সূর্যস্নান পর্ব-০৬

0
1016

#সূর্যস্নান
#পর্ব_০৬
#Nishat_Tasnim_Nishi

উনারা বুঝতেছে না দেখে রাগ দেখিয়ে চলে আসলাম।আসার সময় বলে এসেছি আমি যদি বিয়ে করি তাহলে নিদ্রকেই করবো।
সিড়ি দিয়ে নিচে যাচ্ছিলাম তখন দেখলাম আরুশি উপরে উঠতেছে।আমাকে দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলো তখন আমি ওকে ডাক দিলাম। ও না দাড়িয়ে চলে যাচ্ছিলো দেখে আমি গিয়ে ওর পথ আটকাই।
আমি ওকে বললাম,,,

—“কী হয়েছে এমন করছো কেনো?”

ও রাগ দেখিয়ে বললাম,,
—“কেমন করছি?”

—“আরে,রেগে যাচ্ছো কেনো?”

—“তো কী করবো নাচবো?আমার ভাইকে আমাদের থেকে দূরে সরিয়ে শান্তি পাও নি?”

–“মানে,কী বলছো এসব?”

–“কী মনে করেছো?আমি জানবো না?আর কেউ জানুক আর না জানুক আমি ঠিকই জানি যে কেনো ভাইয়া এখান থেকে সবসময়ের জন্য ঢাকা চলে গিয়েছে।সব তোমার জন্য তাই না?”

আমি বিষ্ময় নিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করতেই ও ঝাড়ি মেরে চলে যায়। বিষয়টা নিয়ে তদন্ত করতেই জানতে পারি যে, আয়ানকে ঢাকায় উনার ফুফুর বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন।

আয়ান নাকি ওখানেই থাকবে,আর এখানে আসবে না। কারন হলো আয়ান নাকি উনার পরিবারকে বলেছে যে আমাকে বিয়ে করতে পারবে না, উনার নাকি রিলেশন আছে। আর এ নিয়ে উনার বাবার সাথে তর্কাতর্কি করে চলে গিয়েছেন। কথাগুলো শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম,উনি আমার জন্য পরিবারের সাথে ঝগড়া করেছেন। কেনো যেনো মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো,অন্তরের গভীর থেকে উনার জন্য শ্রদ্ধা চলে এসেছে।

আচ্ছা আরুশি এমন করলো কেনো? না,বিষয়টা ওকে জিজ্ঞেসস করতেই হবে। এ কথা ভেবে ওকে খুজার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম,অনেক খুঁজাখুজির পর দেখলাম ও ছাদে রেলিং এর পাশে দাড়িয়ে কার সাথে যেনো কথা বলছে।

আমি ধীর পায়ে পিছনে যেতেই শুনলাম ও কাউকে চেঁচিয়ে বলছে,”

—“তুই সিগারেট খাচ্ছিস?ছিঃ,ভাইয়া শুধু মাত্র ওই একটা মেয়ের জন্য নিজের লাইফ শেষ করে দিবি?”

আমি আরো কাছে যেতেই দেখলাম,আরুশি ভিডিও কলে আয়ানের সাথে কথা বলছে। ফোনের ভেতর আয়ান সিগারেট খাচ্ছে,আর আরুশিকে বুঝাচ্ছে। এটা দেখতেই আমার চোখ ছলছল করে উঠলো। আয়নের নজর আমার উপর পড়তেই উনি তাড়াহুড়ো করে সিগারেট টা পিছনে নিয়ে ফেলে দিয়ে বললেন,,

—“নূপুর!”

তখনই আরুশি পিছনে ঘুরে আমার দিকে তাকালো,আমাকে দেখেই ও ফোন টা কেটে দিলো।আমি কোনেরকম বললাম,,

—“আয়ান!”

আমার মুখে আয়ানের নাম শুনে আরুশি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো,ও আমাকে যা নয় তা বলতে লাগলো।আমি চুপচাপ সব হজম করলাম। আরুশির বকাবকির মাঝখানেই আমি বললাম,,

—-“আয়ান ভাইয়ার নাম্বার টা দিবে,আমি একটু কথা বলবো।”

আরুশি এবার আরো কড়া কথা শুনাতে লাগলো।আমার কোনো জবাব না পেয়ে ও চলে গেলো আর আমি ওখানেই বসে পড়লাম। না চাইতেও নিজের প্রতি খারাপ লাগতে লাগলো। আমার কারনেই তো সব হচ্ছে?আচ্ছা,আদৌ কি এসবের জন্য আমি দায়ী? খারাপ লাগাটা কেমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে।

বিকালে নিদ্রের ঘরে গিয়ে আমি বড়সড় ধাক্কা খেলাম। নিদ্র চেয়ারে বসে আছে,ওর মাথা ভর্তি রাশি রাশি চুলের একটা চুলও নেই,ও পুরো ন্যাড়া হয়ে আছে। আমাকে দেখেই ও দ্রুত টুপি মাথায় পরে নিলো,ও ভেবেছে আমি দেখি নি। কিন্তুু আমি ঠিকই দেখে নিয়েছি। আমি ওর সামনে গিয়ে দাড়ালাম,ভালো করে উনার মুখপর দিকে তাকালাম। উনি কেমন পাংশুটে হয়ে গিয়েছেন,মুখ টা কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে।অনেক দিন উনাকে ভালো করে দেখিও নি,আমি স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেসস করলাম,,

—-“আপনি ন্যাড়া হয়েছেন,কেনো?”

উনি থতমত খেয়ে গেলেন। আমাকে কাহিনী বানিয়ে বলতে লাগলেন যে চুলে নাকি চুইংগাম আটকে গিয়েছিলো। কথাটা আমি বিশ্বাস করতাম যদি না টেবিলের উপর মেডিকেলের রিপোর্ট না দেখতাম। আমি সন্দেহ নিয়ে রুপোর্ট টা হাতে নিতেই উনি রিপোর্ট সরিয়ে নিলেন।আমি তাকাতেই বললেন এটা নাকি উনার মায়ের। আমি উনার সাথে জোরাজুরি করে রিপোর্ট হাতে নিতেই দেখলাম ওখানে স্পষ্ট লিখা নিদ্রের ব্রেইন ক্যান্সার। ছলছল নয়নে উনার দিকে তাকাতেই মাথা নিচু করে ফেললেন।

–“ওহ,আচ্ছা,তাহলে এটাই কারন ছিলো আমাকে রিজেক্ট করার পিছনে?”

–“আরে বিষয়টা,,,”

–“হ্যা বা না বলুন।”

উনি চোরের মতো মাথা নাড়ালেন।এরপর উনি সব বললেন,, আর আমি একের পর এক শক খেতে লাগলাম। উনি যে আমাকে ফাকি দিয়ে এ সপ্তাহের মধ্যে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাবেন সেটাও বলেছেন। ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে উনি চলে গিয়েছেন,উনি সব বলেছেন আর কেঁদেছেন।কখন যে আমার চোখ দিয়ে টপটপ পানি পড়তেছিলো টেরই পেলাম না। কোনো এক অজানা কারনে উনাকে জড়িয়ে ধরলাম,খুব কাঁদলাম। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো,এতটা কষ্ট মনে হয় এর আগে কখনও হয় নি। উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলেছেন,,

—-” ভালোবাসা কেনো এমন হয়?যখন দরকার তখন পাই না,আর যখন দরকার নেই তখন পাই। জীবন এত সুন্দর কেনো?এর আগে এত রঙ্গিন লাগে নি, যেদিন জেনেছি তুমি আমাকে ভালোবাসো সেদিন থেকে রঙ্গিন লাগছে। আমি না তোমার সাথে বাঁচতে চাই,খুব করে বাঁচতে চাই। আমার না খুব শখ ছিলো তোমার সাথে ছোট্ট একটা সংসার করবো,এত এত বাচ্চাকাচ্চা পালবো। তুমি ওদের জ্বালায় কেঁদে দিবে।আচ্ছা শুনো আমি যদি না থাকি তাহলে তুমি এত এত বাচ্চাকাচ্চা পালবা, বুঝেছো? সবসময় হাসিখুশি থাকবা।মনে রাখবা রাতের আকাশে যে তারা টা সবচেয়ে বেশি জ্বলজ্বল করবে সেটাই আমি। তুমি সে তারার দিকে তাকিয়ে আমাকে মনে করবে। আর শুনো যখন সে তারার সামনে যাবে তখন হাসিখুশি থেকো,তোমার কষ্টভরা মুখ দেখলে আমারও তো কষ্ট হবে। তাই আমার সামনে হাসবে,আর সেজেগুজে যাবা।”

উনি এমন হাজারো কথা বলতে লাগলেন,আমি নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছিলাম আর সব শুনছিলাম।এ প্রথম উনাকে কাঁদতে দেখেছি,না হয় উনি তো সবসময় হাসিখুশিই থাকেন।সচরাচর উনাকে আমি কাঁদতে দেখি নি।
কোনো জবাব দেই নি,কাঁদুক না, কেঁদে মনটা হালকা করুক। আর তো কখন এমন আবদার না করতে পারে, শুনিই না সব আবদার। কেনো এত কষ্ট হচ্ছে,কেনো জীবনে এত ট্রায়াঙ্গেল,কেনো এত পরীক্ষা।

এরপর সেদিন রাতে অনেক কাহিনীর পর নিদ্রের সাথে আমার বিয়ে হয়। সে কাহিনী না হয় বাদই দিলাম। পুরো পরিবারের সাথে যে কতটা যুদ্ধ করেছি সে খবর আমিই জানি। আমার বাবা-মা তো রেগে আগুন।মা তো আমাকে থাপ্পর ও দিয়েছিলেন। আমার জেদের প্রতি আমি অটুট ছিলাম দেখে উনারা চলে গিয়েছিলেন। যাওয়ার সময় বলেছিলেন আমি যাতে উনাদের বাবা-মা না বলি। কষ্ট হচ্ছিলো খুব কষ্ট হচ্ছিলো তবুও মুখ ফুটে কিছু বলিনি। আমি আমার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিদ্রকে বিয়ে করেছিলাম। উনার পরিবারের মনের অবস্থা আর নাই বললাম,,বাবা-মা উনাদের এত এত কথা শুনিয়েছিলেন যে আমারই কান্না চলে এসেছিলো।

সে রাতে আমি উনাদের বাসাতেই ছিলাম,উনার পাশে বসে খুব কেঁদেছিলাম। উনি আমাকে বারবার বলেছে,,

—“এখন কাঁদতেছো ভালো কথা পরে কিন্তু কাঁদতে পারবে না।”

যত সময় যাচ্ছিলো উনি ততই দূর্বল হয়ে যাচ্ছিলেন,,শেষ রাতে উনার অবস্থা আরো খারাপ লাগছিলো। আমি শাশুড়িআম্মুকে গিয়ে ঢেকে নিয়ে আসলাম। উনারা সবাই মিলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন সাথে আমিও গেলাম। ডাক্তার এসে বললেন যে উনার উপর নাকি আজ বেশিই মানসিক চাপ পড়েছে তাই উনার অবস্থা খুব একটা ভালো না। ডাক্তার দ্রুত বিদেশে কন্টাক্ট করলেন। উনাকে আজকেই বিদেশে ট্রান্সফার করবেন, তখন প্রায় সকাল হয়ে গিয়েছে। ডাক্তার বলেছে আমাদের হাতে দু ঘন্টা সময় আছে কে যাবো আর কে থাকবো ডিসাইড করতে। কাঁন্নার কারনে আমি ঠিকমতো কথাও বলতে পারতেছিলাম না,বারবার সবগুলো কথা জড়িয়ে আসছিলো। নিদ্রের আম্মু তো কাঁদার জন্য কথাও বলতে পারতেছিলেন না,উনি এত বেশি কান্না করছিলেন যে হসপিটালের নার্স রা এসে উনাকে সামলাচ্ছিলেন।

.
.
.
.
.
চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে