হিজিবিজি (৫ম পর্ব)

0
1246

গল্পঃ #হিজিবিজি (৫ম পর্ব)
লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার

উফফ! হাত কাঁপছে, কাপটা ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছে আমার। এ খোদা কি হতে চলেছে আমার সাথে, জাবের একটার পর একটা গেইম খেলেই যাচ্ছে। আমার জীবনটাকে কি মনে করেছে সে!
কিছুক্ষণ স্থির হয়ে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর যখন বুঝতে পারলাম ফোনে কথা বলা শেষ, তখন কফি হাতে এগিয়ে গেলাম বিছানার দিকে। কাপটা রেখে চলে আসবো, তখন রাগী কণ্ঠে জাবের বলে উঠলো..
___ এটা কি কুল কফি দিছো?

___ কই নাতো!

___ দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলে কি কুল হবেনা তো হট রবে? যাও নিয়ে যাও এটা খাবোনা আমি। আজাইরা মানুষকে নিয়ে খাবার পাঠায় কেন বুঝিনা,যত্তসব!

এই জাবেরকে দুনিয়ার সব বকা বকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এই মূহুর্তে কিছু মাথায় আসছেনা।
কিন্তু সে কি ইদানীং সিসিটিভির কাজও করতে পারে? দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলাম এটা কিভাবে বুঝতে পারলো?
যেভাবে নিয়ে আসছিলাম সেভাবেই কাপ নিয়ে চলে যাচ্ছি। তখন জাবের আবার বললো..
___ আমি যে খাইনি সেটা যেন কেউ না জানে। কাপটা খালি করে কিচেনে নিয়ে যাবে! আর আমার কথা না শুনলে মনে রেখো আহানের সাথে সব ফটো আমার গ্যালারিতেই আছে ওকে? সব কিন্তু দেখিয়ে ..

___ হয়েছে হয়েছে, দেখাতে হবে না। যা বলছেন তাই করবো।

রাগে সারাশরীর গিজগিজ করছে। কফি এতটাও ঠান্ডা হয়নি। নাকি আমার হাতে বানানো বলে এটা খাবেনা৷ কি জানি বাবা৷ যা-তা হোক৷
কিন্তু এভাবে ব্ল্যাকমেইলটা আর ভালো লাগছেনা। কিছু একটা উপায় বের করতে হবে। বারবার একটা পাইছে,, দেখিয়ে দিবো সবাইকে,দেখিয়ে দিবো সবাইকে! এই বাক্যটা যে করেই হোক থামাতে হবে।
ড্রয়িং রুমে অনেক্ষণ যাবৎ পায়চারি করছি কিন্তু কোনো বুদ্ধি পাচ্ছিনা৷
আচ্ছা আমাদের বান্ধবীদের নিয়ে কোনো একটা পরিকল্পনা করলে কেমন হয়?
আমাকে তাহলে তাদের সাথে দেখা করতে হবে।
নাকি ওরে একটু উত্তমমাধ্যম দেওয়া উচিত?
সে আমার সাথে যা করে চলেছে তার জন্য এটাই উপযুক্ত শিক্ষা হবে!
কিন্তু এসবে যদি ধরা খাই? আমাকে বাবা আস্ত রাখবেনা,আর জাবের তো একদমই না।

তখনই একটা বাচ্চা দৌঁড়ে এসে টিভি অন করলো। আমি বেখেয়াল বশত টিভির দিকে তাকালাম৷
তাকিয়েই একটা দৃশ্য দেখে একটা বুদ্ধি খেলো । হ্যাঁ কালো! এটাই জাবেরের দূর্বলতা।
দৌঁড়ে রুমে গেলাম, গিয়ে বিয়ের বাজারের সাথে কালো রঙের কিছুই খোঁজে পেলাম না।
আম্মুর রুমে গিয়ে আম্মুকে ডাকলাম। আম্মু কাজ রেখে এসেই ধমকে উঠলো..
___ এখানে কি করছিস, জাবেরকে রুমে একা ফেলে এলি কেন?

আম্মুর কথা শুনে মনে হলো আরে আমার তো নতুন বিয়ে হয়েছে এখন রোমান্সের সময়। আহ্রে আমার কি কপাল!যাই হোক শোক করে লাভ নাই। তারপর ভ্রু কোচকে বললাম..
___ হ আম্মু ওর জন্যই আসছি, তোমার ফুল সিল্কের মধ্যে একটা কালো শাড়ী আছেনা? ওইটা দাও, গোসল দিয়ে পরবো।

___ আরে এটা তুই সামলাতে পারবিনা। কালকের আগে জীবনে শাড়ী পরছিস? অন্য কোনোটা পর।

___ আম্মু আমার কালোটাই লাগবে! তারাতাড়ি দাও।

বাধ্য হয়ে আম্মু এটাই আলমারি থেকে খোলে আমার হাতে দিলো। আম্মু ভাবছে জাবেরই আমাকে কালো রঙের শাড়ী পরতে বলেছে। তাই কিছু বলেনি আর।

আম্মুর গোসলখানায়ই গোসল করতে গেলাম। যাওয়ার সাথে সাথেই আম্মু ডাকতে শুরু করছে খেয়ে নিতে আগে। আমি ভেতর থেকে জবাব দিলাম..
___ উনাকে খাবার দিয়ে দাও। আমি পরে খাবো।

গোসল শেষে আধ ঘন্টা ধরে চেষ্টা করছি, কিন্তু শাড়ী একদিকে পরি অন্যদিকে খোলে। আম্মু ঠিকই বলেছিল আমি সামলাতে পারবোনা। অনেকগুলো সেফটিপিন মেরে কোনোরকম বের হলাম।
বেরিয়েই দেখি মামাতো বোন নোহা চুল আচঁড়াচ্ছে,ওরে দেখেই বললাম,
___ আমি এখন রুমে যেতে পারবোনা৷ তোর ব্যাগে কালো রঙের কি কি আছে বের কর।

সে তার ব্যাগ খোললো, কালো চুরি আর কালোর মধ্যে একজোড়া দুল পেলাম। এখন কালো টিপ দরকার। আমার টিপ দেওয়া পছন্দ না, কিন্তু জাবের টিপ পছন্দ করে। টিপ কিভাবে ম্যানেজ করা যায় ভাবতেই নোহা বলে উঠলো..
___ ছোট আন্টির বাচ্চাকে যে নজর টিপ দেয় সেগুলো চলবে?

___ ওরেএএ নিয়ে আয় তারাতাড়ি।

তারপর হালকা সাজগোজ। নিজে থেকে এতো সাজ কবে সেজেছি মনে নেই। কিন্তু আজকেরটা কখনো ভুলবোনা। এর মধ্যেই নোহা টিপ নিয়ে আসলো।
সব ঠিকঠাক পরার পরে নোহা বলতেছে..
___ দুলোমিয়া সিউর তোমাকে দেখে হার্ট অ্যাটাক করবে। এটা ভেবে, তার বউ এতো সুন্দরী!

আমি হাসলাম। নোহা তার ব্যাগ গুছাতে ব্যস্ত, এর ফাঁকে আমি আম্মুর ঔষধের কৌটা থেকে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা নিয়ে নিলাম।
নিয়ে শাড়ীটা কোনোভাবে আটকে ধীরে ধীরে গেলাম ডাইনিংয়ে, গিয়ে আম্মুকে জিজ্ঞাসা করলাম..
___ তোমাদের জামাইকে খাওয়ার পরে দুধ দিয়েছিলে?

আম্মু মাথায় হাত দিয়ে বললো..
___ওহহো মনেই ছিল না৷ নে তুই দিয়ে আয়। শুন গরম করে নিস।

___ আচ্ছা আম্মু।

রান্নাঘরে গিয়ে দুধ গরম করে, তার মধ্যে সুন্দর করে আম্মুর কৌটা থেকে আনা ঘুমের ঔষধ দুইটা একসাথে মিশিয়ে দিলাম। সেটা যাতে বুঝতে না পারে তার জন্য চিনি মিশিয়ে দিলাম। তারপর একহাতে গ্লাস আর আরেকহাতে শাড়ীর কুঁচিতে ধরে এগিয়ে চললাম আমার রুমের দিকে।
জানিনা কি হবে? যদি এখন জাবেরের আকাশ সমান পাথুরে মন হয়ে থাকে তাহলে আজকে আমার প্ল্যান সফল হবে না, আর তা না হলে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করা এই পর্যন্তই। চান্দু এরপর আর বলতে পারবেনা দেখিয়ে দিবো সবাইকে! ওয়েট আসছি আমি!

দরজার সামনে যাওয়ার পরেই বুক দুরুদুরু করছে। শাড়ী থেকে হাত সরিয়ে রুমে প্রবেশ করলাম। দেখলাম সে এক মনে মোবাইল টিপছে।
আমি আস্তে আস্তে বিছানার কাছে গিয়ে নুয়ে গ্লাসটা রাখতে যাবো তখনি সবগুলো চুল সামনে ঝুকে পড়লো। সেটা ঠিক করতে গিয়েই বুঝলাম আমার শাড়ীর পেঁচ কোমরেরদিকে খোলে গেছে!
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঠিক করতে যাবো তখনি দেখলাম জাবেরের হাত থেকে ফোনটা তার বুকের উপরে পড়ে গেছে, সে হাঁ করে তাকিয়ে আছে।
আমি তাকানোর সাথে সাথেই সে একটু নড়েচড়ে তাকানোর চেষ্টা করলো।

আমি হেসে বললাম..
___ এদিকে তাকানোর কিছু নেই, টেবিলে দুধের গ্লাসটা রেখেছি,খেয়ে নিন।

তৎক্ষনাৎ জাবের টেবিলে তাকালো। আমি পেছন ফিরে আমার ড্রেসিংয়ের ভেতর থেকে কালো মালাটা খোঁজতে লাগলাম। অবশেষে সেটা পেয়ে গলায় পরতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম জাবের গ্লাস মুখে নিয়েই তাকিয়ে আছে। পলক পড়ছেনা!
আমি আয়নায় তাকিয়ে ভ্রু নাঁচিয়ে প্রশ্ন করলাম তাকিয়ে আছে কেন!
নাহ সে এটা খেয়ালই করছেনা। তার মতো করে তার চোখকে যেন এখানেই থামিয়ে রেখেছে। এদিকে সে এখনো খেলো না । আওওও না খেলে আমার পরিকল্পনা সব বৃথা। মনে মনে বলছি প্লিজ প্লিজ খেয়ে নাও,এরপর তাকানোর ফল বুঝবে!

না খাচ্ছেনা। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে ফিরে তাকিয়ে বলতে হলো.
___ আরেহ খাচ্ছেন না যে!

এটা বলার সাথে সাথেই জাবের একশ্বাসে সবটুকু খেয়ে নিলো। তারপর আবার তার সেই চক্ষু আমাতে বিদ্ধ!
কিছুক্ষণ পর তার চোখ কেমন জানি নিভু নিভু করছে। বুঝতে পারলাম ঔষধের কাজ করতে শুরু করেছে, কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে যাবে। আর আমি গিয়ে তখন বিছানায় বসলাম। জাবেরের চোখ মিরমির করছে,সে আমার কাছে এগুচ্ছে। আমি কিছুটা পিছাতে চাইলাম,তখনি সে তার হাত দিয়ে আমার কানের উপর হাত রেখে ক্ষীণ কণ্ঠে বললো.
___ এ কেমন নেশা?

বলেই আমার কাঁধে ঢলে পড়লো। ওহহো এই মাথার সব ভর রাখা আমার পক্ষে সম্ভব না। কোনোভাবে শুইয়ে দিলাম।
তারপর তার মোবাইলটা হাতে নিলাম, খুশিতে আমার চোখমুখ চকচক করছে। তার হাত দিয়ে মোবাইলের ফিঙ্গার খোলে ঢুকলাম তার মোবাইলে।
প্রথমেই গেলাম গ্যালারিতে,আমাকে রাতদিন ব্ল্যাকমেইল করার অবসান ঘটাতে৷ গিয়ে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ এখানে আমার আর আহানের কোনো ছবিই নাই। আছে হাজার হাজার ছবি সবগুলোই দুইবছর আগে আমার আর জাবেরের, আর আছে আমার সাথে বলা সব টেক্সটের স্ক্রিনশট, এবার আমিই নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম,তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম কি নিষ্পাপ চেহেরায় ঘুমিয়ে আছে! মিনিটে মিনিটে তার মধ্যে একেকটা রূপ খোঁজে পাচ্ছি আমি! কিন্তু এখন যেটা পেয়েছি সেটা তো দুই বছর আগের জাবের আমার!

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে