সূর্যস্নান পর্ব-০৮

0
969

#সূর্যস্নান
#পর্ব_০৮
#Nishat_Tasnim_Nishi

—-“বিয়ের তিন মাসের মধ্যেই বিধবা বিষয়টা আমার জন্য চাট্টিখানি ব্যাপার ছিলো না। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি আমরা উনাদের দেশের বাড়ীতে গিয়েছিলাম। আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা সেখানে যাওয়ার পর হয়েছে। চিন্তাও করতে পারবে না কী কী’র সাথে সম্মুখীন হয়েছিলাম। নিদ্রের লাশসহ সরাসরি আমরা উনাদের বাড়ীতে গিয়েছিলাম। আমি তখনও জানতাম না উনার গ্রামের বাড়ী কোথায় প্লাস উনাদের পরিবারে কে কে আছে। তো এটা আমার একটা দূর্বলতা ছিলো।

উনাদের বাড়ীর সামনে নামতেই দেখলাম বাড়ী টা বড় বাড়ী মানে অনেক ঘর রয়েছে বাড়ীটাতে।আমার হুশ তখন ঠিক ছিলো না,মাথা টা বারবার ঘুরাচ্ছিলো,বমি বমি ভাব হচ্ছিলো। সারাদিন না খাওয়ার কারনে এমন হচ্ছিলো, তো হয়েছে কী শাশুড়িআম্মু আমাকে দেখে দ্রুত এসে ধরলেন,উনার চোখে তখনও পানি। উনি আমাকে ধরেই অল্প বয়সী এক মহিলাকে ইশারায় ডেকে বললেন,আমাকে ঘরে নিয়ে যেতে।

শ্যাম বর্ণা মহিলাটি জ্বী,আপা বলে আমাকে নিয়ে চারচালা টিনের ঘরে প্রবেশ করলেন। ঘরের শেষ প্রান্তের রুম টা তে নিয়ে আমাকে বসালেন। একটুপর সাদা কাপড় পরা এক মহিলাকে নিয়ে প্রবেশ করলেন সেই শ্যাম বর্না মহিলাটি। মহিলা টি এসে আমাকে বললেন,,

—–“শরীরের সব অলংকার খুলো..!!”

উনার কথা আমি বুঝেও বুঝলাম না,উনি এসব কেনো বলছে, ঠিক বুঝে উঠেনি আর বুঝবাই কী করে এর আগে তো এসবের সম্মুখীন হই নি। আমার নড়চড় না দেখে উনি নিজে নিজে আমার কানের স্বর্ণের ছোট দুলগুলো খুলে ফেললেন,,গলার পাতলা গড়নের হার টাও খুলে ফেললেন। আমার নাকের কাছে এসে উনি অবাক হয়ে বলললেন,,

–“নাকের নাক ফুল কই?”

সাথে সাথে আমি নাকে হাত দিলাম,নাকফুল নেই। হঠাৎ মনে পড়লো আমি তো নাকে নাকফুল ই দেই নি এবং নাকে ছিদ্র ও করি নাই। উনি ভালো করে তাকাতেই বিষয় টা দেখে ফেললেন। উনি তখন এমন বিদঘুটে রিয়েকশন দিয়েছিলো যে আমি চমকে উঠেছিলাম। এদিকে দরজার বাহিরে ভীড় জমানো কয়েকশ মহিলা এসব দেখে ফুসুর ফুসুর করতে লাগলো।

কথাটা সেকেন্ডেই পুরো বাড়ী হয়ে গিয়েছিলো। এর মধ্যেই ভিড় ঠেলে প্রবেশ করলেন বৃদ্ধ এক মহিলা সাথে শাশুড়িআম্মু। শাশুড়িআম্মু আসতেই আমি উনার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকালাম,কারন আমি নিজেও তখন বিষয়টি বুঝতে পারি নি। বৃদ্ধ মহিলা টি ঠকঠক আওয়াজ করে আমার কাছে আসলেন, আমাকে এসেই অনবরত বকাবকি করতে লাগলেন,মূলত উনি নিদ্রের মৃত্যুর পুরো দোষ টা আমার নাকফুল না পরার কারন হিসেবে দায়ী করলেন। আমি তো ভীষণ রকম অবাক হয়েছিলাম,একটা নাকফুল কারো জীবন-মৃত্যুর সাথে সম্পর্কিত কীভাবে হতে পারে?

আমি চুপ করে ছিলাম কারন আমার শাশুড়িআম্মু প্রথমেই ইশারা দিয়ে আমাকে চুপ করতে বলেছেন। শাশুড়িআম্মু তখনও অনেক স্ট্রং ছিলেন,মানে আমার থেকেও বেশি।আমার ধারনা ছিলো উনি হয়তো আমার থেকেও বেশি ভেঙ্গে পড়বে। অবস্থা বেশি বেগতিক দেখে উনি ভাঙ্গা গলায় বলে উঠলেন,,
—“আম্মা,হেগো বিয়া তো আর আয়োজন কইরা হয় নাই।হেরা তে জানতো না,মাইয়া ডা তো শহরে থাকতো এর লাইগা এইসব জানতো না। ”

বুঝলাম কান্না করার কারনে উনার গলা ভেঙ্গে গিয়েছে,,তখন বৃদ্ধ মহিলা হুংকার দিয়ে বললেন,,
—“কী কও এসব? শহরে থাকতো বইলা হে নাক ফুড়াইবো না!তুমি এ অপয়া মাইয়া ডারে ক্যান আমার সোনার টুকরা নাতিরে বিয়া করাইলা?মাইয়া ডা বিয়া করতেই আমার নাতি রে খাইয়া ফেলছে,! আমার এত সুন্দর রাজপুত্তুর লাগান নাতি ডা আর বাইচা নাই এই মাইয়ার লাইগা,,,!!তুমি পন্ডিতি কইরা আমাগো রে না জিজ্ঞাইয়া ক্যান এডা করলা?”

আমার শাশুড়ি আম্মু মাথা নিচু করে চুপ করে রইলেন,তখন পাশ থেকে তখনকার শ্যাম বর্ণা মহিলা টি বললো,, “আম্মা,এইসব পরে আলোচনা কইরেন। আগে নতুন বউ রে আগে,,,”

এটুকু বলেই মহিলাটি থেমে গেলেন কারন তখন বৃদ্ধ মহিলাটি চোখ রাঙানি দিয়েছিলো। বৃদ্ধ মহিলাটি শ্যাম বর্ণা মহিলাটির দিকে গাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,
—“বড় বউ তোমারে পন্ডিৎ ই করতে কই নাই,!”

ব্যাস উনি চুপ করে গেলেন,এরপর উনি আরো কয়েক ঘন্টা ভাষণ দিয়ে চলে গেলেন। সাদা কাপড় পরা মহিলা টি আমাকে নিয়ে টিউবয়েলের কাছে গেলেন, চারপাশে পর্দা দেওয়া, আমাকে সেখানে গোসল করতে বলা হয়। আমি তো ব্যাপারটা একদম ই বুঝি নি,আমি কাপা কাপা গলায় বললাম,,
—“এখানে,গোসল করতে হবে?”

উনি ইশারায় হ্যা বললেন,,এক বালতি পানি ভরে দিলেন উনি। সাদা কাপড় পরা মহিলাটি আমাকেও সাদা কাপড় পরতে বলায় আমি কিঞ্চিৎ চমকালাম। উনি কাঠকাঠ গলায় বললেন যে চারমাস দশদিন নাকি আমাকে এভাবে সাদা কাপড় পরতে হবে,আর পর্দা করে থাকতে হবে। অর্থ্যাৎ কোনো পুরুষের সাথে দেখা দিতে নাকি পারবো না। উনার নিয়মকানুন শুনে আমি শুধু চুপ করে রইলাম। এর ভেতর নিদ্রকেও নাকি কবর দেওয়ার জন্য তৈরী করে ফেলেছে। এতক্ষণ নিদ্রের কথা মষ্তিষ্কে সুপ্ত অবস্থায় ছিলো,এখন আবার নাড়া দিয়ে উঠলো। রুমের ভেতর বসেই হু হু করে কেঁদে দিলাম।

নিদ্রের নিস্তেজ দেহের দিকে তাকাতেই কলিজা টা আলাদা হয়ে গেছে এমন অনুভব করলাম। এ অনুভূতি টা যে কতটা কষ্টের ছিলে আমার জন্য সেটা আমি আর আমার সৃষ্টিকর্তা জানে। নিদ্রের লাশ যখন নেওয়ার জন্য তৈরী করছিলেন তখনই আমি সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম।

ঔ দিনটা এতটা অভিশাপময় ছিলো আমার জন্য সেটা বলে বুঝাতে পারবো না। এরপর শুরু হলো আরেক জ্বালা,তার আগে উনাদের পরিবারের সদস্যের কথা বলি। এতক্ষণ যাকে বৃদ্ধ মহিলা বলছিলাম উনি হলেন, নিদ্রের আম্মুর শাশুড়ী মানে আমার দাদীশাশুড়ী,উনার তিন ছেলে দুই মেয়ে। বড় ছেলে বিদেশ থাকে উনার বউ হলেন ওই শ্যাম বর্ণা মহিলা, উনাদের দুই মেয়ে এক ছেলে।নিদ্রের আব্বু হলেন এ বাড়ীর মেঝো ছেলে,উনাদের কথা তো বলেইছি। আর এ বাড়ীর ছোট ছেলেও বিবাহিত, উনাদের একটা মেয়ে আর একটা ছেলে আছে। এর থেকে বেশি জানি না এসব শুনেছি আমার সাথে থাকা ওই সাদা কাপড় পরা মহিলাটির থেকে।

তো স্বাভাবিক ব্যাপার যে বাড়ীর বড় নাতী/ছেলের আগে বিয়ে হয়।কিন্তুু এখানে হয়ে গিয়েছে উল্টো,আমার জেদের কারনেই তো আদ্র ভাইয়ার আগে আমার বিয়ে হয়ে যায় আর নিদ্রের সাথে। এটা নিয়ে পুরো পরিবার আবার গোল মিটিং করেছে, সাথে আমাকে ফ্রিতে কথা শুনানো তো আছেই। যা বুঝলাম তা হলো এ পরিবারের সবাই দাদীশাশুড়ীকে ভয় পায়। উনি যা বলেন তা ই হয়,উনার কথার নড়চড় কেউ হয়তো করে না।দুদিনেই সবাই আমাকে নিয়ে নানান -ঝামেলা করেছে,তৃতীয়দিন আমার পরিবারে ফোন দিয়ে বলা হয়েছে যে এখানে আসতে,আমার বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে।

বাবা তখন সরাসরি বলেছেন যে ওর বিষয় নিয়ে আমার সাথে কোনো যোগাযোগ করবেন না,ওকে বলুন ওর জেদের ফল ভোগ করতে। ব্যাস আবার শুরু হয়ে গেলো আরেক অশান্তি। উনারা যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে আমার সাথে ব্যবহার করতে লাগলেন। আমার শাশুড়িমার নিজের ও কোনো হুশ নেই,পুত্র শোকে উনি তো পাগল প্রায়।

এখানে তিন টা দিন আমার কাছে বিষের মতো ছিলো,রাতে এক ফোঁটা ঘুমাতে পারতাম না নিদ্রের কথা ভেবে। সারা রাত কেঁদে কেঁদে পার করতাম। চারদিনের দিন আমার বাবা এসে উপস্থিত হন,বাবাকে দেখে তো আমি চমকে গিয়েছিলাম সাথে পুরো পরিবার। বাবা সরাসরি আমার শাশুড়ির কাছে গিয়ে বললেন,”আমি আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে এসেছি।” তখন দাদীশাশুড়ি এগিয়ে এসে বলেছিলেন সেদিন আসতে বলেছিলাম তখন তো আসেন নি এখন কেনো এসেছেন।জবাবে বাবা বলেছেন আমি শুধু আমার মেয়েকে জিদের ফল বুঝাতে চেয়েছিলাম,আর তা এ দুদিনে নিশ্চয় ও ভালো করে বুঝেছে। পর্দার আড়ালে থেকে আমি সব শুনছিলাম,!

নিদ্রের দাদী তখন সরাসরি বলেছেন যে উনারা আমাকে চারমাস দশদিন হওয়া ছাড়া দিবেন না। কিন্তুু বাবা নাছড়বান্দার ন্যায় জেদ করতে লাগলেন,এক পর্যায়ে আমি আড়াল থেকে বললাম যে “আমি যাবো না বাবা।”

বাবাকে সেদিন ওখান থেকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম,জানি বাবা প্রচুর কষ্ট পেয়েছে। এ নিয়ে দুবার বাবার অবাধ্য হলাম,!

ওখানে থাকার সাপ্তাহ খানেক না হতেই শশুড়বাবা সিলেট চলে আসলেন। সরকারী চাকরী টা আবার কোনোরকম ফিরে পাওয়ার জন্য,! আমি এটুকু শুনেছি এ বাড়ীর কাজের মেয়ে রেহানা থেকে যে সবসময় আমার সাথে থাকে।

ও বলেছে নিদ্রের আব্বু নাকি অনেক এপ্লিকেশন, ফর্মালিটি আর সিনিয়রদের আন্তরিক রিকুয়েস্ট করার কারণে নাকি চাকরী তে আবার জয়েন হন। আমি অবশ্য পুরো কাহিনী জানি না,তাই এটা সত্যি না মিথ্যা বলতে পারবো না।

আবারো এতটুকু বলে থামলাম। গলা টা পূর্বের ন্যায় শুকিয়ে আসছে,আমি আবারো সামনের ব্যক্তিটি অর্থ্যাৎ শুভাকাঙ্ক্ষীকে এক গ্লাস পানি দেওয়ার জন্য ইশারায় বললাম। উনাকে শুভাকাঙ্ক্ষী বলছি কারন উনি একটু আগে আমাকে বাঁচিয়ে ছিলেন।এ কাহিনী পরে বলছি।

উনার হাত থেকে পানিটুকু ঢকঢক করে খেয়ে ফেললাম। পানির গ্লাস টেবিলে রাখতেই উনি কৌতুহল নিয়ে বললেন,, “তারপর?”

আমি বললাম,,
—-“তারপর আমি চারমাস দশদিন সেখানে সাদা কাপড় পরে বন্ধী ঘরে ছিলাম। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় কী ছিলো জানো?

.
.
.
.
.
.
চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে