#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৯
“আজ কলেজ যাবার দরকার নেই, দৃষ।”
মায়ের কথায় দৃষ্টির ভ্রু খানিকটা কুঁচকে গেল। হঠাৎ আজ কলেজ যেতে বারণ করার কারণ কি? কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেলল,
“কেন, মা?”
মিসেস সীমা বসার ঘর গোছাচ্ছেন। জিনিসপত্র মুছে ঠিক করে সাজিয়ে রাখছেন। অতি সূক্ষ্ম নজর প্রদান করছেন যাতে একটাও জিনিস এক ইঞ্চিও বাঁকা না থাকে, না কিঞ্চিৎ পরিমাণ ধুলো। তিনি হাতের কাজ বজায় রেখেই বললেন,
“আজ কিছু মেহমান আসবে। পায়েলও যাবে না। অনেক কাজ আছে বুঝলি তো?”
দৃষ্টি আর কথা বাড়াল না। কারা আসবে তা শোনার প্রয়োজনও অনুভব করল না। এমনিতেই আজকাল তার মন প্রচন্ড ভাবে বিক্ষিপ্ত থাকে। ভালো লাগে না কিছুই। সে চুপচাপ উপরে চলে গেল। পায়েল মিসেস বিউটির সাথে রান্নাঘরে কাজে হাত লাগাচ্ছে। বাড়ির বউ যখন হয়েই গিয়েছে তখন তো আর পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকা চলে না।
দৃষ্টি রুমে গিয়ে ভাবল একটু বই নিয়ে বসা যাক। পড়াতে তো মনই বসতে চায় না। মনে হয় সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টি বই হাতে বিছানায় বসে। বই মেলতে না মেলতেই ফোন টুং করে ওঠে। ফোনটা পাশেই অবহেলায় পড়ে ছিল। সে হাত বাড়িয়ে টেনে নিল। একটা ভয়েস মেসেজ এসেছে। খানিকটা আনমনে সে তা চালু করে ফেলল। পরক্ষনেই চিরপরিচিত চঞ্চল কন্ঠে তার পুরো শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল।
“কেমন আছিস, দৃষ? নিশ্চয়ই খুব ভালো আছিস? ভালোই তো থাকার কথা, আমি তোর আশে পাশে না থাকলে তো তুই খুব ভালো থাকিস। আমি চলে আসার পর তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছিস নিশ্চয়? আমিও খুব ভালো আছি জানিস তো? এখানকার হাসপাতাল আমাদের বাংলাদেশের হাসপাতালের মতো নয়। চারিদিকে এতো সুন্দর সুন্দর নার্স ঘোরে! উফ্! তোকে যে কি করে বোঝাই যে তারা ঠিক কতটা সুন্দরী! দুধের মতো ফকফকা সাদা গায়ের রঙ। আর এতো সুন্দর করে সেজে আসে! সব তো আমার পাশেই ঘুরঘুর করে। তিন চারটা তো আমাকে লাইন মা’রারও চেষ্টা করে। এতো মিষ্টি করে যে কথা বলে! আমার প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। ভাবছি এখানেই থেকে যাব। এদের ছেড়ে তো আমি থাকতেই পারব না। তাছাড়া কার জন্যই বা দেশে ফিরব বল? আমার জন্য তো কেউ অপেক্ষা করছেই না। আচ্ছা এসব কথা এখন থাক। ওখানে এখন সকাল নিশ্চয়? আমার এখানে রাত বুঝলি? কিন্তু আমার ঘুম আসছে না। ঘুমটা যেন দেশেই রেখে এসেছি। কিছুতেই চোখে ধরা দিতে চায় না। আর এতো সুন্দর সুন্দর নার্স দেখে তো আমার ঘুমই উড়ে গিয়েছে। অনেক কথা বলে ফেললাম, বিরক্ত হচ্ছিস? ঠিক আছে আর বললাম না। লাস্ট একটা কথা বলি? তোকে কতদিন দেখি না রে, দৃষ! কতদিন তোর আওয়াজ আমার কানে আসে না! ছয়টা মাস পেরিয়ে গেল!”
দৃষ্টি মুখে হাত চেপে নীরবে কেঁদে উঠল। কান্নার শব্দ চেপে রাখার দরুন মৃদু গোঙানির আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। দৃষ্টি তার পুরো কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেনি। সে তো লোকটার এতো দিন পর পাওয়া কন্ঠে শ্রবণেন্দ্রিয়ের তৃষ্ণা মেটাচ্ছিল। তবে শেষের কথা সে বুঝেছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সে কাঁদতে কাঁদতে আফসোস করল, কেন সে না দেখে মেসেজ অন করতে গেল? জোরে জোরে শ্বাস নিল। কান্না থামছে না। সে ছুটে ওয়াশ রুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে এলো। লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করল। বইটা ফেলে রেখে শুয়ে চোখ বন্ধ করল। এখন আর পড়া হবে না। একটু কেঁদেই মাথা ধরে গিয়েছে।
—
“পায়েল!”
গুরুগম্ভীর কন্ঠের ডাকে পায়েলের হাত থেমে গেল। সেদিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে আবারও কাজ করতে উদ্যত হলেই কন্ঠটা আবার এলো,
“পায়েল, রুমে এসো।”
পায়েল লজ্জা পেল খানিক। এভাবে ডাকার কোনো মানে আছে? মা, ছোট মা কি মনে করবে? মিসেস বিউটি মৃদু হেসে বললেন,
“যাও, কি জন্য ডাকছে শুনে এসো। নাহলে চেঁচাতেই থাকবে।”
পায়েল মাথা নিচু করে হাত ধুয়ে চলে গেল। ফারদিন রেডি হচ্ছে। কোথাও যাবে বোধহয়। সবে মাত্র ট্রাউজার ছেড়ে জিন্স পরেছে। পায়েল কে আসতে দেখে বলল,
“আমার শার্ট গুলো আয়রন করে কোথায় রেখেছ? বের করে দাও।”
পায়েল চুপচাপ ওয়ারড্রবের দিকে এগোলো। ফারদিন শার্ট খুঁজে পেল না কীভাবে? সে তো একদম চোখের সামনেই রেখেছে। সে একটা হালকা নীল রঙা শার্ট বের করে এগিয়ে দিল। ফারদিন তা হাতে নিয়েই ঝটপট গায়ে জড়িয়ে নিল। আপত্তি করল না একদমই। শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল,
“নিচে কি করছিলে? পড়ালেখা কিছু হচ্ছে নাকি সংসার সামলানো হচ্ছে শুধু?”
“পড়ি তো। আজ বাসায় মেহমান আসবে তাই একটু কাজে হাত লাগাচ্ছিলাম। আপনি এখন কোথায় যাচ্ছেন?”
বোতাম লাগানো শেষে সে হাতে ঘড়ি লাগিয়ে নিল। আয়নার মধ্য দিয়ে পায়েলের মুখ দর্শন করে বলল,
“কাজ আছে একটু। তাই যেতে হচ্ছে।”
“ফিরবেন কখন? মেহমান আসবে আর আপনি বাসায় থাকবেন না!”
“মেহমান আসলো কি আসলো না তা দ্যাখার প্রয়োজন আমার নেই। যাদের মেহমান আসবে তারা বুঝে নেবে।”
পায়েল মুখটা ছোট করে ফেলল। ফারদিন তাকাল এক পলক। তার এসব মেহমানদের মাঝে থাকতে একদমই ভালো লাগে না। কোথাকার কারা আসবে তার ঠিক নেই। সে চুলে আঙুল চালিয়ে পায়েলের মুখোমুখি দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে তার মুখ উঁচু করে ধরে বলে,
“আজ কাজে হাত লাগাচ্ছ ঠিক আছে। কিন্তু পরবর্তীতে পড়ালেখা বাদ দিয়ে এসব করতে যেন আমি না দেখি। মনে থাকবে?”
পায়েল ঘাড় কাত করে সম্মতি দেয়। ফারদিনের সান্নিধ্যে এখন আর তেমন লজ্জায় কুঁকড়ে ওঠে না। তবে লজ্জা নিঃশেষ হয়নি। তা কখনো হবার নয়। ফারদিন বেরিয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। ফারদিন আর তার মাঝে ঠিক কেমন সম্পর্ক তা এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। তার মনে হয় ফারদিন তাকে শুধুমাত্র প’শু গুলোর হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই বিয়ে করেছে।
—
দৃষ্টি যখন সবে চোখ মেলে উঠে বসেছে তখন মিসেস সীমা হুড়মুড় করে রুমে প্রবেশ করলেন। পেছনে পায়েল এলো। মুখটা কেমন যেন গোমড়া তার। মিসেস সীমা এগিয়ে এসে বললেন,
“দ্রুত রেডি হয়ে নে।”
তিনি হাত থেকে শাড়ি এবং প্রয়োজনীয় জিনিস বিছানায় রাখলেন। দৃষ্টি জিজ্ঞেস করে,
“এসব কীসের জন্য? আর রেডি হবই বা কেন?”
মিসেস সীমা তড়িঘড়ি করে বললেন,
“সেসব কথা পরে হবে। আগে তুই চোখ মুখ ধুয়ে এসে রেডি হ। পায়েল তোকে সাহায্য করবে। আমি যাই, অনেক কাজ আছে।”
তিনি হাওয়ার বেগে চলে গেলেন। দৃষ্টি পায়েলের দিকে তাকাল। বলল,
“কি ব্যাপার বল তো?”
পায়েল মুখ গোমড়া রেখেই বলল,
“তোকে দেখতে আসছে।”
দৃষ্টি যেন আকাশ থেকে পড়ল। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। কানকেও বিশ্বাস হলো না। মৃদু চেঁচিয়ে বলল,
“কিহ!”
“হ্যাঁ রে। সে জন্যই তো সকাল থেকে এতো আয়োজন।”
“কিন্তু আপুকে রেখে আমাকে কেন? আর তুই আমাকে আগে জানাসনি কেন?”
“আমি কি করে বলতাম? একটু আগেই জানলাম।”
দৃষ্টি পাথর হয়ে বসে রইল। বুকের মধ্যে মুচড়ে উঠল তার। এ অসম্ভব! অসম্ভব! পায়েল ভোঁতা মুখে বলল,
“রেডি হয়েই নে, দৃষ। দেখতে এলেই তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না। কোনো না কোনো সমাধান ঠিক হয়ে যাবে।”
দৃষ্টি ছলছল চোখে তাকাল। জড়ানো গলায় বলল,
“তুই তো সব জানিস, পায়েল। আমি কীভাবে আটকাব এসব?”
পায়েল তাকে আশ্বাস দেয়,
“চিন্তা করিস না। যা হবে ভালোই হবে দেখিস।”
পায়েল তাকে জোর করে রেডি করায়। নাহলে ফাহাদ আবরার তুলকালাম কাণ্ড বাঁধাবেন। দৃষ্টি বড্ড অসহায় হয়ে পড়ে। সে তো আগে থেকেই একজনের কাছে সারাজীবনের জন্য আটকে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও অন্যের সামনে যেতে তার মন সাঁই দিচ্ছে না একটুও। দুরুদুরু বুক কাঁপছে। আজ নিশ্চয়ই কোনো অনর্থ হবে।
মিসেস সীমা কিছুক্ষণ বাদেই ফিরে এলেন। মেয়েকে এক পলক দেখে মুগ্ধ হয়ে বললেন,
“বাহ্! কি সুন্দর লাগছে আমার মেয়েটাকে!”
দৃষ্টি চোখে টলমলে অশ্রু নিয়ে মায়ের দিকে চেয়ে বলে,
“আপু তো আমার বড়, মা। তাহলে আমাকে আগে এসবে জড়ানোর মানে কি?”
মিসেস সীমা হেসে বললেন,
“আরে ধুর পাগলি! দেখতে এলেই কি বিয়ে হয়ে যাচ্ছে নাকি? তাছাড়া তোকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবই না। শুধু শুধু কেঁদে কেটে সাজ নষ্ট করিস না। এখন চল দেখি।”
তিনি পায়েল কে তাগাদা দিয়ে দৃষ্টি কে নিয়ে নিচে নামলেন। মেহমানরা সবে নাস্তা পানিতে হাত দিয়েছে। দৃষ্টিকে দেখে তারা কিছু মুহূর্তের জন্য থেমে গেলেন। দৃষ্টি মাথা নিচু করেই রেখেছে। মিসেস সীমা তাকে একটা জায়গায় বসিয়ে দিলেন। কথা বার্তা চলল টুকটাক। সে জোরপূর্বক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। এক পর্যায়ে পাত্রের মা বললেন,
“আমার মৃন্ময়ের পছন্দ আছে বলতে হবে। ভারি মিষ্টি আপনাদের মেয়ে।”
দৃষ্টি হোঁচট খেল। থতমত খেয়ে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে সামনে তাকাল। মৃন্ময় স্মিত হেসে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিকে তাকাতে দেখে তার হাসি আরও চওড়া হলো। সে এই বিষয়টা নিয়েই তার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু দৃষ্টি সে সুযোগ দেয়নি। এখন নিশ্চয়ই সারপ্রাইজড্ হয়েছে? দৃষ্টির মনে হলো তার পুরো দুনিয়া টলছে। মৃন্ময় স্যার এসেছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে! এবার কি হবে? স্যার তো তাকে আগে থেকেই পছন্দ করে। বাবা মা সহ সকলের হাসি মুখ দেখে তার প্রচন্ড কান্না পেল। তারা কি মৃন্ময় স্যারকে পছন্দ করে ফেলেছে? এতো গুলো মুখের হাসি সে কেড়ে নেবে কীভাবে? কি করবে সে? মনে মনে প্রার্থনা করল এসব বন্ধ হোক। যে করেই হোক বন্ধ হোক। মৃন্ময়ের মা জিজ্ঞেস করলেন,
“দৃষ্টি! আমার ছেলেকে তোমার পছন্দ হয়েছে তো? আমাদের কিন্তু তোমাকে বেশ লেগেছে।”
দৃষ্টি কান্না আটকাতে মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে ধরল। সকলে ধরেই নিল যে সে লজ্জা পেয়েছে। মহিলা আবার বললেন,
“দুজনকে আলাদা একটু কথা বলতে দিলে ভালো হতো না?”
ফাহাদ আবরার কিছু বলার জন্য হা করতে নিলেই কলিং বেল বেজে উঠল। এমন অসময়ে কে আসতে পারে ভেবে সকলে ভ্রু কুঁচকে নিলেন। মিসেস সীমা এগিয়ে দরজা খুলে দিলেন। দরজার ওপাশে দাঁড়ানো অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে দেখে বিস্মিত হবার পাশাপাশি আনন্দে আপ্লুত হয়ে বললেন,
“আপা! তুমি!”
চলবে,
#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৩০
মিসেস সাইমা কে এই অসময়ে দেখে অবাক হয়েছেন সকলেই। মিসেস সাইমা একা আসেননি, সাথে এসেছেন মিসেস অনা এবং তূরাগ। মিসেস সীমা তড়িঘড়ি করে বোনকে ভেতরে প্রবেশ করালেন। বসতে অনুরোধ করলেন সবাইকে। ফাহাদ আবরার অবাক হলেও তাদের সাদরে গ্রহণ করলেন। মিসেস সাইমা চারপাশে চেয়ে বললেন,
“ভুল সময়ে এসে পড়লাম মনে হয়।”
মিসেস সীমা বললেন,
“আরে না না, আপা। কতদিন পর তুমি এলে! আর সবাই তো নিজেদেরই লোক। এই যে ওনারা দৃষ কে দেখতে এসেছেন। মৃন্ময় তো আফরানের সাথেই এক হাসপাতালে চাকরী করে।”
মিসেস সাইমা দৃষ্টির দিকে এক পলক তাকালেন। শাড়ি পরিয়ে তাকে পুতুলের মতো বসিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি শাড়ির আঁচলে কপালের ঘাম মুছলেন। তিনি তো জেনে বুঝেই এই অসময়ে এসেছেন। তিনি মৃদু হেসে বললেন,
“দরকারে আসতে হলো।”
“সব দরকার পরে হবে। আগে একটু নাস্তা করে নাও।”
“নাস্তা পানি সব পরে হবে। আমি এখানে খুব দরকারি একটা কাজে এসেছি। আশা করছি আমাকে তোরা ফিরিয়ে দিবি না।”
ফাহাদ আবরার ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। কি এমন দরকার পড়ল যে এই ভর দুপুরে ছুটে চলে এলেন? মিসেস সাইমা ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কল লাগালেন কোথাও। কল রিসিভ হাওয়ার পরপরই বললেন,
“হ্যালো আফরান?”
এই একটা নাম শুনেই দৃষ্টি জমে গেল। দুরুদুরু কেঁপে উঠল বুক। পরবর্তীতে ঘটা বিস্ফোরণের কথা কল্পনা করেই কপাল বেয়ে ঘামের রেখা নেমে গেল।
ফোনের ওপারের আফরান সকলকে উদ্দেশ্য করে সালাম দিল। বলল,
“মা, পাশে খালামনি আছে?”
“হ্যাঁ আছে।”
“তাকে বলো আঙ্কেলের প্রেশারের ওষুধ টা হাতে রাখতে। কারণ এখন উনি যা যা শুনবেন এবং যা যা ঘটনা ঘটবে তাতে ওনার প্রেশার হাই হয়ে যাবে। আর একজন ডাক্তার হয়ে আমি আমার কর্তব্যে কখনো অবহেলা করি না। কি ডক্টর আহমেদ? আমি ঠিক বলছি তো?”
মৃন্ময় চুপচাপ বসে আছে। হঠাৎ কি থেকে কি হচ্ছে তার বোধগম্য হচ্ছে না। বিয়ের পাকা কথার মাঝে আফরান কোত্থেকে উদয় হলো? মিসেস সীমা আফরানের কথা মতো ছুটে গিয়ে ওষুধ নিয়ে এলেন। তার বোন পো কখনো ভুল কথা বলে না। ফাহাদ আবরার বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে নিলেন। আফরান এবার দৃষ্টিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তোর সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, দৃষ! তোর এতো সাহস বেড়েছে যে আমার অনুপস্থিতিতে তুই সং সেজে অন্যের সামনে যাস! তোর দ্বারা তো ভুল নয়, পাপ হয়ে গেল।”
দৃষ্টি মাথা নিচু করে চোখের জল আটকাবার তীব্র প্রচেষ্টা করতে লাগল। ফাহাদ আবরার কিঞ্চিৎ রেগে বললেন,
“কি হচ্ছে এসব? তুমি আমার মেয়েকে এসব বলছ কেন?”
আফরান শব্দ করে হেসে বলল,
“বলছি কারণ এখানে আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। ও আমি ব্যতীত অন্য কারো সামনে সেজে বসতে পারল কি করে? অনেক সাহস বেড়েছে আপনার মেয়ের।”
“কীসের অধিকার তোমার আমার মেয়ের উপর? সামান্য কাজিন হয়ে এমন অধিকার বোধ দ্যাখাতে আসবে না।”
আফরান হাসল আবারও,
“সামান্য কাজিন! দৃষ? আমি তোর সামান্য কাজিন! এতো মজার মজার কথা শুনে তো আমার গড়াগড়ি দিয়ে হাসতে মন চাচ্ছে।”
আফরান থামল একটু। পরপরই গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“অনেক হয়েছে মজা। আর না। আঙ্কেল, আমি আমার মাকে আপনাদের বাড়িতে পাঠিয়েছি আমার বউকে নিয়ে আসার জন্য। আজকের এমন হীন ঘটনার পর এক মুহূর্তও আমার বউ ওখানে থাকবে না। বলা তো যায় না আপনি মেয়ের দ্বিতীয় বিয়ে করিয়ে দিলেন!”
ফাহাদ আবরার হতভম্ব হলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
“কি সব পাগলের প্রলাপ বকছ? কে তোমার বউ?”
ভরা সভার মাঝে আফরান বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উচ্চারণ করল,
“ফাহাদ আবরার এবং মিসেস সীমার তিন সন্তানের মধ্যে ছোট কন্যাটি যার নাম দৃষ্টি আবরার সে’ই আমার বউ। আমার স্ত্রী।”
মৃন্ময়ের পরিবার সহ ফাহাদ আবরার দাঁড়িয়ে পড়লেন। চোখে মুখে বিস্ময় খেলছে তাদের। মিসেস সীমা ফাহাদ আবরারের হাতে ওষুধ ধরিয়ে দিলেন। তিনি জানেন এখন কুরুক্ষেত্র বেধে যাবে। ফাহাদ আবরার যেন চোখে আঁধার দেখছেন। তিনি কোথাকার কোন ওষুধ ছুড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বললেন,
“মশকরা করো আমার সাথে? আমার মেয়ে তোমার স্ত্রী হয়ে গেল আর আমিই জানি না? আমি মৃন্ময়ের সাথে দৃষ্টির বিয়ে দেব।”
“এ কাজ ভুলেও করতে যাবেন না। আমি এতো কাঁচা খেলোয়াড় নই। মাকে আমি সকল প্রমাণ সহ পাঠিয়েছি আর সাথে সাক্ষী হিসেবে আমার ভাই তূরাগও আছে। আপনার কিচ্ছু করার নেই এখানে। যদি বাঁধা দেন তবে আমি আইনের সাহায্য নিতে বাধ্য হব। আজই নিজের মেয়েকে বিদায় দিয়ে স্বামীর ঘরে পাঠান। আমি ফিরব খুব শীঘ্রই। তার পর যার যার সাথে যা হিসাব তা বুঝে নেব।”
সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। থম মে’রে দাঁড়িয়ে রইলেন ফাহাদ আবরার। তিনি বিশ্বাস করেন না এসব। তিনি গলায় জোর বাড়িয়ে বললেন,
“আমি এসব কিছুই বিশ্বাস করি না। আপা, চলে যান আপনারা।”
মিসেস সাইমা সূক্ষ্ম শ্বাস ফেললেন। এসেছেন যখন ছেলের বউকে নিয়েই ফিরবেন। খালি হাতে ফেরার উপায় নেই। আফরান ল’ঙ্কা কাণ্ড বাঁধবে! এতো বছরের সাধনার প্রশিক্ষণ ফেলে চলেও আসতে পারে। তিনি ব্যাগ থেকে তাদের কাবিননামার কাগজটা বের করে টেবিলে রাখলেন। এর থেকে বড় প্রমাণ আর হতে পারে না। আফরান সব ব্যবস্থা আগে থেকেই করে গিয়েছিল। সে হয়তো এমন কিছু ঘটার আভাস পেয়েছিল। ফাহাদ আবরার ধাক্কা খেলেন। হাত বাড়িয়ে কাগজ তুলে ধরে বড় বড় চোখে চেয়ে রইলেন। কনের সই এর জায়গায় জ্বল জ্বল করা মেয়ের স্বাক্ষর চিনতে তার অসুবিধা হলো না বিন্দু মাত্র। নিষ্পলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন মেয়ের মুখশ্রীতে।
দৃষ্টি এখনো মাথা নিচু করেই আছে। ইতোমধ্যে গাল ভর্তি করে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে ফেলেছে। বারংবার মনে হচ্ছে সে তার বাবার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ফাহাদ আবরার মেয়ের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। নির্লিপ্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“এগুলো কি সত্যি?”
দৃষ্টি জবাব দিল না। চিবুক ঠেকে গেল বুকে। ফাহাদ আবরার ধৈর্যহীন হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,
“আমি জিজ্ঞেস করছি তোমাকে, এসব কি সত্যি?”
দৃষ্টি ঠোঁট কামড়ে কেঁদে উঠল। মাথা উপর নিচ দোলায়। এতে সকলে যা বোঝার বুঝে গেলেন। মৃন্ময়ের মা বললেন,
“এখানে দাঁড়িয়ে তামাশা দ্যাখার আর কোনো মানে নেই। একটা বিবাহিতা মেয়েকে আবার বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন আপনারা? ভাগ্যিস ওনারা ঠিক সময়ে চলে এসেছিলেন। নয়তো আমার ছেলের খুব বড় ক্ষতি হয়ে যেত।”
ফাহাদ আবরার চুপচাপ শুনে গেলেন। বড্ড একা অনুভব করছেন তিনি। তার অনুপস্থিতিতে রামিজ আবরার অফিস ছেড়ে আসতে পারেননি। তাই আজ তার পাশটা শূন্য। তারা আরও দু কথা শুনিয়ে প্রস্থান করলেন। যাবার আগে মৃন্ময় দৃষ্টির দিকে কাতর চোখে চেয়ে গেল। সে এসব কিছু দৃষ্টির থেকে আশা করেনি।
মিসেস সাইমা বোনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“দৃষ্টির ব্যাগ গুছিয়ে দে। আর বেশিক্ষণ বসব না আমরা।”
ফাহাদ আবরার মেয়ের দিকে শূন্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিজের কক্ষে চলে গেলেন। দৃষ্টি এবার শব্দ করে কেঁদে উঠল। বাবার এমন দৃষ্টি তার বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু করেছে। পায়েল এগিয়ে তাকে আগলে নিল। ফারনাজ এতোক্ষণ এখানে উপস্থিত ছিল না। সেও কোথা থেকে দৌড়ে এসে বোনকে সান্ত্বনা দিতে লাগল,
“কাঁদিস না, দৃষ। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
দৃষ্টি থামে না। সর্বদা সে ছিল বাবা মায়ের অনুগত বাধ্য মেয়ে। আজ সে বাবার বিরুদ্ধে যেয়ে তার চরম অপছন্দের পাত্রের সাথে জীবন জুড়েছে। তার বাবা কষ্ট পেয়েছেন। তিনি কখনো দৃষ্টির উপর রাগ দ্যাখাননি। সে কখনো ভুল করলে তিনি নীরব থাকতেন। কথা বলা বন্ধ করে দিতেন। এতেই দৃষ্টির শিক্ষা হতো। আজও তিনি এমনই করছেন। তবে দৃষ্টির কিচ্ছু করার নেই। সে কীভাবে আফরান কে ছেড়ে দেবে? সে ছাড়লেও আফরান তাকে কখনো ছাড়বে না। সকল কথা চিন্তা করে দৃষ্টি হাউমাউ করে কাঁদতেই থাকল।
মিসেস সীমা মনে মনে বেশ খুশি হয়েছেন। তবে বাইরে থেকে বুঝতে দিচ্ছেন না। আফরান তার চিরকাল পছন্দের পাত্র ছিল। তবে অকস্মাৎ এই রত্নকে তিনি ছোট জামাই হিসেবে পেয়ে যাবেন, তা কি কল্পনা করেছিলেন কোনোদিন? তিনি খুশি মনে মেয়ের ব্যাগ গোছাতে গেলেন।
মিসেস সাইমা এগিয়ে এসে দৃষ্টির মাথায় হাত রাখলেন। কোমল স্বরে বললেন,
“কাঁদিস না, মা। আজ আমার ছেলের একটা ছেলেমানুষীর জন্যই তোকে এসব কিছুর মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কিন্তু কি বল তো? আমার ছেলেটা তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে। এসব কিছু আন্দাজ করে সে তোকে বিয়ে করেই রেখে গিয়েছে। যাতে তোর উপর সম্পূর্ণ অধিকার ওর থাকে। নয়তো ও পারতো না এসব আটকাতে, ওর তো কোনো অধিকারই থাকত না। আর তুই অন্যকারো হয়ে যেতিস।”
দু হাতে তার মুখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন,
“থাক! আর না। রেডি তো হয়েই আছিস, আর রেডি হতে হবে না। আর শোন! আজ যে আমার ছেলে তোকে এতো কাঁদাল, দেশে ফিরলে আচ্ছা মতো আমি তার কান মলে দেব দেখিস। এখন শান্ত হ?”
দৃষ্টি লম্বা শ্বাস নিয়ে শান্ত হলো। উঠে দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে বাবার রুমের দিকে অগ্রসর হলো।
ফাহাদ আবরার জানালার পাশে বিছানার কোণে বসে আছেন। দৃষ্টি তার জানালা ভেদ করে বাইরে। দৃষ্টি নিঃশব্দে বাবার পায়ের নিকটে বসে। কোলে রাখে মাথা। দু ফোঁটা চোখের জল ফেলে বলে,
“আমাকে ক্ষমা করে দাও তুমি, বাবা।”
চলবে,
#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৩১
“আমাকে ক্ষমা করে দাও। বিশ্বাস করো আমার হাতে কিছুই ছিল না। আমি বাধ্য ছিলাম, বাবা। তোমার অমতে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।”
বলতে বলতে সে নীরবে চোখের জল ফেলে। ফাহাদ আবরার অনুভব করলেন উষ্ণ জলের স্পর্শ। তিনি নড়ে চড়ে বসলেন। কোনোদিনই তিনি সন্তানের চোখের জল সহ্য করতে পারেন না। তবে মেয়ের এমন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাকে ভাবাচ্ছে। আফরান কে তিনি সর্বদায় খারাপ ছেলে ভেবে এসেছেন। তিনি জানেন না সে আদৌ শুধরেছে কিনা? আদৌ তার কলিজার টুকরা তার কাছে ভালো থাকবে কিনা? মেয়ের চোখের জলে তার বুকে চিনচিনে ব্যথা সৃষ্টি করল। তিনি আলতো করে হাত রাখলেন তার মাথায়। দৃষ্টি যেন ভরসা পেল। ফাহাদ আবরার মৃদু কন্ঠে বললেন,
“আমি জানি এখানে তোমার কোনো দোষ নেই। সবটা ওই স্টুপিড ছেলের কাজ। কেন? আমার সামনে দাঁড়ানোর সৎ সাহস তার নেই? এভাবে হুট করে আমার মেয়েকে বিয়ে করে ফেলল! তবে সে যদি ভেবে থাকে আমি তাকে ছেড়ে দেব, চরম ভুল। আমি তাকে উচিত শিক্ষা দেব। আগে তাকে দেশে ফিরতে দাও। তোমাকে আজ আটকে রাখলে স্টুপিডটা যদি ওদেশের সব ফেলে চলে আসে? তখন তো আমাকেই দোষ দেবে। আমার জন্য ওর ট্রেইনিং শেষ হয়নি বলে বলে আমার মাথা খাবে। ফাহাদ আবরার হাঁটুর বয়সী এক ছেলের কাছে হেরে যেতে পারে না।”
একটু থামলেন তিনি। শ্বাস টেনে নিয়ে বললেন,
“তুমি আপাতত যাও। স্টুপিডটা দেশে ফিরলে আমি তোমাকে নিয়ে আসব। ওর অনুপস্থিতিতে যুদ্ধটা ঠিক জমবে না।”
দৃষ্টির কান্না থেমে গিয়েছে আগেই। বাবার কথায় সে হেসে ফেলল। তিনি যে মেনে নিতে চেষ্টা করছেন সেটা তার কথাতেই দৃষ্টি বুঝেছে। সে চোখ মুছে বাবার দিকে চেয়ে বলল,
“তুমি আমাকে মাফ করেছ তো, বাবা?”
“তোমার কোনো ভুল নেই। তোমার মাফ চাওয়ারও দরকার নেই। যার দরকার তার সাথে আমি বুঝে নেব, যাও।”
দৃষ্টি প্রশান্তির হাসি হেসে বাবা আলতো আলিঙ্গন করে বলল,
“আমি তোমাকে ভালবাসি, বাবা।”
ফাহাদ আবরার মলিন হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তিনি নিজে গেলেন মেয়েকে গাড়িতে তুলে দিতে। সাথে ফারনাজ কে রেডি হয়ে ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালেন। মিসেস সীমা বললেন,
“আপা বলছিল, নাজের তো পরীক্ষা শেষ। শুধু শুধু বসে আছে ঘরে। তাই একটু ঘুরে আসুক।”
ফাহাদ আবরার কিছু বললেন না। তার নীরব সম্মতি পেয়ে ফারনাজ খুশি হলো। বেশ অনেক দিন পরই সে যাবে খালামনির বাড়ি।
সকলকে বিদায় দিতে যেয়ে দৃষ্টির চোখ ভরে এলো, তবে অতিকষ্টে সে তা দমিয়ে রাখল। মিসেস সীমা মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
“কি থেকে কি হয়ে গেল! আমার ছোট্ট মেয়েটার কবে বিয়ে হয়ে গেল টেরই পেলাম না। তবে কি জানিস তো? বিয়েটাতে আমি খুব খুশি। আমি তোকে আফরানের কাছে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকব, কারণ আমি জানি সে তোকে খুব ভালো রাখবে। তুই খুব ভালো থাকবি দেখিস। আমাদের কথা ভেবে মন খারাপ করবি না একদম। যখনই আমাদের কথা মনে পড়বে তখনই চলে আসবি, নাহয় ফোন করবি তোর ভাই গিয়ে নিয়ে আসবে। ভালো থাকিস।”
দৃষ্টি মাকে জড়িয়ে ধরে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। সব শেষে পায়েল কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ধরা গলায় বলল,
“তুই আমাকে তাড়াতে চেয়েছিলি না? দ্যাখ চলে যাচ্ছি।”
“হু চেয়েছিলাম তো। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি আমাকে শান্তি দিয়ে চলে যাবি, ভাবিনি।”
তার কন্ঠও জড়িয়ে আসছে। দৃষ্টি সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে বলল,
“ভাইয়ার সাথে দ্যাখা হলো না। বলে দিস আমি ও’কে খুব মিস করব। সবাইকে খুব মনে পড়বে আমার।”
পায়েল তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
“আমাকে মনে করতে হবে না। মেডিকেলে দ্যাখা তো হবেই।”
দৃষ্টি মৃদু হাসে। বাবার কাছে গেলে তিনি বললেন,
“চিন্তা করবে না একদমই। কোনো সমস্যা হলে সাথে সাথে আমাকে ফোন করবে, আমি গিয়ে নিয়ে আসব। নয়তো কাউকে পাঠিয়ে দেব।”
বন্যা আর বর্ষণ তো কেঁদে ফেলল প্রায়। তারা দৃষ্টিকে যেতে দিতে নারাজ। দৃষ্টি কোনো মতে তাদের আদর করে, তাদের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসে। তূরাগ ড্রাইভ করে এসেছিল। সে ড্রাইভিং সিটে বসে। পেছনে মিসেস সাইমা, মিসেস অনা এবং দৃষ্টি। বাকি ফারনাজ, সে মাঝে বসার জায়গা পেল না। বাধ্য হয়ে তাকে তূরাগের পাশে উঠে বসতে হলো। গাড়ি চলতে শুরু করল। দৃষ্টি চোখ বন্ধ করে সিটে মাথা এলিয়ে দিল। এইটুকু তেই যেন ক্লান্তির শেষ নেই। মিসেস সাইমা সযত্নে তার মাথা নিজের কাঁধে রাখলেন। মিসেস অনা এতোক্ষণ ধরে ফারনাজের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছিলেন। তিনি এবার মুখ খুললেন,
“তোমার নাম বুঝি নাজ?”
তাকে বলা হলো বুঝে ফারনাজ ঠোঁট টেনে হেসে বলল,
“না, আন্টি। আমার নাম ফারনাজ, সকলে ছোট করে নাজ বলে ডাকে।”
“তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছ?”
ফারনাজ ঘাড় পেছনে ঘুরিয়ে কপট হেসে বলে,
“আপনাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু চিনতে পারছি না ঠিক। কোথায় দেখেছি বলুন তো?”
মিসেস অনা উৎসাহ পেলেন। তিনি গদগদ কন্ঠে বললেন,
“মনে নেই? ওই যে শপিং মলে ভিড়ের মাঝে আমি আটকে পড়েছিলাম? আর তুমিই তো আমাকে বের করেছিলে।”
ফারনাজের মনে পড়ল। সে ভীষণ প্রফুল্ল হয়ে সিট বেল্ট খুলে মিসেস অনার দিকে ঘুরে বসল। বলল,
“আপনি সেই আন্টিটা! ইশ্ আমি একদমই ভুলে গিয়েছিলাম। কেমন আছেন আপনি?”
গল্প জুড়ে দিল দু’জনে। সেদিন শপিং মলের কথা সহ আরও কত কথা! তূরাগ বিরক্ত হলো ভীষণ। এভাবে কেউ গল্প করে? গল্প করার সময় কি ফুরিয়ে যাচ্ছে? সে দাঁত কিড়মিড় করে ধমকের সুরে বলল,
“এই মেয়ে! সোজা হয়ে বসো। এক্ষুনি সোজা হয়ে বসো।”
ফারনাজ ধড়ফড়িয়ে লাফিয়ে উঠল। গাড়ির উপরিভাগে মাথায় আঘাত পেল। মৃদু আর্তনাদ করে সোজা হয়ে বসল। মাথায় হাত ঘষে মুখ কুঁচকে তূরাগের দিকে তাকাল। সে নির্লিপ্ত। মিসেস অনা বললেন,
“মেয়েটাকে ওভাবে বললি কেন, বাবা?”
তূরাগ বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,
“গাড়ির ভেতরে এভাবে গল্প করে কেউ? আমার সমস্যা হচ্ছে। বাড়িতে গিয়ে শান্ত হয়ে বসে, তারপর ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প কোরো।”
মিসেস অনা আর কিছু বললেন না। তবে ফারনাজ মুখ ঘুরিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
“আমরা গল্প করছি তাতে ওনার কি? হুহ! এই মেয়ে সোজা হয়ে বসো!”
মুখ ভেংচাল সে। তূরাগ গমগমে কন্ঠে আবার বলে,
“সিট বেল্ট কে লাগাবে? ভুতে?”
সে মুখ ছোট করে সিট বেল্ট লাগায়। এই লোকের সমস্যা কি সে বোঝে না। দ্যাখা হওয়া থেকে এই পর্যন্ত কোনো দিন তার সাথে ভালো ব্যবহার করেনি এই পাথর মানব!
আরও আধঘন্টা পর তারা বাড়ি পৌঁছায়। মিসেস সাইমা এবং মিসেস অনা দৃষ্টিকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। ফারনাজ পড়ল বিপাকে। সে ব্যাগ টেনে নিয়ে যেতে পারছে না। একটু বেশিই ভারী হয়ে গিয়েছে। হাল ছেড়ে দিয়ে সে কোমরে হাত ঠেকিয়ে লম্বা শ্বাস নিলো। তাকে তো একা ফেলে সবাই চলে গেল। তূরাগ গাড়ি পার্ক করে এসে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকাল। বলল,
“দাঁড়িয়ে আছ কেন? ফিরে যাবে নাকি?”
ফারনাজ কড়া জবাব দিতে গিয়েও দিল না। কারণ এই লোকের সাহায্য তার প্রয়োজন। সে বিনীত কন্ঠে বলল,
“আমাকে একটু সাহায্য করুন, প্লিজ? ব্যাগটা অনেক ভারী। আমি নিয়ে যেতে পারছি না।”
তূরাগ কপালে ভাঁজ ফেলে তাকায়। এক হাতে ব্যাগ উঁচু করে বলে,
“কি এর মধ্যে? এতো ভারী কেন? সারাজীবনের জন্য থাকতে এসেছ নাকি?”
ফারনাজ অপমানিত হলো। সে মুখ কুঁচকে থমথমে কন্ঠে বলে,
“আমার তো খেয়ে কাজ নেই যে খালামনির বাড়িতে সারাজীবন থাকব! এতে দৃষের কিছু বই আছে। সব ওর ব্যাগে ধরেনি তাই।”
একটু থেমে বলল,
“আমি আপনাকে এসব বলতে যাচ্ছি কেন? আপনাকে সাহায্য করতে হবে না। আমিই পারব।”
ফারনাজ হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলে তূরাগ ব্যাগ উঠিয়ে হাঁটা ধরল। ফারনাজ চোখ ছোট ছোট করে বলে,
“সাহায্যও করবে আবার অপমানও।”
সে তূরাগের পেছনে পেছনে যায়। মনে মনে কতবার যে তাকে ধুয়ে দিল তার ইয়াত্তা নেই।
—
“খালামনি! এই রুমে থাকতে হবে? আমি নাহয় আপুর সাথে থাকি?”
মৃদু কন্ঠে বলল সে। তাকে শুধু শুধু এই রুমে থাকতে দেওয়ার কি দরকার। ফারনাজের সাথে গেস্ট রুমে দিব্বি থাকতে পারত সে। মিসেস সাইমা তার হাত টেনে বিছানায় বসালেন। বললেন,
“খালামনির বাড়িতে আসিসনি। শশুর বাড়িতে এসেছিস। তো এখন তো আর গেস্ট রুমে থাকলে চলবে না, স্বামীর রুমে থাকতে হবে। যদিও আফরান এখন নেই, কিন্তু তার সব কিছুতে তোর অর্ধেক অধিকার।”
দৃষ্টি চুপ রয়। বুকের মধ্যে কাঁপছে তার। আফরানের রুমে শেষবার কবে এসেছিল তার খেয়াল নেই। এখন থেকেই তাকে এই রুমে থাকতে হবে ভেবেই, তার বুক ভার হচ্ছে। কোনো ভাবে নাহয় থাকবে, কিন্তু আফরান আসার পর কি করবে?
“ফ্রেশ হয়ে নে। দুপুরে তো কারোরই কিছু খাওয়া হয়নি। ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে আসিস। কেমন?”
দৃষ্টি ভাবনা থেকে বেরিয়ে মাথা নেড়ে সায় দেয়। মিসেস সাইমা হেসে চলে গেলেন। ছেলের বউ হিসেবে দৃষ্টিকে তার মোটেও অপছন্দ নয়। ছোট থেকে দেখে এসেছেন, তুলনামূলক শান্ত এবং বাধ্য মেয়ে সে। যেখানে তার ছেলে চঞ্চল, অবাধ্য। তিনি ভেবেছিলেন ফাহাদ আবরারের কাছে দৃষ্টিকে চায়বেন, কিন্তু আফরানের বাবা আমিনুল ইততেয়াজের জন্য পারেননি। তিনি নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষদের পছন্দ করেননা। তেমনই তার বোনের পরিবার অপছন্দের তালিকায় ছিল তার। ছেলের জন্য হয়তো কোনো কোটিপতির মেয়েকে চেয়েছেন। এখন ফিরে যখন সব জানতে পারবেন, তখন কি করবেন তিনি জানেন না। কীভাবে সবটা সামলাবেন কে জানে? এবার হয়তো বাপ ছেলের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধবে। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে আওড়ালেন,
“সাহায্য করুন, আল্লাহ্! এসবের মধ্যে মেয়েটার কোনো দোষ নেই। সে যেন কষ্ট না পায়।”
চলবে,
বানান ভুল হলে ধরিয়ে দেবেন।🙂