#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৩৫
“তাকে অল্প কাছে ডাকছি
আর আগলে আগলে রাখছি
তবু অল্পেই হারাচ্ছি আবার
তাকে ছোঁবো ছোঁবো ভাবছি
আর ছুঁয়েই পালাচ্ছি
ফের তাকে ছুঁতে যাচ্ছি আবার..
অভিমান পিছু নাম
তাকে পিছু ফেরাও
তার কানে না যায় পিছু ডাক আমার
মুখ বুজেই তাকে ডাকছি আবার
তাকে অল্প কাছে ডাকছি
আর আগলে আগলে রাখছি
তবু অল্পেই হারাচ্ছি আবার”
রাতে এমন মধুর কন্ঠের গান কানে আসায় ফারনাজ নিজেকে ঘরে রাখতে পারল না। দরজা খুলে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল গানের উৎসের নিকট। গানের সুর ধরে সে বাগানে এসে থামে। এতো রাতে কে গান গায়ছে? তূরাগ নিশ্চয়? সে তার কন্ঠ খুব ভালো ভাবে চেনে। জেনে শুনেও ফারনাজ এগোয়। এতো রাতে বাগানে বসে চর্চা করছে কেন লোকটা? এটা কি কোনো গান গাওয়ার সময় হলো? সে খুব সতর্ক হয়ে পা ফ্যালে। মৃদু আলো আছে এদিকে। সে তাকে দেখতে পেল। ওই তো তার দিকে পিঠ রেখে একটা টুলে বসে গায়ছে। ফারনাজ শব্দ বিহীন দূরত্ব রেখে দাঁড়ায়। মনোযোগ দিয়ে গানের শেষের অংশ শোনে।
“ফাঁকা বুক, চেনা সুখ
জানি ঘুম সে ভাঙাবেই (২)
ভেজা মন, বলি শোন
রাতভোর জাগতে নেই
মুখচোরা ডাক তাকে
ঘুম পাড়াক এবার..
তাকে ছুঁয়ে স্বপ্ন বুনছি আবার”
হঠাৎই গান থেমে যায়। কানে কোনো আওয়াজ না আসায় ফারনাজ ফট করে চোখ মেলে তাকায়। মুখোমুখি তূরাগকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভড়কায়। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়। তূরাগ রাশভারী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“এতো রাতে এখানে কি?”
সে মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়ে। কি জবাব দেবে ভেবে পায় না। গান শুনতে এসেছে জানলে তূরাগের ভাব নিশ্চয় অনেক বেড়ে যাবে? সে একথা একদমই স্বীকার করবে না। সে আকাশ থেকে পড়ার ভান করে বলে,
“আপনি এখানে! কখন এলেন?”
সে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মুখশ্রীতে বিরক্ত ভাব উপচে পড়ে। বলে,
“আমার বাড়ি আমি যেখানে খুশি যখন খুশি থাকতে পারি। তুমি এখানে কেন তাই জিজ্ঞেস করছি আমি।”
“কেন আমি থাকতে পারি না?”
“না, পারো না। এটা তোমার বাড়ি নয়।”
মুখের উপর এভাবে বলে দেওয়ায় কোমল হৃদয়ের ফারনাজ কষ্ট পেল। তবুও দমে না গিয়ে বলল,
“আমার ঘুম আসছিল না, তাই দেখতে চলে এলাম রাত বিরেতে এভাবে চেঁচায় কে?”
তূরাগ কটমটিয়ে চেয়ে বলল,
“কি বললে তুমি! আমি চেঁচায়? গান বলে এটাকে মাথা মোটা।”
সে অবাক হবার ভান করে বলে,
“আপনি না বললে তো জানতামই না যে এটাকে গান বলে!”
তূরাগ পূর্বের জায়গায় গিয়ে বসে। গিটার হাতে নিয়ে বলে,
“তোমার সাথে ঝগড়া করার মুড নেই আমার। বিদেয় হও।”
ফারনাজ মুখ বাঁকিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দু হাত বুকে গুজে বলে,
“আমি তো চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম, কোনো শব্দ করিনি। আপনি বুঝলেন কি করে যে আমি এসেছি? ঐ দিনও আপনি জবাব দেননি। আজ আমি জবাব না নিয়ে কোথাও যাব না। হুহ!”
সে শান্ত দৃষ্টি তাকায়। টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। এক পা এক পা করে এগোতে এগোতে বলে,
“তোমার ভয় করে না?”
ফারনাজ চোখ বড় বড় করে তাকায়। দু পা পিছিয়ে বলে,
“কেন ভয় করবে কেন?আআর আপনি এএভাবে এগোচ্ছেন কেন?”
তূরাগ এগোতে থাকে। অতিরিক্ত শীতল কণ্ঠে বলতে থাকে,
“এখন গভীর রাত। আশে পাশে কেউ নেই। একদম শূন্য। বাগানে ঝোপঝাড়ের মধ্যে একজন ছেলে একজন মেয়ে। তুমি আর আমি। আমি ছেলে তুমি মেয়ে। এখন যদি..”
ফারনাজ কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
“এএএখন যযদি?”
“এখন যদি আমি তোমাকে কিছু করি? ভয় করছে না?”
ফারনাজ পাশ কাটিয়ে পালিয়ে যেতে নিলেই হোঁচট খায়। উপুড় হয়ে যাচ্ছিল পড়েই। তৎক্ষণাৎ তূরাগের শক্ত পোক্ত বলিষ্ঠ হাত এসে পেট জড়িয়ে আটকে দিল। ফারনাজের শ্বাস যেন থেমে গেল। প্রথম পুরুষালী গভীর স্পর্শে যেন দম বন্ধ হয়ে এলো। সে তাকে হেঁচকা টানে সোজা করে দাঁড়িয়ে দিতে চায়। ফারনাজ টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে তার বুকে। এবার হৃদস্পন্দন থেমে গেল তার। চোখের চশমা তো আগেই পড়ে গিয়েছে। চোখেও অন্ধকার দেখছে সে। কিন্তু মাথা রাখা শক্ত জায়গায় হৃদস্পন্দনের তীব্র গতি শুনতে পাচ্ছে সে। অস্বাভাবিক হারে চলছে তা। থমকানো মুহূর্ত পার হয়। তূরাগ দুরত্ব বাড়িয়ে দাঁড়ায়। ঝুঁকে তার চশমা তুলে হাতে দিয়ে বলে,
“যাও, রুমে যাও।”
ফারনাজ অপেক্ষা করে না এক মুহূর্তও। চশমা চোখে দিয়ে দৌড়ে চলে যায়। রুমে এসে দরজা আটকে লম্বা লম্বা শ্বাস নেয়। হৃদস্পন্দন এখন অস্বাভাবিক। হুট করেই হেসে ফেলল। আজ এক রহস্য সমাধানের সূত্র পেয়েছে সে। নব্বই শতাংশ সমাধান করা শেষ, শুধু দশ শতাংশ সমাধান হবার অপেক্ষা।
—
কলেজে আজ প্রায় অনেক দিন পর দৃষ্টি মৃন্ময়ের সাক্ষাৎ পেল। ভীষণ এলোমেলো লাগছে তাকে, উসকোখুসকো চুল। দৃষ্টি তাকে দেখে অপরাধবোধে মাথা নামিয়ে নিল। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে মৃন্ময় তাকে ডাকে,
“দৃষ্টি, কেমন আছ?”
দৃষ্টি থামে। মাথা নিচু রেখেই বলে,
“ভালো আছি, স্যার। আপনি কেমন আছেন? এতো দিন কোথায় ছিলেন আপনি?”
মৃন্ময় মৃদু হেসে বলে,
“আমি যে ছিলাম না সেটা খেয়াল করেছ তুমি! আমি ধন্য হলাম। আজ কি আমার সাথে একটু বসা যায়? এক কাপ কফি? চিন্তা নেই, প্রেম বা বিয়ের প্রস্তাব দেব না। ডক্টর ইততেয়াজকে ভয় পাবার দরকার নেই।”
সে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে মৃন্ময়ের সাথে যায়। ক্যান্টিনে মৃন্ময় দু কাপ কফি অর্ডার করে বসে। বলে,
“সেদিন মা অনেক আবোল তাবোল কথা বলেছিল। আমি তার হয়ে স্যরি বলছি।”
দৃষ্টি চমকে উঠে বলে,
“না স্যার, তার কোনো দরকার নেই। ওনারা যে অপমানিত হয়েছেন, ওইটুকু কথা কিছুই না।”
মৃন্ময় একটু নীরব থেকে হুট করে জিজ্ঞেস করে,
“তুমি কি সত্যিই ভালো আছ, দৃষ্টি?”
দৃষ্টি বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায়। বলে,
“হ্যাঁ স্যার, আমি ভালো থাকব না কেন?”
সে শান্ত চোখে চেয়ে বলে,
“আমি শুনেছি, ডক্টর ইততেয়াজ তোমাকে জোর করে বিয়ে করেছে। তুমি রাজি ছিলে না। তাহলে মতের বিরুদ্ধে করা বিয়েতে কি তুমি ভালো আছ?”
দৃষ্টি হঠাৎ হেসে ফ্যালে। মুচকি হেসে বলে,
“আমি আমার বাবার জন্য বিয়েতে রাজি হচ্ছিলাম না, স্যার। আমি চাইছিলাম বাবার অনুমতি নিয়েই বিয়েটা হোক। কিন্তু উনি শুনলেন না।”
“তার মানে তুমি!”
“জি, আমার কোনো আপত্তি ছিল না। শুধু বাবার বিষয়টা ছাড়া।”
বলতে বলতে সে সদ্য রেখে যাওয়া কফিতে চুমুক দেয়। মৃন্ময় চেয়ে রয়। দৃষ্টি ফিসফিসিয়ে বলে,
“আমি যে তাকে ভালোবাসি, স্যার। কিন্তু তার সামনে আমি কখনো সেটা প্রকাশ করব না।”
মৃন্ময়ের কান পর্যন্ত তা যায় না। দৃষ্টি কফি শেষ করে বলে,
“আজ তাহলে উঠি, স্যার? আর হ্যাঁ! খুব শীঘ্রই আপনার বিয়ের দাওয়াত চাই কিন্তু।”
সে হাসে। বলে,
“অবশ্যই। সবার আগে তোমার কাছে দাওয়াত পৌঁছে যাবে।”
—
আজ বাড়ি ফিরতেই ছেলের বউয়ের সামনে পড়লেন আমিনুল ইততেয়াজ। ইতস্তত করে তাকে এড়িয়ে চলে যেতে চায়লে সে বলল,
“ফ্রেশ হয়ে খেতে আসুন।”
তিনি থেমে গিয়ে বললেন,
“তুমি কেন? সাইমা কোথায়?”
“খালামনি একটু অসুস্থ। ঘুমিয়ে পড়েছেন। ডাকবেন না যেন।”
আমিনুল ইততেয়াজ, তিয়াস ইততেয়াজ চলে গেলেন রুমে। ফ্রেশ হয়ে ফিরে এলেন। দৃষ্টি তাদের সামনে দু গ্লাস লেবুর শরবত এগিয়ে দিল। ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই বলল,
“খেয়ে নিন। ক্লান্তি গায়েব হয়ে যাবে।”
তারা তা নিয়ে ঢকঢক করে শেষ করে গ্লাস ফেরত দিল। সত্যিই এখন ভালো অনুভব হচ্ছে। দৃষ্টি গ্লাস নিয়ে যেতে যেতে বলল,
“একটু অপেক্ষা করুন, আমি টেবিলে খাবার সাজাচ্ছি।”
সে অভিজ্ঞ হাতে টেবিল সাজায়। নিজের হাতে পরিবেশন করে তাদের। তিয়াস ইততেয়াজ রুটি মাংসের ঝোলে চুবিয়ে খেয়ে বললেন,
“আহা! সেই একই স্বাদ। তুমি রান্না করেছ নিশ্চয়?”
দৃষ্টি মৃদু হেসে সম্মতি দেয়। আমিনুল ইততেয়াজ গম্ভীর মুখে খেতে থাকেন। তারও যে ভালো লেগেছে তা প্রকাশ করলেন না। তিনি চান না এই মেয়ে হাওয়ায় উড়ুক। খাওয়া শেষে দুজনকে পায়েস দিল। আমিনুল ইততেয়াজকে বললেন,
“এটা থ্যাঙ্ক ইউ ট্রিট।”
তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“কীসের জন্য?”
“ওই যে আমার জন্য দোলনা এনে দিয়েছেন, সেজন্য। থ্যাঙ্ক ইউ।”
আমিনুল ইততেয়াজের পায়েসটাও দারুণ লাগল। কিন্তু তিনি স্বীকার করতে নারাজ। মনে মনে বললেন, ‘ঢং!’
তিয়াস ইততেয়াজ তো প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। এমন মজাদার খাবার তিনি জীবনেও খাননি। আমিনুল ইততেয়াজ চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে গেলেন। যাবার সময় তিয়াস ইততেয়াজ বললেন,
“ভাই, এতো ভালো খাবার আর তুমি কিছু বললে না কেন?”
তিনি ভাইয়ের দিকে চেয়ে বললেন,
“অতো বলার দরকার নেই। শেষে দ্যাখা যাবে আমার মাথায় উঠে নাচবে।”
কথাটা তিয়াস ইততেয়াজের খারাপ লাগল। মেয়েটা তো খারাপ নয়। দেখতে কালোও নয়, উজ্জ্বল শ্যামলা। ভীষণ মিষ্টি মেয়ে। আর সর্ব গুণে পূর্ণ। এতো সুন্দর ব্যবহার, শান্ত শিষ্ট! তার ভাই মেয়েটার সাথে এমন করে শুধু বিজনেস পার্টনারের মেয়েটার জন্য। তবে মানতেই হবে আফরান খাঁটি রত্ন চিনেছে।
চলবে,
#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৩৬
নিশুতি রাত। ঘোর নীরবতা চারিদিকে। গভীর ঘুমে মগ্ন ফারনাজ। ক্ষণে ক্ষণে ফেলছে ভারী শ্বাস। ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে প্রবেশ করল একটি পুরুষালি অবয়ব। বিছানায় ঘুমন্ত রমনীর দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে বিড়বিড় করে,
“দরজাটা খোলা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে, বোকা মেয়ে!”
মৃদু হেসে সে দরজা চাপিয়ে এগোয়। আলতো করে পা ফেলে এগিয়ে সে তার শিয়রের নিকট বসে। মুগ্ধ চোখে চেয়েই রয়। সে দৃষ্টির কোনো পরিবর্তন হয় না। আনমনে বলে,
“এতো পাগল আমাকে কীভাবে বানিয়ে দিলে, মেয়ে? এর শাস্তি খুব শীঘ্রই পাবে তুমি। কঠিন শাস্তি পাবে।”
হাত বাড়িয়ে তার নাক ছুঁয়ে দেয়। নড়েচড়ে ওঠে সে। নাক কুঁচকে পাশে থাকা তুলতুলে বালিশ জড়িয়ে পুনরায় ঘুমিয়ে যায়। প্রশস্ত হাসে অবয়বটি। এলোমেলো চুলে আঙুল চালিয়ে আওড়ায়,
“খুব শীঘ্রই আমার খাঁচায় বন্দী হবে তুমি।”
পরপরই দ্রুত পা ফেলে প্রস্থান করে। বেশিক্ষণ থাকলে হয়তো উল্টো পাল্টা কিছু করে ফেলতে পারে।
—
কোলাহল পূর্ণ শহর। ফারনাজ আজ বেরিয়েছে। প্রায় একটা মাস হতে চলল সে খালামনির বাড়িতে আছে। বোর হয়ে গিয়েছে সে বাড়ির মধ্যে বসে থাকতে থাকতে। তাছাড়া তার বের হবার আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে। সেটা খুবই গোপন। এই কারণটা সে খালামনিকে বলেনি, শুধু বাইরে ঘুরতে আসার নাম করে বেরিয়েছে। যদিও তিনি রাজি হচ্ছিলেন না। সে বহু কষ্টে তাকে রাজি করিয়ে এসেছে। রেস্টুরেন্টের মধ্যে প্রবেশ করে সে শ্বাস ছাড়ে। এক কোণে সামান্য পরিচিত ব্যক্তি কে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে যায়। মৃদু হেসে বলে,
“হ্যালো রিমান? আমি ফারনাজ।”
রিমান ফারনাজের দিকে চেয়ে খেই হারিয়ে ফেলে। ফোনের ছবির থেকেও দেখতে অত্যাধিক সুন্দর লাগছে তাকে। যেন জলজ্যান্ত পুতুল! ফারনাজ তাকে চেয়ে থাকতে দেখে আবার বলে,
“আমি কি বসতে পারি?”
রিমান ভাবনাচ্যুত হয়। চওড়া হেসে বলে,
“ইয়াহ, শিয়র। প্লিজ সিট।”
ফারনাজ চেয়ার টেনে বসে। এই ছেলেটার সাথে তার ফেসবুকে পরিচয় হয়েছে। ছেলেটার আগ্রহ দেখে ফারনাজ এগিয়েছে। তাই আজ দ্যাখা করতে এসেছে। যদিও ফারনাজ একদমই সিরিয়াস নয়। এখন দ্যাখা যাক বিষয়টা কতদূর এগোয়। দু কাপ কফি অর্ডার করে তারা টুক টাক কথা বার্তা শুরু করে। কথা বলতে বলতে এক সময় রিমান বলে,
“উইল ইউ ম্যারি মি, ফারনাজ?”
ফারনাজ হা করে তাকায়। আজই প্রথম দ্যাখা আর আজই সরাসরি বিয়ের প্রপোজ! বিস্ময় গিলে জিজ্ঞেস করে,
“কি!”
“তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে? আমার তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। তোমার কথা বার্তা চাল চলন সব কিছু।”
নিজের স্থানে দৃঢ় রিমান। ফারনাজ বিপদে পড়ল। সে তো শুধু টাইম পাসের জন্য এসেছিল। এরই মধ্যে বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে যাবে কে জানত? সে জোর পূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে,
“না মানে হঠাৎ..”
তার কথা তার মুখেই থেকে গেল বের হলো না আর। তৎক্ষণাৎ একটা শক্ত বলিষ্ঠ হাত তাকে টেনে তুলে সজোরে থা’প্পড় দিল। থা’প্পড়ের ভারে সে কিঞ্চিত হেলে পড়ল। গালে হাত ঠেকিয়ে সামনে তাকাতেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। তার সামনে দাঁড়িয়ে তূরাগ ফোঁস ফোঁস করছে। তার রাগান্বিত র’ক্তিম মুখশ্রী দেখে ফারনাজ গুটিয়ে গেল। এই লোক এখানে কেন? তাকে মারলই বা কেন? আর এতো রেগে আছে কেন? মাথা ভনভন করে ঘুরছে তার। গালটা প্রচুর জ্বলছে। মনে হচ্ছে কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে ওখানে। রিমান চমকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“কে আপনি? ও’কে মা’রলেন কেন?”
তূরাগ চোয়াল শক্ত করে তাকায়। রাগে তার মাথা দপদপ করছে। আশে পাশের মানুষ তাকে দেখে এগোতে যেয়েও পারে না। রেগে থাকতে দেখে আর সাহস হয় না। সে তাকে কোনো জবাব না দিয়ে পুনরায় গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছলছল চোখের মেয়েটার দিকে তাকায়। রিমান আবার জিজ্ঞেস করে,
“ফারনাজ, কে উনি? তোমার ভাই?”
ফারনাজ মাথা উপর নিচ দোলায়। হ্যাঁ, তার ভাই। আফরান ভাইয়ের ভাই মানে তারও ভাই। তাই না? যদিও এখনো কোনোদিন ভাই ডাকার সুযোগ পায়নি তেমন, একবার ছাড়া। এই মাথা দোলানো যে তার কাল হয়ে দাঁড়াবে এটা সে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। তূরাগ আরও ভয়ঙ্কর ভাবে তাকায়। বলে,
“আমি তোর ভাই? আমি তোর ভাই হই?”
ফারনাজের চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার উপক্রম। তার এবার কলিজার পানি শুকিয়ে গেল। সে কি ভুল বলে ফেলেছে? তূরাগ ভাই নয়তো কি? সে কাঁপতে কাঁপতে বলে,
“আআপনি ভাই না? ততাহলে কি?”
তূরাগ ক্ষিপ্র গতিতে তার হাত চেপে ধরে বলে,
“চল বোঝাই আমি তোর কি হই, কে হই? চল।”
সে তাকে টেনে হিচড়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়। পেছনে রিমান চেঁচামেচি করেও বিশেষ কিছু করতে পারে না, দেখে যাওয়া ছাড়া। তূরাগ তাকে গাড়ির মধ্যে ছুঁড়ে ফ্যালে। ড্রাইভিং সিটে বসে শা করে গাড়ি টানে। ফারনাজ গুটিসুটি মে’রে বসে গুনগুন করে কাঁদছে। এতো জোরে চ’ড় সে কোনোদিন খায়নি। তূরাগ ফোন লাগায় কোথাও। তাকে গুনগুনিয়ে কাঁদতে দেখে দেয় এক ধমক,
“চুপ, একদম চুপপ।”
ফারনাজ ভয়ে গুটিয়ে মুখে হাত চেপে ফোঁপায়। তূরাগ ফোনে গুরুত্বপূর্ণ কথা সেরে নিল। গাড়ি বাড়ির সামনে থামিয়ে তাকে পুনরায় টানতে টানতে নিয়ে গেল। কলিং বেল বাজাতেই কাজের মেয়েটা দরজা খুলে দেয়। সে তাকে টেনে ড্রয়িং রুমের সোফায় ছুড়ে মা’রে। কাজের মেয়েটা ভড়কে গিয়ে সবাইকে ডেকে জড়ো করে। সবাই বলতে মিসেস সাইমা, মিসেস অনা এবং দৃষ্টি। দৃষ্টি বোনকে এভাবে মুখ চেপে কাঁদতে দেখে ছুটে যায়। জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে, আপু? কাঁদছিস কেন?”
সে কান্নার তোপে কথা বলতে পারে না। দৃষ্টি বোনের ফর্সা গালে চার আঙুলের ছাপ দেখে থমকায়। তার বোনের গায়ে কে হাত তুলল? তূরাগ এক কোণে দাঁড়িয়ে লম্বা লম্বা শ্বাস নেয়। মা’কে বলে,
“এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দাও, মা।”
মিসেস অনা দ্রুত গিয়ে নিয়ে আসেন। ছেলের লাল হওয়া মুখ দেখে বুঝে নিলেন ছেলে কোনো কারণে রেগেছে। তূরাগ এক নিঃশ্বাসে পানি শেষ করে মায়ের হাতে গ্লাস দেয়। পুনরায় শ্বাস টেনে নিয়ে বলে,
“মা, আমি ফারনাজ কে বিয়ে করতে চাই। এক্ষুনি এবং এই মুহূর্তে।”
প্রচণ্ড ধাক্কা খেল সকলে। ফারনাজের কান্না থেমে গেল। সে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। মিসেস অনা নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
“কি বললি?”
“হ্যাঁ, আমি ও’কে বিয়ে করব আজই। আর কিছুই জানি না আমি। কাজী আসছে। ওর পরিবার কে জানালে জানাও। প্রস্তাব দাও, রাজি না হলেও আমার কিছু করার নেই।”
মিসেস অনা শান্ত কন্ঠে বললেন,
“তুই কি নাজ কে পছন্দ করিস? আমরা নাহয় আস্তে ধীরে এগোয়। এতো তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই।”
“আমি ও’কে পছন্দ নয় ভালোবাসি, মা। আমার ও’কে চাই, সারাজীবনের জন্য। আজই আমি ও’কে সম্পূর্ণ হালাল রূপে চাই।”
আর নির্লিপ্ত গম্ভীর কন্ঠস্বরে সকলে চিন্তায় পড়লেন। ফারনাজ জমে গেল। যে লোকটা তাকে একটু আগেও মা’রল সেই লোক তাকে ভালোবাসে? এটা কি বিশ্বাস করা সম্ভব? ফারনাজ হু হু করে কাঁদে,
“আমি বিয়ে করব না। এই লোক আমাকে বকে, আমাকে দেখতে পারে না। খারাপ ব্যবহার করে। আজ তো মে’রেওছে। বিয়ে করে নিলে তো রোজ রোজ মা’রবে।”
তূরাগ কড়া দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। চাপা ধমক দিয়ে বলে,
“তোমার কাছে শুনতে চায়নি কেউ। চুপচাপ বসে থাকো।”
মিসেস অনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন,
“তুই মেয়েটাকে মে’রেছিস কেন, বাবা?”
তূরাগ এক পলক ফারনাজের মুখ দেখে নিয়ে রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে,
“অন্য ছেলের সাথে রেস্টুরেন্টে বসে কফি খাবে, হাসবে, গল্প করবে। আবার সেই ছেলে ও’কে বিয়ের প্রস্তাব দেবে! আমার ভীষণ রাগ উঠে গিয়েছিল, মা এবং আমি এখনো রেগে আছি। তোমরা যদি আমার কথা না শোনো তাহলে আমি কি করে ফেলব জানি না।”
মিসেস অনা ভীষণ চিন্তায় পড়লেন। ছেলের যা চায় তা না দিলে ছেলে ভীষণ ক্ষেপে যাবে। হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধাবে। তিনি ইশারায় মিসেস সাইমা কে ডেকে একটু দূরে নিয়ে গেলেন,
“আপা, এখন কি করব তুমি বলো? তুমি তো ও’কে চেনো খুব ভালো করে।”
“তুই চিন্তা করিস না। আমি সীমাকে সব জানাই আগে। তারপর দেখি কি হয়।”
তিনি ফারনাজের দিকে তাকালেন। সে দৃষ্টির বুকে মুখ গুজে এক নাগাড়ে বলেই যাচ্ছে,
“আমার থেকে পাঁচ বছরের বড় একটা লোককে আমি বিয়ে করতে পারব না। এতো অনেক ডিফরেন্স। না না কিছুতেই না। আমার বর হবে আমার থেকে এক বছরের বড়ো।”
দৃষ্টি ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তার মুখ খোলার আগে মিসেস সাইমা এগিয়ে এসে বলেন,
“তূরাগ তোর থেকে পাঁচ বছরের বড়ো বলে তোর এতো আপত্তি! আর আফরান যে দৃষের থেকে নয় বছরের বড়ো তার বেলা?”
বলতে বলতে তিনি ঠোঁট চেপে হেসে ফেললেন। ফারনাজ চোখ তুলে দৃষ্টিকে দ্যাখে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“তোর যখন এতো ডিফরেন্সে আপত্তি তাহলে আমাকে আটকালি না কেন? একটা বারও আমার বিয়ে নিয়ে আপত্তি করলি না! আমার সাথে তো নাচতে নাচতে চলে এলি।”
ফারনাজ ঠোঁট উল্টে বলে,
“আফরান ভাই তো পরিচিত, তোকে খুব ভালো রাখবে। তাছাড়া বিয়েটা তো হয়েই গিয়েছিল, আমি আটকে কি করতাম? আর তুই এই লোককে চিনিস না! রা’ক্ষস একটা।”
তূরাগ চোখ পাকিয়ে তাকাতেই সে দৃষ্টিকে জাপ্টে ধরে বলে,
“দ্যাখ দ্যাখ! কীভাবে তাকিয়ে আছে দ্যাখ? যেন এক্ষুনি আমাকে না চিবিয়ে আস্ত গিলে খাবে! আর ঢেকুরও তুলবে না।”
চলবে,
#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৩৭
ফাহাদ আবরার থমথমে মুখে বসে আছেন। ক’দিনের মধ্যেই তার জীবনে কত কিছু ঘটে গেল! তার ছেলে বউ নিয়ে এলো, তার ছোট মেয়ে শশুর বাড়িতে চলে গেল। আবার বড়টাও নাকি যাবে! তাও আবার দুইবোন একই বাড়িতে! তিনি মাথা দুলিয়ে নাকোচ করে বললেন,
“নাহ, এ হয় না।”
মিসেস সাইমা শান্ত কন্ঠে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন,
“শুনুন ভাই, তূরাগ সত্যিই নাজকে পছন্দ করে। নাজ আমাদের কাছে ভালো তো থাকবেই তাছাড়া দুই বোন একসাথে থাকবে। আপনারা যখন খুশি তখন আসতে পারবেন মেয়েদের দেখতে। দুজনের শশুর বাড়ি একই হবে, তাই আলাদা জায়গায় বার বার যাওয়ার দরকার নেই। আর আমরা একটুও যৌতুক নেব না।”
এমন গুরুত্বর পরিবেশের মধ্যেও মিসেস সীমা হেসে ফেললেন। আশ্চর্য ঘটনা ঘটছে। বাড়ির বড় ছেলে তার ছোট মেয়েকে হুট করে বিয়ে করে ফেলল, এখন নাকি ছোট ছেলেটা তার বড় মেয়েকে পছন্দ করে! তিনি তো হাতে একের পর এক চাঁদ পাচ্ছেন। দুটো মেয়েই তার বোনের কাছে থাকলে তিনি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারবেন। রাতে শান্তির ঘুম হবে। সকল দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হবেন। প্রথম প্রথম খবর পাওয়ায় একটু চমকে ছিলেন ঠিকই তবে এখন তিনি খুশি। তূরাগ ছেলেটাও তো আফরানের মতোই এক্কেবারে খাঁটি সোনা।
মিসেস সাইমা একটু থেমে আবার বললেন,
“তূরাগ কিন্তু আফরানের মতো একদমই নয়। ও ভীষণ দায়িত্ববান। আফরানের মতো চঞ্চল নয়। ও চায়লে আফরানের মতোই হুট করে নাজকে বিয়ে করে ফেলতে পারত। কিন্তু আপনাদের সবার মতামতের জন্য অপেক্ষা করছে সে। আপনাদের দোয়া নিয়েই বিয়ে সারবে। তাছাড়া ও তো গান বাজনা করছেই, তার উপর অফিসেও বসবে কদিন বাদেই। এখন আপনি ভেবে দেখুন মেয়ের জন্য এমন ছেলে আর পাবেন কিনা?”
ফাহাদ আবরার যেন অথৈ জলে পড়লেন। তাদের বাড়ির কাউকেই তো আমিনুল ইততেয়াজ পছন্দ করেন না। এই বাড়িতে মেয়েকে দেবেন? একটা নাহয় ভুল করেই এসে পড়েছে। এবার তিয়াস ইততেয়াজ মুখ খুললেন,
“ভাই, আপনার দুটো মেয়েকেই আমার খুবই ভালো লাগে। লক্ষ্মী মেয়ে দুটো! কি শান্ত! যদিও ফারনাজ একটু চঞ্চল। কি সুন্দর ব্যবহার! মানতেই হবে আপনাদের শিক্ষাকে। ফিরিয়ে দেবেন না আমাদের। অনেক আশা নিয়ে আপনাদের সবাইকে ডেকেছি। ফারনাজ আমার ছেলের বউ হলে আমরা সবাই খুশি হব। কি বলো ভাই?”
আমিনুল ইততেয়াজ নড়ে চড়ে বসলেন। তিনি সব শুনছেন মুখ বুজে। তিনি পছন্দ না করলেও ভাইয়ের যখন অমত নেই, তখন তার মানা করা সাজে না। তিনি বললেন,
“হ্যাঁ হ্যাঁ খুব ভালো হবে।”
ফাহাদ আবরার সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে ভাবলেন মেয়ের থেকে একটু শুনে নেওয়া উচিত। তিনি বললেন,
“নাজের কি মত আছে? ও কি রাজি?”
মিসেস সীমা বললেন,
“নাজের আবার কি মতামত? এতো ভালো ছেলে, ও রাজি হবে না কেন?”
“তবুও একবার শোনা দরকার। আমি জোর করে কোনো সিদ্ধান্ত তাদের উপর চাপিয়ে দিতে চাই না।”
মিসেস সীমা রুমে গিয়ে ফারনাজের মতামত জানতে চায়লে সে লাজুক মুখে বলে,
“তোমরা যা বলবে তাই। যা ভালো বুঝবে করো।”
“ভেবে বলছিস তো? তোর বাবা তোর মতামত ছাড়া এগোবেন না।”
ফারনাজ মাথা দুলিয়ে সম্মতি দেয়। দৃষ্টি বোনের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,
“তুই না একটু আগেই বিয়ে করব না করব না বলে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছিলি? এখন হাওয়া বদলে গেল!”
ফারনাজ মৃদু হেসে বলে,
“তুই বুঝবি না। সে অনেক কাহিনী।”
সে মুখ ভেংচি কাটে,
“হুহ, আমি বুঝব না।”
ঘরোয়া ভাবে তৎক্ষণাৎ বিয়ের আয়োজন হলো। তূরাগ বলেছে বিয়ে করবে আজই তো বিয়ে আজই হতে হবে। ফাহাদ আবরার মৃদু আপত্তি নিয়ে বললেন,
“একটু তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে না? আর কদিন পর নাহয়..”
মিসেস অনা খুশির ঠ্যালায় এতক্ষণ কথা বলতে পারেননি। ফারনাজকে তার আগে থেকেই খুব পছন্দ ছিল। সে ছেলের বউ হলে তো কথাই নেই। তার পারমানেন্ট একটা গল্প করার সঙ্গী হবে। একজন সঙ্গী হিসেবে ফারনাজের তুলনা হয় না। তিনি গদগদ হয়ে বললেন,
“সমস্যা নেই, ভাই। আজ বিয়েটা হয়ে যাক। পরে আফরান ফিরলে দুই ভাইয়ের অনুষ্ঠান একসাথে করা যাবে। অনেক বড় করে অনুষ্ঠান করব। এখন আপাতত হয়ে যাক।”
ফাহাদ আবরার আবার মুখে কুলুপ আঁটলেন। তার আর কিছু বলার রইল না। এবার তার চোখের সামনে তার বড় মেয়ে অন্যের ঘরের বউ হয়ে গেল। আগে ছিল তার মেয়ে আর এখন হলো অন্যের বউ। বুক ভার হলো তার। তার ঘরের আলো যে দুইটা মেয়ে। দুজনই এতো দ্রুত পর হয়ে যাবে, তা ভাবেননি কখনো।
তিনি মুখ গম্ভীর করে বসে আছেন। তাকে সবাই উনিশ বিশ বুঝিয়ে বড়ো মেয়েটাকেও হাতিয়ে নিল!
আফরানকে ছাড়া বিয়ে করতে চায়নি তূরাগ। কিন্তু করতে হলো। এই বোকা মেয়েকে একদমই বিশ্বাস নেই। কখন কি করে বসে! তবে আফরান সশরীরে উপস্থিত হতে না পারলেও ভিডিও কলে উপস্থিত ছিল। তা দৃষ্টির ছিল অজানা। সে নিজের অজান্তেই হাসি হাসি মুখে ফোনের সামনে দিয়ে এসেছে এবং গিয়েছে। অজান্তেই আফরানের বুকে শান্তি ভরেছে। তার ছটফটানি বাড়িয়েছে। তার ধৈর্যশক্তি কমিয়ে দিয়েছে। বিয়ে সমাপ্ত হতেই তূরাগ লোকজনের মাঝ থেকে একটু সরে দাঁড়িয়ে ফোন কানে ধরে। পরপরই শুনতে পায়,
“বিয়েটা তাহলে করেই ফেললি! আমার জন্য একটু অপেক্ষা করা যেত না? আমি তো তোর জন্য অপেক্ষা করেছিলাম আর তোকে সাক্ষীও বানিয়েছি।”
“তোর মতো অতো ধৈর্য আমার নেই। আমি অপেক্ষা করতে পারলাম না।”
“তা হবে কেন? আমার সুন্দরী শ্যালিকাকে চোখের সামনে ঘুরঘুর করতে দেখে তো তোর মাথা আউট হয়ে গিয়েছিল, তাই বল।”
“হ্যাঁ তাই। তোর সুন্দরী মাথা মোটা শ্যালিকা আমার মাথা সত্যিই খারাপ করে ছেড়েছে। কত্তবড় সাহস ওর ভাব? ও রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল এক ছেলের সাথে দ্যাখা করতে আর সেই ছেলে তাকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিল। মাথাটা যে এতো গরম হয়েছিল আমার! দিয়েছি ঠাস করে একটা।”
“কাকে? ওই ছেলেকে?”
“না, তোর মাথা মোটা শ্যালিকাকে।”
“কাজটা ঠিক করলি না। নাজ নরম মনের মানুষ। তোর ব্যবহারে নিশ্চয় কষ্ট পেয়েছে। এমনিতেই তোর ব্যবহার খারাপ। ও’কে স্যরি বলে দিস, নাহলে বাসরের কথা ভুলে যা।”
“পারব না স্যরি বলতে। বাসর করার জন্য আমি ম’রে যাচ্ছি না।”
“আচ্ছা? ঠিক আছে। তবুও একটা পরামর্শ দিচ্ছি। আমি তোর বড় ভাই সেই হিসেবে তুই চাচ্চু হবি আগে। আমি দেশে না থাকার সুযোগে আমাকেই আগে চাচ্চু বানিয়ে দিস না। বুঝলি?”
আফরান আরো কিছু বলল। তূরাগের কান জ্ব’লে গেল। বিরক্ত হয়ে বলল,
“ভাই! আমি তোর ভাই লাগি। একটু তো লজ্জা শরম রাখ। সব কি বিসর্জন দিয়ে ফেলেছিস?”
“আরে! ডাক্তার হিসেবে আমার দায়িত্ব এসব পরামর্শ দেওয়া।”
“তোর দায়িত্ব তোর কাছেই রাখ। আর ফোন রাখ!”
ঝাড়ি দিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করল সে। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে এগিয়ে আসা দৃষ্টির দিকে তাকাল। দৃষ্টি জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে ভাইয়া?”
“তোমার জন্য আমার ভীষণ খারাপ লাগে, দৃষ্টি। তুমি এমন একটা ভালো মেয়ে, আমার ভাইয়ের হাতেই পড়লে! আমার ভাইটার কথা আর কি বলব? না জানি তুমি কীভাবে তাকে সামলাবে। তোমাদের বিয়েতে আমি সাক্ষী ছিলাম ভাবতেই আমার খারাপ লাগে।”
দৃষ্টি মৃদু হেসে বলল,
“বাদ দিন ওসব কথা। খেয়ে নেবেন চলুন।”
তূরাগ আমতা আমতা করে বলল,
“ইয়ে মানে, ফারনাজ কোথায়?”
“আপু গেস্ট রুমে দরজা আটকে বসে আছে। এখন সে কারো সাথে কথা বলবে না বলেছে। আপনি চিন্তা করবেন না। আপুকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। সে এখানেই থাকবে।”
তূরাগ ছোট্ট শ্বাস ফ্যালে। তার ভয় ছিল বিয়ের পর যদি তারা ফারনাজকে নিয়ে যায়? বা ফারনাজ যদি যেতে চায়? তাহলে তো তূরাগ চেয়েও নির্লজ্জের মতো বউয়ের পিছু পিছু শশুর বাড়িতে উঠতে পারবে না। সে আফরানের মতো এতোটাও নির্লজ্জ নয়। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না দেখে ভালো লাগল তার। যতই রাগ করুক আর অভিমান করুক সে তাকে কোথাও যেতে দেবে না। বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখে দেবে একদম।
চলবে,