#সুতোয়_বাঁধা_জীবন
লেখনীতে – তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – এক
-‘আমার বাবা তো নেই, স্যার।’
পাঁচ বছরের ছোট্ট রুহানের মুখে এমন একটা হাহাকারজনিত বাক্য শোনে হতভম্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল উষাদ। প্রতিবার এ্যাক্সামের আগে অভিভাবকদের ডেকে এনে স্কুল কর্তৃপক্ষ একটা মিটিংয়ের আয়োজন করে। এই মিটিংয়েই আজ ছাত্রছাত্রীদের বাবা-মাকে আসতে বলা হয়েছিল। সব ছাত্রছাত্রীদের বাবা-মা আসলেও রুহানের বাবা-মা দু’জনের মধ্যে কেউ-ই আসেনি। কেন আসেনি এটা জানতেই রুহানের কাছে প্রশ্ন রেখেছিল উষাদ। প্রতুত্তর যে এমন হৃদয় বিদারক হবে তা তো তার জানা ছিল না। সে হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠে জানতে চাইল,
-‘কোথায় তোমার বাবা?’
-‘মাম্মাম সবসময় বলে, বাবা আকাশের তারা হয়ে গেছে।’
বাক্যটা উষাদকে বোকা বানিয়ে দিল নিমিষেই। সে এই স্কুলে জয়েন করেছে বছর চারেক আগে। প্লে ওয়ানের শ্রেণী শিক্ষক হওয়ার সুবাদে অভিভাবকদের ডেকে আনার দায়িত্বটা তার কাঁধেই ছিল। নিজের সবটুকু চেষ্টা নিংড়ে দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পিছনে শ্রম দেয় সে। সবাইকে ভালোভাবে পড়ানো, বুঝানো, সাপোর্ট দেয়া সবটাই করে। এজন্য ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরাও তাকে ভীষণ ভালোবাসে। উষাদ আবারও রুহানকে বলল,
-‘তাহলে তোমার মাম্মামকে নিয়ে আসলেই হতো।’
-‘মাম্মাম তো ব্যস্ত। আমি সকালে বলেছিলাম, আজ পেরেন্টস্ মিটিং আছে, স্কুলে আসতে। মাম্মাম বলল, তার অফিসে জরুরী মিটিং। তাই আসতে পারবে না।’
-‘বাড়িতে আর কেউ নেই?’
-‘সোনামা, নানু, মামা-মামী, পিকলু ভাইয়া, মৌমি আপু সবাই আছে।’
এখানে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষার চর্চাও হয় খুব। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের সব ধরনের শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে মানুষের মতো মানুষ করার উদ্দেশ্যেই এখানকার স্যার-ম্যাডামরা এত ধৈর্য্য, এত চেষ্টার মাধ্যমে নিজেদের দায়িত্বটুকু পালন করে থাকেন। উষাদ এবার জানতে চাইল,
-‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তোমার ডায়রীতে একটা ছোট্ট নোট লিখে দেব, এটা তোমার মাম্মামকে দেখাবে। মনে থাকবে?’
-‘ওকে স্যার।’
-‘এখন যাও। মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করো।’
অফিস-রুমে বসে রুহানের মায়ের নম্বর খুঁজে বের করে বেশ কয়েকবার সেই নম্বরে ডায়াল করল উষাদ। ওপাশে রিং হলো ঠিকই, কিন্তু কেউ কল রিসিভ করল না। গুটিকয়েক চিন্তার ভাঁজ পড়ল তার কপালে। সন্তানকে নিয়ে এই মায়ের এত হেয়ালি আচরণ কেন? তার চিন্তিত ভাব দেখে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম নওশীন আরা খানম বললেন,
-‘মিসেস রুদিতাকে কল করছেন?’
-‘জি ম্যাম।’
-‘কল ধরেননি?’
-‘হতে পারে, ব্যস্ততা বেশি।’
-‘আমি মাঝেমধ্যে অবাক হয়ে ভাবি, রুহানের আম্মু কোনোদিন স্কুলে কেন আসেননি! সেইযে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দায়িত্ব শেষ করলেন, এরপর আর খোঁজ নেই। কতবার কত মিটিং হলো, অথচ উনি অনুপস্থিত। একটু গভীরভাবে ভাবলেই গা’ছাড়া একটা ভাব ওনার মধ্যে লক্ষ্যে করা যায়।’
উপরনিচ মাথা নেড়ে উষাদ বলল,
-‘বাচ্চা যেহেতু ওনার, খোঁজ রাখা ওনারই দায়িত্ব-কর্তব্য। আমাদের দায়িত্ব গার্ডিয়ান অবধি খবর পৌঁছে দেয়া। সন্তান ওনারা কীভাবে লালন-পালন করবেন, কীভাবে বাচ্চার টেককেয়ার করবেন, সেটা ওনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এই বিষয়ে আমাদের কথা বাড়ানো অনুচিত ম্যাম।’
-‘আমি অকারণে কথা বলি না, সেটা আপনি জানেন স্যার। রুহানের দিকে খেয়াল করে দেখবেন, অন্য বাচ্চাদের তুলনায় ও একটু চুপচাপ। এই বয়সের বাচ্চারা স্বভাবতই বেশি চঞ্চল, দুরন্ত ও ভীষণ আমোদে মেজাজের হয়। শান্তশিষ্ট স্বভাবটা বাচ্চাদের জন্য বেমানানই।’
প্রিন্সিপাল ম্যাডামের এই কথাটা অযৌক্তিক নয়। উষাদ নিজেও এটা খেয়াল করেছে। টিফিন পিরিয়ডে রুহান একা একাই খায়। বন্ধুদের সাথে খুব একটা হৈ-হুল্লোড় করে না। একবার সব ছাত্রছাত্রীদেরকে নিজেদের পরিবারের একটা ছবি আঁকতে বলা হয়েছিল। সবাই বাবা-মা, ভাই-বোন মিলে ছবি আঁকলেও রুহানের আঁকা ছবিটা ছিল অদ্ভুত। তিনটে মানুষের মধ্যে বাবার ছবি আঁকলেও সেটা ছিল আবছা, মায়ের ছবি তার থেকে বেশ খানিকটা দূরে। আর তার নিজের ছবির জায়গায় এঁকেছিল, একটা ছোট্ট বাচ্চার হাতে ভিডিওগেম ও গালভরা চোখের পানি। এইটুকু উষাদকে নাড়িয়ে দিয়েছিল সেদিন। খুব বেশি মাথা ঘামায়নি সে। তবে নিয়মিত এটা দেখত, ছুটির পর রুহানের খালামণি অথবা তার নানু এসে তাকে নিয়ে যান। অথচ কোনোদিন রুহানের মাকে স্কুলের আঙিনায় দেখা যায়নি। সে অন্যমনস্ক মন নিয়ে বলল,
-‘আপনি ওর বিষয়টা এত গভীরভাবে দেখছেন কেন ম্যাম?’
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম চিন্তিত স্বরেই বললেন,
-‘আমি ভাবছি, ও কোনোভাবে মানসিক আঘাত পাচ্ছে কি-না! কিংবা ওর মায়ের সাথে ওর বন্ডিং ঠিকঠাক কি-না। দেখুন, এই বয়সের বাচ্চাদের সবার আগে বাবা-মাকে পাশে প্রয়োজন। বাচ্চাদের সুস্থ থাকার, হাসিখুশি থাকার মাধ্যমই বাবা-মা। প্রকৃতপক্ষে বাবা-মা ছাড়া, ভালো বন্ধু আর কেউ হতে পারে না।’
দীর্ঘশ্বাসকে গিলে নিল উষাদ। মা ও বাবা একত্রে না থাকলে সন্তান যে দিনরাত ভরানদীতে হাবুডুবু খায়, সেটা সে ছাড়া আর কে জানে! মেকী হাসির মাধ্যমে নিজের জীবনের দুঃখ ভারাক্রান্ত অধ্যায়টুকু আলগোছে আড়াল করে নিয়ে বলল,
-‘ঠিক বলেছেন ম্যাম।’
ঠকঠক শব্দে অফিস-রুমের দরজায় আওয়াজ হলো। এরপর শোনা গেল, ‘ম্যে আই কাম ইন?’ উষাদ চোখ বাড়িয়ে দেখল, তার দিনের খুশি ও রাতের শান্তি, তার আদর ও ভালোবাসার একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু যে, সে দাঁড়িয়ে আছে। চোখমুখে ফুটে উঠল, একরাশ আনন্দ ও সুখ। বলল,
-‘ইয়েস্, কাম ইন।’
ছোটো ছোটো পা ফেলে ভেতরে প্রবেশ করল উমামা। উষাদের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
-‘উমা বলছে, সে কিছু খেতে চায়। সি ইজ ভের্যি মাচ্ হাংরি।’
মেয়ের ফিসফিস শোনে শব্দ করে হেসে ফেলল উষাদ। হাতের কাজ ফেলে উঠে দাঁড়াল। বলল,
-‘তাইতো, বাবাই তো ভুলেই গিয়েছিল, তার প্রিন্সেসের খাওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। স্যরি মামণি।’
-‘ইট’স ওকে বাবাই।’
-‘প্রিন্সেস কি রাগ করল দেরী হওয়াতে?’
উমামা মিষ্টি হাসি দিয়ে দু’দিকে মাথা নেড়ে না বুঝাল। উষাদ ঝটপট মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে অফিস-রুম ত্যাগ করতে যাবে, তখন প্রিন্সিপাল ম্যাম পিছন থেকে বললেন,
-‘আপনি খুব ভালো এবং সৎ একজন বাবা হতে পেরেছেন।’
উত্তরে শুধু হাসিটা ফেরত দিল উষাদ। তারপর মেয়েকে নিয়ে ক্যানটিনে চলে এলো। বাইরের এই ফাস্টফুড স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হওয়াতে বয়স্ক মায়ের ওপর সংসারের বাড়তি চাপ দিতে পারে না উষাদ। তাই বাড়ি থেকে নিজেই রান্না করে নিয়ে আসে। বাবা-মেয়ে একসাথে বসে খায়। খেতে বসে একগাল হাসিতে, টুকরো টুকরো গল্প দিয়ে ক্লাসের সব বন্ধুবান্ধবদের কথা বলে যাচ্ছিল উমামা। উষাদ মেয়েকে খাওয়াতে গিয়েই খেয়াল করল, ক্যানটিনের একটা কর্ণারের টেবিলে খাবার রেখে, একা একা চেয়ারে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে রুহান। তার চেহারায় যে ব্যথাবেদনা লুকানো, তা যে কাউকে ছুঁয়ে যাবে নিমিষেই। কোথা থেকে যেন একগাদা মন খারাপের মেঘ এসে জমা হলো মনে। সে গলা বাড়িয়ে ডাকল,
-‘রুহান, এইদিকে এসো।’
আচমকা আওয়াজে খানিকটা চমকাল রুহান। পরপরই ছুটে আসল টিফিনবাটি হাতে নিয়ে। উষাদ বলল,
-‘আমাদের পাশে বসো।’
উমামাকে দেখে মিষ্টি করে হেসে রুহান বলল,
-‘আমি কি এখানে বসতে পারি উমা?’
