স্বপ্নীল
১৭
-“চলে যাওয়ার আগে বাড়ি কথা কী মনে ছিলো না।কোন সাহস তুই এই বাড়ির চৌকাঠে পা রাখলি।”
রোকেয়া নিজের মেয়ের উদ্দেশ্য বলল।নীল বাড়িতে পা রাখতেই মির্জা পরিবারে সবাই নিচে বসার করে উপস্থিত হয়।সবাই শীতল চাউনি মেলে তাকে দেখল।সবার মুখ কথা নেই।যেন সবাই নিরবতা নিয়ে প্রতিযোগিতা করছে তাই কথা বলছে না।তাই রোকেয়া বেগম প্রথমেই মুখ খুলল।তার চুপ করা মানায় না।তাকে যে এবার কড়া শাসন করতেই হবে।মায়ের এমন কথা শুনে নীল কিছু ঘাবড়ে যায়।নিজের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করে মায়ের দিকে এগিয়ে যেয়ে ঝাপটে ধরে।
-“আমি জানি তুমি আমার উপরে রেগে আছো। রেগে থাকাই স্বাভাবিক। ”
মাকে চুপ থাকতে দেখে বাবার কাছে যায় নীল।
-“বাবা আমি চলে এসেছি।আর কখনো তোমাদের কে এভাবে ছেড়ে যাবো না।তোমাদের আর কষ্ট দিব না।”
তার বাবা ও কোনো কথা বলল না।দাদুর পায়ের কাছে বসে সে বলল।
-“ও দাদু!দেখো না বাবা,মা কেউ কথা বলছে না আমার সাথে।তুমি ও কি কথা বলবে না আমার সাথে।
সোলোমান মির্জা হাতের লাঠিতে দুইহাত রেখে খুব গম্ভীর হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।নীল আবার বললো,
-“ও দাদু! কথা বলছে না কেন?সবাই কেন এত চুপচাপ আছে।
রোকেয়া বেগম মেয়ের কাছে এসে বলল,
-“এক্ষুনি বের হয়ে যায় তুই এই বাসায় থেকে।তোর সাথে এই পরিবারে কোনো সম্পর্ক নেই।”
মায়ের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দাদুর কাছে এসে বসে আগের জায়গা।সে খুব ভালো করে জানে এই পরিস্থিতি থেকে নিজেকে বাঁচানো জন্য তার দাদুকে প্রয়োজন।তাই দাদুকে পটাতেই হবে।আদুরে নাতনীর কান্না দেখলে দাদু সহ্য করতে পারবে না। তাই সে কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে বলল,
-“দাদু এবার থেকে তুমি আমার কদমফুল বলে ডাকলে। এটা নিয়ে কোনোদিন আর ঝগড়া করবো না। তারপর তুমি কথা বল।”
নীল বুঝতে পাচ্ছে এবার পালিয়ে যাওয়াতে দাদু খুব হার্ট হয়েছে তাই পটাতে দেরী হচ্ছে।এবার কান্না করতে করতে বললো,
-“তোমার কেউ আমায় ভালোবাসো না। এতদিন ধরে সবাই আমার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করেছে।মুখে যত বলে ভালোবাসি।কিন্তু মোটে ও তোমরা আমায় ভালোবাসো না।”
সোহান সাহেব কাঁদো কাঁদো মুখে নীলের মাথায় হাত ভুলিয়ে বলল,
-“কান্না করিস না মা,তোকে কেউ ভালো না বাসলে তোর এই অধম কাকাই তোকে খুব ভালোবাসে।”
নীল কাকাই বলে জড়িয়ে ধরে।কান্না করতে করতে বলল।
-“সত্যি কেউ আমায় ভালোবাসে না।যদি ভালোবাসতে তাহলে আমার এই ছোট ভুলের জন্য ক্ষমা করে দিত।”
রোকেয়া বলল,
-“বিয়ে থেকে পালিয়ে যাওয়ার তোর কাছে ছোট কোনো বিষয় মনে হচ্ছে।তোর কথা শুনে আশ্চর্য না হয়ে থাকতে পারলাম না।”
নিজের কথা আবার দ্বিমতপোষণ করে বলল,
-“ওহ! আমি ভুলেই গেলাম।তোর কাছে তো এটাই ছোট মনে হবেই।ছোট খুকি তুই তাই।”
মায়ের উপর রাগ উঠছে তার।সবার মন একটু গলিয়ে আসতে নিলে তার মা মাঝখান দিয়ে এসে ব্যাঘাত ঘটায়।রোকেয়া বলল,
-“এই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাবি এখন তুই।”
নীল উঠে দাঁড়ায়।চোখে পানি মুছে ফেলে বলল,
-“হ্যাঁ আমি চলে যাবো।যেখানে কেউ আমায় ভালোবাসে না সেখানে থাকার ইচ্ছা ও নেই আমার।”
এটা বলে দরজা দিকে পা বাড়ায় সে।সোহাগী এতক্ষণ চুপ থাকলে এবার সে মুখ খুলল।নীল বিয়ে থেকে পালিয়ে যাওয়াতে যে একটু কষ্ট ফেলে ও এখন নীলের চোখে পানি দেখে তার খুব কষ্ট হচ্ছে।নীল কে তার মেয়ের আসন জায়গা দিয়েছে সে।
-“বড়ভাবি নীল চলে যাচ্ছে।ওকে আটকায় ও।”
নীল আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।তার খুব রাগ হচ্ছে এখন কেন দাদু ডাকল না তাকে।আর যদি না ডাকে তাহলে কোথায় যাবে সে।আবার কি ঢাকা ফিরে যেতে হবে।সোহাগী তার শ্বশুরে কাছে এসে বলল,
-“বাবা নীল চলে যাচ্ছে।নীলকে ছাড়া এই বাড়ি হাহাকার করে।এই বাড়ি একমাত্র আদরের মেয়ে নীল। তাকে ছাড়া আমরা কিভাবে থাকব।এবারে মত তাকে ক্ষমা করে দেন।”
তামিম চুপ করে দাঁড়িয়ে মায়ের কথা শুনছে।সেদিন নীলকে পালাতে সাহায্য করায় তাকে থাপ্পড় মেরেছে।এখন পর্যন্ত ভালোভাবে কথা বলছে না।আর এখন নীলের জন্য তার মায়ে দাদুর কাছে দিয়ে বলল নীল যেন ক্ষমা করে দেয়।সত্যি সবাই কত না ভালোবাসে নীলকে।দরজা চৌকাঠ দাঁড়িয়ে আছে নীল।তখনই সোলোমান মির্জা বলল,
-“দাঁড়াও।”
এটার অপেক্ষাই ছিল নীল।দৌড়ে গিয়ে দাদুকে জড়িয়ে ধরে।
-“ধন্যবাদ দাদুভাই।আমি জানি আমার দাদু ভাই আমার কত ভালোবাসে।আমার দাদু ভাই কিছুতে রাগ করে থাকতে পারবে না তার কদমফুলের উপরে।
-“আমার ভালোবাসার মর্যদা রেখেছি দাদুভাই।”
দাদুর কথা নীলের মুখ ফানসে হয়ে যায়।
-“সরি দাদু।”
-“সরি বললে হবে না।আমায় কথা দিতে হবে।”
-“আমি তোমায় সব কথা দিতে রাজি। ”
-“বাড়ি সবার সামনে আমার মাথা হাত রেখে বলতে হবে।তুমি কখনো কোনো পরিস্থিতে পালিয়ে যাবি না বাড়ি থেকে এবং আমরা যায় বলব তাই শুনতে হবে।”
উপস্থিত সবার মুখে থম থম অবস্থা।নীল সবার দিকে চোখ ভুলায়।সবাই ভাবছে নীল কিছুতে কথা দিবে না।তাতে আমার সোলোমান মির্জা কষ্ট পাবে।সবাইকে অবাক করে দিয়ে নীল তার দাদু মাথা হাত দিয়ে বলল।
-“এই তোমার মাথা ছুয়ে বললাম।তোমাদের সব কথা শুনবো আর,,,,
সবার দিকে আবার চোখ ভুলায় সে।সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে সে কি বলবে।
-“আর কোনোদিন বাড়ি থেকে পালাবো না।”
সবাই খুশি হয়। সোলোমান মির্জা নাতনীর হাত ধরে বলল।
-“দাদু কে কিন্তু কথা দিয়েছে তুমি।কথার খেলাফ যেন না হয় তোমার।”
জড়িয়ে ধরে বলল,
-“কখনো কথার খেলাফ করব না।”
-“অনেক জার্নি করে এসেছো। রুমে গিয়ে রেস্ট নাও।তোমার কাকি মা তোমার খাবার ঘরে দিয়ে আসবে।”
সোহা খাটের উপরে শুকনা কাপড় গুলো ভাজ করছিল।তখনই নীল চুপি চুপি হেঁটে যেয়ে পিছন থেকে সোহাকে জড়িয়ে ধরে।
চিৎকার করে বলল,
“-সোহা!
সোহা পিছন ফিরে অবাক হয়।
“-তুই কখন এসেছিস।”
নীল তার হাত থেকে কাপড় গুলো খাটের উপরে রেখে তাকে টেনে নিয়ে নিজের পাশে বসিয়ে বললো।
-“মাত্রই এসেছি।
“-বাড়ি সবাই কিছু বলেনি পালিয়ে যাওয়ার জন্য”
“-সেটা কি আর বাদ আছে।সব জামেলা মীমাংসা করেই এখানে এসেছি।”
“-তো কেমন কেটেছে ওখানে।”
-“খুব! খুব! ভালো কেটেছে।”
-“এত ভালো কাটার কারণ কি?ওখানে গিয়ে হিরো কে খুজে পেয়েছিস নাকি ”
তখনই মনে পড়েছে যায় তার সুরওয়ালার কথা।সোহা বলল,
“-কিরে!পেয়েছিস নাকি? নিরবতা কিন্তু সম্মতি লক্ষণ।তাহলে কি আমি ধরে নিব,,,,
-“হ্যাঁ”
নীল জড়িয়ে ধরে বলল,
-“সত্যি। ফাইনালি কাউকে তোর মনে ধরেছে।জিজু নাম কি, থাকে কোথায়, প্রথম দেখা হয়েছে কোথায়। ছবি দেখা।”
খুশিতে গদগদ হয়ে হাজারখানেক প্রশ্ন করে সে।সোহার এত প্রশ্ন শুনে হুমড়ি খাওয়ার অবস্থা নীলের।
-“বাপরে বাপ এক সাথে এত প্রশ্ন। কোনটা ছেড়ে কোনটার আন্সার দেবো।”
-“এক এক করে বলা শুরু করে দেয়।আগে বল নাম কি?
-“জানি না ”
সোহা ভ্রু কঁচকে তাকায়।নীল বলল,
-“সত্যি জানি না আমি ”
গোয়েন্দা মতো নজরদারী করে বলল,
-“সত্যি জানিস না, নাকি আমায় বলবি না।”
-“আমার এমন কোনো কথা আছে যে তোকে বলি নাই।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে।নাম জানিস না কিন্তু ছবি বোধ হয় তুলেছিস।”
আবার সেই হতাশার নিশ্বাস ফেলল নীল,
-“জানি না।”
-কি জানি তুই, মনে মানুষ পেয়েছিস কিন্তু নাম ধাম কিছু জানিস না।কিন্তু বাড়ি কোথায় সেটা জানিস। ”
নীল মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়।বান্ধবীর এহেম কান্ড খুব রাগ হচ্ছে সোহার।নিজেকে খুব শান্ত করে বলল,
-“কী ভাবে দেখা হয়েছে তোর।”
-“দেখা হয়নি। ”
-” কি বলছিস।দেখা যদি না হয়। তাহলে কিভাবে প্রেমে পড়েছিস।মাথায় কিছু ঢুকছে না।সব গুলে যাচ্ছে আমার।
-“ঠান্ডায় মাথায় আমার কথা শুন, তাহলে বুঝতে পারবি।”
নীলের কথা শুনার জন্য খাটের উপরে পা দুটো জড় করে বসে,
“-হুম বল!”
“-যার প্রেমে আমি হাবুডুবু খাচ্ছি তাকে আমি চিনি না।”
এটা বলে থামে সে।সোহা মুখে দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আমি জানি তুই কি ভাবছিস।আমি যাকে চিনি না তাকে কি ভাবে ভালোবাসলাম।সত্যি আমি ও জানি না কি করে ভালোবাসলাম।”
“-হেয়ালি না করে সব ক্লিয়ার কর আগে?”
-“সাজেকে রাতেবেলা সবাই মিলে আড্ডা দিয়ে ঘুমাতে গেলাম।তখন আমি শুনতে পেলাম একটা মধুর সুর।সুরটা ছিল নেশাধরানোর মত।সে সুরে মাদকতা বিরাজমান করছিল।সেই সুর শুনে আমি কিছুতে ঘুমাতে পারছিলাম না। চটপট করছিলাম বিছানায়।শেষমেশ না পেরে সেই সুরে টানে ছুটে যাই । সুরটা কোথায় থেকে আসছে তা দেখার জন্য সুরে উৎস খুজতে খুজতে বারান্দ পৌঁছায়।ওখানে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে সুর শুনছিলাম। এতটাই ওই সুরে মগ্ন ছিলাম আমি কখন যে সুরটা থেমে গেলো বুঝতে পারিনি।ধ্যান ভাঙার পর সুরওয়ালাকে সেখানে তন্নতন্ন করে খুঁজলাম।কিন্তু ফেলাম না।তারপর হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হলো রুমে।
এটুকু বলে থামল নীল।সোহা বলল,
“-সুরটা কিসের ছিল!বাঁশির!”
“-মাউথ অর্গান।”
-“সেটা আবার কি? ”
“-ওইটার মাধ্যমে মানুষ তার প্রিয়গান তুলে রাখে আগেই তারপর বাজায় ।”
“-ওহ!তারপর কি হলো”
-“সেদিন রাত নির্ঘুম কেটেছিল আমার।পরেদিন রাত সেইম একই কাহিনি।আমি সেই সুরওয়ালাকে খুজতে বের হই।আমি বারান্দা থেকে সেই সুরওয়ালাকে সেখানে একটা স্থানে দোলনায় বসে মাউথ অর্গান বাজাতে দেখেছি।অন্ধকারে তা মুখ দেখা যাচ্ছে না বলে আমি নিচে যাওয়ার জন্য পা বাঁড়াই ঠিক তখনই প্রাচ্য আপু কান্না করতে করতে তার একবন্ধুর রুমে ঢুকছে তার পিছনে আর বাকি বন্ধগুলো ছিল।প্রাচ্য আপুকে এভাবে কান্না করছে কেন?তা জানার জন্য সবার পিছন আমি যাই।সেখানে জামেলা মিটিয়ে যখন সেই স্থানে আসি।তখন দেখি সেই সুরওয়ালা নেই।তাকে সেখানে আমি হন্য হয়ে খুজেছি।তারপর না পেয়ে ফিরত আসতে হলো।সেদিন সারারাত আমি কেঁদেছি।তাকে পাইনি বলে আর কখনো পাবো না সেই জন্য। সেদিন সকালে আমরা সেখান থেকে আসার সাথে সাথে হারিয়ে ফেলেছি তাকে, একবার বলতে পারিনি দুইটারাত তার সুরের টানে ছুটে এসেছি। শুধু একবার তাকে দেখার জন্য।বলতে পারিনি আমি তার সুরে প্রেমে পড়েছি। সেই মধুর সুরওয়ালার প্রেমে পড়েছি আমি।”
তার চোখে কোনো পানি চিকচিক করছে। সোহা বুঝতে পারে সত্যি তার বান্ধবী কষ্ট পাচ্ছে।তাকে ঝাপটে ধরে বলল,
-“দেখিস তার সাথে দেখা হবে তোর খুব শীঘ্রই”
“-তাই যেন হয় সোহা।তাকে যে এই কয়দিনে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি।”
“-তোর এই বান্ধবী তোকে দোয়া করে দিয়েছে।ঠিক একদিন না একদিন তোর সুরওয়ালার সাথে দেখা হবে।”
#চলবে…
@কাউছার স্বর্ণা