স্বচ্ছ প্রণয়াসক্ত পর্ব-২৯ এবং শেষ পর্ব

0
1266

#স্বচ্ছ_প্রণয়াসক্ত
#পর্ব_২৯
#মুসফিরাত_জান্নাত

রজনীর ছোঁয়ায় মেতেছে পুরো আকাশ। শুভ্র নীরদ দেশ ছেঁয়ে গিয়েছে কালচে আঁধারে।আবহমন্ডল অনুষ্ণ, অতুলনীয়।বিশাল অন্তরীক্ষের মধ্যভাগে চন্দ্রিমার আবির্ভাব হয়েছে।বাতাসে ভাসছে মিষ্টতা।কয়েক ঘন্টা পূর্বে কিছু হাসি,কান্না, পিতা-মাতা ও কন্যা বিচ্ছেদের আবেগঘন দিনের সমাপ্তি টেনে ঐশীকে নিজের ঘরে তুলেছে সাদাত।এখানে আসা মাত্র তাকে স্বর্ণের রিং ও চেইন দিয়ে সমাদৃত করে নিয়েছে সবচেয়ে বয়োজেষ্ঠা সাদাতের নানা ও দাদা।তার মামা -মামী,চাচা-চাচীসহ ছোট-বড় সকলেও উপস্থিত ছিলো সেখানে।আমোদ প্রমোদে মাতানো পরিবেশ হয়ে আছে।অতঃপর বাকি সময়টুকু কাটল তাদের সাথেই।হাস্যরসের মাধ্যমে কেটে গেলো সময়।সাদাতের বাবা বেঁচে না থাকায় মাসুদা শেখের উপর চাপ পড়েছে বেশ।সবটা সামলে নিয়ে পুত্র বধুকে খেতে ডাকলেন তিনি।

বিয়ের দিন কন্যাদের একটা ব্যামো সৃষ্টি হয়।কোনো কারণ ছাড়াই পেটে কিছু দিতে পারে না তারা।ঐশীরও খাওয়ার কোনে ইচ্ছা নেই।শাশুড়ীর কথা ফেলতে না পেরে খেতে বসলেও বেশিরভাগ খাবারটুকুই প্লেটে রয়ে গেলো।সে না খেয়ে উঠে পড়লো।রাত বেশি হতে দেখে মাসুদা শেখও আর জোর করলেন না।ঐশীকে ফ্রেশ হওয়ার জন্য সাদাতের রুমে বসিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি।অবশ্য এক জন্য ঐশীকে গুনতে হলো দশ হাজার টাকা।টাকা ছাড়া বাসর ঘরে ঢুকতে দিবে না বলে দরজায় তালা এঁটে দিয়েছিলো সাদাতের কাজিন গ্রুপ।সাথে সিন্থিয়াও যোগ দিয়েছিলো।বান্ধবীর থেকে সুযোগ পেয়ে ইচ্ছামতো টাকা হাতিয়ে নিয়ে সেসব ভাগ বাটোয়ারায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো তারা।চাবি ছেড়ে দিলো তালা খোলার জন্য।নতুন বউ হওয়ায় নিরবেই সবটা দেখে গেলো ঐশী।তাদের বিভিন্ন কথায় লজ্জাও পেলো অনেকটা।রুমে ঢুকে মিষ্ট ঘ্রানে বিমোহিত হলো ঐশী।রুমটা নানা রঙের, নানা প্রজাতির ফুল দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে।বিশেষ কিছু স্থানে মোমবাতি জ্বলছে টিমটিম করে।বেড সাইড টেবিলে একটা ফুলদানিতে শোভা পাচ্ছে লাল ও সাদা রঙা তাজা জারবেরা।সেসবে চোখ বুলিয়ে ঐশী চোখ মেলে বিছানার দিকে।চোখ আটকে যায় তার।বেশ জাঁকজোমকপূর্ণ ভাবে বিছানা সাজানো হয়েছে।স্ট্যান্ডের সাথে লাল,নীল,সাদা ও হলুদ রঙা পাতলা নেটের পর্দা ঝুলিয়ে তার উপর দিয়ে কমলা রঙা গাদা ফুলের মালা বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।আর স্ট্যান্ডের উপর দিকটায় নানা রঙের জারবেজা ও হরেক রকমের ফুল পাতা দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে।বিছানায় পেতে রাখা বেড কভারের উপর গোলাপ ও গাদার পাপড়ি মিশিয়ে লাভ সাইন একে তার মাঝে ‘এস’ প্লাস ‘ও’ লিখে দেওয়া হয়েছে।রুমের সাজসজ্জা দেখে ঐশী লজ্জা পেল বেশ।সলাজ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলো সবটা।ক্ষণকাল পর সাদাতের দুইটা কাজিন এসে লাগেজ গুলো দিয়ে গেলো।

একটু পর সাদাত ঘরে এলো।ঐশীকে ঘাটে ঘোমটা টেনে বসে থাকতে দেখে সে বলে উঠে,

“এখনো ফ্রেশ না হয়ে বসে আছো?”

জবাবে ধীর কন্ঠে ঐশী বললো,

“শাড়ি, গহনা,ওড়না এসব না খুলে কি করে ফ্রেশ হবো?

“তাহলে খুলে নাও ওসব।বাধা দিয়েছে কে?”

সাদাতের প্রশ্নে আহত দৃষ্টি মেলে তাকায় ঐশী।লোকটা কি বুঝতে পারছে না কারো হেল্প ছাড়া এসব খুলতে পারবে না সে।ঐশীর দৃষ্টি দেখে কিছু একটা অনুভব করে সাদাত।নির্লিপ্ত কণ্ঠে শুধায়,

“কোনো প্রয়োজন?”

মাথা নাড়ায় ঐশী।

“হুম।পিনগুলো খুলে দিলে উপকার হতো।”

ঐশীর কথায় তার দিকে পূর্ন দৃষ্টিতে তাকায় সাদাত।ধীর পা ফেলে এগিয়ে যায় সে।ঐশীকে হেল্প করতে গিয়ে সে দেখে মেয়েটির এক খোপা বাঁধতে গিয়েই পার্লার থেকে হাজার খানেক বার্বিপিন চুলে গেঁধে দিয়েছে।বেশিরভাগ পিন এমনভাবে গাঁথা না দেখে খুঁজে পাওয়া দুস্কর। মাথার ওড়নাটা খুলে পিনগুলো এক এক করে খুলে দেয় সাদাত।ঐশী ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো বিধায় আয়নার মধ্য দিয়ে সাদাতের মুখশ্রী দেখতে পায়।তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকে সে সাদাতের পানে।আচমকা মৃদু হাসি দেখা দেয় তার ঠোঁটে।সাদাত এতো সাবধানে, আস্তে ধীরে সব কটা পিন খুঁজে খুঁজে বের করছে যাতে ঐশী সামান্যটুকুও ব্যাথা না পায়।ব্যাপারটায় বেশ মুগ্ধ হয় ঐশী।মনে মনে সে আবারও বলে,

“অন্যপুরুষ এমনি বলি না আপনাকে।আপনার সব কার্যকলাপ ভিন্ন।”

সাদাত ঐশীর খোপা খুলে গহনা খুলতে সাহায্য করে।গলার হার খুলতে গিয়ে তার হাতের শীতল স্পর্শ লাগে ঐশীর গলদেশে।আচমকা কেঁপে ওঠে সে।হুট করে কেনো যেনো স্পর্শটাকে প্রথম স্পর্শের ন্যায় অনুভুত হয় তার নিকট।লজ্জায় অরুন রঙা হয়ে যায় সে।তির তির করে কাঁপে দেহ।হৃদস্পন্দন বেড়ে দ্রুত হয়।ব্যাপারটা যেনো স্পষ্টই টের পায় সাদাত।স্মিত হেসে সে বলে,

“লজ্জা পাচ্ছো?”

প্রশ্নটা আরও লজ্জা দেয় ঐশীকে।মাথা নুইয়ে থুতনি গলায় স্পর্শ করে সে।যার দরুন মুখ দৃশ্যমান হয় না।কিন্তু ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় অনুভব করে মেয়েটা কতোটা লজ্জা পাচ্ছে। ঐশীর এই লজ্জা ভালোলাগার সৃষ্টি করে সাদাতের অন্তস্থলে।নিঃশব্দে হাসে সে।ঐশীর কানের কাছে মুখ নিয়ে মোহগ্রস্ত কণ্ঠে বলে,

“লজ্জাপরী তুমি কি জানো নারীদের এই লজ্জা বেসামাল করে দেয় পুরুষ জাতিকে।তোমার এই আচরণটা যে আমাকে তোমার নিকটে কতোটা টানছে তা কি বুঝতে পারছো না তুমি?”

কথাটা কর্ণগোচর হতেই সারা দেহ কেঁপে ওঠে ঐশীর।ছোট করে সে বলে,

“আপনি থামবেন?”

কথাটা বলে সে লাগেজ থেকে এক সেট জামা নিয়ে চলে যায় ফ্রেশ হতে।সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসে সাদাত।মেয়েটা বড্ড লাজুক।অল্পতেই লজ্জা পেয়ে যায়।এ কারণেই হয়তো ঐশীকে লজ্জা দিতে তার আরও ভালো লাগে।

ফ্রেশ হয়ে আসার পর ঐশী অনেকটা স্বস্তি বোধ করলো।ভারী শাড়ি গহনায় বেশ কষ্ট হচ্ছিল তার। বেরিয়ে এসে সাদাতকে ঘরে পেলো না ঐশী। ভ্রু কুঁচকে তাকালো সে৷কিছুক্ষণ তার খোঁজ করে ভেজা চুল মুছে নিল সে।অতঃপর উদাস হয়ে দাড়ালো করিডোরে।আকাশের মেঘ কেটে চাঁদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে রইলো সে।একটু পর সাদাত ঘরে এলো।ঐশীকে ঘরে না পেয়ে ভাবলো এখনো ওয়াশরুমে আছে।ঘড়ির দিকে তাকালো একবার, রাত একটার বেশি বাজে। এতো সময় নিচ্ছে কেনো মেয়েটা? মনে প্রশ্ন জাগ্রত হলো তার।এক পা দু পা করে এগিয়ে গেলো সে ওয়াশরুমের দিকে।দরজার সিটকিনি যে বাহির থেকে লাগানো তা খেয়ালই হলো তা তার।চিন্তিত মনে সে জিজ্ঞেস করলো,

“কোনো সমস্যা ঐশী?বের হচ্ছো না যে!কিছু ফেলে গিয়েছো?”

সাদাত ভেবেছিলো হয়তো পোশাক বা এমন কিছু ঐশী ভিতরে নেয় নি যার জন্য সে বের হতে পারছে না।তাই ফাঁকা ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে এই প্রশ্ন করলো সে।ওয়াশরুম থেকে কোনো আওয়াজ এলো না।ভেতরে কেও থাকলে তো আসবে।তবে উত্তর শোনার অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘতর হলো না তার।সাথে সাথে করিডোরের এক কোন থেকে ঐশী পাশ ফিরে বললো,

“নাহ কিচ্ছু ফেলে যাইনি আমি।বরং ফেলে রেখে এসেছি।”

শব্দের উৎপত্তি স্থলের দিকে তড়িৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় সাদাত।বলে,

“ওহ তুমি ওখানে?”

স্মিত হেসে ঐশী মাথা নাড়ায়।

“হুম।”

ঐশীর সান্নিধ্যে যেতে যেতে সাদাত জিজ্ঞেস করে,

“তা কি ফেলে রেখে এসেছো?এনে দিবো?”

ঠোঁট কামড়ে হাসে ঐশী।

“তার প্রয়োজন নেই।ঘর্মাক্ত শরীরের ব্যাকটেরিয়া ও সারাদিনের ক্লান্তি ফেলে এসেছি।”

কথাটা বলে স্ব জোরে হাসে ঐশী।সাদাতও তাল মেলায়।মেয়েটা দুষ্টুমি করতে পারেও বটে।গুটি গুটি পা ফেলে সে এগিয়ে যায় ঐশীর সান্নিধ্যে।হটাৎ নানা রঙা মরিচ বাতি ও ঘর থেকে আসা ঝকঝকে আলোর সংমিশ্রনের মাঝে দাঁড়ানো ঐশীকে দেখে থমকায় সে।হালকা মিষ্টি রঙা থ্রি পিছ পরিহিত মেয়েটিকে অপূর্ব সুন্দর লাগছে।ভ্রু কুটি করে তাকায় সে।মোহনীয় কণ্ঠে বলে,

“ভেজা চুলে কি স্নিগ্ধতা প্রাচুর্য পায় নাকি?”

সাদাতের নেশাক্ত কণ্ঠে লজ্জারা হানা দেয় ঐশীর মাঝে।ঘার ঘুরিয়ে লজ্জা লুকাতে চেষ্টা করে সে।
সেদিকে স্থির নয়নে তাকিয়ে থাকে সাদাত।

কিছুটা সময় যেতেই এক বাটি নুডলস, আলাদা পিরিচ এ ফ্রুটস ও দই নিয়ে হাজির হলো সাদাত। করিডোরে রাখা টি টেবিলে সেসব স্থান দিলো সে।ঐশী বিস্ময়কর নয়নে তাকিয়ে বলে,

“এসব কেনো?”

সাদাত মন্থর কন্ঠে বলে,

“সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে।তাছাড়া আমি খোঁজ নিয়ে শুনেছি সারাদিন কিছু খাওনি তুমি।এখন এসব খেয়ে নেও।ক্লান্তি ভাবটাও কেটে যাবে।”

“তা ঠিক।কিন্তু নুডলস?”

“তোমার পছন্দ বলে আনলাম।একদিন খেলে কিচ্ছু হবে না।তাছাড়া এখন পুরোদমে সুস্থ তুমি।আমি খাইয়ে দিচ্ছি হা করো।”

কথাটা বলে কাটা চামচের সাহায্যে নুডলস পেচিয়ে ঐশীর মুখে তুলে ধরে সাদাত।প্রেমিকের তুলে দেওয়া খাবারটা নিজ মুখে পুরে নেয় ঐশী।খাওয়ার মাঝে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকে সাদাতের পাণে।কতো নিখুঁত লোকটা।সৌন্দর্য,ব্যক্তিত্ব সব দিকে যেনো পরিপূর্ণ।সাদাতের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে তার অতীতের কিছু কথা।সাদাতের সাথে হুট করে অনাকাঙ্ক্ষিত এক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিলো সে।অতঃপর সেখান থেকেই তাদের পথচলার সুচনা।সম্পর্কের শুরুটা কেমন এলোমেলো ও খাপছাড়া ছিলো।এই রুষ্ট মেজাজী মানুষটার সাথে দা মাছ সম্পর্ক ছিলো তার।সেখানে এই সম্পর্ক টিকবে কি না তা নিয়ে দ্বিধায় ছিল সে। তার উপর দুইজনের পূর্বের একটা সম্পর্ক তো ছিলোই। শিক্ষক ও ছাত্রীর সম্পর্ক। সেটাই বা কিভাবে এড়িয়ে চলতো তারা?সব মিলিয়ে কেমন এলজেব্রা অবস্থা ছিল৷তাই ভরসা রাখেনি সে কোন। কিন্তু পরে, আস্তে ধীরে সময় যত গড়ালো সব পাল্টে যেতে শুরু করলো।কলেজে শিক্ষক হিসেবে যে সাদাতকে ঐশী চিনতো তার পাশাপাশি উল্টো এক সত্তার সাদাতকে আবিষ্কার করলো সে।কঠোর ব্যক্তিত্বের সাদাতের মাঝের কোমলতা প্রকাশ পেতে শুরু করলো।আর ঐশী হতে থাকলো মুগ্ধ।ধীরে ধীরে সেই সমদর্শিতার মায়ায় জড়িয়ে গেল সে। নিজের অগোচরে, তাকে নিজস্ব অভ্যাসে পরিনত করে ফেললো।নির্লজ্জ ঠোঁটকাটা স্বভাবের মেয়েটি তার সান্নিধ্যে লজ্জায় আবৃত হলো।সবসময় উঁচু কন্ঠে কথা বলা মেয়েটির কণ্ঠে নম্রতা বেষ্টিত হলো একজনের স্পর্শে।যার অস্তিত্ব পছন্দ ছিল না এক মুহূর্তের জন্য, আজ তার অস্তিত্বের বেড়াজালেই সুখ খুঁজে পেলো সে।এখন কিনা এই মানুষটির পাশেই আজীবন থাকতে চাওয়ার সাধ তার।আমৃত্যু পর্যন্ত। কি অদ্ভুত এই সম্পর্কের উচাটন তাই না?

ঐশী মৃদুহাসে৷বুকজুড়ে নিমজ্জিত মুগ্ধতা ও বাহ্যিকদিকে স্নিগ্ধতার প্রকাশ।সাদাত হাসিটা খেয়াল করে জিজ্ঞেস করে,

“হাসছ যে?”

ঐশী সাদাতের দিকে তাকিয়ে বলে,

“এমনি!”

অতঃপর কি যেন ভেবে পিছন দিকে একটু হেলান দেয় সে।বেখেয়ালেই পড়ে যেতে নেয় যেনো।সাদাত তড়িৎ দু হাতে আগলে নেয় ঐশীকে।ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করে,

“ব্যাথা পেয়েছো?”

স্মিত হাসে ঐশী।

“যার জীবনে এমন সঙ্গী আছে সে কখনো ব্যাথা পেতে পারে?”

কথাটা বলে লাজুক হেসে সন্তর্পণে সাদাতের বুকের মাঝে মাথা রাখে ঐশী।সাদাত ঐশীর পিছন দিয়ে দু হাতের বাঁধনে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরে তাকে।মন্থর করে অদৃষ্টে অঁধর ছুঁয়ে দিয়ে আলাপ জুরে দেয়।

_______________

পরিশিষ্টঃ

অপরাহ্নের শেষভাগ।মেহেদী রঙা রবি গড়িয়ে পড়ছে পশ্চিমাকাশের গহীনে।পাখ পাখালির ঘরে ফেরার ব্যস্ততা গুঞ্জন তুলছে এদিক-সেদিক। ঐশী জানালার ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে আনমনে।কিছুক্ষণ পর পিরিচে সান্ধ্যকালিন নাশতা সাজিয়ে রুমে আসলেন মাসুদা শেখ।ঐশীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,

“খেয়ে নাও, আজ একটু দেরি হয়ে গেলো।”

ঐশীর ধ্যাণ ভাঙ্গে।ঘার ঘুরিয়ে তাকায় সে। নিস্পৃহ কন্ঠে বলে,

“খেতে ইচ্ছে করছে না মা।”

“কিন্তু না খেলে তো চলবে না মা।ডেলিভারির ডেট ঘনিয়ে আসছে তোমার। এখন খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম করলে চলবে নাকি?শরীরে শক্তি পাবে কই থেকে?তার উপর অনেক কষ্টে এই বাবু পেটে এসেছে তোমার।সময়মত না খেলে কি সব ঠিক থাকবে?যতটুকু পারো খাও নাহলে সাদাত শুনলে কিন্তু খুব রাগ করবে।জানোই তো তোমার শরীর নিয়ে অনিয়ম তার একটুও পছন্দ না।”

