#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগষ্ট_২০২০
গল্পের নাম : হঠাৎ তুমি
লেখকের নাম : মুহতাছিম ফুয়াদ
ক্যাটাগরি : রোমান্টিক
প্রতিদিনের ন্যায় আজও সকাল থেকে নিজস্ব চেম্বারে রোগী দেখছেন ডা.হিমা। ডাবল ডজন খানেক অপেক্ষমান রোগীর সিরিয়াল ভেদ করে ফাহিম রহমান ডাক্তারের কক্ষে প্রবেশ করলেন!
অন্য সকল রোগীর মতো ফাহিম রহমানও তার পুরাতন প্রেসক্রিপশন আর নিজের সমস্যার কথা আটকা আটকা কন্ঠে ডা.হিমাকে বর্ণনা করলেন।
প্রচণ্ড মদ্যপ অবস্থায় থাকার কারণে ফাহিমের দু’পাটির দাঁত হয়তো এক করা সম্ভব হচ্ছিল না!আচমকাই ঠোঁট গুলো নড়ে উঠছিল! তাই কথা গুলো ছিল অস্পষ্ট!
দামী দামী সব অ্যালকোহলের ভয়ংকর গন্ধ আর মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের প্রেসক্রিপশন দেখে ডা.হিমা মনে মনে ধরে নিয়েছে বড় লোকের সন্তান বটে!
তবে তখনো রোগীর দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখা হয় নি ! অসংখ্য রোগীর ভিড়ে একজন ফাহিম রহমানের দিকে তাকিয়ে দেখার তেমন কোন প্রয়োজনও বোধ করেন নি, ডা.হিমা!
অ্যালকোহলের মারাত্মক গন্ধ ডা. হিমাকে বিরক্ত করে তুলছে।তবুও নাক-মুখ বন্ধ করেই রোগীর হৃদস্পন্দন মাপার জন্য বুকে স্টেথোস্কোপ রেখে ডাক্তার যখন কিছু বুঝার চেষ্টা করছে,ঠিক তখন ফাহিম রহমান ডা.হিমার স্টেথোস্কোপ সংবলিত সেই নরম হাতটিকে চাপটে ধরে বুকের বা’পাশে নিয়ে বলছে,”এখানটাই, ঠিক এখানটাই ব্যথা!এখানেই শূল বিঁধে আছে!”
ডা.হিমা দ্রুত হাতটি ছাড়িয়ে নিয়ে রাগান্বিত চোখে যখন স্পষ্ট করে ফাহিম রহমানের দিকে তাকাল তখন চমকে ওঠে বলল,”ফাহমিদ,হঠাৎ তুমি!”
সত্যিই ফাহমিদ তো! তাই হৃদয়ের চিত্রপটে থাকা ফাহমিদের সাথে এই ফাহিম রহমানকে একটু মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা!
“এখনো আগের মতোই খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি পার্থক্য শুধু বর্ণে।বয়সের বার্তা দিতে কালো দাঁড়ি শুধু সাদা হয়েছে এমনটা কিন্তু নয়! আগের মতো মাথা জুড়ে ঝাঁকড়া চুল আর নেয়,মাথার দু’পাশের অনেক গুলো চুল বুঝি হতাশা অকালেই কেড়ে নিয়ে গেছে! এখনো ঠিক আগের মতোই চোখে কালো ফ্রেমের চশমা পরিবর্তন শুধু লেন্সের পুরুত্বে! অর্থাৎ রোগে,শোকে আর অযত্নে ফাহমিদের চোখের ক্ষমতা এখন শূন্যের কোটায়। ঠোঁট গুলোও আর আগের মতো নেয়,কখনো সিগারেটের গন্ধ না নেওয়া ফাহমিদের মুখে এখন দামী দামী অ্যালকোহলের গন্ধ !”
মাঝে পরিবর্তন হয়েছে পনেরটি ক্যালেন্ডারের অর্থাৎ প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় দেয়াল থেকে খুলে ফেলা হয়েছে গত হয়ে যাওয়া পরেনটি ক্যালেন্ডার!
দীর্ঘ এই সময়ে ফাহমিদের চোখ গুলো আরো ঘোলাটে হয়েছে! বিবর্ণ হয়েছে প্রতিটি অঙ্গ, তবুও ডা.হিমা চিনতে কোন ভুল করেনি।তাই তো অনেকটা কৌতূহলের বশে জিজ্ঞেস করেছে,”প্রেসক্রিপশনে ফাহিম রহমান লেখানোর কারণ কি?”
ফাহমিদ কিছু বলার আগেই ডা.হিমা মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের প্রেসক্রিপশনে চোখ বুলিয়ে দেখে,এখানে ঠিকই ‘ফাহমিদ’ লেখা!
ফাহমিদ চুপ করে বসে থাকলেও, ডা.হিমা মনে মনে ধরে নিয়েছে, ” নিজেকে গোপন রেখে এতো বছর পর আমার হৃদস্মৃতির পরীক্ষা নিতেই তার এই হঠাৎ আগমন!”
এতো বছরের সংকোচ আর অভিমান ভেঙে মুহূর্তেই জড়সড় ভাব!
পনের বছর আগে ফাহমিদের দেওয়া কথাটি মিলিয়ে নেওয়ার জন্য প্রথমেই ডা.হিমা জিজ্ঞেস করে বসল,
~ ডা.হিমা : তোমার ছেলে মেয়ে কয় জন?
~ ফাহমিদ : একজন ছেলে,একজন মেয়ে!
~ ডা.হিমা : আলহামদুলিল্লাহ!
( কিন্তু মনে মনে বলছে,”কথা রাখনি!”তুমি তো কথা দিয়েছিলে,”আমাকে ছাড়া কখনো বিয়ে করবে না!”)
পনের বছর আগে হিমা নিজেই সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে ফাহমিদকে অন্ধকার জগতের দিকে ঠেলে দিয়েছিল!তবুও ফাহমিদের উপর এক অদৃশ্য অধিকার বলে মনে মনে ধরে নিয়েছিল, “ফাহমিদ তাকে ছাড়া কখনো বিয়ে করবে না!”
অনেকটা আফসোসের সুরে ডা.হিমা এবার জিজ্ঞেস করলো,
~ ডা.হিমা : ছেলে-মেয়ে কোথায় পড়াশোনা করে?
~ ফাহমিদ : দু’জনেই অবসরপ্রাপ্ত!
~ ডা.হিমা : ঘটনা কি?
~ ফাহমিদ : ছেলে আমার বাবা আর মেয়ে আমার মা!
তাদেরকে নিয়েই আমার সংসার।
~ ডা.হিমা : তাহলে তুমি এখনো বিয়ে কর নি?
~ ফাহমিদ : না! পনের বছর আগে দেওয়া প্রতিটি কথা
আজও আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করি।
~ ডা.হিমা : সত্যি! ( বিস্ময়ের সুরে হয়তো নিজের
অজান্তেই ডা.হিমা উচ্চারণ করে ফেলেছে)
হঠাৎ দু’জনেই চুপ হয়ে গেল।গলায় ঝুলিয়ে রাখা স্টেথোস্কোপটি খুলে টেবিলের উপর রাখে দিল ডা.হিমা।
অন্য দিকে চেম্বারের বাহিরে অপেক্ষমান রোগীর চাপ বাড়ছে!
কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে ডা.হিমার ব্যক্তিগত সহকারী দরজায় নক করে বলছে,”ম্যাডাম,বাহিরে রোগীর চাপ বেশি!”
এতক্ষণে ডা.হিমার হুঁশ ফিরেছে! ফাহমিদও ইতস্ততায় পরে বলছে,”তোমার অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য দুঃখিত,আজ উঠি!”
ফাহমিদ যখন ওঠে দাঁড়াবে তখন ডা.হিমা ফাহমিদের হাত আটকে বলছে,”এখন তুমি যেত পার না!”
ডা.হিমা টেবিলের উপর রাখা কলিং বেলে কয়েকবার ক্লিক করতেই ব্যক্তিগত সহকারী দরজায় এসে হাজির!
“ইয়েস ম্যাডাম!”
~ ডা.হিমা : “আজকে আর রোগী দেখব না!”
প্রেসক্রিপশনের দিকে আরেক দফা তাকিয়ে ডা.হিমা বলছে,”তোমার হৃদরোগ হয়েছে বুঝি!”
“জানি না ঠিক কি হয়েছে! তবে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের ডাক্তাররা বলেছে,”ভালোবাসা নামক এক মরণব্যাধি রোগে আমি আক্রান্ত!” তবে এই মরণব্যাধি রোগের ঔষধ আছে! কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, প্রতিটি ব্যক্তির জন্য এই ঔষধ আলাদা ভাবে নির্ধারিত! তাই তো মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল থেকে তোমার কাছে রেফার্ড করা হয়েছে! এই ঔষধ গুলো সাধারণত অর্থের কাছে বিক্রি হয় না,তবে কখনো যদি অর্থের কাছে বিক্রি হয় তবে একপক্ষ ভালোবাসা নামক মরণব্যাধি রোগে আক্রান্ত হয়!”
ডা.হিমা হতভম্ব!
“তোমার হাতের এই স্টেথোস্কোপ যদি হৃদয়ের সবকিছু ব্যাখ্যা করতে পারত তবে আমার বুকের ভেতর শকুনির শক্ত চঞ্চুর ঠুকরানোর শব্দ তুমি নিশ্চয়ই শুনতে পেতে!”
ডা.হিমার হাত পা বরফ হয়ে আসছে।ফাহমিদের প্রতিটি কথা ডা.হিমার কানে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করছে! ডা.হিমা নিজেকে সামলে কিছু বলে উঠার আগেই ফাহমিদ বলে উঠছে,
“এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না। আমরা তো সস্তা মেসেজে বিক্রি করিনি আবেগ! চড়া মূল্য দিয়ে চিঠির অক্ষরে লিখেছি এক একটি হৃদয় বাণী!”
“যে ভালোবাসা নামক ঔষধের সন্ধানে তোমার কাছে এসেছি, সেই ঔষধ আজ থেকে পনের বছর আগেই বিক্রি করে দিয়েছ!তবুও এসেছি।কারণ আমি বাঁচতে চাই! আরো অনেক বছর তোমাকে দেখতে চাই, কখনো নিশ্বাস সমান দূরত্বে দাঁড়িয়ে আবারও কখনো বা দূর অজানায় হারিয়ে! ”
“আজও রাত জেগে কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠি লিখি,ভোরের আলো ফুটার আগেই শব্দের বুননে তৈরি হওয়া আবেগ গুলো খাকি খামে বন্দী করে কবুতরের গলায় বেঁধে উঠিয়ে দেই!”
“বাঁচতে চাই,আরো লিখতে চাই,আরো ভালোবাসতে চাই!”