সেদিনও ছিলে তুমি পর্ব-০৫

0
2718

#সেদিনও_ছিলে_তুমি❤
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৫

১২.
কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। ভার্সিটিতে যাওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু এসব দেখে আর কোথাও যাওয়ার জন্য সাহস বা শক্তিটা পেলাম না। হোস্টেলের সেই অগোছালো, গুমোট ঘরটাতে মরার মতো ঘুমিয়ে রইলাম। বিকেলের দিকে ঘুমটা ছুটে গেলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম কামড়ের দাগগুলো দগদগে ঘা’য়ের মতো লাল হয়ে গিয়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্টোভে ভাতের হাড়ি চড়ালাম। একটা ডিমের অমলেট তৈরি করে খেয়ে ক্ষিধে মেটালাম।

হোস্টেল বলতে এটা একটা বাসা। খুব ছোট্ট পুরানো দিনের দোতলা একটা বাসাতে আমি আর শেফা একটা রুমে থাকি। শেফার বাসা ভার্সিটি থেকে একটু দূরে হওয়ায় আমার সঙ্গে থাকে। আর দোতলায় বাসার মালিক মানে একটা বুড়ো মহিলা থাকে। আমরা ওনাকে দাদী ডাকি, ওনার ছেলেমেয়েরা সবাই বড় বড় চাকরি করে। সবাই এই বাসাতেই একসাথে থাকে, খুব ভালো একটা পরিবার। যাইহোক, একা একা রুমের ভেতর দমবন্ধ লাগছিলো। তাই মোবাইল নিয়ে একটু বসলাম। কখন যে রাত হয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম না। এমন সময় শেফার ফোন এলো। আমি রিসিভ করতেই বলে উঠলো, ‘এই গাধী, কই তুই?’

—“বাসায়, কেন?”

—“আজ আসলি না কেন?”

—“কোথায়?”

—“ভার্সিটিতে। আমি তো বাসা থেকে এসেছিলাম, ভাবলাম তুইও আসবি। কিন্তু তুই তো এলিই না।”

—“ওহহ। আমার শরীরটা ভালো লাগছিলো না, তাই আসিনি। কেন? কোনোকিছু হয়েছে?”

—“হুম।”

—“কি?”

—“কাল বাসন্তী উৎসবের প্রোগ্রাম আছে ভার্সিটিতে। আর আমাদের ওই পলিটিশিয়ান বড় ভাই ওনি তোর খোঁজ করছিলো।”

আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, এই পলিটিশিয়ান লোকটা আবার কে, আমার ঠিক মনে পড়লো না। আমি শেফাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন বড় ভাই?’

শেফা ক্ষুব্ধ স্বরে বললো, ‘তুই চিনস না গাধি!’

—“আরে তুই বলবি তো। কত ভাই-ই তো আছে, আমার যিনি খোঁজ করছিলো ওনি কে?”

—“আদ্র ভাই। আই মিন তোকে ওইদিন বিচার করতে যে ভাইয়ের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।”

আমি চমকে উঠলাম। ‘এই লোক আমার খোঁজ কেন করবে? আমাকে আবার কোন নতুন শাস্তি দেওয়ায় পায়তারা করছে ওনি?’

শেফা বললো, ‘কিরে শুনছিস?’

—“বল।”

—“তুই আজ এতো চুপচাপ কেন? কথা বলতে কি ভাল্লাগছে না?”

—“এই তুই কাজের কথা বল। ওই লোক আমাকে খোঁজেছিলো কেন? কিছু বলছে তোকে?”

—“হুম। আসলে বাসন্তী উৎসবের সব দায়িত্ব তো ওনার উপরেই পড়েছে। তাই ওনি সব স্টুডেন্টদের কাজটাজ ভাগাভাগি করে দিয়েছেন। আর তোর কাজ হলো সবকিছুর হিসাব রাখা, ঠিকঠাক মতো ওনাকে পরে বুঝিয়ে দেওয়া। আমার কাছে সবার নামের লিস্ট দিয়ে দিয়েছেন। তুই কাল ওদের থেকে সব রসিদ জমা নিয়ে আদ্র ভাইকে হিসাব বুঝিয়ে দিবি। আমি ফোনে পাঠাচ্ছি ছবিগুলো।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘মানে? আমি এসব করবো কেন?’

—“আমি কি জানি? আদ্র ভাই বলে দিয়েছে।”

আমি বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিতে যাবো আর তখনই শেফা বললো, ‘শোন!’

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘বল!’

—“কাল সবাই বাসন্তী শাড়ি পড়ে আসবে। তুইও পরে আসিস।”

—“কিন্তু আমার তো এই রঙের শাড়ি নেই!”

শেফা বললো, ‘কি বলিস!’

—“হুম।”

—“তাহলে কি পরবি?”

—“জানিনা। লাল, নীল যা আছে ইচ্ছে হলে পরবো নইলে যা ইচ্ছা তা-ই পরবো। রাখি।”

বলেই ফোন রেখে দিলাম। এই ন্যাকামুর মানে হয়? যার বাসন্তী শাড়ি নেই সে কি পরে যাবে তার চিন্তা করলো না কেউ। যত্তসব!

১৩.
আজ রাতেও ঘুমানোর পর আমি কারো হাতের ছোঁয়া পেলাম গালে। কপালে কারো ঠোঁটের ছোঁয়া। আমি বুঝতে পেরেও উঠলাম না। এক ভয়ংকর ভীতি আমাকে গ্রাস করলো। চোখ খোলার সাহসটাও করলাম না। তবে কিছুক্ষণ পর কারো অস্তিত্ব টের না পেয়ে আমি চোখ খুলে তাকালাম, কখনো ঘরের লাইট অফ করিনা। সেই আলোতে চোখ খুলে দেখলাম, ‘একটা প্যাকেট রাখা! রুমে কেউ নেই। আমি ঝট করে উঠে দাঁড়ালাম। প্যাকেট খুলে হাতে নিয়ে দেখি একটা হলদে শাড়ি।’

কেউ কি করে জানলো আমার ঠিক এই শাড়িটাই দরকার? যাইহোক, কালকের শাড়ির ব্যবস্থা হয়ে গেলো। হাসলাম আমি। পরদিন যথাসময়ে রেডি হয়ে রওনা দিলাম ভার্সিটিতে।

১৪.
ভার্সিটিতে ঢুকলাম শেফার সাথে। পরণে সেই হলুদ শাড়িটা। কিছুক্ষণ ঘুরাফেরা করে পানি খাবার উদ্দেশ্যে ক্যান্টিনের দিকে যেতেই হঠাৎ আদ্রে’র সাথে দেখা। ওনি আমার পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই শাড়িতে পা বেঁধে উল্টে আমি আদ্রে’র উপর পড়ে গেলাম।

এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম, আদ্র’কে দেখে মনে হচ্ছে ওনি আমার চেয়ে দ্বিগুণ হতভম্ব! আমি অবাক এবং বাকরুদ্ধ! পুরো ভার্সিটির সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে রইলাম। আমার পিঠের যেখান থেকে শাড়িটা সরে গিয়েছিলো ঠিক সেখানেই অসভ্য আদ্র’ ওনার হাত দিয়ে আমাকে ধরে রেখেছেন। ইচ্ছে করছে ওনার চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে দিই। নিজেকে সামলে নিয়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম, সেদিনের অসভ্য ইতর ছেলেটা আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। আদ্র ছেলেটার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকাতেই ছেলেটি সে সরে গেলো। সবাই হাসাহাসি করছে, আদ্র’ ও উঠে দাঁড়ালো। ওনার হলদে-সোনালি পাঞ্জাবি ধুলোয় মাখামাখি। আমি আর সেখানে এক মুহূর্তও দাঁড়ালাম না। চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে থাকা শেফাকে নিয়ে সেখান থেকে চলে আসতে চাইলে আদ্র’ আমাদের দাঁড়াতে বললেন। তারপর আশেপাশে থাকা সবাইকে ধমকে সেখান থেকে চলে যেতে বললেন, শেফাও ভয়ে ভয়ে চলে গেলো।
সবাই চলে গেলে ওনি আমার উদ্দেশ্যে বললেন,

-“আচ্ছা, তুমি কি মেয়ে? এতো উড়নচণ্ডী দশা কেন তোমার? সবসময় লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি না করলে তোমার শান্তি লাগেনা?”

আমি কাঠ কাঠ গলায় বললাম, ‘আমার মোটেও উড়নচণ্ডী দশা হয়নি। আর লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি করলে আপনার কি সমস্যা? আপনি আমার উপর পড়লেন কেন?’

-“বাহ! বেশ তো বেশ পটর পটর করছো, শাস্তির কথাটা এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে! ওয়াও।”

-“দেখুন,আপনি আমায় অপমান করার চেষ্টা করছেন! আর শাস্তির কথা আপনার মুখে মানায় না, যে লোক মেয়েদের অসম্মান করতে ভুলে না তার সাথে আমার কথা বলতে ঘেন্না হচ্ছে।”

আদ্র গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে অবাক হয়ে বললো, ‘মানে? তুমি এসব কি বলছো, সুযোগের সদ্ব্যবহার মানে?’

আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম, ‘এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন সবকিছু? বাহ! আসলে বড়লোকের ছেলে বলে কথা। এদের কি আর সব মনে থাকে!’

-“মানে?”

আমি বিরক্ত চাহনি মেলে ওনার মুখপানে তাকালাম। বললাম, ‘এতো মানে মানে করছেন কেন আপনি! আপনি সাথে কথা বলার কোনো মুড নেই আমার। আমার সাথে করা ঘটনাগুলো মনে করুন, বুঝে যাবেন!”

ওনি বললেন, ‘কি করেছি আমি? তুমি আমায় অপমান করেছো আমি তোমাকে একদিন আটকে রেখেছি, আটকে রেখেছি বললে ভুল হবে। তুমি সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলে তাই আমি তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে গিয়েছি। দ্যাটস এনাফ।’

—“ওহহ তাই! তাহলে ভার্সিটিটা তো আপনার , আপনিই তাহলে থাকুন।”

ওনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘মানে?’

—“মানে আমি এখানে আর পড়বো না।”

—“পড়বেনা মানে?”

—“মানে আমি এখান থেকে চলে যাবো, এই ভার্সিটিতে আমি আর পড়বোনা। আপনি শান্তিতে থাকুন! আমার চেহারাও আপনার দেখতে হবে না!”

আদ্র’ কিছু না বলে গম্ভীর হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। সত্যিই আমি আর ওনাকে নিতে পারছিনা। বড্ড অসহ্য লাগছে। এখান থেকে আমি চলে যাবো, ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে অন্য কোনো কলেজে ভর্তি হবো। এ শহরেই আর থাকবোনা আমি।

১৫.
আমি আড়চোখে একবার আদ্র’কে দেখে নিলাম। বাই বলে চলে আসলাম। পেছনে ফিরে দেখলাম, ওনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি সেখান থেকে চলে আসলাম। স্টেজে নাচগান হচ্ছে, আমি শেফাকে অনেক খুঁজে একটা চেয়ারে বসারত অবস্থায় দেখতে পেলাম। দৌড়ে গিয়ে ওর পাশে বসে পড়লাম। ও বড়বড় চোখ করে আমার দিকে তাকাতেই আমি বললাম, ‘এদিকে না তাকিয়ে পারফরম্যান্স দেখ। একটা কথাও বলবিনা!’

বেচারি শেফা আমার কথামতোই চুপচাপ স্টেজে মনোযোগ দিলো! আর আমার মাথায় ঘুরছে ওখানে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা আদ্রে’র বিষন্ন চেহারা। ওফফ..এই লোকটার সামনেই কেন বারবার তার সাথে এমন ঘটছে?বারবার আমার সাথেই ওনার দেখা হয়। শেফাকে পর্যন্ত বলিনি আমি এখানে আর পড়বোনা! ইশ,কি বাজে পরিস্থিতি!

অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। ভার্সিটির মাঠ প্রায় খালি, সবাই চলে গিয়েছে। আমি সব হিসাব ঠিকঠাক করে একটা ছেলেকে দিয়ে আদ্রে’র কাছে পাঠিয়ে দিলাম। তারপর শেফাকে নিয়ে চলে আসলাম। শেফা বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। আর আমি ভার্সিটি গেইটের সামনে রিকশার জন্য ওয়েট করছি। হেঁটে যেতে মোটেও ভালো লাগছেনা। হঠাৎ আদ্র’ এসে আমার হাত ধরে টেনে ভার্সিটির ভেতর নিয়ে গেলো। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ওনি শক্ত গলায় বললেন,

-“কি? পগার পার হওয়ার মতলব করছো নাকি?”

আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘আমাকে যে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে এমন তো নয়, আমি সব কাজ শেষ করে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার আর এখানে থাকার কোনো মানে হয়না!’

ওনি রেগে বললেন, ‘চুপ। একদম চুপ।’

তারপর কি একটা ভেবে বললো, ‘ চলো তোমাকে রিকশা করে দিই।”

আমি কঠিন গলায় বলে উঠলাম, ‘লাগবে না। আমি একাই বাড়ি ফিরবো।”

-“তুমি কি আমার উপর রাগ করেছো নাকি?”

-“আজব!আমি রাগ করবো না কি করবো না সেটার কৈফিয়ত আপনাকে কেন দেব? প্লিজ আপনি অন্যপথ ধরুন, আমার পিছু ছাড়ুন। গেট এনাদার ওয়ে!”

ওনি রেগে গেলেন। প্রচন্ড জোর গলায় নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললেন, ‘তুমি কিন্তু আবারও বাজে বিহেভ করছো মেয়ে!’

-“আপনার আজাইরা প্যাঁচাল বন্ধ হলে যান এখান থেকে।”

ওনি রেগে আমাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলেন।
আমার কপালে চুমু দিয়ে বসলেন। আমি কি রিয়েকশন করবো বুঝলাম না। ওনাকে একটা ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলাম। এ সময় দরজায় এসে দাঁড়ালো ভিসি স্যার, আমি অবাক হয়ে গেলাম!

👉”মুমিন বান্দার ওপর যে কষ্ট-ক্লেশ, রোগ-ব্যাধি, দুশ্চিন্তা ও পেরেশানি আসে, এমনকি যে কাঁটা তার দেহে ফোটে, এসবের মাধ্যমে আল্লাহ তার গুনাহ গুলো ক্ষমা করে দেন।”

~ [বুখারি, হাদিস নং- ৫৬৪১]

চলবে…..ইনশাআল্লাহ!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে