#সে_ফিরে_আসবেই
#১ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘বাবা,জানো মার কাছে রোজ একটা আঙ্কেল আসে দেখা করতে।কালও এসেছিল।ওই আঙ্কেল খুব ভালো। একেবারে তোমার মতো।মার কপালে একটা পাপ্পাও দিয়েছে কাল।আর মাকে বলেছে কী জানো? তাকে নিয়ে সুইজারল্যান্ড চলে যাবে রোজার ঈদের পর! আমাকেও নাকি সাথে করে নিবে।আমি কিন্তু তোমাকে ছেড়ে ওদের সাথে যাবো না বাবা!’
কথাটা বলছিলো আমার তিন বছরের মেয়ে মানহা।শুনে আমার কান গরম হয়ে গেল।চোখ কেমন জ্বলতে শুরু করলো।সারা শরীর কেন জানি হঠাৎ করে থরথর করে কাঁপছে।কী বলছে এসব মানহা!
আমি দ্রুত হাঁটু গেড়ে বসে মানহার দু গালে দু হাতে নরম করে চেপে ধরি। তারপর বলি,’মানহা, তুমি মিথ্যে বলছো তাই না?’
মানহা তখন বড়দের মতো করে রাগ দেখিয়ে বলে,’আমি কখনো মিথ্যে বলি না। মিথ্যে বললে আল্লাহ জিভ কেটে ফেলবেন ধারালো কাঁচি দিয়ে।তুমিই তো শিখিয়েছো বাবা। তুমি বলো নি আল্লাহ মিথ্যেবাদীদের একদম পছন্দ করেন না?’
ছোট্ট একটা মেয়ের কথা শুনে আমার ভেতরটা হো হো করে কেঁদে উঠে। তবে আমার কন্যা মানহা ভুল কিছু বলছে না।সব সত্যি। আমার স্ত্রী নীলা আমায় ঠকাচ্ছে!অথচ আমি এর কিছুই জানি না!
আমি মানহাকে বুকের কাছে টেনে নেই। তারপর বলি,’মানহা,ওই আঙ্কেলটা কখন আসে মা?’
মানহা তখন বলে,’তুমি তখন অফিসে থাকো।আসরের আজানের পর।’
আমি মানহাকে কাছে টেনে আদর করি। তারপর বলি,’আমার কাছে যে এসব বলেছো তা কিন্তু মাকে বলো না আবার। তোমার মা তো রাগী মেয়ে।সে এসব শুনলে রেগে গিয়ে তোমায় আর আমায় দুজনকেই মারবে।’
মানহা তখন আমার কানের কাছে ঠোঁট এনে ফিসফিস করে বললো,’মা এখন ঘুমে। আমিও গিয়ে মার পাশে ঘুমিয়ে পড়ি বাবা। তবে আর মা কিছুই বুঝবে না!’
একটা ছোট্ট মেয়ে আমার। মাত্র তিন বছর বয়স তার।এই অতটুকু মেয়ে অতকিছু বুঝে কীভাবে!কী সূক্ষ্ম জ্ঞান তার! এমন একটা লক্ষ্মী মেয়েকে রেখে কীভাবে নীলা এসব করে!কার সাথে করে? আমার ভীষণ খারাপ লাগে। কান্না আসতে চায় বুকের পাঁজর ইঁছড়ে।আমি তবুও কান্নাকে প্রশ্রয় দেই না। পুরুষ মানুষের যে প্রকাশ্যে কখনো কাঁদতে নেই!
এখন সকাল ছ’টা বাজে।নীলা শরীর খারাপের অজুহাতে ঘুম থেকে উঠেনি। হয়তোবা তার শরীর সত্যি সত্যি খারাপ।অথবা সে বাহানা করছে।সে যায়হোক।আজ আমি অফিস যাবো ঠিক কিন্তু আসরের আজানের ঠিক আগে আগে ফিরে আসবো।আর ততোক্ষণ বাসার কাছে মোড়ের চায়ের স্টলে বসে অপেক্ষা করবো ওই লোকটার জন্য।দেখবো কে এসে দেখা করে যায় নীলার সাথে!
নীলার সাথে আমার বিয়ের ছ’বছর হয়েছে।এই ছ’বছরের কোনদিন তার কাছ থেকে এমন কোন আচরণ আমি পাইনি যেখানে তাকে সন্দেহ করা যায়। কিন্তু গত এক সপ্তাহ যাবৎ ও জানি কেমন হয়ে গেছে। সেদিন রাতে হঠাৎ তার কাছে যেতে চাইতেই ও আমায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো।এর আগে কখনো এমন হয়নি। পরদিন সকাল বেলা অফিস যাওয়ার আগে ওকে বললাম,’নীলা তোমার কী হয়েছে বলো তো? গতরাতে এমন করলে কেন?’
এই একটা সামান্য কথায় তার সে কি রাগ! একেবারে হো হো করে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,’আমি চলে গেলেই ভালো হবে তোমার।এখান থেকে চলে যাবো আমি।থাকবো না তোমার সাথে!’
কী অদ্ভুত ধরনের আচরণ।সত্যি বলতে আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। শুধু চিন্তা করছিলাম। ভাবছিলাম কেন এমন করছে সে!আজ সকালে মানহা যখন আমার সাথে ঘুম থেকে উঠে গেল তখন মানহা নিজেই বললো,’বাবা চলো আমরা ছাদে যাই। সকাল দেখবো।’
আমি তখন নীলাকেও ডাকলাম। বললাম,’নীলা চলো ছাদে গিয়ে সকাল হওয়া দেখি!’
নীলা তখন ঘুম জড়ানো গলায় বললো,’আমার শরীর খারাপ লাগছে। তুমি যাও তো মানহাকে নিয়ে।ডিস্টার্ব করো না প্লিজ!’
আমি আর কথা বাড়ালাম না তখন।মানহাকে কোলে করে নিয়ে সোজা ছাদের উপর উঠে গেলাম। তারপর গিয়ে দাঁড়ালাম নীলার গোলাপ বাগানের কাছে।মানহা ওখানে দাঁড়িয়েই এসব বললো আমার কাছে।
‘
অফিসে যেতে হয় সকাল নটায়।নীলা আজ উঠবে বলে মনে হয় না। রান্নার কাজ আমাকেই করতে হবে।ভাগ্যিস ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় মেসে ছিলাম দু’বছর। তখন মাঝেমধ্যে বুয়া আসতো না।মাসের চার পাঁচদিন আমরা বন্ধুরা মিলেই রান্না করতাম। প্রথমে ডিম বাজি আর আলু ভর্তা করাটা শিখেছিলাম। তারপর আস্তে আস্তে সবকিছু শিখে ফেলেছি।ইন্টারমিডিয়েট জীবন শেষ হয়েছে বহু বহু বছর আগে।প্রায় বারো বছর। এরপর আর রান্নার ধারে কাছেও যাইনি।যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু আজ যেতে হচ্ছে।আমি না হয় কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে ফেলতে পারবো কিন্তু মানহার তো খেতে হবে।ওর জন্য স্যুপ করতে হবে।নীলাও তো ঘুম থেকে উঠে খেতে চাইবে ।
‘
রান্নাবান্না শেষ করে মানহাকে স্যুপ খাইয়ে দিলাম। নীলা তখনও বিছানা থেকে নামেনি। ঘুমাচ্ছে। অনেক অনেক দিন পর এই বাসায় একা একাই খেতে হলো আমার। খাওয়া শেষ করে জামা-প্যান্ট পরে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হলাম। কিন্তু বাসার গেট পেরিয়েই সিদ্ধান্ত নিলাম আজ অফিসে যাবো না।এই দুপুরের কাঠফাঁটা রোদে এলোমেলো ভাবে ঘুরবো।ঘুরতে ঘুরতে যখন প্রচন্ড তেষ্টা পেয়ে যাবে তখন যাবো একটা রেস্টুরেন্টে।বলবো এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিতে। সেই ঠান্ডা পানি আমি মুখের কাছে নিবো। কিন্তু পান করবো না! নিজেকে নিজেই কষ্ট দিবো।এটাই আজ আমার জন্য একটা গেইম।এই গেইমে আমাকে জিততে হবে।জিততেই হবে।কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমায় অর্জন করতে হবে।করতে হবেই!
‘
গেইমে হেরে গিয়েছি আমি।তেষ্টায় মনে হয়েছিল মরে যাবো আমি।আর ওয়েটার এনে দিয়েছিল তখন বরফের কুচি দেয়া ঠান্ডা পানি।পানি দেখে সব ভুলে গিয়েছিলাম আমি।ঢকঢক করে গ্লাসের পর গ্লাস পানি খেয়ে ফেললাম!
‘
আসরের আজানের সময় ঘনিয়ে এসেছে।আমি এবার গিয়ে চুপচাপ বসে পড়লাম মোড়ের মতি মিয়ার চায়ের স্টলে। ওখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় আমাদের বাসার সামনের গেট।গেট দিয়ে কেউ ভেতরে ঢুকলেই স্পষ্ট দেখা যাবে।আর তখনই আমি পেছন পেছন যাবো। গিয়ে যদি ওদেরকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখি তবে আমি কিছুই বলবো না। একটা টু শব্দ পর্যন্ত করবো না। ওই লোকটাকে সুন্দর মতো বলবো চলে যেতে। তারপর নীলার সাথে কথা বলবো আমি। নীলাকে শুধু একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো,কেন ঠকালে আমাদের?কী দোষ ছিল আমার তিন বছরের মেয়ে মানহা আর আমার?
‘
আসরের আজান হয়ে গেছে। আমার শরীর কেমন কাঁপছে। ঘটনা এক্ষুনি ঘটবে বলে মনে হচ্ছে।
হ্যা তাই হলো। আজানের ঠিক পাঁচ মিনিট পর একটা ফর্সা পাতলা দেহী ছেলে যার পরনে মেরুন রঙা পাঞ্জাবি,সাদা পাজামা সে ঢুকলো গেট দিয়ে ভেতরে।আর তার ঠিক পাঁচ মিনিট পর আমি ঢুকলাম।ওরা ভেতর থেকে দরজা আটকে দিয়েছে।আমি দরজার কাছে কান পাতলাম।
নীলার কন্ঠ শুনতে পাচ্ছি।নীলা বলছে,’তমাল,কেন ফিরে এলে তুমি বলো?কেন আমার ছ’বছরের সুন্দর একটা সংসার এলোমেলো করে দিলে? জবাব দাও?’
তমাল কাঁপা কাঁপা গলায় বলছে,’আমি কিচ্ছু জানি না নীল।আমি শুধু এটা জানি যে তুমি আর কারোর নয়। শুধু আমার।শুধুই আমার। তুমি ওকে ডিভোর্স দিবে।ফাহাদের সাথে আর থাকবে না বুঝলে?’
নীলা বললো,’কীভাবে এটা করবো বলো? ফাহাদ আমায় ছাড়া থাকতে পারবে না!’
তমাল রাগের গলায় বললো,’তার মানে তুমি এখন আমায় আর ভালো বাসো না?ফাহাদকে ভালোবেসে ফেলেছো?’
নীলা কেঁদে ফেললো।সে কাঁদতে কাঁদতে বললো,’তমাল,আমি বুঝতে পারছি না কিছু। কিন্তু ওকে আমি ডিভোর্স দিতে পারবো না!’
তমাল বললো,’তবে আমি মরবো।সোইসাইড করবো আজ রাতেই।’
নীলা আরো জোরে জোরে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বলছে,’না। এমন করবে না তুমি।তমাল তুমি আমায় আরো তিনটা মাস সময় দাও।আমি একটু ভেবে দেখি!’
একটু চুমু খাওয়ার শব্দ হলো। হয়তোবা তমাল নীলাকে অথবা নীলা তমালকে চুমু খেয়েছে। তারপর তমাল বললো,’আমি তোমায় সময় দিচ্ছি। কিন্তু জবাব যেন একটাই হয়। তুমি শুধু আমার।ফাহাদের না।মাইন্ড ইট আমার স্যুইটি নীল!’
তারপর, তারপর ওখানে আর আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। শরীর থরথর করে কাঁপছিলো।রাগ উঠে যাচ্ছিল খুব। হয়তোবা ওখানে থাকলে নিজেকে সংবরণ করতে পারতাম না। খারাপ কিছু করে বসতাম রাগের বশে।তাই খারাপ কিছু যেন না ঘটে সেইজন্য খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলে আসি আমি মতি মিয়ার চায়ের স্টলে। এসে বেঞ্চির উপর পা ঝুলিয়ে বসে একটা সিগারেট কিনে নেই।দেয়াশলাই দিয়ে সেই সিগারেট জ্বালাই। তারপর পাগলের মতো টানতে থাকি। কোনদিন সিগারেট খাইনি আমি।এই প্রথম। জীবনের প্রথমবার। আমার হঠাৎ কী হয়ে গেল?আমি এমন পাগলামি করছি কেন?
‘
#চলবে