#স্যার
#সূচনা_পর্ব
লেখনীতে — আফরোজা আক্তার
কলেজ থেকে এসে ব্যাগটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে রুশা। মন মেজাজ খুব খারাপ তার। কলেজে আজ বেশ বড়ো সড়ো ঝামেলা করে এসেছে সে। সাইন্স গ্রুপের একটা মেয়েকে থাপ্পড় মেরে ফেলেছে। মন মেজাজ যেমন খারাপ তেমন ভয়ও হচ্ছে। কখন না জানি বিচার নিয়ে আসে বাসায়।
ঝামেলা হয়েছিল রাসিনকে নিয়ে। রাসিন রুশার ভালো বন্ধু। শুধু বন্ধু না বেশ ভালো বন্ধুত্ব তাদের। কিন্তু সাইন্স গ্রুপের ওই মেয়েটা বলা নেই কওয়া নেই শুধু রাসিনের সাথে আঠার মতো লেগে থাকে। সমস্যাটা এখানেই। আজ যখন রুশা ক্লাস শেষে রাসিনকে দেখতে না পেয়ে কলেজ মাঠে যায় তখনই সে দেখতে পায় রাসিন আর ওই মেয়েটা পাশাপাশি বসে বুট খাচ্ছে আর গল্প করছে। সহ্য করতে না পেরে দৌড়ে যায় তাদের কাছে। এরপরই মুখ দিয়ে যা এসেছে তাই বলেছে সে রাসিনকে। মাঝে ওই মেয়ে বলতে আসায় মেরে দিয়েছে এর চড়। আশেপাশে সবাই তাকিয়ে তার কান্ডকারখানা দেখছে।
রাসিনও চুপ থাকেনি। ইচ্ছামতো কিছু কথা শুনিয়ে দিয়েছে রুশাকে। বলেছে তার সাথে রুশার আর কোনো কথা নেই। রাগে দুঃখে সেখান থেকেই সোজা বাসায় চলে আসে রুশা। রুশার একটা বদভ্যাস আছে আর তা হলো, যেটা তার জিনিস সেটা একমাত্র তার-ই জিনিস। সব কিছুই তার। যেটা সে তার নিজের বলে দাবী করে তা সেই জিনিসে কারো চোখ পড়লে তার পছন্দ হয় না।
দরজায় জোরে জোরে কড়া পড়ছে। নাসরিন গলা ছেড়ে ডাকছেন মেয়েকে।
“রুশা। এই রুশা। দরজা বন্ধ করেছিস কেন?”
রুশার মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যায়। সে-ও ভেতর থেকে ধমকানো শুরু করে তার মা’কে।
“সমস্যা কী তোমার আম্মু? হ্যাঁ, বলি সমস্যা কী? আমার বাবা আমার জন্য এই রুমটা বানিয়েছে। আমি রুমে দরজা বন্ধ করে বসে থাকি না শুয়ে থাকি তাতে তোমার কী? যাও তো এখান থেকে।”
মেয়ের এমন কথা শুনে নাসরিনের মেজাজও গরম হয়ে যায়। এইটুকুন মেয়ের কত্ত বড়ো সাহস সে তার মায়ের সাথে এইভাবে উঁচু গলায় কথা বলে। আজ তার একদিন কি রুশার একদিন কি। দরজায় আরও জোরে কড়া নাড়েন তিনি।
“দরজা খুল। নয়তো আজকে জানে মেরে ফেলবো। বেয়াদব মেয়ে। এসেই দরজায় খিল মেরেছিস। জিজ্ঞেস করায় কথায় শোনায়। এই রুশা দরজা খুল। নয়তো আমি দরজা ভেঙে ফেলবো।”
টিকতে না পেরে রুশাও দরজা খুলে দেয়। রুশা দরজার খোলার সাথে সাথে নাসরিন রুশাকে কিছু বলতে যাবে তখনই দেখতে পায় তার মেয়ের গালে চোখের পানির দাগ। মুখটা শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে আছে। রুশা তার আর আশরাফের একমাত্র মেয়ে। বিয়ের প্রায় আট বছর পর রুশার জন্ম। রুশা তার আর আশরাফের চোখের মনি। মেয়ের কিছু হলে যেমন আশরাফ মাথা ফেলে দেয়। তেমনি সে-ও অস্থির হয়ে যায়। রুশার চেহারা দেখে সে এতটুকুন আন্দাজ করতে পেরেছে যে, নিশ্চয়ই মেয়ের কিছু হয়েছে।
রুশা দরজা খুলে দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে পড়ে। নাসরিন পেছন পেছন গিয়ে মেয়ের পাশে বসে।
“কী হয়েছে? কাঁদছিলি কেনো?”
মায়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে ভ্যা ভ্যা করে আরও জোরে কেঁদে দেয় রুশা। মা’কে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে। নাসরিন মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“হয়েছে কী?”
মায়ের কাছে এক এক করে সব কথা বলা শুরু করে রুশা। রাসিনের সাথে ওই মেয়ের বসে গল্প করা, রাসিনের ক্লাস ফাঁকি দেওয়া, ওই মেয়ের সাথে ঢলা-ঢলি করা, এক সাথে বসে বুট খাওয়া, ওই মেয়েকে চড় মারা, রাসিনের সাথে ঝগড়া করা। সব কিছু বলে দেয় সে তার মায়ের কাছে। মেয়ের কথা শুনে নাসরিন কী বলবেন ভাবছেন শুধু। মেয়ে তার এতটা উগ্র কবে থেকে হলো?
“তুই অন্য গ্রুপের মেয়েকে থাপ্পড় মারতে গেলি কেন?”
“ও কেন আমার আর রাসিনের কথার মাঝে ঢুকতে গেল?”
“তোর আর রাসিনের কথার মাঝে কোথায় ঢুকলো সে। আমি তো দেখছি তুই তার আর রাসিনের মধ্যে ঢুকে পড়েছিস।”
“আম্মু তুমিও?”
“স্বাভাবিক ব্যাপার। দেখ, রাসিন তো আর বাচ্চা ছেলে না যে ওই মেয়ে ডেকেছে আর রাসিন গিয়েছে। তারা দু’জন গল্প করবে বলেই সেখানে বসেছে।”
“তাই বলে ক্লাস মিস দিয়ে?”
“তোর প্রবলেম কোথায় বল তো? রাসিনের ক্লাস মিস দেওয়া নাকি ওই মেয়ের সাথে বসে বুট খেতে খেতে গল্প করা?”
“দুইটাতেই আমার প্রবলেম আম্মু। রাসিন আমার ভালো বন্ধু। আমার সব থেকে কাছের বন্ধু। আমি চাই না সে আর কারো সাথে বসুক, কথা বলুক।”
“এখন তো রাসিন তোর উপরেই ক্ষেপে গেছে। এখন কী করবি?”
“তুমি কি রাসিনকে একবার ফোন করবা? প্লিজ আম্মু।”
“আমি কেন করবো। ঝামেলা করেছিস তুই, এর সমাধানও করবি তুই। এখন যা, ফ্রেশ হয়ে নে। দুইটা বাজে। ভাত খেতে হবে।”
“আম্মু রাসিন,,,”
“রেগে আছে। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। তখন তোর বন্ধু তোর-ই থাকবে। চল এখন।”
মায়ের কথায় একটু শান্ত হয় রুশা। তার এমন বেশি করাটা উচিত হয়নি। সে চাইলেই পারতো নিজেকে একটু সামলে নিতে। কিন্তু তা করেনি। সময় বুঝে রাসিনকে স্যরি বলে দিবে। কিন্থ ফোন করবে না। ফোন করলে দেখা যাবে রাসিন ফোন নাম্বারটা ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে দিবে। তখন আর যোগাযোগ করা যাবে না।
নাসরিন টেবিলে খাবার বাড়তে বাড়তে মেয়ের কথা ভাবছে। মেয়ে তার দিন দিন উগ্র হচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই তার এই অভ্যাস। যেটা নিজের বলে দাবী করে সেটার ওপর কারো নজর সহ্য করতে পারে না সে। ক্লাস ইলাভেনের স্টুডেন্ট সে। ধীরে ধীরে আরও বড় হবে, তখন কী করবে খোদা-ই জানেন।
দুইদিন পর।
ফার্স্ট টার্মিনালের রেজাল্ট দিয়েছে। পরিসংখ্যানে ফেইল করেছে রুশা। শুধু ফেইল না, মারাত্মক রকম ভাবে ফেইল করেছে। ৩৩ এ পাশ অথচ সে পেয়েছে মাত্র ১০। সবাই তার রেজাল্ট দেখে বেশ মজা নিয়েছে। কাজ সেরেছে। প্রিন্সিপাল স্যার সরাসরি রুশার বাবা আশরাফকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছেন। জানাবেন না-ই বা কেন? স্যারের সাথে আশরাফের বেশ ভালো খাতির। তাই তো বেছে বেছে মেয়েকে এই কলেজেই ভর্তি করিয়েছেন আশরাফ।
প্রিন্সিপাল স্যার রুশাকে তার অফিসে ডেকেছেন৷ মাথা নিচু করে অফিসে গিয়ে দাঁড়ায় রুশা। প্রিন্সিপাল স্যার রুশাকে দেখে প্রশ্ন করেন,
“খাতায় কী এমন লিখেছিলে আম্মাজান, যে মাত্র ১০ পেয়েছো। এই প্রথম আমার কলেজে ক্লাস ইলাভেনে কেউ পরিসংখ্যানে ১০ পেয়েছে। মন থাকে কোথায় তোমার? সেদিন সাইন্সের এক মেয়ে বিচার দিয়ে গেছে তুমি তাকে কলেজ মাঠে সবার সামনে থাপ্পড় মেরেছো। এইসব কী রুশা? কলেজে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছে তোমার বাবা-মা তোমাকে, গুন্ডামী করার জন্য নয়।”
প্রিন্সিপাল স্যারের কথা শুনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রুশা। নিজেই নিজের রেজাল্ট দেখে অবাক হয়েছে। আসলেই তো কী এমন পরীক্ষা দিলো সে যে টেনেটুনে ৩৩ মার্কও তুলতে পারলো না। আজ বাসায় গেলে উত্তম-মধ্যম খাবে সে। প্রিন্সিপাল স্যার আরও কিছু জ্ঞান দিয়ে তাকে যেতে বলেন।
স্যারের রুম থেকে বের হয়ে কলাপসিবল গেইট দিয়ে বের হয়ে যায় রুশা। কলেজ গেইট পার হবে এমন সময় রাসিন এসে দাঁড়ায় রুশার সামনে। মাথায় গাট্টা মারে রুশার।
“কিরে ফেল্টুস! যাচ্ছিস কোথায়?”
রাসিন মজা নিচ্ছে তার সাথে। সহ্য হচ্ছে না একদম। রাসিন আবারও বলে,
“আবুল মাইয়া, ১০ পাইলি কীভাবে? কী লিখছিলি খাতার মধ্যে?”
রুশা উল্টো প্রশ্ন করে,
“তুই কত পেয়েছিস রাসিন?”
“৯৫।”
“বাহ! কত্ত ভালো রেজাল্ট করলি তোরা।”
“তোর মতো কী সারাক্ষণ ফোন গুতাই নাকি আমরা। আবার আমাকেই জ্ঞান দেস ক্লাস মিস করি কেন? আমি তো ক্লাস মিস করেও ৯৫ পাইলাম আর তুই পাইলি মাত্র ১০। হা হা।”
“হাসছিস কেন এইভাবে?”
“যাহ ফেল্টুস মাইয়া। যা বাসায় যা।”
রাসিন আবারও গাট্টা মেরে চলে যায়। রুশার খুব কষ্ট হচ্ছে। আগের কথা ভাবছে সে। এই রাসিন ক্লাস টেনে থাকতে অংকে ৫ পেয়েছিল৷ সেইবার রাসিনকে কত্তো কত্তো সান্ত্বনা দিয়েছিল সে। অথচ আজ পরিসংখ্যানে ১০ পাওয়ায় রাসিন কতগুলো কথা শুনিয়ে দিলো তাকে। সেরে গেলে সবাই বাঘের বাচ্চা হয়ে যায়। কিন্তু রাসিন,, রাসিন বাঘের বাচ্চা না রাসিন হচ্ছে কুত্তার বাচ্চা। হ্যাঁ হ্যাঁ, রাসিন হচ্ছে কুত্তার বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা। রাসিনের পুরো চৌদ্দ গুষ্টির ষষ্ঠী পূজা করে দেয় রুশা।
বাসায় এসেই মায়ের কাছে এক ধাপ বকা খায় রুশা। একই প্রশ্ন তার মায়েরও।
“খাতায় লিখেছিস টা কী তুই যে ১০ পেয়েছিস? রাসিন ক্লাস মিস দেয়, এই দেয় সেই দেয়। অথচ ওই পোলা ৯৫ পেয়েছে কীভাবে?”
রাসিনের কথা শুনে মাথায় রক্ত উঠে যায় রুশার। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সে বলে,
“রাসিনও তো ক্লাস টেনে থাকতে অংকে ৫ পেয়েছিলো আম্মু। সেদিন আমি ওকে কত্তো সান্ত্বনা দিয়েছিলাম। আর আজ সেই রাসিন আমাকে কলেজ গেইটে ফেল্টুস বললো, আবুল মাইয়া বললো। আম্মু, রাসিন সেরে গেছে তো তাই তার পাখনা গজিয়েছে। আম্মু, রাসিন বাঘের বাচ্চা না। রাসিন, কুত্তার বাচ্চা।
“এই চুপ। একদম চুপ। এক বছর আগের কথা নিয়ে পড়ে আছেন উনি। বর্তমান নিয়ে ভাবেন আপনি। ফেল্টুস বলবে না তো কী বলবে? ফাযিল মেয়ে একটা। ছিঃ ছিঃ প্রিন্সিপাল স্যার তোর বাবাকে ফোন করে বলে, আশরাফ মেয়ে তো পরিসংখ্যানে ১০ পেয়েছে। কীভাবে সম্ভব?”
“আম্মু আমি তো সবই লিখছিলাম।”
“ভুলভাল লিখলে তোমার খালু নাম্বার দিবে তোমাকে? আসুক তোমার বাবা আজকে। দেখি সে কী করে? আমার আর ভালো লাগে না এইসব। এইভাবে আর হচ্ছে না। এইবার স্যার রাখতে বলবো। স্যার এসে বাসায় দুই ঘন্টা সময় দিয়ে যাবেন।”
এই বলে নাসরিন তার নিজের ঘরে চলে যায়। স্যারের কথা শুনে রুশার কলিজায় কামড় পড়ে। সে জীবনেও বাসার স্যারের কাছে পড়বে না। বাসার স্যারে প্রচুর প্যারা। সে আর পড়বে না কখনো বাসার স্যারের কাছে। এটাই তার শেষ কথা।
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়………………..