সোনার কন্যা পর্ব-০৯

0
408

#সোনার_কন্যা
#পর্ব৯
#রাউফুন

কবুল বলার ঠিক কিছু মুহুর্ত আগে আছিয়া খাতুনের ঘর থেকে গোঙানির শব্দ এলো। সেই গোঙানির শব্দ প্রথমে কানে এলো সুবাশের। সুবাশ কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো, ‘আপনাদের ঐ রুম থেকে গোঙানির শব্দ আসছে। শুনেছি আপনার দাদি অসুস্থ, উনার কি কিছু হলো? চলুন আগে গিয়ে দেখা করে আসি। আজকের এই শুভ দিনে আপনার দাদীর দোয়া নেবো না?’

অশ্রুসিক্ত লোচনে কটমট করে তাকালো নুরিশা। তার চোখের পানি দরদরিয়ে পড়ছে। কেন এরকম একটা সময় তার জীবনে এলো? নুরিশার হৃদপিন্ড ছলাৎ ছলাৎ করে উঠছে। মনে হচ্ছে হৃদপিন্ড লাফিয়ে লাফিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসবে। আর তক্ষুনি র’ক্ত বমি হয়ে সে জ্ঞান হারাবে। এতোটা কষ্ট হচ্ছে কেন তার? একদিকে এতো অল্প সময়ে এই বা’জে, ধূর্ত লোকটা সবাইকে কনভিন্স করে ফেলেছে তাকে বিয়ে করার জন্য! একটা লোকের মধ্যে মানুষকে অতি দ্রুত আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা বিদ্যমান থাকতে পারে কিভাবে?

সবাই সুবাশের কথা শুনে আছিয়া খাতুনের রুমে চলে গেলো। আছিয়া খাতুন খাটে চোখ উলটে তাকিয়ে রইলেন নুরিশা আর সুবাশের দিকে। তার দু চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। তিনি এখন আর কথাও বলতে পারেন না। শুধু ইশারা বাম হাতের একটা আঙুল তুলে নুরিশাকে কাছে ডাকলেন। ইশারায় কি যেনো বোঝাতে চাইলেন। রিক্তা আর বিভা আহাজারি শুরু করে দিয়েছেন আছিয়া খাতুনের অবস্থা এতো শোচনীয় দেখে। মতিউর আর শফিউল্লাহ নিজেদের মায়ের এই অবস্থা সহ্য করতে পারলেন না। নুরিশা কি বুঝলো কে জানে, সে দাদিকে বুকে জাপ্টে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। শেষবার তওবা পড়ে নিয়ে আছিয়া খাতুন এই দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চির বিদায় জানালেন। নুরিশা পাথরের মতো দাদির বুকের উপর মাথা রেখে কাঠ কাঠ হয়ে পরে রইলো। একটি আনন্দঘন বাড়ি মুহুর্তের মধ্যে হয়ে উঠলো বিষাদের ন্যায়। শয্যাশায়ী বৃদ্ধার মৃত্যুর খবর পেয়ে নানান মানুষ এলো। সুবাশের পরিবার সহ সবাই রয়ে গেলো। এভাবে তো আর যাওয়া যায় না। যতই হোক এই বাড়িতে তারা সম্বন্ধ করতে চাইছিলেন আজকে।

মতিউর রহমান, শফিউল্লাহ আর রেহান আছিয়া খাতুনের খাটিয়ে কাঁধে তুলে নিলেন। তাকে নিয়ে যাওয়ার আগে নুরিশা ছুটে এলো উদ্ভ্রান্তের মতো। শেষ বার দাদির মুখটা দেখে নুরিশা একটা চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালো। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই দাফন কার্য সম্পন্ন করার পর সুবাশের পরিবার সবাই বিদায় নিয়ে চলে গেলো। তাজফি জানতেও পারলো না তার অগোচরে কত কিছু হয়ে গেলো। তার প্রিয় একজন মানুষ তার নাম জপ করছিলো শেষ নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার আগ অব্দি!

সপ্তাহ গড়ালো৷ মাস গড়ালো তাজফির দেখা নেই৷ তাজফি কোথায় গেছে তারও হদিস পাওয়া গেলো না। নুরিশার বিয়ে ঠিক করা হলো আরও দুমাস পর। এবারে বিয়েটা ধুমধামে হবে। বাড়ির সবাই ধরেই নিয়েছিলো আছিয়া খাতুন এই বিয়েতে খুশি ছিলেন। কারণ মৃত্যুর পরও তার মুখে হাসি ছিলো। সব কিছু মিলিয়ে নুরিশা এখন সম্পুর্ন একা নিঃসঙ্গতায় দিন কাটাচ্ছে। পরীক্ষার পর এডমিশন কোচিং এ ভর্তি হয়েছে। কোচিং এ যায় আসে এছাড়া বইটি ছুঁয়েও দেখে না। ভালো ভার্সিটিতে চান্স না হলে সুবাশ নাকি অনেক রাগ করবে। সুবাশ চায় তার বউ কোনো ভালো ভার্সিটিতে টপ করুক। সুবাশ রাগ করুক আর না করুক তাতে নুরিশার কিছু যায় আসে না৷

এই এক মাসে রোজ একবার করে নুরিশা তাজফির ছোট্ট মেসে গিয়ে খোঁজ নিয়েছে। তাজফি নাকি এই মেস ছেড়ে দিয়েছে। আর আসবে না। কি কারণে তার এমন পালিয়ে বেড়ানো নুরিশা জানে না। আচ্ছা মানুষটা কি তার প্রিয় দাদির মৃ’ত্যু’র খবর পায়নি?

আনিকা নুরিশার কাছে এলো। নুরিশার জেদে আছিয়া খাতুনকে বাগানের একটা স্থানে কবর দেওয়া হয়েছে। ওখানে একটা ব্রেঞ্চ বসে নুরিশা বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দেই। আনিকা নুরিশার পাশে বসে সস্নেহে জিজ্ঞেস করলো,’খাবে না? এখন বেলা গড়িয়ে চারটে বেজে গেছে! গত এক মাসে তোমার কি হাল হয়েছে দেখেছো?’

‘আমি ঠিক আছি ভাবিজান। ভাইয়া কোথায়? ভাইয়া কি তাজফি ভাইয়ার খবর পেয়েছে?’

‘তুমি তাজফি ভাইয়ার খবর পাওয়ার জন্য এতো উতলা কেন হয়ে আছো জানতে পারি?’

‘নাহ পারো না।’

‘আচ্ছা, আমি তোমার ভাইয়াকে আবার তাগদা দিবো! যেনো দ্রুত খুঁজে আনে তাজফি ভাইয়াকে।’

‘ভাবিজান!’

‘হু বলো?’

‘আমি এই বিয়েটা করতে চাই না।’

‘আমি জানি!’

‘তুমি জানো?’

‘হুম। তবে তোমার জন্য এই সম্পর্ক টা ঠিক লাগে আমার কাছে!’

‘আমার কাছে লাগে না যে!’

‘পরিবার যা চাই তার বিরুদ্ধে যেও না।’

‘তুমি যাওনি?’

‘কি বোঝাতে চাইছো?’

‘তুমি পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে দাদু ভাইকে বিয়ে করোনি?’

‘নাহ, যদি আমার আব্বা না চাইতেন তবে বিয়েটা সেদিন হতো না। আমি কিন্তু একটিও শব্দ উচ্চারণ করিনি সেদিন। তুমি তো যাওনি তাই জানো না নুরি!’

নুরিশা নিরস গলায় বললো, ‘আমি আমার দাদির কথা রাখতে সব করতে পারি ভাবিজান। সব মানে সব!’

‘নুরি!’

‘হু!’

‘তুমি তাজফি ভাইকে ভালোবাসো?’

‘হ্যাঁ!’ নুরির এমন অকপটে স্বীকারোক্তিতে যারপরনাই অবাক হয়ে চকিতে তাকালো আনিকা।সে আন্দাজে ঢিল ছুড়েছিলো, ঢিলটা যে ঠিক ঠাক নিশানায় লাগবে সেটা সে ভাবতেও পারেনি। আনিকা নুরিশার মুখোমুখি হয়ে দুই কাঁধে হাত রেখে চোখে চোখ রাখলো। ম্লান কন্ঠে বললো, ‘তাজফি ভাই থার্টি টু, আর তুমি অনলি এইটিন, বয়সের তারতম্য দেখেছো? পরিবারের নিশ্চয়ই কেউ চাইবে না তোমার বিয়ে এতো বয়সের একজনের সঙ্গে হোক।’

নুরিশা উঠে দাদির কবের কাছে গেলো। কবরের পাশে সদ্য জন্মানো ঘাসের উপর হাত বুলিয়ে দিলো। অল্প আওয়াজে বললো, ‘ভাবিজান, এখন তুমি যাও। আমি দাদির সঙ্গে কথা বলবো!’

‘রোজ তুমি এই কাজ করো নুরি! নিজেকে সামলাও!’

‘সামলেছি বলেই জীবিত আছি ভাবিজান!’

আনিকা ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো। নুরিশা যখন আপন মনে ফিসফিস বাক্যে কথা বলায় ব্যস্ত হলো তার কিয়ৎক্ষন পর প্রস্থান ঘটালো আনিকা। এভাবেই নুরিশা সন্ধ্যা অব্দি এখানে কাটাবে। এরপর রুমে ঢুকে দরজা আটকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। নানান আহাজারি, বিলাপের সঙ্গে তার সময় কাটে। রাতের খাবার তাকে ঘরে দেওয়া হয়। প্রথম প্রথম রিক্তা বেগম মেয়েকে নিজে হাহুতাশ করলেও এখন সবটা ছেড়ে দিয়েছেন সৃষ্টিকর্তার উপরে।

রাত নটার দিকে নুরিশার ফোনে কল এলো। সে জানে এটা কার ফোন। রিং হতে হতে ফোনের রিংটোন থেমে গেলো। সে নিজের মর্জি মতো ফোনটা রিসিভ করবে। বাজতে থাকুক। ফোনের অপর প্রান্তের ব্যাক্তি বিরক্ত হোক। কিছু কিছু মানুষকে এভাবে বিরক্ত করতেও মজা পাওয়া যাই।

এটা রোজ ই হয়। নুরিশা ফোনটা হাতে নিয়ে বারান্দায় বসলো। বারান্দা থেকে স্পষ্ট দাদির কবর দেখা যায়। ফুলের টব থেকে সদ্য ফোটা ফুলের গন্ধ বাতাসের তোড়ে ভেসে এসে তার নাকে তাল খাচ্ছে।
নুরিশা ফোন হাতে নিয়ে বসেছে পাঁচ সেকেন্ড ও অতিক্রম হয়নি এর মধ্যেই কল এসেছে আবারও।

‘কি আপনি? একটা মানুষ এতো বার কল দিচ্ছে, রিসিভ না করে ফোনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকার মানে কি?’

‘কিছু বলবেন?’

‘আপনি আমার হবু বউ, আমি আপনার হবু স্বামী হয়ে আপনাকে ফোন দিতে পারি না?’

‘নাহ পারেন না।’

‘কেন?’

‘আমাদের বিয়ে তো এখনো হয়নি। বিয়ে হলে কল করার অধিকার পাবেন, নতুবা না!’

‘আপনি আমাকে এতো অপছন্দ কেন করেন?’ সুবাশের কম্পিত স্বর শুনে চাপা হাসলো নুরিশা। তাচ্ছিল্য করে বললো, ‘আপনি অতিরিক্ত ভালো মানুষ। আর অতিরিক্ত ভালো মানুষ আমার সবচেয়ে অপছন্দের তালিকায় থাকে। কি দরকার বলুন?’

‘কোনো দরকার নেই।’

‘তাহলে রেখে দিন!’

‘দরকার ছাড়া কথা বলা যাবে না?’

‘নাহ!’

সুবাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিভে যাওয়া গলায় বললো, ‘এই মুহুর্তে আপনার সঙ্গে কথা বলতে না পারলে যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। আমার খুব খুব ইচ্ছে হচ্ছে আপনার সঙ্গে রাত্রী জেগে কথা বলতে। আজকে একটু সময় দেবেন নুরিশা?’

‘নাহ!’

‘এসবের মানে কি তবে?’

‘আমি তো বিয়ে করতে চাই না,আগেও বলেছি! বিয়েটা ভেঙে কেন দিচ্ছেন না?’

‘আপনি আমার জেদ! বিয়েটা আমি আপনাকেই করবো!’

‘আমি করবো না।’

‘তাহলে বিয়েটা আপনি নিজে ভেঙে দিচ্ছেন না কেন?’

‘পারছি না। আমি বললে আমার কথা শোনে না! আপনি বলুন!’

‘আমি তো বলবো না নুরিশা, আমার তো আর আপনাকে অপছন্দ নয়। যতো কিছু হোক আমি আপনাকে ছাড়ছি না!’

‘এই জেদ আপনার জন্য ভয়ংকর হবে!’

‘হোক, আমি তবুও আ…..!’

সুবাশের পরবর্তী বাক্য শোনার অপেক্ষা করলো না নুরিশা। কল কে’টে দিয়ে বেড সাইটে রেখে অত্যন্ত গরমেও কাথা মুড়িয়ে শুয়ে পরলো৷

গভীর রাত, রাতের অন্ধকারে তাজফি নুরিশার বাড়ির ওয়াল টপকালো। রোজকার মতো দাদির কবরের কাছে বসে পরলো। দু চোখ ভিজে যাচ্ছে বার বার। সে তীব্র আর্তনাদ করে নিচুস্বরে বললো, ‘প্রেমিকা, আমাকে ক্ষমা করেছো তো? যে ভুলটা আমি করেছি, সেজন্য প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছি। আমি তোমার নুরির জন্য পার্ফেক্ট না কোনো দিক থেকেই। আমার মতো একটা জানুয়ার, বর্বর তোমার নুরির মতো নিষ্পাপ মেয়ের মানাই না। সুবাশ ছেলেটা সত্যিই ভালো, ওর কাছে তোমার নুরি ভালো থাকবে প্রেমিকা। তাছাড়া আমার যে হাত পা বাঁধা! আমি যে উনাকে কথা দিয়েছি নুরিশার সামনে যাবো না। আমার হাতে কিচ্ছু নেই। কিচ্ছু না। আমি সবটা সৃষ্টিকর্তার হাতে ছেড়ে দিয়েছি। যা কিছু হবে, যা কিছু সৃষ্টিকর্তা চান সেটাই হবে। কেউ জানবে না, আমি মধ্যরাতে তোমার কাছে আসি। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও প্রেমিকা। ‘

‘কিন্তু আমি যে জেনে গেলাম, এবারে কোথায় পালাবেন আপনি? আপনি কার কথায় নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন তাজফি ভাই?’

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে