হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
১৮.
হিমির শিওরে জড়সড় হয়ে বসে আছেন মুহিব রহমান। দুপুরে জ্বর ছেড়েছে অনেকটা। তবে গা গরম এখনো। আপাতত বেঘোর হয়ে ঘুমোচ্ছে সে। তীব্র অপরাধ বোধ কাজ করছে মুহিব রহমানের মাঝে। মেয়ের শীর্ণ ফ্যাকাসে মুখের দিকে নির্বিকার ভঙ্গীতে চেয়ে আছেন। দু একবার মাথায় হাত বুলিয়েছেন। আমিনা বেগম ক্ষনিক পর পরই কপালে ঠান্ডা তোয়ালে ছুঁয়াচ্ছেন। পায়ের তলায় তেল মালিশ করে দিচ্ছেন। গরম খাবার খাওয়াচ্ছেন। তবে হিমির দূর্বলতা কমে নি। নিজে থেকে উঠে বসতে অব্দি পারে না সে। মুহিব রহমানের মনটা বিষিয়ে উঠে। মেয়েকে সামান্যতম ভালোবাসা দিতে অক্ষম বাবার এর চেয়ে আর কিই বা করার আছে? তিনি ভাবেন। ভাবনার অন্ত নেই।
_______________
সন্ধ্যে ঘনিয়েছে। বসার ঘরে চায়ের আসর জমেছে। কলিং বেল বাজতেই কাজের মেয়ে দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে। হাতে বড়সড় এক ব্যাগ নিয়ে ঘরে ঢোকে মিশ্মি। রোশন আরা মেয়ের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকান। মিশ্মি তা পরোয়া করে না। অনাহিতা নাহার মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করেন,
‘এর সন্ধ্যে বেলা কার সাথে এলি তুই মিশু? একা? তোর বান্ধবী এখন কেমন আছে?’
মিশ্মি শুকনো হেসে জবাব দেয়,
‘ভালো আছে। তাই চলে এলাম।’
রোশন আরা মেয়েকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে বলেন,
‘ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হও। কাল অথৈরা আসবে। কাজে হাত লাগাও এসে।’
মিশ্মি মাথা দুলিয়ে শোবার ঘরে ঢোকে। ভালোবাসার মানুষকে অন্যকারো হতে দেখতে পারতো না বলেই বান্ধবীর অসুস্থতার মিথ্যে নাটক সাজিয়ে বিয়ের দিন সকাল বেলাতেই চলে গেছিলো মিশ্মি। সে নাটকের ইতি ঘটেছে অথৈর রিসেপশনের পর। না চাইতেও সব মেনে নিতে হবে মিশ্মিকে। মিশ্মি জানে এসব খুব কঠিন। ইয়াসিরকে অথৈর সাথে দেখলে বুক ফেটে কান্না আসে তার, শরীরে কাঁপুনি ধরে, অসার হয়ে আসে শরীর। তবুও তাদের সামনে মুখে লম্বা হাসি ঝুলিয়ে থাকতে হবে তাকে। ভাবতে যতোটা সহজ মনে হচ্ছে করতে তার থেকেও দ্বিগুন কষ্টের হবে। মিশ্মির মনে প্রশ্ন জাগে, ইয়াসির কি কখনোই বুঝে নি ওই মেয়েটা মিশ্মি ছিলো? কখনোই কি মিশ্মির অনুভূতির সম্মান করতে পারে নি? কাউকে ভালোবাসার পরিণাম যে এতো ভয়ানক শাস্তি হতে পারে জানতো না মিশ্মি। জানলে হয়তো কখনো ভালোই বাসতো না সে।
____________
মতিউর রহমানের সামনে আসামির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে দুই তরুণী। দুজনের পরনেই সাদা মাটা থ্রি পিস। চুল পরিপাটি করে আঁচরে বেনি করা। মাথার অর্ধেক ওড়নায় ঢাকা। কাধে ঝুলানো ব্যাগ। হিমিকে দেখতে এসে এভাবে ক্রিমিনালের মতো কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে, ভাবে নি সোহিনী-দোহা। রাত আটটা বাজার পর মেয়েরা কি করে বাড়ির বাইরে থাকে আর তাদের বাবা মায়েরা কি করে মেয়েদের অবাধ স্বাধীনতা নেই সেই নিয়ে বিস্তর আলোচনায় লেগেছেন মতিউর রহমান। ওনার কথার সাথে তাল মিলিয়ে রাদিবাও এ যুগের মেয়েদের কিছুটা গোষ্ঠী উদ্ধার করলেন। সোহিনী আর দোহা ঢোক গিলে একে অপরকে দেখলো। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে একসাথেই বললো,
‘হিমিকে দেখতে যাই?’
মতিউর রহমান সরু চোখে তাকালেন। দুজনকেই আগাগোড়া দেখে বললেন,
‘যা জিজ্ঞেস করেছি আগে তার উত্তর দাও। বাবা মাকে কি বলে এসেছো তোমরা? এতো রাতে এলে কি করে এতোদূর? কে দিয়ে গেছে?’
দোহা কিছু বলতে নিলেই সোহিনী তার হাত চেপে ধরে। শীতল গলায় বলে,
‘আম্মু আব্বুকে বলেছি বান্ধবীকে দেখতে যাবো। ওর অসুখ। প্রথমে এলাও করেন নি। পরে ভাইয়াই নিয়ে এলো আমাদের।’
মতিউর রহমান ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘দুজনেরই ভাইয়া?’
‘জি না দাদু। ভাইয়া তো আমার। দোহাকে তো ওর বাবা দিয়ে গেছেন।’
‘দিয়ে গেছেন! বাড়ির ভেতরে এলেন না কেনো তবে?’
সোহিনী জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে দোহার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো। দোহা তরিঘরি করে বললো,
‘বাবার কাজ ছিলো দাদু। এবার যাই। তাড়াতাড়ি বাড়ি না ফিরলে মা বকবে।’
মতিউর রহমান এবার শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন তাদের দিকে। তাদের বাবা মা স্ট্রীক্ট আছেন শুনে স্বস্তি পেলেন। মাথা নেড়ে তাদের ভেতরে যেতে সায় দিলেন। গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে দুজনেই হিমির শোবার ঘরে ঢোকলো। হিমি তখন বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসে ছিলো। সোহিনী আর দোহাকে দেখে গোল গোল চোখে তাকালো। দুজনে ঘরে ঢোকে দরজা ভেজিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দরজার পাশেই। হিমি কৌতুহলী গলায় বললো,
‘ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো তোরা? ভেতরে আয়!’
সোহিনী চাপা স্বরে বললো,
‘দাঁড়া আগে ওরা তো আসুক।’
হিমি বুঝার চেষ্টা করলো কাদের কথা বলছে সোহিনী। হঠাৎই চোখ মুখ উজ্জল করে স্মিত গলায় বলে উঠলো দোহা,
‘এসে গেছে এসে গেছে। সর সর দরজা আটকা।’
হিমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দরজার বাইরের দিকে তাকাতেই দেখা গেলো নিচু হয়ে দৌড়ে এসে ঢোকলো মেঘ। তার পিছু পিছুই ইমন আর সূর্যর প্রবেশ। হিমি চমকালো এবার। বার কয়েক চোখ পিট পিট করে বললো,
‘তোরা কি করে এলি? দাদু কিছু বলে নি?’
সূর্য ক্লান্ত ভঙ্গীতে খাটে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে বললো,
‘তোর দাদু দেখলে তো!’
হিমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বাকিদের দেখলো। মেঘ টি টেবিল থেকে পানির বোতল উঠিয়ে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে শান্ত হয়ে বসলো। ইমন হিমির বিপরীতে বসে মুখে হাসির রেখা টেনে বললো,
‘এখানে আসার জন্য কতো প্ল্যান যে করেছি তার হিসেব নেই। শেষমেষ এই প্ল্যান কাজে দিলো।’
‘প্ল্যান কার দেখা লাগবে না!’
শার্টের কলার পেছনে ঠেলে দিয়ে কথাটা বললো মেঘ। হিমি অসহায় গলায় বললো,
‘আরে ইয়ার! কি প্ল্যান সেটা তো বলো!’
‘তোর দাদু যখন আমাদের ক্লাস নিচ্ছিলেন তখন কৌশলে বড়মা বাড়ির পেছনের দরজা খোলে দিয়েছিলেন। ওরা রান্নাঘরে লুকিয়ে ছিলো এতক্ষন। আমরা তোর ঘরে আসতেই বড়মা বসার ঘরের পর্দা ফেলে দিয়েছেন আর এই খচ্চর গুলা সোজা তোর ঘরে প্রবেশ করতে সক্ষম!’
সূর্য পাশে রাখা বালিশ ছুড়ে দিলো দোহার দিকে। সেটা সজোরে মুখে গিয়ে লাগলো তার। অস্ফুট স্বরে ‘আহ’ বলেই তেড়ে এলো দোহা। সোহিনী আটকে দিলো তাকে। থমথমে গলায় বললো,
‘গাইজ স্টপ ইট। আমরা হিমিকে দেখতে এসেছি ঝগড়া করতে না। আর তাছাড়া বড়মা ছাড়া আর কেউ জানে না ঘরে ছেলেরা আছে। জানলে উপায় নেই। আস্তে আস্তে কথা বলতে হবে আমাদের।’
হিমি খুক খুক করে কাশতেই কাধে হাত রাখলো সোহিনী। মেঘ পানির বোতল এগিয়ে দিলো। হিমি পানি খেলো না। গলা কেশে বললো,
‘দাঁড়িয়ে না থেকে বস। বেশিক্ষন তো থাকবি না।’
‘না রে, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। তোর দাদু বাইরে বসে আছে। নির্ঘাত তোর ঘরের দিকে তাকিয়ে আছে। উফ, এতো সেকেলে কেনো?’
দোহার কথায় হাসে হিমি। সে জানে দাদু সেকেলে নয় বরং রাগি, গম্ভীর আর ভীষন ডিসিপ্লীন। যদিও এসব শুধু হিমির ক্ষেত্রে। তবুও আক্ষেপ নেই হিমির। সূর্য চোখের দৃষ্টি সিলিংএর দিকে স্থির করে বলে,
‘জ্বর বাঁধাইলি কেমনে?’
‘কি জানি! হুট করেই,,,’
‘হুট করেই না হিমি। নিশ্চয় দুশ্চিন্তা করছিলি কিছু নিয়ে। খাওয়া দাওয়াতেও তো অনিয়ম করিস। যদি বড় কোনো অঘটন হতো!’ (দোহা)
‘সেটাই তো ও চায়। নিজের খেয়াল রাখলে পৃথিবীর একাংশ ডুবে যাবে কি না!’ (ইমন)
‘ডাক্তার দেখিয়েছিলি?’ (মেঘ)
‘না। একজন ডাক্তার নিজ দায়িত্বে ঔষধসহ আমায় আমাকে বাড়িতে ড্রপ করে গেছেন। এখন তো সুস্থই!’ (হিমি)
‘কোন ডাক্তার?’ (ভ্রু উচিয়ে কথাটা বললো সূর্য)
‘ওই যে সোহিনীর বফের নাম্বার ভেবে যাকে কল করেছিলাম! সেই ডাক্তার।’
বন্ধুমহলের চোখ ছানাবড়া। তাদের মনে একটাই প্রশ্ন, সেই ডাক্তার হিমিকে পেলো কোথায়? সূর্য সবার তরফ থেকেই প্রশ্নটা করলো। জবাবে হিমি অলস ভঙ্গীতে বললো,
‘বলতে পারবো না।’
সাথে সাথেই তীব্র আক্রোশ নিয়ে বললো দোহা,
‘কেনো কেনো? বলতে পারবি না কেনো? ওই ডাক্তার তোকে বলতে মানা করেছে? উনি মানা করলেন আর তুই শুনলি! এসবের মানে কি হিমি?’
দোহা থামতেই ইমন খোঁচা মারা গলায় বললো,
‘তুমি দেখি মামা ছুপা রুস্তাম! প্রেম পিরিতি সেরে ফেলছো এইদিকে আর আমাদের বলো ‘এসব প্রেমের মতো ফাউল কাজে আমি নাই’! বাহ বাহ! কালে কালে আর কতো কি দেখবো।’
হিমি হতভম্ব চোখে তাকালো এবার। সোহিনী দুঃখী দুঃখী গলায় বললো,
‘দোস্ত! তুই আমাদের এভাবে ধোয়াশায় রাখবি? আমরা কি খুব বড় প্রশ্ন করে ফেললাম না কি? খালি জানতে চাইলাম ডাক্তার বাবু তোকে কোথায় পেলো? তুই এইটুকু কথার জবাব দিতে পারছিস না!’
হিমি খেঁকিয়ে উঠা গলায় বললো,
‘চুপ করতো। আশ্চর্য! আমি বলি কি আর এরা বলে কি! ডাফার। আমি “বলতে পারবো” দ্বারা এটা বুঝাই নি যে বলতে মানা বরং এটা বুঝিয়েছি যে আমার মনে নেই কোথায় তিনি আমায় পেয়েছেন, কি করে এখানে এনেছেন। বড়মা বললো একজন ডাক্তার দিয়ে গেছেন আমায়। তিনি আমার নামটাও জানেন। আর তার যা ডেস্ক্রিপশন বড়মা দিয়েছে তা থেকে আমি শিওর ওই ওই ডাক্তার! বুঝছো গাধাদের দল?’
সবার মুখ চুপসে গেলো মুহুর্তে। দরজায় হালকা ঠখঠখ আওয়াজ হতেই ছেলেরা হুরমুরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দোহা সোহিনী ঢোক গিলে হিমিকে দেখছে। হিমি ভড়কে গেছে। কে হতে পারে বুঝতে পারছে না ঠিক। মেয়েদের থেকে সাহায্যের আশা ছেড়ে দিয়ে তিনজন ছেলেই মেঝেতে চিৎ শুয়ে পরলো। হাত পা দিয়ে ঠেলে ঠেলে খাটের তলায় আশ্রয় নিলো। দোহা এগিয়ে গিয়ে দরজার ছিটকিনি খোললো। ভেতরে ঢোকলেন আমিনা বেগম। ভয়ার্ত চেহারায় ঘরে চোখ বুলিয়ে বললেন,
‘তোমাদের বন্ধুরা কই? জলদি পালাতে বলো। আব্বা হয়তো হিমিকে দেখতে আসবেন এখন। তোমরাও বেরিয়ে পরো সময় থাকতে। কোথায় ওরা?’
হিমি চোখের ইশারায় খাটের নিচে ইশারা করতেই সোহিনী আর দোহা নিচে ঝুঁকে তাদের বেরিয়ে আসতে বললো। একে একে বেরোলো মেঘ, সূর্য আর ইমন। আমিনা বেগম দোহা আর সোহিনীকে আগে বাইরে গিয়ে বসার ঘরে সবার থেকে বিদায় নিতে বললেন। আসলে বিদায়ের বাহানায় তাদের ব্যস্ত রাখার ছক কষেছেন। ওই সময়টাতেই ছেলেদের রান্নাঘরের পেছনের দরজা দিয়ে বের করে দেবেন তিনি। ওনার কথামতোই দোহা সোহিনী হিমির থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে চলে গেলো। ছেলেরা ওত পেতে রইলো, কখন সবার চোখ এদিক থেকে সরবে। আমিনা বেগম দরজা হালকা ফাক করে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন। একটা সুযোগের অপেক্ষা শুধু, তারপর সব ঠিক।
________________
‘তাহির?’
‘হ্যা মা!’
‘এই অসময়ে কোথায় বেরচ্ছো?’
‘হাসপাতালে এমার্জেন্সি!
‘মিথ্যে কথা বলো না তাহির। তুমি জানো আমি মিথ্যে সহ্য করতে পারি না। তুমি এও জানো আমি তোমার উপর রাগ করতে পারি না। সুতরাং এমন কিছু করো না যার কারনে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। ঘরে গিয়ে শুয়ে পরো। আমি বসছি এখানেই। আজ আর ঘুম হবে না। যাও।’
মায়মুনা জামানের শীতল কন্ঠে বলা ভারি কথা গুলো শুনেই বুক ধ্ক করে উঠলো তাহিরের। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাথা দুলিয়ে শোবার ঘরে চলে এলো সে। অস্থির লাগছে খুব। ভেতরটা জ্বলছেও ভীষন। কাউকে ফিরিয়ে দেয়াটা বুঝি খুব কষ্টের! খুব করুণ! তাহির নিজেকে বুঝায়, তাকে মায়ের মতো কঠোর হতে হবে। কারো কান্নায় বুকে হাহাকার হবে না। কারো কথার মারপ্যাচে আটকে যাবে না। শক্ত করতে হবে নিজেকে। এতোটাই শক্ত যেনো দীর্ঘশ্বাসগুলো জমাট বেধে ভেতরেই মিলিয়ে যায়।
চলবে,,,,,,,
হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
১৯.
‘সাইকিয়াট্রিস্ট ডক্টর তাহির মাহমুদ! এটা ওনার চেম্বার? আমি একটু কথা বলতাম ওনার সাথে।’
অ্যাসিটেন্ট ছেলেটি ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে ঘাড় ঘুরালো। গম্ভীর গলায় বললো,
‘আপনার এপোয়েনমেন্ট আছে? কত নম্বর সিরিয়াল?’
‘এপোয়েনমেন্ট নেই। একটু দরকার ছিলো।’
‘পেশেন্ট দেখছেন স্যার। এটা কাজের সময়। এই সময় কারো সাথে দেখা করেন না। আপনি আসুন এখন!’
হিমি কিছুটা রেগে বললো,
‘আশ্চর্য! আপনি বলবেন আর আমি চলে যাবো? দেখুন, আমার ওনার সাথে কিছু দরকারি কথা আছে।’
ছেলেটি শান্ত দৃষ্টিতে দেখে বললো,
‘কি দরকারি কথা? আমায় বলুন, আমি বলে দেবো স্যারকে। উনি খুব ব্যস্ত এই মুহুর্তে। শুধু শুধু এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। যা বলার আমায় বলে যান।’
এ তো আচ্ছা ছেলে! হিমির ডক্টরের সাথে কি কথা না কথা সেটা ওকে কেনো বলতে হবে? অ্যাসিটেন্ট হয়েছে তো কি মাথা কিনে নিয়েছে? অসম রাগকে কন্ট্রোল করে গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো হিমি। অত্যন্ত শান্ত গলায় বললো,
‘ওনার সাথে আমার কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে। সেটা আপনাকে বলা যাবে না! ওনাকেই বলতে হবে।’
অ্যাসিটেন্ট ছেলেটি হাতের ফাইল বন্ধ করলো। রাগে কটমট করে কিছু বলতে গিয়েও কিছু একটা ভেবে কথাটা গিলে নিলো। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,
‘আপনি ম্যাডাম? মানে, ওই সামিয়া ম্যাডাম?’
হিমি চিনে না সামিয়া কে? জানে না ছেলেটার এতো উচ্ছাসিত হওয়ার কারন। তবে তার মন বলছে এই মূহুর্তে যদি সে নিজেকে সামিয়া বলে পরিচয় দেয় তবে নিঃসন্দেহে ছেলেটি তাকে তাহির অব্দি পৌঁছে দেবে। ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে হিমি মাথা নেড়ে সায় জানালো। পকেটে হাত ঢোকিয়ে বললো,
‘হুম, আমিই সামিয়া। এবার বুঝেছেন নিশ্চয়, আপনার স্যারের সাথে আমার কতোটা দরকারি কথা থাকতে পারে!’
ছেলেটি দ্বিগুন উৎসাহ দেখালো। মুখে চওড়া হাসি টেনে বললো,
‘আমি এক্ষুনি আসছি। আপনি দাঁড়ান।’
বলেই চেম্বারের দরজা খোলে ভেতরে ঢোকলো সে। খানিক পরই সাথে দুজন পেশেন্ট নিয়ে বেরিয়ে এলো। পেশেন্টদের যেতে বলে হিমির সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ম্যাডাম আপনি ভেতরে যান। স্যার আপনার অপেক্ষা করছেন। আর সরি, আপনাকে আগে ভেতরে যেতে মানা করেছিলাম, আমি চিনি নি তো তাই। আপনি যান, আমি কফি নিয়ে আসছি।’
হিমি বাঁধা দিয়ে বললো,
‘কফি না চা। কড়া করে এক কাপ দুধ চা।’
ছেলেটি মাথা হেলিয়ে দৌড় লাগালো। হিমি লম্বা শ্বাস টেনে চেম্বারের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। তাহির নিজ চেয়ারেই বসে ছিলো। সামনের প্রেসকিপশন লিখার খাতাটা সরিয়ে রেখে সামনে তাকালো সে। হিমিকে দেখেই ভ্রু যুগল কুঁচকে গেলো তার। দরজার দিকে একপলক দেখে বললো,
‘আপনি এখানে?’
হিমি নির্বিকার ভঙ্গীতে তাহিরের মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসলো। ক্লান্ত গলায় বললো,
‘থেঙ্কস জানাতে এসেছি।’
‘কিসের থেঙ্কস?’
‘আপনি ওইদিন আমায় বাড়িতে ড্রপ করে দিলেন সাথে মেডিসিনও দিলেন। তাই!’
তাহির ভ্রু উচিয়ে বললো,
‘শুধু এটুকুর জন্য এতোদূর আসা?’
হিমি অস্বস্তি ভর করা চোখ সরালো। এদিক ওদিক তাকালো। তাহির মৃদু হাসলো। বললো,
‘এখন কেমন আছেন?’
হিমি আশ্বস্ত গলায় বললো,
‘একদম ঠিক।’
তাহির মাথা দুলিয়ে বললো,
‘এবার আসুন তবে। আমার অন্যান্য রোগী দেখা আছে।’
হিমি তটস্থ হলো। তার সব কথা তো এখনো শেষ হয় নি। যায় কি করে? তাহির ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কিছু বলবেন?’
হিমি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। আমতা আমতা করে বললো,
‘হ্যা বলবো।’
তাহির শান্ত গলায় বললো,
‘বলুন।’
হিমি মনে মনে কিছু ভাবলো। তারপর বললো,
‘আমায় ঠিক ঠাক বাড়ি পৌঁছে দিলেও আমার বাইকটাকে একা রাস্তায় ফেলে আসলেন কোন আক্কেলে?’
তাহির গোল গোল চোখে তাকালো। অবাক হওয়া কন্ঠে বললো,
‘আমি আপনার বাইক ফেলি নি। ইন ফ্যাক্ট ব্রীজের উপর যে আপনার বাইক ছিলো সেটাও মনে নেই আমার।’
হিমি বড় বড় চোখ করে তাকালো। ক্ষিপ্ত গলায় বললো,
‘মানে কি? ব্রীজের উপর? আপনি আমায় নিয়ে এলেন আর আমার বাইকটাই খেয়াল করেন নি? যদি আমার বাইক চুরি হয়ে যেতো তখন?’
‘চুরি হয় নি?’
হিমি মাথা নাড়লো। বললো,
‘না। কাজিন পরদিন সকালে বাড়ি নিয়ে গেছিলো সেটা। কথা সেটা নয়, কথা হলো আপনি আমার বাইকে চাবি রেখেই আমাকে নিয়ে সাথে নিয়ে চলে গেলেন! কমন সেন্স নেই আপনার?’
তাহির চট করে উঠে দাঁড়ালো। কড়া গলায় বললো,
‘এক্সকিউজমি! বাইক আপনার, চাবি আপনি রেখেছেন, জ্বরের ঘোরেও আপনি ছিলেন। এখন সব দোষ আমার?’
হিমি ছোট্ট শ্বাস টানলো। ঢোক গিললো। হাসার চেষ্টা করলো। তাহির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে হিমিকে দেখে বললো,
‘আপনি হয়তো অন্য কিছু বলতে চাইছেন পারছেন না।’
হিমি তড়িৎ গতিতে তাহিরের দিকে তাকালো। চোখাচোখি হতেই নিজের চোখ সরিয়ে নিলো হিমি। তাহিরের হঠাৎই মনে হলো হিমির চোখ সুন্দর। খুব সুন্দর। টানা টানা স্বচ্ছ দুটো মায়াবী চোখ। হিমি কিছু বলতে নিলেই দরজায় টোকা পরলো। তাহির মৃদু গলায় ভেতরে আসার পারমিশন দিতেই হাতে ট্রে নিয়ে ঢোকলো অ্যাসিটেন্ট ছেলেটি। কফির কাপ তাহিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে হিমির দিকে চায়ের কাপ এগুলো সে। হিমি এক প্রকার ছিনিয়েই নিলো সেই কাপ। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তার। একটু ভিজানো দরকার। ভেবেই দু একবার ফু দিয়ে গরম চায়ে চুমুক বসালো। সাথে সাথেই মুখ বাঁকিয়ে চায়ের কাপ টেবিলে রাখলো। পকেট থেকে চুইঙ্গামের প্যাকেট বের করে একটা চুইঙ্গাম মুখে পুরলো সে। বার কয়েক চিবিয়ে নিয়ে বললো,
‘এটা কড়া চা? ছিহ! কি বিশ্রী স্বাদ!’
তাহির রাগি ভয়েজে অ্যাসিটেন্টের উদ্দেশ্যে বললো,
‘নিশ্চয় রাস্তার পাশের ওই দোকান থেকে এনেছো? কতোবার মানা করেছি এসব আনহেলদি খাবার দাবার হাসপাতালে আনবে না। তারপরও? ইটস মাই লাস্ট ওয়ার্নিং রেজা।’
রেজা তুমুল গতিতে মাথা ডানে বায়ে নাড়লো। চোখে আকুলতা নিয়ে বললো,
‘ওখান থেকে আনি নি স্যার। অফিসের ক্যান্টিন থেকেই এনেছি।’
হিমি আয়েস করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বললো,
‘এই জন্যই এতো বাজে খেতে। আরে রোড সাইড চায়ের দোকানের চা সব সময় ভালো হয়। তাদের টেস্টটাই আলাদা হয়ে থাকে। আপনারা কিসব ক্যান্টিনের অতি স্বাস্থ্যকর খাবার খান। এই যে, নিয়ে যান এটা। আমার চা খাওয়ার শখ মিটে গেছে।’
রেজা মুখ ফুলিয়ে ট্রেতে চায়ের কাপ উঠিয়ে বেরিয়ে গেলো। তাহির কফি কাপে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো,
‘কি যেনো বলছিলেন?’
হিমি আবারও থমকে গেলো। থেমে থেমে বললো,
‘বড়মার ঘাড়ে ভুত চেপেছে।’
তাহির বিস্ময় নিয়ে বললো,
‘ভুত? তাহলে আমার কাছে কেনো? আমি ভুত তাড়াতে জানি না। অবশ্য ‘ভুত আছে’ বিষয়টা বিশ্বাসও করি না।’
হিমি বিরক্ত গলায় বললো,
‘সম্পূর্ণ কথা তো শুনুন!’
তাহির ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে বললো,
‘বলুন।’
হিমি বললো,
‘বড়মার ঘাড়ে থাকা ভুতটা বড়মাকে কুমন্ত্রণা দিচ্ছে। আমাকে না কি সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে।’
‘তো যান। যেতে চাইছেন না কেনো?’
তাহিরের স্পষ্ট কথা না শোনার ভান করেই হিমি বললো,
‘আপনি বড়মাকে কিসব বলেছেন আমার ব্যাপারে?’
তাহির যেনো আকাশ থেকে পরলো। হিমির বড়মাকে তো সে চিনেই না। তাহলে বলার প্রশ্ন আসছে কি করে? তাহিরকে ভাবতে দেখে হিমি টেবিলে আলতো হাতে বারি লাগালো। তাহির ভ্রু নাচিয়ে বললো,
‘কি বলেছি আমি?’
‘ওইতো আমি না কি আপনাকে আমার কিছু গোপন কথা বলেছি। বড়মা আমায় পাগল করে দিচ্ছে দু দিন থেকে। কি এমন গোপন কথা যা আপনাকে বললাম অথচ উনি জানেন না? এদিকে আপনার সাথে আমার কি কথা হয়েছে সেটাই মনে নেই আমার। আপনি যে আমায় ব্রীজের উপর থেকে নিয়ে এসেছেন সেটাও তো এখনি জানলাম!’
কিছুক্ষন থেমে পরমুহুর্তেই বলে উঠলো,
‘আচ্ছা, আমার কি বড় ধরনের রোগ হয়েছে?’
তাহির কুঞ্চিত ভ্র জোড়া স্বাভাবিক করলো। তারমানে সেদিন যাকে হিমির অতি কাছের কেউ ভেবেছিলো তিনিই তার বড়মা। তাহির কফির কাপ টেবিলে রাখলো। উল্টো ঘুরে দেয়ালে ছোট ছোট তাক বিশিষ্ট সেল্ফ থেকে কিছুটা একটা বই বের করে পাতা উল্টালো। ধীরে স্থিরে বললো,
‘রোগের সিম্পটম কি শুনি!’
হিমি যেনো এ কথারই অপেক্ষায় ছিলো। তাহির বলা মাত্রই চট করে বলে উঠলো,
‘সেদিন আমি কখন ব্রীজে গেলাম, কোথায় ছিলাম, আপনার সাথে দেখা হয়েছে কি না কিছুই মনে পরছে না। আপনার সাথে কিছু কথাও হয়েছে হয়তো। অথচ সবটাই ভুলে গেছি আমি।’
তাহির নিঃশব্দে হাসলো। টেবিলে হাতের বইটা নামিয়ে রেখে বললো,
‘রোগ টা ছিলো জ্বর।’
হিমি বোকা বোকা চেহারায় তাকালো। তাহির চেয়ারে বসে দু হাত চেয়ারের হাতলে রেখে বললো,
‘আপনার জ্বর খুব তীব্র ছিলো। ফলে ঘোরে চলে গেছিলেন। ওই সময় কোথায়, কি হচ্ছে সেসব খেয়াল রাখা সম্ভব না। আপনি যখন আমার সাথে নিঃসংকোচে কথা বলছিলেন তখনই কিছুটা আন্দাজ করেছিলাম আমি। পরে আপনার কপাল ছুঁয়ে বুঝলাম। আপনি জ্বরে কাত!’
হিমি অপ্রস্তুত হাসলো। চুইঙ্গাম চিবোতে চিবোতে অস্বস্তি কাটানোর চেষ্টা করে বললো,
‘কি কথা হয়েছিলো আমাদের?’
তাহির শান্ত চোখে তাকালো। বললো,
‘জানা খুব প্রয়োজন?’
হিমি জবাব দিলো না। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। তাহির এক হাত টেবিলে রেখে পেপার ওয়েট ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,
‘অতি গোপন কথা বলে ফেলেছেন আমায়। আপনি ফেঁসে গেছেন!’
হিমি চমকে উঠলো। কি এমন গোপন কথা বলেছে সে? ভয়ানক কিছু বলে ফেলে নিতো? ফেঁসে গেছে মানে কি? এই ডাক্তার কি তাকে ব্লেইকমেল করবে না কি কোনো বিষয় নিয়ে? হিমির মাথা ভনভন করে। এসি রুমে বসে থেকেও তরতর করে ঘামছে সে। তাহির হাত ঘড়িতে একপলক দেখলো। হিমির অবস্থা দেখে ব্যাপক হাসি পেলো তার। হাসি চেপে ব্যস্ত ভঙ্গীতে বললো,
‘আর সময় দিতে পারছি না। আমায় রাউন্ডে যেতে হবে।’
কথাটা বলে উঠে দাঁড়িয়ে পকেটে এক বাত ঢোকালো তাহির। যার অর্থ, হিমি আপনি এখন আসুন। আমি আপনাকে বলবো না আপনার সেই গোপন কথা কি ছিলো! হিমি অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। কাতর গলায় বললো,
‘দু মিনিটও লাগবে না। আপনি শর্টকাটে বলে ফেলুন।’
‘আচ্ছা। আপনাকে ব্রীজে দেখে এগিয়ে গেলাম, সরি বললাম, আপনি ইগনোর করলেন, তারপর আমার চশমা পরলেন, আমায় বাচ্চা ডাক্তার বলে সম্বোধন করলেন আর তারপর একটা গল্প বললেন। একটা তেইশ বছর পুরনো প্রেমের গল্প। ব্যস এইটুকুই!’
হিমি চোখ পিটপিট করে তাকালো। তাহিরের বলা কথাগুলো কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে তার। প্রথম থেকে শেষ অব্দি কথাগুলো মিলাতে নিলেই তাহির এক হাত বাড়িয়ে দরজার দিকে দেখালো। হিমি রাগে কটমট করে তাকালো। সে কি এখানে থাকতে এসেছে না কি? আজব! চলেই তো যাবে। এতো অপমানের কি আছে! হিমি দুম দাম পা ফেলে বাইরে বেরুলো। অ্যাসিটেন্ট রেজা ঠোঁটে চওড়া হাসি ঝুলিয়ে এগিয়ে এসে বললো,
‘চলে যাচ্ছেন ম্যাডাম!’
হিমি জোরপূর্বক হাসি হেসে দাঁত দাঁত চেপে বললো,
‘না তো, এখানে থাকবো বলে খাট, বালিশ, কাঁথা আনতে যাচ্ছি।’
রেজা মুখ ছোট করে সরে দাঁড়ালো। হিমি গটগট করে বাইরে এসে বাইকে চেপে বসলো। হেলমেট মাথায় না পরেই বাইক স্টার্ট দিলো সে। মাথায় চলতে থাকলো ‘গোপন কথা’! কি গোপনীয় আছে তার জীবনে সেটাই বুঝতে পারছে না হিমি। মনে মনে আবারও আওড়ালো তাহিরের কথা। ধীরে ধীরে মিলিয়ে নিলো সবটা। তেইশ বছরের পুরনো প্রেম। মানে বাবা মায়ের প্রেম কাহিনী! ধ্যাত তেরিকি! এসব কাউকে বলে? অথচ হিমি অচেনা অজানা এক লোককে নিজ বাবা মায়ের ঐতিহাসিক প্রেম কাহিনী বলে এসেছে। আর কিছু বলে নি তো? হয়তো বলে নি। গোপন কথা বোধ হয় এটাই ছিলো। হিমির ঠোঁটে হাসি ফুটে। যাক, অতিরিক্ত কিছু বলে টলে দেয় নি। বড়মাকে জানাতে হবে সে ঠিক আছে। সাইকিয়াট্রিস্টের দরকার নেই। মাথায় গোলমাল হয় নি এখনো। শুধু শুধু টাকা নষ্ট করে লাভ নেই।
চলবে,,,,,,,,,,