি ওবাড়ি গেলাম। সবাইকে বলতে হবে। (ফোন কানে ঠেকিয়ে) হ্যালো, জ্যাঠুমনি? থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ সোওওওওও মাচ! ‌আমার দিনটাকেই একদম খুশি খুশি করে দিলে তুমি। তাত্তারি চলে এসো! উফ, কতো বছর পর তোমায় সামনাসামনি দেখবো বলো তো! বড়মা তো খু‌শিতে পাগল হয়ে যাবে। আর দাদুর রোগ বালাই সব একশো হাত দূরে দৌড় লাগাবে। আই লাভ ইউ জ্যাঠুমনি। টাটা রাখছি।

মোজাম্মেল সাহেব হো হো করে হাসতে লাগলেন। যাক, হিমি তবে আগের মতোই আছে। একদম ছোট্টটি! শুধু শুধু অভিমান করেছিলেন মেয়েটার উপর। ঘুমের ঘোরে কি শুনতে কি শুনেছে!

____________________

রাদিবা মুখ ফুলিয়ে আছেন সকাল থেকে। শ্বশুর স্বামী ভাসুর সবাই এক কথায়। বড় জা‌ও তাদের দলে। উনি একা বিরোধী দলের সাথে কতক্ষন লড়বেন? শেষমেষ হার স্বীকার করেছেন। তবে মন থেকে মেনে নেন নি। ওনার ছেলের বিয়ে কার সাথে হবে, কবে হবে সেসব তো উনি ডিসাইড করবেন। অথচ এ বাড়িতে তার কোনো অধিকার নেই। কেউ তাকে গ্রাহ্য করে না। এমনকি স্বামী নেহাল রহমান‌ও না। ছেলে তো না,ই! অপমানে কান্না আসে তার। এদিকে বড় জা আমিনা বেগম যেনো বাড়ির কর্ত্রী। মুখে কিছু না বললেও কি সুন্দর করে সবাইকে নিজের কথায় উঠবস করাচ্ছে। বিয়ের এতো বছর পর‌ও মা হতে না পেরেও শ্বশুরবাড়ির মাটি কামড়ে পরে আছে। শ্বশুর মশাইয়ের কোনো আপত্তি নেই। তাকে কেউ আজ পর্যন্ত এ বিষয় নিয়ে কটু কথাও শোনায় নি। সেই এক‌ই জায়গায় যদি রাদিবা থাকতেন? তবে? নিশ্চয় উঠতে বসতে খোঁটা দিতো সবাই। এক‌ই বাড়ির দুই ব‌উয়ের মধ্যে এতো তফাত রাখা হয়েছে! অসুস্থ শ্বশুর মশাই এখন সব কথাতেই বড় ব‌উমার হ্যা তে হ্যা মিলাচ্ছেন। কেউ না থেকেও ওই মহিলার সব আছে, আর রাদিবার সব থেকেও কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। ঈর্ষা হচ্ছে রাদিবার। কার না কার সাথে ছেলের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন মতিউর রহমান। আর তিনি মুখ খোলে কিছু বলতে পারছেন না। কথা শুরুর আগেই বৃদ্ধ মতিউর রহমান বলে উঠেছেন,

-আমি আর কদিন বাঁচবো! কাল‌ই তো চলে যাচ্ছিলাম মনে হলো। আল্লাহ্ রহম করেছেন। আর কতদিন? ‌একবার নাতি নাতনিদের হিল্লে করে দেই, তারপর শান্তি পাবো। আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নিহানের বিয়েটা করিয়ে দেই। কি বলো?

রাদিবা কিছু বলতে যাবেন তার আগেই তিনি আবার বলে উঠেছেন,

-আমার কথাই যদিও শেষ কথা তবুও তোমরা ভাবো। আসলে, মেয়েও ভালো। তোমরা চেনো। মুহিব‌ই বলেছিলো ভেবে দেখতে। তার উপর নাতি চাইছে, মানা করি কি করে? সব যখন হাতের নাগালে তখন ফেলে রাখা উতিত হবে না। কাল‌ বরং পাকা কথা সেরে আসবো। বড় ব‌উ মা বলছে আমার সিদ্ধান্তে কোনো ত্রুটি নেই। এবার তোমরা বলো, ঠিক বলছি কি না!