ঐশী বিরবির করে বলে,

“সব প্যারা,অরুচি যাচ্ছে তো সব আমার উপর দিয়ে, সে বুঝে কি? পারে তো শুধু আমার সাথে। জাঁদরেল একটা।”

মাসুদা শেখ কথাটা শুনতে পেলেন না।নাশতাটা টি টেবিলে রেখে হাতের কাজ সাড়তে এগিয়ে গেলেন তিনি।ঐশী ভারী পেটটা টেনে এগিয়ে আসতেই পেটে টান অনুভব করলো।সাথে প্রচণ্ড ব্যাথা ও ব্লিডিং শুরু হলো।ব্যাথায় চিৎকার করে উঠলো সে।পাশের ঘর থেকে তড়িৎ ছুটে আসে সিন্থিয়া।ঐশীকে কাহিল হয়ে বিছানায় বসতে দেখে হাঁক ডাক শুরু করে দেয়।হাতের কাজ ফেলে ছুটে আসেন মাসুদা শেখ।ঐশীর মুখশ্রী দেখে বিচলিত হয়ে পড়ে সে।সাদাতও বাড়ি নেই।এখন কি করবে সে?

সিন্থিয়া দৌড়ে গিয়ে ড্রাইভারকে ডেকে ঐশীকে সাথে নিয়ে হসপিটালে যাত্রা করে।মাঝপথে সাদাতকে ফোন দেয় সে।মাসুদা শেখ হায় হুতাশ করতে থাকে।পথে যেনো কোনো বিপদ না হয়।

একটু পরই হসপিটালে পৌঁছে গেলো তারা।সঙ্গে সঙ্গে সাদাত এলো।ঐশীকে ডেলিভারি রুমে নিয়ে যাওয়া হলো।সাদাতও ভেলিভারির সময়টা ঐশীর সাপোর্ট হয়ে থাকতে অনুমতি চাইলো।ডাক্তার রুবাইদা ইসলাম চেয়েও চিন্তায় অস্থির সাদাতকে ফিরিয়ে দিতে পারলেন না।বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই প্রথমবারের মতো ডেলিভারি রুমে স্বামীকে থাকার অনুমতি দেওয়া হলো।দৌড়ে গিয়ে সে ঐশীর হাত চেঁপে ধরলো।এতো নার্স ও ডাক্তার উপস্থিতির লজ্জা ফেলে ঐশীকে সাহস ও স্বান্তনা দিতে লাগলো সে।তা দেখে বিমোহিত হলেন ডাক্তার ও নার্সরা।সত্যি এরকম স্বামী পাশে থাকলে মেয়েরা মুখ বুজে হাজারও কষ্টের পথ পাড়ি দিতে পারবে।ঐশীও পাড়ি দিলো এই কষ্টের মুহুর্তটা।নির্দিষ্ট সময় পর তাদের কোল আলোকিত করে হলো একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান।বাচ্চাটিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সকলে।এই ফাঁকে সাদাত ঐশীর দু চোখের অশ্রু মুছে দিয়ে কপালে অধর ছোঁয়ালো।বিধ্বস্ত চোখদুটো মেলে ঐশী তাকালো।দৃশ্যমান হলো সাদাতের চেহারা।এইতো তার অবলম্বন।তার শত কষ্টের উপশমকারী।অর্ধাঙ্গিনীর আহত চোখদুটো দেখে বুক কেঁপে উঠলো সাদাতের।যদিও কোনো জটিলতা নেই।তবুও ব্যাথাতুর স্ত্রীর এই কষ্টও যেনো সহ্য হচ্ছে না তার।ব্যগ্র কণ্ঠে সে বললো,

“যদি পারতাম তোমার সব ব্যাথা নিজের করে নিতাম।কিন্তু এই ক্ষমতাটা আমাদের নেই বলেই হয়তো তোমরা পরম মমতাময়ী মা।”

কম্পিত কণ্ঠে জবাবে ঠোঁট নাড়ায় ঐশী।

“কে বলেছে আমার ব্যাথা আপনি ভাগ করে নেন নি।পাশে ছিলেন এতো সময় এটাই আমার ব্যাথায় মলম লাগিয়ে দিয়েছে।আর কি লাগে?”

“তোমার কষ্টে আমার পুরো দুনিয়া ওলট পালট হয়ে যাচ্ছিলো ঐশী।তোমার কষ্টের তীব্রতার কাছে আবার বাবা হওয়ার আনন্দটা তুচ্ছ হয়ে গিয়েছে।তোমার সুস্থতাই আমার সব সুখ।”

বাক্যগুলো উচ্চারণে গলাটা ধরে এলো সাদাতের।কঠোর স্বভাবের লোকটার কি চোখ ভিজে গেলো তবে?হ্যাঁ ভেজাটা স্বাভাবিক।মেয়েদের এই মুহুর্তের কষ্টটা দেখলে পাষাণের মনও যে কেঁদে উঠবে।মেয়েদের সম্মান জানাতে বাধ্য হবে কাপুরুষের দলও।সেখানে সাদাত তো তার প্রেমিক পুরুষ।লোকটির বিচলতা দেখে শত কষ্টেও হাসার চেষ্টা করে ঐশী।মিহি কণ্ঠে বলে,

“আমার জন্য এই ব্যকুলতা সারাজীবন থাকবে তো?”

“তোমাকে পাওয়ার যেই আক্ষেপ তা আমাকে সারাজীবন ব্যকুল করে রাখবে ঐশী।”

“আমাকে যে এতো ভালোবাসেন।ভবিষ্যতে ভালোবাসা ফুরিয়ে যাবে না তো? ”

“না যাবেনা।খাল যত খনন করা যায় তার দৈর্ঘ্য প্রস্থ ও গভীরতা যেমন বৃদ্ধি পায়।তেমনি ভালোও যতো বাসা যায় তা সবদিকে তত বৃদ্ধি পায়।তাই ভবিষ্যতে তোমার প্রতি ভালোবাসা কখনো কমবে না বরং বাড়বে।”

সাদাতের কথার যুক্তিতে হেরে তাকিয়ে রইলো ঐশী।একটু পরে মায়ের কোলে তুলে দেওয়া হলো সদ্য প্রসূত কন্যাটিকে।পৃথিবীর প্রথম খাবার তার পেটে দেওয়ার প্রচেষ্টা চললো তখন।
____
ধীরে ধীরে দিন গড়াতে লাগলো।সাতদিনের মাথায় বাবুর আকীকা করে দিলো সাদাত।মাথার চুল ফেলে দিয়ে ঐশীর নামের সাথে মিল রেখে নাম দিলো ঐশ্বর্য শেখ।সাদাতের এমন পাগলামি দেখে বিষ্মিত হলো সবাই।সিন্থিয়া টিপ্পনি কেটে বলেই বসলো,

“বউ পাগলা।”

হেসে উঠলো সবাই।সেটা আনন্দের হাসি।সেই হাসিতে সাদাতও তাল মেলালো।পরিবারের এমন মিষ্টি মুহুর্তে অকারণেই হেসে উঠলো ছোট্ট প্রাণটি।তাকে নিয়ে মেতে উঠলো সবাই।তাদের মাতানো গন্ধে মেতে উঠলো যেনো পরিবেশও।টবে ফুটে থাকা গোলাপের সুবাস দিয়ে গেলো।প্রকৃতি যেন বলে ওঠলো, এমন মুহূর্তের সাক্ষী যেন হাজারটা প্রহর হয়।অমর হয়ে থাকে দৃশ্যগুলো।মুগ্ধতা, শুদ্ধতা,পবিত্রতাময় আনন্দিত এই মুহুর্তগুলো এভাবেই ছড়িয়ে যায়, যুগ থেকে যুগান্তরে।তাদের স্বচ্ছ,শুদ্ধ প্রণয়াসক্তির মাধ্যমে।

~~~~~সমাপ্ত~~~~~~

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে