#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১০
দৃষ্টিকে মেডিকেলে ড্রপ করতে এসেছে ফারদিন। বাইরেই পায়েল দাঁড়িয়ে ছিল। দৃষ্টিকে বাইক থেকে নামতে দেখে এগিয়ে গেল। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া।”
ফারদিন বরাবরের মতো গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল। অতঃপর কিছু দৃষ্টিগোচর হতেই বলল,
“দৃষ, তুই এগো। পায়েলের সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
ভাইয়ের কথা অনুযায়ী দৃষ্টি অগ্রসর হলো। সে চলে যেতেই ফারদিন জিজ্ঞেস করে,
“বাড়ির সবাই ভালো আছে?”
“হ্যাঁ ভাইয়া।”
“পড়ালেখা করছ তো ভালো মতো?”
‘এইটুকু কলেজ আসতে পারছি তাই আমার কপাল ভালো। আর পড়ালেখা!’ মুখে বলে,
“জি।”
অতঃপর সে পায়েল কে আগা গোড়া পর্যবেক্ষণ করে বলল,
“তুমি ঠিক আছ?”
হঠাৎ এমন প্রশ্নের কারণ খুঁজে পেল না পায়েল। জোর পূর্বক হেসে বলল,
“হঠাৎ এমন প্রশ্ন?”
“না, এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।”
“হ্যাঁ ভাইয়া, আমি ঠিক আছি। ভালো আছি।”
“তাহলে গালে এই দাগ কীসের?”
সে আলতো আঙুল ছুঁয়ে দেয়। পায়েল চোখ বন্ধ করে নিল। কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হলো না? হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল যেন। সে একটু পিছিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,
“হবে কিছু একটার। খেয়াল নেই। ভাইয়া, আমি আসি তাহলে? ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।”
বলে সে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করল। পায়েল কিছু লুকিয়ে গেল এটা স্পষ্ট। ফারদিনের কপালে ভাঁজ পড়ে। কি লুকাচ্ছে পায়েল?
–
ক্লাসে দৃষ্টির পাশে বসে লম্বা শ্বাস নিল পায়েল। দৃষ্টি ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি হয়েছে? কি বলল ভাইয়া?”
“আরে তেমন কিছু না। জিজ্ঞেস করছিল মুখের এই দাগ কীসের?”
দৃষ্টি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে পায়েলের বা গালে চার আঙুলের দাগ দেখতে পেল। আঁতকে উঠল সে। তার গালে হাত বুলিয়ে করুণ কন্ঠে বলল,
“কে মে’রেছে পায়েল?”
পায়েল তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
“কে আবার? বড় চাচি। কেন মে’রেছে জানিস? আজ কলেজ আসার জন্য তাড়াহুড়োয় একটা রুটি পুড়িয়ে ফেলেছিলাম তাই।”
দৃষ্টির ভীষণ কষ্ট হয়। ছলছল চোখে তাকিয়ে বলে,
“তুই আমাদের বাড়িতে কেন চলে আসছিস না পায়েল? প্লিজ তুই ও বাড়ি ছেড়ে চলে আয়।”
পায়েল তার হাতে হাত রেখে বলে,
“এটা কখনও সম্ভব নয় রে। ওই বাড়ির প্রতিটা কোণায় কোণায় আমার বাবা মায়ের স্মৃতি আছে। আমি তা ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না। ওই স্মৃতি টুকু আঁকড়েই তো বেঁচে আছি। নাহলে ওই নরকের মধ্যে কে থাকতে চায়?”
দৃষ্টি তাকে আশ্বাস দেয়,
“দেখিস এমন কেউ তোর জীবনে আসবে যে তোর নরককে স্বর্গে পরিণত করবে। তোর সকল দুঃখকে সুখে রুপান্তরিত করবে। তোর সকল দোষীদের শাস্তি দেবে। আসবে, তাকে আসতেই হবে।”
পায়েল মৃদু হাসে। মনে মনে বলে,
“আমার ধৈর্য্যের সীমা পার হবার আগে কি সে আসবে, দৃষ?”
—
“রকস্টার তূরাগ ইততেয়াজ! উফ্, আমার ক্রাশ সে। যদি কোনো দিন সামনাসামনি দ্যাখা করতে পারতাম!”
ফারনাজের মেজাজ তুঙ্গে। একে তো ওই রকস্টারের জন্য নিজের ফোন নিজেই ভেঙেছে, তার উপর তার নামের গুনগান সহ্য হচ্ছে না। রুক্ষ কন্ঠে বলল,
“দ্যাখ পাপিয়া! এসব আলতু ফালতু বকা বন্ধ কর। মেজাজ ভালো নেই আমার।”
আফিয়া মুখ কুঁচকে তাকায়। কিছু বলতে নিলেই সুমি জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে নাজ? তুই তো এমন মুডে কখনও থাকিস না।”
“প্রচন্ড রাগ লাগছে আমার। একে তো আগের ফোনটা এক পাথর মানবের জন্য ভাঙলাম। তার পরের ফোনটা কিনতে যেয়ে মায়ের কাছ থেকে অনেক বকা শুনতে হয়েছে। আমার মেজাজ একদম ঠিক নেই।”
তারা বুঝল। আফিয়া বলল,
“কুল ডাউন, নাজ। আচ্ছা? তুই কি নতুন কোনো বয়ফ্রেন্ড পাসনি?”
“আর বয়ফ্রেন্ড! একটাও কি জাতের ছেলে নেই? নাকি আমার সামনে পড়ছে না?”
“চিন্তা করিস না। ঠিকই একজন পেয়ে যাবি। চল আজ তোর মুড ফ্রেশ করার জন্য ঘুরে আসি। তোর মন ভালো হয়ে যাবে।”
ফারনাজের মনে হলো ঘুরতে গেলে মন্দ হয় না। তাই সে রাজি হয়ে গেল। তিনজন মিলে ঘোরার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল।
একটু ঘুরে ফিরে তারা গেল ফুচকা খেতে। আফিয়া ও সুমি এক প্লেট করে ফুচকা নিল। ফারনাজ বলল,
“আমার একজনের উপর ভীষণ রাগ বুঝলি তো? তাই আমি আজ বেশি ঝাল দিয়ে তিন প্লেট ফুচকা খাব। একটা একটা ফুচকার জায়গায় তার মাথা কল্পনা করে নেব। এবার তার মাথা চিবাবো আমি।”
তারা হতাশ শ্বাস ফেলে। কারো উপর রেগে গেলে ফারনাজ এমন কান্ড প্রায়ই ঘটিয়ে থাকে। আফিয়ারা নিজেদের ফুচকা শেষ করে বলল,
“নাজ, তুই খেতে থাক। আমরা ওইদিক থেকে আইসক্রিম নিয়ে আসি। একটু পর তোরই দরকার পড়বে।”
ফারনাজ খেতে খেতে মাথা নেড়ে সাঁই দিল। তারা চলে গেল। ফারনাজ একটা একটা ফুচকা মুখে দিচ্ছে আর তূরাগের চেহারা কল্পনা করছে। তার যে এতো শান্তি লাগছে! মনে হচ্ছে স্বয়ং তূরাগের মাথা খাচ্ছে সে। আহা! শান্তি শান্তি। তার রাগটাও কমে এসেছে। এদিকে ঝালের ঠ্যালায় তার চোখে জল এসে গিয়েছে। কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। মনটা চেঁচিয়ে উঠতে চাচ্ছে। চেঁচানোর আগেই হাতে টান অনুভব করল। একটা শক্ত পোক্ত হাত তাকে টেনে নিয়ে পাশের একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। পানির বোতল সামনে ধরে ধমকে বলল,
“পানি খাও ইডিয়েট।”
ফারনাজ হম্বিতম্বি করে পানি গিলল। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। লোকটা তার চশমা খুলে হাতে রুমাল দিয়ে বলল,
“মুখ মুছে নাও। ঝাল খেতে পারো না তো খেতে যাও কেন?”
ফারনাজ মুখ মুছে ফেলার পরপরই চশমা ফেরত পেল। মাথা উঁচু করে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুঠাম দেহের অধিকারী লোকটাকে দেখতে চায়ল। মুখে মাস্ক আর চোখে সানগ্লাস পরিহিত একটা লোক। ফারনাজ লম্বা শ্বাস টেনে বলল,
“আপনি কে? আপনার কন্ঠস্বর কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে।”
ভ্রু কুঁচকায় লোকটা। সানগ্লাস ভেদ করে দৃষ্টি বোঝা যায় না। আলতো হাতে তার মাথায় চাপড় মেরে বলে,
“মাথা মোটা কোথাকার!”
বলেই গটগটিয়ে হেঁটে ভীড়ে মিশে যায়। ফারনাজ তাকে আর খুঁজে পায় না। একটু পর আফিয়া ও সুমি ফিরে আসে। তাকে আশে পাশে তাকাতে দেখে জিজ্ঞেস করে,
“কি রে? কাকে খুঁজছিস?”
“আরে ওই লোকটাকে। ওই লোকটা না থাকলে আজ আমি ঝালের ঠ্যালায় চেঁচিয়ে পটল তুলতাম নিশ্চিত।”
সুমি তার দিকে আইসক্রিম এগিয়ে দেয়। বলে,
“এতো ঝাল খাবার দরকার কি ছিল?”
ফারনাজ আইসক্রিমে কামড় বসিয়ে বলে,
“কারণ ছিল। আমার মেজাজ এখন ভালো হয়ে গিয়েছে। আর রাগ লাগছে না।”
মৃদু হাসে তারা। ফারনাজের সকল কার্যক্রম উদ্ভট ধরনের।
—
“মিস দৃষ্টি!”
দৃষ্টি পিছু ফিরে তাকায়। মৃন্ময় কে দেখে মৃদু হেসে বলে,
“আসসালামু আলাইকুম, স্যার।”
সে জবাব দেয়। বলে,
“বাড়ি ফিরছ?”
“জি।”
“একটু পর যেও। লাইব্রেরী থেকে কিছু নোটস করে দেব, নিয়ে যাও।”
দৃষ্টি একটু ভাবে। পড়ালেখার বিষয় বলে আর মানা করে না। সম্মতি দেয়,
“ওকে স্যার।”
তারা লাইব্রেরী তে গিয়ে বসে। মৃন্ময় বিভিন্ন বই ঘেঁটে তাকে নোট করে দেয়। দৃষ্টি মনোযোগ দিয়ে দ্যাখে। মৃন্ময় মাঝে মাঝে আড় দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। এই মেয়েটার প্রতি ভালোলাগা কাজ করে তার। তাই তো সামনে বসিয়ে রাখার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। হঠাৎ মৃন্ময় বলে,
“ইউ আর লুকিং বিউটিফুল টুডে।”
দৃষ্টি বিব্রত বোধ করে। স্যারের থেকে এমন প্রশংসা সে আশা করেনি। জোর পূর্বক হেসে বলে,
“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।”
ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে। দৃষ্টি উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“আজ আমি আসি, স্যার। দেরি হয়ে গিয়েছে অনেক। বাড়িতে চিন্তা করবে।”
মৃন্ময়ও উঠে দাঁড়ায়। ঠোঁট প্রসারিত করে বলে,
“ঠিক আছে, যাও। বাকিটা নাহয় আগামীকাল শেষ করব?”
“ওকে স্যার।”
দৃষ্টি বেরিয়ে গেল। স্যারের দৃষ্টি অন্য রকম লাগে তার। এই মেডিকেলে দুইজনই ইয়ং স্যার আছে। একজন মৃন্ময় আহমেদ ও অপরজন আফরান ইততেয়াজ। দৃষ্টি বের হওয়ার পথে সতর্ক দৃষ্টি বুলায়। তবে আশেপাশে আফরানকে দেখতে পায় না। সে স্বস্তির শ্বাস ফেলে। ভাগ্যিস আশে পাশে নেই, নাহলে মৃন্ময় স্যারের সাথে তাকে দেখে না জানি কি কান্ড করত!
চলবে,
#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১১
পড়ালেখার মধ্যে ব্যাঘাত একদম পছন্দ নয় দৃষ্টির। ঘড়ির কাঁটা এগারোটা পার করেছে। এই অসময়ে কে তাকে স্মরণ করল? সে বিরক্ত চোখে ফোনের দিকে তাকাল। সেখানে জ্বল জ্বল করছে “লু’চু ডাক্তার” নামটি। দৃষ্টি অবাক হয় না। আফরান মাঝে মধ্যেই এমন সময়ে কল দিয়ে থাকে এবং হাজার রকম কথা বলে তার মাথা খায়। সে রিসিভ করে কানে ধরে। মৃদু স্বরে বলে,
“বলুন।”
ওপাশ থেকে একটু থেমে আফরান জিজ্ঞেস করে,
“কি করছিস?”
“পড়ছি তো, আফরান ভাই। আপনি কি এটা শুনতে কল দিয়েছেন?”
“না। আচ্ছা শোন?”
“হু শুনছি।”
“বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে?”
“হ্যাঁ সবাই ঘুম। আমি বাদে।”
“আর, আর তোর ওই জল্লা’দ বাপ? ঘুমিয়েছে?”
বাবার এমন সম্বোধন শুনে দৃষ্টি রেগে গেল। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল,
“দেখুন! বাবাকে উল্টা পাল্টা কিছু বলবেন না।”
“আচ্ছা বলব না। ঘুমিয়েছে কিনা বল।”
“হ্যাঁ ঘুমিয়েছে। আপনি এসব জেনে কি করবেন? আপনি কি হাসপাতালে নাকি বাড়িতে? বাড়িতে থাকলে ঘুমিয়ে পড়ুন।”
আফরান গম্ভীর কণ্ঠে ডাকে,
“দৃষ!”
দৃষ্টি একটু নড়েচড়ে বসে। আফরানের এমন গম্ভীর রূপ ও কন্ঠ সহজে দ্যাখা যায় না, শোনা যায় না।
“জি?”
“ব্যালকনির দরজা খোল।”
দৃষ্টি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“এই রাতে ব্যালকনির দরজা খুলতে যাব কেন? চোর ঢুকলে?”
আফরানের ভাবলেশহীন কন্ঠস্বর,
“আমি বলছি তাই। এক থেকে পাঁচ গুনব এর মধ্যে দরজা খুলবি।”
হতভম্ব দৃষ্টি ঠাঁই বসে রয়। হঠাৎ কেন দরজা খুলতে বলছে আফরান? সে বাধ্য হয়ে পড়ার টেবিল থেকে উঠে দরজা খোলে। নাহলে আফরান থামবে না। কানে ফোন ঠেকিয়ে বলে,
“খুলেছি। আর কিছু?”
“নাহ, আর কিছু করার দরকার নেই।”
আফরান দরজা দিল। বিস্ময়ে হতবাক দৃষ্টি হা করে চেয়ে রইল। তার সামনে স্বয়ং আফরান দাঁড়িয়ে আছে! বিশ্বাস হচ্ছে না তার। কম্পিত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“আ আপনি! মানে, আপনি এখানে কীভাবে এলেন?”
আফরান আরাম করে বিছানায় বসল। কপাল কুঁচকে বলল,
“তোর বাপটা ভীষণ কিপ্টে রে, দৃষ। বাড়ির ওপাশটা প্লাস্টার না করে রেখে দিয়েছে কেন? এটুকু করতে গেলে কি তোর বাপকে পথে বসতে হতো? আমার হাতের চামড়া চুমড়ি গেল সব। উফ্!”
দৃষ্টি এগিয়ে আসে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে,
“কই দেখি? আপনি কি পাইপ বেয়ে উঠেছেন? ও আল্লাহ্! যদি পড়ে যেতেন তাহলে কি হতো?”
আফরানের উভয় হাত থেকে চামড়া উঠে র’ক্ত বের হচ্ছে। দৃষ্টি দ্রুত ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এলো। বিছানায় বসে তার হাত খুব যত্ন সহকারে ড্রেসিং করতে লাগল। আফরান তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“পড়ে গেলে হাত পা ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যেতাম। লোকে বলত পেশেন্টের জায়গায় ডাক্তার নিজেই ভর্তি। আর তুই আমার বহুত সেবা যত্ন করতিস। খুব ভালো হতো।”
মলম লাগানো শেষে দৃষ্টি বক্স জায়গায় রাখে। মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,
“সত্যি খুব ভালো হতো। কিন্তু আমি মোটেও আপনার সেবা করতে যেতাম না। ঠেকা পড়েনি আমার।”
“তাহলে এভাবে চিন্তিত হয়ে মলম লাগালি কেন? আমি কি বলেছিলাম যে, আমার খুব জ্বলছে মলম লাগিয়ে দে? যেখানে মলম লাগানোর কথা সেখানে তো লাগাবি না?”
দৃষ্টি তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে বলে,
“আর কোথায় ব্যথা পেয়েছেন?”
আফরান বুকের বা পাশে হাত রেখে বলে,
“এখানে খুব জ্ব’লে রে। দিবি? মলম লাগিয়ে?”
দৃষ্টি ফোঁস করে শ্বাস ফেলে। তেজী কন্ঠে বলে,
“রাত বিরেতে আপনার মশকরা দ্যাখার ইচ্ছে নেই। চলে যান।”
“যাব না। যাব বলে কি পাইপ বেয়ে এতো দূর এসেছি? পাগলে কামড়েছে আমাকে?”
দৃষ্টি উত্তেজিত না হয়ে নিজেকে শান্ত করে। কোমল কন্ঠে বলে,
“আপনার আজ ডিউটি ছিল না?”
“ছিল তো। ওই ব্যাটার ঘাড়ে চাপিয়ে চলে এসেছি। আমার জিনিসে নজর দেওয়া মোটেও ভালো হবে না, তা হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে ছাড়ব।”
অতঃপর দৃষ্টির হাত ধরে টেনে নিজের পাশে বসায়। বিছানায় পা তুলে তার মুখোমুখি বসে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে,
“ওই শা’লা মৃন্ময় তোর দিকে কেমন করে তাকায় কেন, দৃষ? আমার একদম সহ্য হয় না।”
দৃষ্টি ভ্রু কুঁচকে বলে,
“ডাক্তারের মুখের কি ভাষা! তাছাড়া আপনিও তো তাকিয়ে থাকেন।”
নিজের কথাতে নিজেই বোকা বনে গেল সে। লজ্জা পেল মনে মনে, প্রকাশ করল না। আফরান শক্ত কন্ঠে বলে,
“আমার ভাষার কথা এখন বাদ। আমি আর ওই মৃন্ময় কি এক হলাম? আমি তো তোর দিকে একবার কেন হাজার বার.. এক মিনিট এক মিনিট! তুই দেখেছিস যে আমি তোর দিকে তাকিয়ে থাকি? তার মানে..”
দৃষ্টি চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। ধরে ফেলেছে। আফরান দুষ্টু হেসে বলে,
“তার মানে তুইও আমার দিকে তাকাস, দৃষ! ইশ্! তুই এমনটা করতে পারিস? তাই তো বলি ইদানিং আমার শরীর খারাপ লাগে কেন? তোর নজর লেগেছে আমার, দৃষ। আমার মতো সহজ সরল একটা ছেলের উপর তুই নজর দিতে পারলি?”
দৃষ্টি মুখ কুঁচকে বলে,
“আমি কোনো জ্বিন পরী না যে আমার নজর লাগবে। আর আপনিও কোনো সহজ সরল মানুষ নন।”
আফরান হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। থমথমে কন্ঠে বলল,
“আজ তুই লাইব্রেরীতে মৃন্ময়ের সাথে কি করছিলি?”
দৃষ্টি হকচকায়। আফরান তাহলে দেখে ফেলেছে? বলে,
“স্যার আমাকে কিছু নোটস করে দিচ্ছিলেন।”
সে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
“কলেজের এতো স্টুডেন্ট থাকতে তুই কেন? বোঝা আমাকে। তুই’ই কেন?”
“আমি জানি না।”
“বেশ। তোর জানাও লাগবে না। লাইব্রেরীতে দু ঘন্টা ছিলি। এখন আমার সামনে সারা রাত বসে থাকবি। এটা তোর শাস্তি।”
দৃষ্টি হতবাক। বিস্ফোরিত কন্ঠে বলে,
“আমার কি দোষ এখানে? আমি শাস্তি পেতে যাব কেন? আশ্চর্য!”
সে উঠে যেতে নিলেই আফরান হাত চেপে ধরে। শক্ত করে আকড়ে ধরে বলে,
“তোর শাস্তির প্রয়োজন আছে। সেটা এখন নয় পরে বুঝবি। এখন নড়াচড়া বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাক।”
দৃষ্টি আর পথ না পেয়ে মুখ কালো করে বসে থাকে। সে জানে এই লোক তার উদ্দেশ্য পূরণ হওয়ার আগে এখান থেকে যাবে না।
আফরান অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে। যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে দৃষ্টির মুখশ্রীর প্রতিটি অংশ, প্রতিটি কোণা। দৃষ্টি অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বসে। এভাবে তাকিয়ে থাকলে কি শান্ত হয়ে বসা সম্ভব? চোখ নিচে থাকলেও আফরানের প্রখর দৃষ্টির তোপে তার দেহ কেঁপে কেঁপে ওঠে। এভাবেই ঘড়ির কাঁটা বারোটা পেরোলো। এবার আফরান একটু নড়ে উঠল। পলক ফেলল চোখের। নিচু কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“তুই ভীষণ নিষ্ঠুর রে দৃষ! একটা নিরীহ মানুষ দেওয়াল টপকে, পাইপ বেয়ে তোকে দেখতে এলো! আর তুই একটু নাস্তা পানির জন্যও বললি না? বুঝেছি, সব তোর ওই কিপ্টে বাপের থেকে শিখছিস।”
দৃষ্টি বিরক্ত মাখা কন্ঠে বলে,
“বাবাকে নিয়ে এসব বলবেন না। আর এভাবে চোরের মতো বাড়িতে আসা কাউকে আমরা জামাই আদর করতে যাই না। হুহ!”
“ঠিক আছে। আমি সারা রাত না খেয়ে থাকি, আর সকালে অজ্ঞান হয়ে যাই। তারপর এখান থেকে আমাকে হাসপাতালে শিফট করিস। আর বাড়িতে খবর দিয়ে দিস, তোর বাপের একটুও খরচ হবে না।”
দৃষ্টি হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নেয়। উঠে দাঁড়ালে সে বলে,
“কোথায় যাস? শাস্তি বাকি এখনও।”
“উফ্! আপনি একটু আস্তে কথা বলুন। কেউ দেখে ফেললে বাড়ি মাথায় তুলবে। চুপ করে বসে থাকুন, আমি আসছি।”
সে ধীর গতিতে দরজা খুলে উঁকি দেয়। আশে পাশে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে দরজা চাপিয়ে দিয়ে যায়। আফরান ধপ করে শুয়ে পড়ল। সারাদিনে অনেক ধকল গেল। ক্লাস নিয়ে, রোগী দেখে, ওয়ার্ড ঘুরে সে শ্বাস নেওয়ার সময় প্রর্যন্ত পায়নি। তার উপর এতো কাজের মধ্যে মৃন্ময়ের নজর দৃষ্টির উপর দেখে র’ক্ত ছলকে উঠেছিল তার। সে অনেক আগে থেকেই লক্ষ্য করেছে, আজ তার হাতে নাতে প্রমাণ পেয়েও গেল। আফরানের জিনিসের উপর নজর দেওয়া! এর মাশুল মৃন্ময় কে গুনিয়েই ছাড়বে সে। তাই তো আজ শরীর খারাপের বাহানা দিয়ে মৃন্ময়ের ঘাড়ে নাইট ডিউটি চাপিয়ে দিয়ে এলো।
চলবে,