রাদিবা আবার‌ও কিছু বলবেন তার আগে নেহাল রহমান বাবার কথার সাথে সূর মিলিয়ে বললেন,

-আপনি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছেন তখন আমাদের আর কিছু বলার থাকে না। আমরাও রাজি। কাল কখন বেরুবো বাবা?

কথার জবাবে মতিউর রহমান উজ্জল চোখে তাকালেন। মৃদু হাসলেন‌ও। মুখ কালো হয়ে গেলো রাদিবার। চোখ ফেটে জল আসছে। এখানে যে ছেলের মা দাঁড়িয়ে আছে সে খেয়াল কারো ছিলো? তার‌ও কিছু বলার থাকতে পারে! সেটা কেউ ভাবলো না। কোনোদিন ভাবেও নি। বিয়ে করে আসার পর থেকেই এই দশা। নতুন ব‌উ কম কথা বলবে, নতুন ব‌উ বুঝবে না, নতুন ব‌উ জানে না বাড়ির রীতিনীতি এমন হাজার‌ও কথা বলে থামিয়ে দেয়া হয়েছে তাকে। কিছুটা পুরনো হ‌ওয়ার পর‌ও নিজে কোন ঘরে থাকবে সে সিদ্ধান্ত‌ও নিয়েছেন শ্বশুর শাশুড়ি। শাশুড়ি পৃথিবী ত্যাগ করতেই সব দায়িত্বের সাথে সাথে অধিকার‌ও হস্তান্তর হয়েছে বড় ব‌উয়ের হাতে। বাড়ির ছোট ব‌উ কি কিছু না? বছরের পর বছর এসব নানান কথা মনে গেঁথে থেকেছে রাদিবার। সময়ে সময়ে তা আর‌ও জমা হয়। তিনি মন খারাপ করেন। তীব্র আক্রোশ নিয়ে আমিনা বেগমের সাথে এক বেলা কথা কাটাকাটিও করেন। তবুও তার আশ মেটে না। এখন তো আরো মিটবে না। ভবিষ্যতে হয়তো এই দুই জায়ের সম্পর্কের আরো অবনতি হবে।

_____________________

-কাল দোহার গায়ে হলুদ। যাবি না?

সোহিনীর কথা শোনে চোখ কপালে তোললো হিমি। আশ্চর্যান্বিত গলায় বললো,

-কাল?

-হ্যা কাল‌ই তো। পরশু তো বিয়ে। তুই ভুলে গেছিস?

হিমি মাথা নেড়ে সায় জানালো। অর্থাৎ সে ভুলে গেছিলো। মেঘ হাসি হাসি মুখে বললো,

-আমরা তো মনে করিয়েই দিলাম। এখন আর চিন্তা নাই। একসাথে যাবো সবাই?

সূর্য মাথা নাড়লো। বললো,

-তোরা একসাথে যা। আমি পরে আসবো।

-কেনো মামা? পরে কেনো? আমাদের সাথে যেতে সমস্যা কি?

ইমনের প্র‌শ্নের জবাবে সূর্য মৃদু গলায় বললো,

-কাজ আছে মামা। আজ বাড়ি যাবো। ওখান থেকে ব্যক্তিগত কাজ শেষ করে কাল সোজা দোহার বাড়ি হানা দেবো। তোরা সবাই একসাথে যা। আমার একটু দেরি হবে।

হিমি মন খারাপ করে বললো,

-আমি যেতে পারবো না।

বন্ধুমহল গোল গোল চোখে তাকালো। মেঘ ভ্রু কুঁচকে বললো,

-কেনো? তোকে বাড়ি থেকে যেতে দেবে না?

-তা নয়। আসলে, কাল জ্যাঠুমনি দেশে ফিরছে।

সূর্য কৌতুহলী গলায় বললো,

-জ্যাঠুমনি দেশে ফিরছে তাতে তোর কি? তুই কি ওনারে স্বাগত জানানোর জন্য এয়ারপোর্ট চলে যাবি নাকি?

-ধুর ছাই! এয়ারপোর্টে যাবো কেনো? জ্যাঠুমনি কতো বছর পর ফিরছে তুই জানিস? বেক্কল! এতোগুলো বছর শুধু ওনার ফেরার অপেক্ষা করে গেছি। কাল ফিরছেন, আর আমি বান্ধবীর হলুদ সন্ধ্যায় চলে যাবো? হয় কখনো?

সোহিনী ভাবুক গলায় বললো,

-শুধু এক ঘন্টার জন্য‌ও বেরুতে পারবি না?

-নারে সোহু। আমি ওই একটা পুরো দিন বাড়িতেই থাকবো। ছোটবেলায় বাবার আদর ওনার থেকেই প্রাপ্য। অনেক আদর বাকি আছে। সেগুলো উসুল করতে হবে। আর দোহাতো হারিয়ে যাচ্ছে না। এমনিতেও তোরা জানিস, পারিবারিক অনুষ্ঠানে আমার ব্যাপক এলার্জী। পরশু বিয়েতে যাবো আমি। এক দেখা দিয়ে আসবো। তোরা যা না কাল। এনজয় কর। ওকে বলিস যেনো মন খারাপ না করে। একটা দিনের‌ই ব‌্যাপার!

ইমন জোড়ালো গলায় বললো,

-সেই তো। একটা দিনের‌ই ব্যাপার। তোর জ্যাঠু তো একদিনের জন্য আসছেন না। অনেক দিন থাকবেন। এতো বছর ওনার থেকে দূরে থাকতে পারলে কাল পারবি না?

হিমির স্পষ্ট জবাব,

-না। পারবো না। এতো বছর উনি দূরে ছিলেন বলেই বাধ্য হয়ে দূরে থেকেছি। কাল এতো কাছে আসছেন আর আমি তার থেকে দূরে থাকবো তা তো হয় না। আরেকটা কথা কি জানিস?

বন্ধুদের সমস্বরে প্রশ্ন,

-কি?

-জ্যাঠুমনি বাচ্চাদের মতো ভীষন অভিমান করে। আজ উনার দেশে আসার খবর শুনে যখন আমি বুঝতে পারি নি উনি কি বলতে চাইছেন তখন বেশ রাগ করেছিলেন। অভিমান করে ফোন কেটে দিয়েছেন। পরে আমিই কল করে খুশি জাহির করলাম। বিশ্বাস করবি কি না জানি না তবে কাল যদি জ্যাঠুমনিকে বাড়িতে রেখে আমি কোথাও বেরোই তবে অভিমান করে আমার সাথে কথাও বলবেন না। ভাবতে পারেন আমি ওনাকে ভালোবাসি না। হি ইজ লাইক আ চাইল্ড। আমাকে মেয়ের মতো রেখেছেন সব সময়। আজীবন রাখবেন‌ও। তাই চান যেনো আমিও তাকে বাবার মতো রাখি। একটা দিন ওনাকে দিতে দে।

সবাই শুকনো হেসে মাথা নাড়লো। হিমি আলোচনার সমাপ্তি টেনে আড্ডার সূত্রপাত ঘটালো। টেবিলে আঙুল দিয়ে বারি মেরে আওয়াজ করে বেসুরো গলায় গান ধরলো সূর্য। সোহিনী চোখ মুখ কুঁচকে ডান হাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে কান চেপে ধরলো। ইমন গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে গান গাইছে। মেঘ হাসিতে লুটুপুটি খাচ্ছে। আশেপাশের মানুষজন বেজায় বিরক্ত। তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই বন্ধুমহলের।

চলবে,,,,,,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে