#সে_ফিরে_আসবেই
#৭ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
মা এবার চুপ হয়ে যান। তাকে কেমন ভীত দেখায়। চেহারা মলিন হয়ে আসে।
আমি তাকে তাড়া দেই। আবার বলি,’মা ও মরে গেলে ফিরে আসতে পারে কীভাবে?’
মা এবার কাঁপা কন্ঠে বললেন,’ও কী সত্যিই তমাল?’
‘হ্যা সত্যিই তমাল।নীলা ওকে তমাল নামেই সম্বোধন করেছে।’
মা এবার বললেন,’তমালের চেহারার গড়ন বল তো?ও দেখতে কেমন!’
‘অতকিছু বলতে পারবো না মা। শুধু এটা জানি নীলাকে ও নীল বলে ডাকে।আর ও সব সময় পাঞ্জাবি পরে।দেখতে চিকনা টাইপের!’
মা এবার একটা ধাক্কার মতো খেলেন।মার চেহারা এখন আরও বেশি ভীতসন্ত্রস্ত দেখা যাচ্ছে।
তিনি বললেন,’একটু পানি।পানি খাবো!’
আশেপাশে কাজের বুয়া নাই।কাজের বুয়াকে তিনি আজ সকাল সকাল ছুটি দিয়ে দিয়েছেন।কাজের বুয়ার সামনে নিজের মেয়ের সম্পর্কে এইসব কথা নিয়ে আলোচনা করা যায় না।করলে সর্বনাশ হবে।এইসব কথায় তারা লেজ মাথা কান এবং ঠোঁট লাগিয়ে এ বাড়ি ও বাড়ি প্রচার করবে।
আমি উঠে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে গ্লাস ভরে মার জন্য পানি নিয়ে এলাম।মার হাতে সেই গ্লাস তুলে দিতেই মা এক চুমুকে সবটুকু পানি খেয়ে সাবাড় করে ফেললেন। তারপর মেঝেতে ঝনাৎ শব্দ তুলে খালি গ্লাসটা রেখে বললেন,’এটা কীভাবে সম্ভব বাবা?যেখানে নীলার বাবা নিজের হাতে খুন করেছে তমালকে!’
কথাটা বলে হঠাৎ থম মেরে গেলেন মা। এবার তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি এভাবে খুনের বিষয়টা আমার কাছে বলতে চাননি। কিন্তু মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন। এখন তিনি অনুশোচনায় ভুগছেন!
এবার তো আমি নিজেই রিতিমত ভয় পাচ্ছি। বিষয়টা অবশেষে খুন পর্যন্ত গড়িয়ে পড়লো!
তবে কী একটা ছোট্ট ঘটনার ভেতরেও সুপ্ত থাকে অনেক বড় বড় ঘটনা?
মা এবার কথা ঘুরিয়ে ফেলতে চেষ্টা করেন।বলেন,’না খুন করেনি তোমার শশুর। ভুল বলছি।
ও টাইফয়েডে মারা গিয়েছিল। কিন্তু নীলা সন্দেহ করেছিল ওর বাবা ওকে খুন করেছে!’
আমি এবার হেসে ফেলি। হেসে বলি,’মা, আমার তিন বছরের ছোট্ট মেয়েটাও মিথ্যে বলে না এই ভয়ে যে মিথ্যে বললে আল্লাহ কাঁচি দিয়ে তার জিভ কেটে ফেলবেন!আর আপনি চুল পাকা বৃদ্ধা হয়েও কী করে অবলীলায় এইসব মিথ্যে বলে যাচ্ছেন!কেন আমার কাছে সব লুকোতে চাচ্ছেন বলুন তো? আপনি লুকিয়ে রাখলেও আমি কিন্তু সব কথা বের করে ফেলবো। তখন আপনি অসম্মানিত হবেন। তখন আর আপনাকে আমি শাশুড়ি হিসেবে এতোটুকুও সম্মান করবো না। ভালো আচরণ তো দূরে থাক সবচেয়ে যে নোংরা আচরণ আছে তাই করবো আপনার সাথে!’
মা এবার একটু চমকে উঠলেন। তিনি এখনও সবকিছু লুকোতে চাচ্ছেন। বলছেন,’তুমি আমার কাছে কেন এসেছো বল তো?তমাল কে তা আমি জানি নাকি ?এই বিষয়ে আর একটা কথাও আমার সাথে বলবে না! আমার তো মনে হয় তুমি নিজেই নীলাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছো। আরেকটা বিয়ে করতে চাও তাই না?আমি কিন্তু সহজে তোমায় ছেড়ে দিবো না।মামলা করবো তোমার নামে!’
মার এই আচরণগুলো খুবই হাস্যকর! শিশুসুলভ।কেউ কেউ এই আচরণগুলোকে ধৃত চোরদের আচরণও বলে থাকেন। অর্থাৎ কোন চোর ধরা পড়ে গেলে হাজার হাজার মিথ্যে বলে, একেকবার একেক ধরনের কথা বলে বাঁচার চেষ্টা করে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করে। এমনকি যে তাকে ধরলো তার নামেও অনেক সময় চোরির অপরাধ দিয়ে বসে!মাও ঠিক এই কান্ডগুলিই করছেন আমার সাথে!আমি জানি তার কাছ থেকে এখন কোন সঠিক তথ্যই পাওয়া যাবে না। সঠিক তথ্য পেতে হলে তমাল এবং নীলাকে আমার প্রয়োজন। কিন্তু ওদের আমি কোথায় খুঁজে পাবো!
মানহাকে নিয়ে বাসায় এসে পড়ি।মানহা এখনও কিছু খেতে চাচ্ছে না।ওর সেই একটাই কথা।একটাই বাণী।
‘মা কখন আসবে?বাবা, তুমি খুব খারাপ! মাকে তুমি তাড়িয়ে দিয়েছো!’
এবার আমার কান্না পায় খুব। মেয়েটার লাল টুকটুকে মুখটা শুকিয়ে অতটুকু হয়ে গেছে। চোখ দুটো ফুলে গেছে একটানা কাঁদার কারণে।
আমি ওকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠি এবার। নিজের উপর খুব রাগ হতে থাকে আমার।রাগ হয় এই জন্য যে কেন আমি তার কথাগুলো শুনলাম না।ও তো খুব করে চেয়েছিল তার কথাগুলো যেন আমি শুনি। অনুরোধ করেছিল।অনুনয় করেছিল।আমি তো শুনতেই চাইনি। উল্টো তাকে তাড়িয়ে দিয়েছি।
এখন মানহাকে কীভাবে বোঝ দিবো?মেয়েটা আমার নীলাকে ছাড়া মুখে কিছুই তুলবে না! কাঁদতে কাঁদতে শেষ হয়ে যাবে!
মানহা বোকার মতো তাকিয়ে থাকে।কথা বলে না।
আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ধরা গলায় বলি,’মা,একটু স্যুপ খেয়ে নেও কেমন? তারপর তোমাকে নিয়ে তোমার মাকে আনতে যাবো!’
মানহা বসে যাওয়া গলায় বললো,’মা কোথায়?’
আমি বললাম,’ওর বন্ধুর বাসায়। তুমি আগে খাও। তারপর তোমায় নিয়ে ওর কাছে যাবো।’
মানহা তখন বললো,’আমি মার কাছে গিয়ে খাবো। এখানে খাবো না। এক্ষুনি মার কাছে নিয়ে যাও বাবা। এক্ষুনি নিয়ে যাও।’
মানহার গলা ভেঙ্গে গেছে একটানা কাঁদার কারণে। এই ভাঙ্গা গলা নিয়েই সে আবার কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে।
কী ভয়াবহ বিপদেই পড়লাম আমি।এর থেকে উতড়াবো কী করে?আমি তো কোন পথ দেখছি না!
আচ্ছা তমালের সাথে তো আবার চলে যায়নি নীলা? ওদের তো সুইজারল্যান্ড চলে যাওয়ার কথা ছিল!
এবার আমি ঘরের কাগজ পত্র ঘাঁটতে থাকি। খুঁজে দেখতে থাকি কোথাও তমালের নম্বর আছে কি না!তমাল সম্পর্কে কোথাও কোন কিছু লিখা আছে কি না। কিন্তু কোন কিছুই খুঁজে পাওয়া গেল না। অবশেষে ব্যর্থ পরাজিত মানুষের মতো এসে বসলাম মানহার সামনে। আবার ওকে দরদ মাখা গলায় বললাম,’মা,খেয়ে নাও প্লিজ!না খেলে তো তুমি বাঁচবে না!অসুখ করে ফেলবে তোমার!’
মানহা তখন রাগের গলায় বললো,’আমার কাছে তুমি আর আসবে না। তোমাকে আর কখনো আমি বাবা বলে ডাকবো না।’
আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে চাই।ও তখন আমার হাত দূরে সরিয়ে দেয়।আমি সরাতে না চাইলে ও নিজেই এখান থেকে উঠে চলে যায় ও ঘরের দিকে।আর বলে,’আমার কাছে আসবে না তুমি। তুমি একদম ভালো না। তুমি খুব পঁচা! খুব পঁচা!’
মানহা রাগে থরথর করে কাঁপছে।
ছোট্ট একটা মেয়ের অত রাগ হতে পারে!
আমি ওকে বুঝাতে চাই।বলি,’মা, এমন করো না তুমি! তোমার মা আজ বিকেলেই এসে যাবে।’
মানহা আর কথা বলে না।ও ঘরে গিয়ে খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে করুণ গলায় কাঁদতে শুরু করে!
‘
ভুলটা কার তা আমি বুঝতে পারি না!
নীলাকে আগে দোষ দিতাম।ওকেই অপরাধী মনে করতাম। কিন্তু এখন আর ওকে দোষ দিতে পারছি না। এখন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। কেন নীলার কথটা শুনলাম না আমি।কী হতো একটিবার ওর কথাগুলো শুনলে!
তারপর তমালকে নিয়ে ভাবি।ভাবি নীলার মাকে নিয়ে।তমালের সাথে নীলার কী সম্পর্ক ছিল। ওদের কী বিয়ে হয়েছিল আগে?যদি বিয়ে হয়ে থাকে তবে তমালকে খুন করলো কেন নীলার বাবা? আবার নীলার মা আমার কাছে সবকিছু লুকোতে চাইছে কেন?
এইসব কথা জানতে না পারলে ঘোর কাটবে না কিছুতেই! কিন্তু এইসব কিছু জানতে হলে নীলাকে প্রয়োজন।নীলাই বলতে পারবে সবকিছু। হয়তোবা এই কথাগুলোই সে আমায় বলতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি শুনিনি।শুনতে চাইনি!
তমালকে পাওয়া গেলেও কাজ হতো। কিন্তু ওর বাসার ঠিকানা আমি জানি না। কোথায় গিয়ে ওকে খুঁজবো?বাইরেও বেরুতে পারছি না।মানহা কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় নেতিয়ে পড়ে আছে! ওর দিকে তাকালে বুকটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।বুক ছিঁড়ে কান্না আসে। উথাল পাতাল সেই কান্না!
এভাবে আর কতোক্ষণ?কতো টা সময়?মানহা নীলাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। কিছুতেই না।
আমি নীলাকে গিয়ে কোথায় খুঁজবো? কোথায় খুঁজে পাবো?
মা ছাড়া বাবা ছাড়া একটা সন্তানের বেড়ে উঠা কতটা কঠিন ,বেড়ে উঠার এই পথটা কতটা পঙ্কিলময়,কর্দমযুক্ত,কন্টকাকীর্ণ তা কে বুঝবে!
‘
#চলবে