#সেই_তুমি?
#পর্ব_০২
#Tabassum_Kotha
এই বাড়িতে আমি আর তুর্য ছাড়া আরো অনেকেই ছিল,, দেখে মনে হচ্ছে এরা সবাই সার্ভেন্ট। কিন্তু এতোগুলো মানুষ এখানে ছিলো তাহলে একটা মানুষও আমাকে বাঁচালো না কেনো? সবগুলো মানুষ আমার সাথে এতো বড় অন্যায় হতে দিলো, কেউ একজনও বাঁধা দিলো না? প্রশ্নটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তখনই তুর্য আমার হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দিলো।
— It’s time to go babe.
— একদম উল্টা পাল্টা নামে আমাকে ডাকবেন না।
— তো কি নামে ডাকবো?
— আমার নাম হীর। এক মিনিট, আপনি আমাকে ডাকবেনই বা কেনো?
— কেনো আমি তোমাকে ডাকবো না কেনো?
— আপনার আমার সাথে যা প্রয়োজন ছিল সব তো শেষ। আমার সর্বস্ব তো লুটে নিয়েছিনই, এখন আমাকে ডাকার কি দরকার?
তুর্য কিছু বললো না, আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
তুর্য আহমেদ চৌধুরী ওরফে রকষ্টার তুর্য, বাংলাদেশের সিঙ্গিং সেনসেশন, ইউথ আইকন। অল্প কয়েক বছরেই নিজের গান গাওয়ার প্রতিভা দিয়ে জয় করে নিয়েছে সকলের মন। এমন না যে আমরা একে অপরকে চিনি, তবে উনাকে চিনে না এমন মানুষ খুব কম আছে। মনে মনে সেই দিনটাকে ঘৃণাভরে স্বরণ করছি যেদিন এই তুর্যর সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল। প্রায় ১৫ দিন আগে মামাতো বোন রাহির সাথে একটা কনসার্টে গিয়েই এই মানুষরূপী পশুটার সাথে দেখা হয়েছিল। প্রথম দেখায় একবারের জন্যও বুঝতে পারি নি, লোকটা এতোটা নিচ। বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পরছে। হয়তো তুর্য কয়েকবার আমার দিকে ফিরে তাকিয়েছিল কিন্তু আমার এই পশুর মুখটা দেখার আর ইচ্ছা নাই।
আমার বাড়ির ঠিক সামনে এসে গাড়িটা থামলো, তার মানে সবকিছু প্রিপ্ল্যানড্ ছিল। আমার সব তথ্য আগে থেকেই নিয়ে নিয়েছে। গাড়ির দরজা টা খুলে একছুটে বাড়ির ভিতর ঢুকে পরলাম। হয়তো পিছন থেকে দু একবার ডেকেও ছিল। কিন্তু তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।
বাড়িতে ঢুকতে রাহি আটকে ধরলো।
— এতো দেরি কেনো? আর এটা কার শাড়ি?
কি উত্তর দেবো? মাথায় কিছু আসছে না। কোনোরকম অসুস্থতার বাহানা বানিয়ে ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম। এখন যেনো আমার কষ্ট আর বাঁধ মানছে না। মরে যেতে ইচ্ছে করছে,, নিজেকে অপবিত্র মনে হচ্ছে। গায়ের শাড়িটা টেনে খুলে আগুন লাগিয়ে দিলাম, কেনো এই কাজ টা করলাম জানি না। কিন্তু মনে হচ্ছে শাড়িটার জায়গায় তুর্যকে জ্বালাতে পারলে অনেক শান্তি পেতাম। ওয়াশরুমে গিয়ে ঝর্ণার নিচে বসে কাঁদছি আমি। আজকে আম্মু আব্বুর কথা ভীষন মনে পরছে। আজ আম্মু বেঁচে থাকলে আমার মনের কষ্টটা একটু হলেও বুঝতো, সবটা তার সাথে শেয়ার করতে পারতাম। মামা-মামি, রাহি, রায়ান সবাই অনেক ভালো কিন্তু মা তো মা ই হয়।
রায়ানের কথা মনে পরতেই আরো জোরে কান্না পাচ্ছে। কি থেকে কি হয়ে গেলো। মানুষটা আমাকে কতো ভালোবাসে আর আমি কি না। ছিঃ! নিজের উপর নিজেরই ঘৃণা হচ্ছে। যদি রায়ান সবটা জানতে পারে, তখন কি হবে? রায়ান কি আর আমাকে মেনে নেবে? হ্যাঁ মেনে নেবে রায়ান আমাকে অনেক ভালোবাসে কিন্তু এটাতো রায়ানকে ঠকানো হবে। আমি কিভাবে রায়ান কে ঠাকাবো?? আর ভাবতে পারছি না। কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে গেছে। জানি না কতো সময় ধরে এভাবে কাঁদছি আর ভিজছি। আরো কিছুক্ষণ ভিজার খুব ইচ্ছা হচ্ছে। হয়তো আমার কলঙ্ক ধুয়ে যাবে এই পানির সাথে।
দরজায় বারবার নক পরছে, মামি আর রাহি ডাকছে। না আর বেশিক্ষণ এভাবে থাকে যাবে না। ওরা সন্দেহ করবে। ঝটপট জামা টা পাল্টে বেরিয়ে পরলাম। কোনোরকম একটু খেয়েই দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পরলাম।
ব্যালকোনিতে দাড়িয়ে আছে তুর্য হাতে গিটার, আর গলায় করুণ সুর।
??
Ye Dil Tanha Kyun Rahe
Kyun Hum Tukdon Mein Jiye
Ye Dil Tanha Kyun Rahe
Kyun Hum Tukdon Mein Jiyein
Kyun Rooh Meri Ye Sahe
Main Adhoora Jee Raha Hoon
Hardum Ye Keh Raha Hoon
Mujhe Teri Zaroorat Hai
Mujhe Teri Zaroorat Hai
Andheron Se Tha Mera Rishta Bada
Tune Hi Ujaalon Se Waaqif Kiya
Ab Lauta Main Hoon Inn Andheron Mein Phir
Toh Paaya Hai Khud Ko Begaana Yahaan
Tanhaayi Bhi Mujhse Khafaa Ho Gayi
Banjaron Ne Bhi Thukra Diya
Main Adhoora Jee Raha Hoon
Khud Par Hi Ik Sazaa Hoon
Mujhe Teri Zaroorat Hai
Mujhe Teri Zaroorat Hai…
??
গানটা গাইতে গাইতেই দুচোখ ভিজে গেছে তুর্যর। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আপন মনে। পুরো আকাশটা মেঘলা, পূর্ণিমা তীথি হওয়ার পরেও আজ আকাশের কোনো আনন্দ নেই। যেনো আকাশও আজ তুর্যর সাথে কাঁদতে চায়, ওর কষ্ট কমাতে চায়। প্রিয়জনকে হারানো কষ্ট তবুও বুকে নিয়ে বেঁচে থাকা যায় কিন্তু প্রিয়জনের ঘৃণার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াও অনেক সুখের।
” কেনো হীর কেনো? কেনো দাও আমাকে এতোটা কষ্ট, আর কতো কষ্ট সহ্য করবো বলো? আর কতো যন্ত্রণা দিতে চাও। প্রতিটা মুহূর্ত তুমি আমার সামনে কিন্তু তোমাকে ছোঁয়ার অধিকার নেই। আমার কলিজা তুমি তবুও তোমায় ভালোবাসার অধিকার নেই। তুমি চাইলে সারাজীবন তোমার অপেক্ষা করতে পারি কিন্তু তোমাকে,,,,
আজকে তুমি আমাকে চরিত্রহীন বলেছো! মানুষরূপী পশু আরো না জানি কতো কি! তুমি আমাকে যতো পারো ভুল বোঝো। তবুও আমি কিছুই বলবো না। আচ্ছা হীর, একটাবারও কি আমার কথা তোমার মনে পরে না? একটাবারও কি আমার কাছে আসার জন্য তোমার মন ছুঁটে যায় না? বলো না হীর, প্লিজ বলো।” কথাগুলো বলতে বলতেই তুর্য কান্নায় ভেঙে পরে। তখনই বৃষ্টি শুরু, ঝুম বৃষ্টি। হয়তো তুর্যর কষ্ট আকাশও সহ্য করতে না পেরে কান্নায় ভেঙে পরেছে।
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় আমার। প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে, শরীরটাও বেশ গরম। চোখে ঝাপসা লাগছে সবকিছু। বেশ ভালো রকমেরই জ্বর এসেছে মনে হচ্ছে। ড্রয়ার থেকে একটা জ্বরের ঔষধ খেয়ে খাটে বসে আছি। দিনে যা কিছু ঘটেছে সবটা মাথায় ঘুরছে। সবকিছু পুনরায় একবার চিন্তা করতে গেলে একটা কথা আটকে যায় মাথায়। তুর্য তখন বলেছিল “তার প্রতিটি স্পর্শ বৈধ।” এই কথাটার কি মানে ছিল। আমার শরীরে তার স্পর্শ বৈধ কিভাবে হবে। রায়ান কেউ আজ পর্যন্ত নিজেকে স্পর্শ করতে দেই নি আর এই লোক! ছিঃ! এই লোকের কথা আমি কেনো ভাবছি? যার চরিত্র খারাপ তার মুখের কথার কি সত্যতা আছে।
দরজায় কড়া নড়ছে, নিশ্চিত রায়ান দেখতে এসেছে আমাকে। কিন্তু আমি এই মুখ কিভাবে দেখাবো রায়ানকে? আমার যে তার সামনে যাওয়ার সাহস নেই। কি বলবো আমি তাকে?
— হীর দরজাটা খুলে দে না আর কতোক্ষণ দাড়িয়ে থাকবো? রাহি বললো তোর শরীর খারাপ খুল আমি দেখবো তোর কি হলো?
— রায়ান ভাই তুমি যাও তো এখান থেকে আমাকে ঘুমোতে দেও, (কান্না আটকে কথা গুলো বললাম)
— এমন করছিস কেনো? খুল না প্লিজ। একবার তোকে দেখেই চলে যাবো।
— এতো দেখার কি আছে যাও তো ঘুমাও।
— খুলবি না?
— না।
— এইতো আর দুইদিন তারপর দরজা কিভাবে লাগিয়ে রাখিস আমিও দেখবো আর তোর ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দেবো।
রায়ানের কথায় যেনো আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম দুইদিন পর আমার আর রায়ানের বিয়ে। এখন আমি কি করবো। আমি পারবো না রায়ানকে ঠকাতে। আমি এখন অপবিত্র হয়ে গেছি, আমি পারবো না রায়ান কে বিয়ে করতে। খুব কান্না পাচ্ছে কিন্তু জ্বরের মাত্রা অনেক বেরে গেছে তাকিয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে,,, কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি খেয়াল নেই।
বেশকিছুক্ষণ বৃষ্টিতে ভেজার পর রুমে চলে এলো তুর্য। রুমের লাইট অন করে রুমের দেয়াল ভর্তি লাগানো হীরের ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে তুর্য।
“তুমি আমাকে ভুল বুঝো না হীর, আমি কখনই তোমার ক্ষতি চাই নি। কিন্তু আজ আমি সত্যি নিরুপায় ছিলাম। আমি বেঁচে থাকতে কি করে তোমাকে অন্যকারো হতে দিতাম বলো। তুমি যে আমার নিশ্বাসে আটকে আছো। তোমাকে হারালে আমি নিশ্বাসও নিতে পারবো না। জানি না তোমাকে কিভাবে বোঝাবো কিন্তু ওয়াদা করছি তোমার প্রতি করা সব অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবো। আমিও তোমার উপর অনেক অন্যায় করেছি, তার পিছনের সব কারণ তোমাকে বোঝাবো। তুমি শাস্তি দিলে মাথা পেতে নেবো। কিন্তু তোমাকে হারাতে পারবো না। আমার স্পর্শে আজ তোমার ঘৃণা হচ্ছে তাই না হীর? জানো হীর, খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকের বা পাশটা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। আমি তোমার কোনো সর্বনাশ করি নি হীর।” কথাগুলো বলতে বলতে তুর্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
সকালে ঘুম থেকে উঠতেই দেখি প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে। জ্বরের কারণেই এমনটা হয়েছে বুঝতে পারছি। ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হতেই জানতে পারলাম বিয়েটা পিছিয়ে দিছে। কারণ রায়ান ভাইয়ার জরুরি ভিত্তিতে ঢাকার বাইরে যেতে হয়েছে অফিসের কাজে। বিয়ের তারিখ পিছানোর কথাটা শুনে কেনো জানি না ভালোই লাগছিল। যাক অন্তত আরো কিছুদিন সময় পেলাম বিয়েটা কিভাবে ভাঙবো সেটা ভাবার।
তুর্যকে সকালে ওর ম্যানেজার হসপিটালে নিয়ে যায়। তিনদিন তুর্য হাসপাতালে ভর্তি থেকে বাসায় এসেই কাউকে ফোন করলো।
— হীর কোথায়? কেমন আছে এখন?
—–
— আমি নিরুপায় ছিলাম। জানি আমার অপরাধ ক্ষমার যোগ্য নয় কিন্তু হীরকে বাঁচানোর জন্য আমি সব করতে পারি।
—–
— আমি দেখছি ব্যাপারটা।
আজ ৭ দিন হয়ে যায় কলেজে যাই না। কিন্তু আজ কিছুতেই বাড়িতে থাকতে পারলাম না মামি আর রাহির চাপে। জোর করে কলেজে পাঠিয়ে দিলো। অন্যমনষ্ক হয়ে ক্লাসরুমের বারান্দা দিয়ে হাটছিলাম তখনই কেউ আমার বাম হাতে হেচকা টান দিয়ে একটা খালি ক্লাস রুমে নিয়ে গেলো। গঠনার আকষ্মিকতায় আমি পরে যেতে নিলো আমাকে বুকে জরিয়ে নিলো সামনে থাকা লোকটা। লোকটা আমাকে এতো শক্ত করে ধরে রেখেছে যে আমার নাক বন্ধ হয়ে রয়েছে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কোনো উপায় না পেয়ে শরীরে যতো শক্তি ছিল সব দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সামনে থাকা লোকটা কে সরিয়ে ঠাসস্ করে গালে একটা চড় বসিয়ে দিলাম। সামনের লোকটাকে দেখে আমার হাত পা কাঁপা শুরু হয়ে গেলো। তুর্য আমার সামনে দাড়িয়ে আছে। অগ্নিচক্ষু নিয়ে, যেনো এখনি চোখ থেকে আগুন বের হবে আর আমি জ্বলে যাবো।
চলবে..