উমামা কাঁধ নাচিয়ে হেসে বলল,
-‘অফকোর্স।’
একই শ্রেণীতে পড়ার সুবাদে দু’জনের মধ্যে টুকটাক কথাবার্তা হলেও সখ্যতা নেই খুব একটা। রুহান সবসময় একা একা থাকতে পছন্দ করে। সবার সাথে খুব বেশি মেলামেশা বা ভাব-বিনিময় হয় না তার। সেই হিসাবেই সে উমামার পাশে বসার জন্য অনুমতি চাইছিল। অনুমতি পেয়ে ভয়মিশ্রিত মন নিয়েই বসল। টিফিনবাটি খুলে খাবার খেতে শুরু করল। উষাদ তাকে মনোযোগ দিয়ে নোটিশ করে বলল,
-‘বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে আসো?’
-‘জি স্যার।’
খেতে খেতে জবাব দিল রুহান। উমামা উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে বলল,
-‘তাই? কে দেয়, তোমার মা?’
রুহান মন খারাপের সুরে বলল,
-‘না। সোনামা।’
-‘সোনামা কে?’
-‘আমার খালামণি। আমি সোনামা বলে ডাকি।’
-‘তুমি তোমার নানুবাড়িতে থাকো?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘তোমার মা কী করে?’
-‘চাকরি করে।’
-‘আর বাবা?’
-‘নেই।’
-‘ওমা! কোথায়? নেই কেন?’
-‘আকাশে।’
রুহানের এই কথায় উমামারও মন খারাপ হয়ে গেল। সে-ও বেদনামাখা মলিনমুখে বলল,
-‘আমার মা-ও আকাশে।’
দু’জনার এই টুকরো টুকরো কথা শোনে দু’জনকেই মনোযোগ দিয়ে দেখছিল উষাদ। যত্ন করে দু’জনের মুখেই খাবার তুলে দিল সে। খেয়াল করল, এইভাবে আদর করে খাওয়ানোতে রুহানের চোখেমুখে অনাকাঙ্ক্ষিত বিস্ময় ও সুখ নেমে এসেছে। আশ্চর্য! একটা বাচ্চা ঠিক কতটা একা হতে পারে? খেতে খেতে দু’জনই দু’জনার ভীষণ প্রিয় হয়ে গেল। টিফিনের নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলে উমামা বলল,
-‘বাবাই, আমি রুহানের সাথে ক্লাসে যাই?’
সম্মতি জানিয়ে দু’জনার কপালেই চুমু খেল উষাদ। বলল,
-‘ঠিক আছে, যাও।’
দরজা অবধি একসাথে এগিয়ে গেল দু’জনে। আচমকাই ফিরে এলো রুহান। উষাদের কানের কাছে মুখ নামিয়ে ভয়মিশ্রিত গলায় বলল,
-‘আপনি অনেক কিউট।’
***
ছুটিরপর ক্লাস শেষ করে উমামা ও রুহান দু’জনেই মাঠের খোলা অংশে ছোটাছুটি শুরু করল। অফিস-রুমের সব কাজ গুছিয়ে উষাদ বাইরে বের হয়ে দেখল, দু’জনে তখনও ছোটাছুটি করছে। ততক্ষণে সব ছাত্রছাত্রীরা স্কুল থেকে ফিরে গেছে নিজেদের বাড়িতে। অভিভাবকরা এসে নিজেদের মানুষ নিজেরা বুঝে নিয়েছেন। রুহানকে এতক্ষণ অবধি স্কুলের ক্যাম্পাসে দেখে উষাদ বলল,
-‘তুমি এখনও যাওনি?’
-‘বাসা থেকে কেউ আসেনি তো স্যার!’
স্কুলের মূল গেটের দিকে দৃষ্টি দিল উষাদ। এখনও কেউ আসার নাম নেই। সব স্যার-ম্যাডামরাও চলে যাওয়ার পথ ধরেছেন। অথচ রুহানের নানু বা খালামণি দু’জনের কেউ-ই এসে উপস্থিত হোননি। সে উমামাকে নিয়ে রওনা দেবে এক্ষুণি। কিন্তু বাচ্চা ছেলেটাকে একা ফেলে চলে যাবে? ভাবনারত চেহারা নিয়েই রুহানকে বলল,
-‘চলো, আমরা একটু অপেক্ষা করি। যদি কেউ পনেরো মিনিটের মধ্যে আসে, তাহলে তো ভালো। আর যদি না আসে, আমি তোমাকে পৌঁছে দিব। বাসার ঠিকানা জানো?’
-‘জি স্যার। জানি। সোনামা মুখস্থ করিয়েছে।’
বাহ্! এইটুকু বাচ্চার বাসা নম্বর মুখস্থ! শোনে খুশি হলো উষাদ। স্কুলের আঙিনা পেরিয়ে যাত্রী ছাউনির নিচে ফাঁকা বেঞ্চে বসল। দু’জনকে দু’পাশে নিয়ে হাসিঠাট্টার গল্প জমাল। অল্প একটু সময়ে রুহান নিজের চিরচেনা আচরণ ও প্রকাশভঙ্গী থেকে বাইরে বেরিয়ে আসলো। সে এমনভাবে উষাদ ও উমামার সাথে মিশে গেল, যেন দু’জনেই ওর কত চেনা। গল্পের ফাঁকে, উমামার জেদ ও বায়নায় দু’জনের হাতে দুটো আইসক্রিম ধরিয়ে দিল। যদিও রুহান প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে আইসক্রিম হাতে নিয়েছে, তবুও মুখে তুলতে পারছে না। তার চেহারায় একটা ভয় ভয় ছাপ লক্ষ্মনীয় ছিল। উষাদ সেটা খেয়াল করে বলল,
-‘কী ভাবছ রুহান? তুমি কি আইসক্রিম পছন্দ কোরো না?’
-‘ভীষণ। আমার তো খুবই পছন্দের এটা। কিন্তু…।’
-‘কিন্তু কী?’
-‘কিছু না স্যার। খাচ্ছি।’
উপরের কাগজটা সরিয়ে প্লাস্টিকের ছোট্ট চামচ দিয়ে মাত্রই আইসক্রিম মুখে তুলতে যাচ্ছিল রুহান, তারমধ্যেই ছোঁ মেরে কেউ আইসক্রিমটা নিয়ে নিল। নিমিষেই ছুঁড়ে ফেলল সেটা রাস্তায়। সবটুকু আইসক্রিম পড়ে গেল সড়কে। ঘাবড়ে গিয়ে পাশ ফিরে তাকিয়ে ভয়ে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রুহান। উষাদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে দেখল, সামনে থাকা নারীমূর্তিকে। রেগে গিয়ে বলল,
-‘আশ্চর্য! ওর মুখের খাবার এইভাবে কেড়ে নিলেন কেন?’
নারীমূর্তিটা জ্বলজ্বল চোখে তাকাল। তারপর রুহানকে দেখল। কাঁধের ব্যাগটা টান মেরে নিয়ে গাড়ির পিছনের সিটে ফেলল। একহাতে রুহানকে টেনে নিয়ে এগোতে লাগলেই উষাদ বলল,
-‘এটা কেমন আচরণ? কে আপনি? একটা বাচ্চার সাথে এরূও ব্যবহার করতে পারেন না। জ্ঞান-বুদ্ধি নেই না-কি আপনার?’
নারীমূর্তিটা কয়েক সেকেন্ডে রুহানকে গাড়ির পিছনের সিটে বসিয়ে কড়া চোখে তাকাল। ভয়ে নিজের জায়গাতেই জড়োসড়ো হয়ে বসে রইল রুহান। উষাদ রীতিমতো শকড! কে এই মেয়ে? রুহান-ই বা চুপ কেন? পরিচিত কেউ ওর? কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই নারীমূর্তিটা তার সামনে এসে আঙুল দিয়ে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
-‘লিসেন, রুহান আমার সন্তান। আমি ও’কে পেটে ধরেছি। আমার বাচ্চার সাথে আমি কেমন ব্যবহার করব, সেটা নিশ্চয়ই আপনার কাছ থেকে শিখতে হবে না! আপনি বরং এটা শিখে রাখুন, ঠাণ্ডাজনিত রোগ যাদের আছে, তাদেরকে অতি আহ্লাদ দ্যাখিয়ে আইসক্রিম খাওয়াতে নেই। আপনি অপরিচিত, অপরিচিত হয়েই থাকুন। আমার বাচ্চার প্রতি অতি আদিখ্যেতা দেখাতে আসবেন না।’
মিসেস রুদিতা রাহা! এমন? অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে খুবই বাজেভাবে নাকমুখ কুঁচকে নিল উষাদ। এই নারী যে কেমন মা সেটা বোঝা হয়ে গেছে তার। সে একবার রুহানের দিকে তাকাল, আরেকবার রুদিতার দিকে। এরপর বলল,
-‘অফকোর্স আমি অপরিচিত। কিন্তু বাচ্চাদের সাথে কীরূপ ব্যবহার করতে হয় এটা আমি জানি। এখন গ্রীষ্মকাল। চারপাশে প্রচণ্ড গরম। এই গরমে দু’একটা আইসক্রিম বাচ্চাদের খুব একটা ক্ষতি করবে না। বাচ্চা আপনি একা পালছেন না। আমিও বাচ্চা লালন-পালন করেছি। এবং আমি এ-ও জানি, কখন তাদের মনের ওপর কীসের প্রভাব পড়ে। তাই আপনাকে একটা ছোট্ট সাজেশন দিয়ে যাচ্ছি। বাচ্চার শারিরীক দুর্বলতা দেখার আগে, তার মানসিক দুর্বলতা দ্যাখুন। তার মনে কী চলে, কী সে চায়, সেটা বুঝুন। এরপর ট্রিটমেন্ট দিন। দেখবেন, বাচ্চাটা হাসছে। একটা বাচ্চার সুস্থতা কিন্তু তার হাসি-ই। বাচ্চা যদি হাসতে না জানে, তবে…।’
রুদিতা হাত বাড়িয়ে উষাদকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
-‘আপনার লেকচার, অন্য কোথাও গিয়ে দিন। আমার সামনে না। জীবনে অনেক লেকচার শুনতে শুনতে এই অবধি এসেছি। এসব এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে, অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়ার অভ্যাস আমার আছে।’
-‘তাই বলে একটা বাচ্চার সাথে এরূপ আচরণ! এটা ওর মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলছে না? ক্ষতিটা তো আপনার বাচ্চারই হচ্ছে।’
-‘যথেষ্ট বলেছেন, এবার থামুন! নিজের বাচ্চার কথা ভাবুন। আমার বাচ্চার জন্য আমি-ই যথেষ্ট।’
মুহূর্তেই গাড়ির পিছনের সিটে বসে ডোর আটকে দিয়ে চিলের মতো উড়ে গেল গাড়িটা। উষাদ এমন জঘন্য মানসিকতার মানুষ বোধহয় আজ দ্বিতীয়বার দেখল! মনে মনে একগাদা গালি দিল রুদিতাকে। ভাগ্যিস এমন মা তার মেয়ের হয়নি। তার আগেই উপরওয়ালা উমামাকে মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করেছেন। পৃথিবীতে আরও কত রঙের ও রূপের মানুষ যে আছে, একমাত্র আল্লাহ্-ই ভালো জানেন! সে রুদিতাকে নিয়ে এত বেশি মাথা ঘামাল না আর। উমামাকে নিয়ে একটা ট্যাক্সিক্যাব ভাড়া করে বাড়ির দিকে রওনা দিল। বিড়বিড় করল,
-‘এমন আজিব কিসিমের মানুষ কোথা থেকে এলো এই পৃথিবীতে? কেন এলো? এদের উদ্দেশ্য কি? সবাইকে কেন ঘুরেফিরে সে-ই বিপাশার মতো হতে হবে!’
***
চলবে…