স্বপ্নীল
১১
সোহা তামিমের রুমে এসে দেখে পুরো রুম অন্ধাকার করে রেখেছে।বুঝতে পাচ্ছে না ঘুমিয়ে আছে নাকি জেগে আছে, হাতের ভাতের থালা নিয়ে যেয়ে রুমে লাইট জ্বালিয়ে দেয়। আলো জ্বলে উঠতে তামিম বলে উঠে,
-কে?
-“আমি
তামিম উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল,সোহার কন্ঠ শুনে সে উঠে বসে,
-“তুই কেন এসেছিস?
সোহা খাবারের থালা রাখতে রাখতে বলে,
-“মা বলেছে আপনি না খেয়ে আছেন সারাদিন।তাই খাবার নিয়ে এসেছি।
-“খাবার আরো আগে নিয়ে আসতে পারলে না,খিদে যে আমি মরে যেতে ছিলাম।আরেকটু দেরী করে আসলে হয়তো আমি অক্কা পেতাম।
-“ছি ঃ ছিঃ কি সব বলছেন?মুখে কোনো কথা আটঁকায় না আপনার।যা মুখে আসে তা বলে ফেলেন।
তামিমে ভাত একলোকমা মুখে তুলে বলে,
-“আমি মরে গেলে তোর কি??তুই আর আমায় ভালোবাসিস না?মরে গেলেই তো বাঁছিস।আর আমার জ্বালা তোকে সহ্য করতে হবে না।
সোহা আর কিছু বলে না।তাকে চুপ থাকতে দেখে তামিম বলে,
-“আমায় খাবার দিতে কি মা বলেছে,
সোহা আমতা আমতা করে বলে,
-“আস…লে,,,
তামিম বিরক্ত হয়ে বলে,
-“কোনো কিছু তোকে জিজ্ঞেস করলে তোতঁলাইয়া তোঁতলাইয়া কথা বলিস কেন?আর যদি এমন ভাবে কথা বলিস। থাপ্পড়ি তোর কান গরম করে ফেলব।আমি যেটা জিজ্ঞেস করব স্পর্শ ভাবে তার উত্তর দিবি। খালা পাঠিয়েছে খাবার তাইতো।
সোহা আর কিছু না বলে ঘাড় কাত করে হ্যাঁ জানায়।
ইশিল মাছ ভাজা দিয়ে ভাত খাচ্ছে সে।ইলিশের কাঁটা বাছবে, নাকি খাবে বুঝতে পাচ্ছে না।সে বিরক্ত সুরে বলে,
-“এখানে সঙের মত দাঁড়িয়ে না থেকে এদিকে এসে আমার ইলিশ মাছের কাঁটা বেছে দেয় তো।
-“কি?
-“কানে শুনছ নাই।নাকি আবার বলতে হবে তোকে।
সোহা আর কিছু না বলে তামিম মুখোমুখি বসে খাটের উপরে।
-“তাড়াতাড়ি বেছে দেয়।আমার খুব খিদে পেয়েছে।
-“আপনি ছোট খোকা যে মাছের কাটা বেছে দিতে হবে?
-“ছোট খোকা নয় আমি,তুই জানিস না ইলিশ মাছে কাটা আমি বেছে খেতে পারি না।সব সময় মা বেছে দেয়।এখন মা নেই, তাই তোকে করতেই হবে।
সোহা আর কিছু না বলে মাছের কাঁটা বেছে দিতে থাকে।আর তামিম খেতে থাকে।খাবুসগুবুস করে তা দেখে সোহা বলে,
-“আপনার খাবার কি কেউ নিয়ে যাবে?
তামিম তার দিকে ভ্রু কুঁচকিয়ে তাকিয়ে নিজের মুখে ভাতের লোকমা দেয়।
-যে ভাবে ঘাবুসঘুবস করে খাচ্ছেন যেন হাজার জনম ধরে কিচ্চু টি খান নাই।
মুখে ভাতের আরেক লোকমা তুলে বলে,
-“হাজার জনম নাই বা হোক।কালকে রাত ধরে না খেয়ে আছি এটা আমার কাছে হাজার জনম মনে হচ্ছে। তুই এক কাজ কর নিজে গিয়ে আমার জন্য আরেকটু ভাত আর তরকারি নিয়ে আস।
বাধ্য মেয়ের মত সে নিচে গিয়ে ভাত আর তরকারি নিয়ে আসে।তামিম খেয়ে দেয়ে বলে
-“আহ্ পেট ভরে গেছে! কি শান্তি লাগছে।
সোহা খাবার প্লেট গুলো নিয়ে নিচে যাচ্ছিল তখনই তামিম বলে
-“এই গুলো নিচে রেখে এসেছে আমার কাছে আসবি কথা আছে?
——————————-
স্বপ্ন আর নীল অনেক রাত পর্যন্ত হ্যালিপ্যাড ছিল।অনেক রাত হওয়া আজকে তার ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে যায়।কথা ছিল সবাই সকালে সে উঠাবে,কারণ সে খুব ভালো করে জানে তার বন্ধুদের এত তাড়াতাড়ি উঠার অভ্যাস নেই।তাই সে উঠাবে বলে দিয়েছে। কিন্তু সে নিজেই ঠিক সময় উঠতে পারেনি।তাই আজকে সকালে হ্যালিপ্যাডের সূর্যোদয় মিস করে ফেলে। সবাই হোটেল গিয়ে নাস্তা খেয়ে নেয়। তারা কমলর্ক ঝর্না যাওয়ার জন্য তেরী হচ্ছে।তাদের সাথে একজন গাইড আছে তার নাম বিকাশ। সাজেকের মেইন রাস্তার পাশে ডাল হয়ে নিচের দিকে একটা রাস্তা যায় সেই রাস্তা দিয়ে যাওয়া শুরু হয় কমলক ঝর্ণা।সবার হাতে হাতে একটা একটা করে ৪ফুটের বাঁশ হাতে।
সাজেক এর রুইলুই পাড়া থেকে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা ট্রেকিং করলেই কমলক ঝর্ণা পৌঁছে যেতে পারে।কমলক ঝর্ণা টি অনেকের কাছে কাছে পিদাম তৈসা ঝর্ণা বা সিকাম তৈসা ঝর্ণা নামে পরিচিত।
প্রাচ্য আর রোদ কিছুক্ষন ট্রেকিং করে হাঁপিয়ে যায়। তাদের দাঁড়িয়ে যেতে দেখে স্বপ্ন বলে,
-“দাঁড়িয়ে গেছি কেন?
প্রাচ্য হাপাতে হাপাতে বলে,
-“আর হাঁটতে পাচ্ছি না,
ধূসর বিরক্ত হয়ে বলে,
-“তাহলে আসতে গেলি কেন??জানিস না এখানে আসলে ট্রেকিং করতে হয়।
-“আপু এখন একটু কষ্ট হবে,যখন ঝর্ণা দেখবে তখন এই কষ্ট মনে থাকবে না।”বললো নীল।
তৃণ ফোঁড়ন কেটে বলে,
-“কষ্ট করলে মিষ্টি খেতে পারবি।”
-“একটু জিরিয়ে যা,তাহলে আর ওদের কোনো সমস্যা হবে না।”
স্বপ্ন কথা মত সবাই এখানে কিছুক্ষন জিরিয়ে নেয়।স্বপ্ন নীলের দিকে তাকায়,এই মেয়ের মধ্যে নেই কোনো ক্লান্তি, নেই কোনো বিরক্তি। কি আনন্দের সাথে হাঁটছে, সত্যি মেয়ে অন্যরকম!
মাঝে মাঝে সবার মনে হচ্ছে ঠিক মত পথে চলছে!তারপর বিশাল এক ঝিরিপথ। আবার সবার মনে হচ্ছে আদৌ কি এই পথে কোনো ঝর্ণা আছে? এর পরে জাদি পাইর এর মতো একটা ট্রেইল বয়ে নিচে নামতে হবে।সামনে পড়বে হামহাম মত ঝিরিপথ। ঝিরিপথ টি ও সম্ভব সুন্দর, একটু কষ্ট হলেও সবার এডভেঞ্চারটি ভালো লেগেছে সবার।ঝিরিপথ আর বুনো রাস্তা দিয়ে৮০-৮৫ ডিগ্রী খাড়া পাহাড় বেয়ে নামতে আর উঠতে হবে অনেকখানি।এইভাবে আরো কিছুক্ষণ ট্রেক করা পর পৌঁছে যায় ঝর্ণার কাছে। ।
ঝরনার কাছে পৌছতে খুব বেশি সময় লাগলো না। নীল ছপছপ করে এগিয়ে গেলো ঝরনার দিকে। সবাই ওর স্টামিনা দেখে অবাক হয়ে যায়। যেখানে ট্রেকিং শেষে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়ে, সেখানে ও আনন্দে উল্লাস করে।
নীল ঝরনায় গিয়ে দ্রুত পানি ছিটিয়ে খেলা করতে লাগলো। পানিতে বসে পা দুটো মেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিতে লাগলো। পাহাড় থেকে শো শো শব্দ হচ্ছে। ঠিক শো শো শব্দও বলা যায়না। কেমন যেন ঝিরঝির একটা শব্দ। ঝরনার অন্যরকম একটা শব্দ আছে। নীল চোখ বন্ধ করে ঝরনার জলে ভিজতে লাগলো। বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছে আর পানিতে নেমে বসে আছে। বরফ শীতল জলে পা কেটে যাওয়ার মতন অবস্থা হয়ে যাচ্ছে। এত ঠাণ্ডা কেন এই জল! অবশ্য বেশ আরাম ও লাগছে। ঝরনার মাঝে কেমন একটা ভালোবাসা মিশে থাকে যেন।
স্বপ্নর স্পর্শে চোখ খুললো মিশু। তাকিয়ে দেখলো আশেপাশে আর কেউ নেই,শুধু স্বপ্ন বাকিরা সবাই অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছে। নীল অবাক হয়ে বললো, “হোয়াটস আপ?”
স্বপ্ন ওকে টেনে তুলে এনে ঝরনার নিচে দাড় করিয়ে দিলো। একসাথে খুব জোরে পানির ঢল মাথার উপর পড়ছে যেন। মাথার তালু ফেটে যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু বেশ ভালো লাগছে। স্বপ্ন নীলকে চিবুক ধরে দুহাতে ওর মুখটা ধরলো। তারপর ঝরনার মাঝেই চোখ মেলে ওকে দেখার চেষ্টা করলো। নীলের গালে লেগে থাকা পানির বিন্দুগুলো দেখে আজকে স্বপ্নর হিংসে হচ্ছে। ইস! সেযদি জল হতো ঠিক এভাবেই ছুয়ে থাকত নীলের গালে,ঠোঁটে,চুল।
এত সুন্দর ঝরনা দেখে নীলের সত্যেন্দনাথ দত্ত ঝর্না কবিতা কথা বার বার মনে মনে পড়ছে।তার নিজের অজান্তে মুখ দিয়ে কবিতা বের হয়ে যায়,
ঝর্না!ঝর্না!সুন্দরী ঝর্ণা!
তরলিকা চন্দ্রিকা!চন্দন বর্ণা!
অঞ্চল সিঞ্চিত গৈরিকে স্বর্ণে,
গিরি -মুল্লিকা দোলের কুন্তলে কর্ণে,
তনু ভরি’যৌবন,তাপসী অপর্ণা,
ঝর্ণা!
পাষানের স্নেহধারা!তূষারের বিন্দু!
ডাকে তোরে চিত-লোল উতরোল সিন্ধু!
মেঘহীন জুঁইফুলী বৃষ্টির ও-অঙ্গ
চুমা-চুমকীর হারে চাঁদ ঘেরে রঙ্গে,
ধূলা-ভরা দ্যায় ধরা তোর লাগিয়ে ধর্ণা!
ঝর্ণা!
এস তূষার দেশে এস কলহাস্যে-
গিরি-দরি-দহিরিনী হরিনী লাস্যে,
ধুসরের ঊষরের কর তুমি অন্ত,
শ্যামলিয়া ওপরশে কর গো শ্রীমন্তী,
ভরা ঘট এস নিয়ে ভরসা ভর্ণায়
ঝর্ণা!
শৈলের পৈঠৈয় এস তনুগত্রী
পাহাড়ের বুক চেরা এস প্রেমীদাত্রী
পান্নার অঞ্জলি দিতে দিতে আয় আয় গো,
হরিচরণ -চ্যুতা গঙ্গায় প্রায় গো,,
স্বর্গের সুধা আনে মর্ত্যের সুপর্ণা,
ঝর্ণা!
মঞ্জুল -ও হাসির বেলোয়ারি আওয়াজ,
ওলো চঞ্জলা! তোর পথ হল চাওয়া যে,
মোতিয়া মোতির কুঁড়ি মূরছে ও-অলকে,
মেখলায়,মরি মরি রামধনুর ঝলকে,
তুমি স্বপ্নের সখী বিদ্যুৎ পর্ণা
ঝর্ণা!
-সত্যেন্দনাথ দত্ত
কতই না কাব্যিকভাবে ঝর্ণার ছবি এঁকেছেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। বাংলা সাহিত্যজুড়ে ঝর্ণার রূপ বর্ণনা বুঝি অন্য কোনো কবির কবিতায় এতটা জীবন্ত হয়ে ওঠেনি। বহুবিধ অলংকার, উপমায় ভূষিত করে ছন্দের জাদুকর পাহাড়ি ঝর্ণাকে উপস্থাপন করেছেন। ছন্দ তুলে ছুটে চলা ঝর্ণার রূপে কবি মুগ্ধ হয়েছেন। শুধু কবি নয়, এমন কোনো প্রকৃতিপ্রেমী নেই যার কণ্ঠ গুনগুন করে ওঠে না ঝর্ণার ছুটে চলা ছন্দ-সুরে। নেচে নেচে প্রবাহিত হওয়া পাহাড়ি ঝর্ণায় প্রকৃতিপ্রেমীরা যেন খুঁজে পান উচ্ছ¡াস, উল্লাস, মুগ্ধতা, যৌবন, অনুপ্রেরণা, বাধা-বিপত্তি জয় করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র।
-“চমৎকার
ঝর্ণার সৌন্দর্য এতটাই বিভোর ছিল, সে যে কবিতা আবৃত্তি করছে বুঝতে পারেনি, স্বপ্নের চমৎকার বলায় তার ঘোর ভাঙে।স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে সে মৃদু হেসে আগে ন্যায়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
#চলবে
#kawsar_sorna