সুখ সন্ধানী পর্ব-১০

0
729

#সুখ_সন্ধানী
পর্ব-১০
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
★★★

নোহা পেছন দিয়ে জড়িয়ে ধরে।রাফি নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে।তার-ও যে খুব ইচ্ছা হচ্ছে বুকে মিশিয়ে আদরে ভরিয়ে দিতে কিন্তু পারছেনা সমাজ সংসার হাত পা আঁকড়ে ধরে আছে।নোহা কাঁদে।পিঠে নাক ঘষে আদুরে গলায় বলে “সরি”।
রাফি কিছু বলে না।মনের ভিতর পাগলা ঘোড়া ইতোমধ্যে জেগে গেছে,হন্যে হয়ে নোহার ভালোবাসার পরশ পাওয়ার জন্য কাতরাচ্ছে।রাফি নিজেকে ছাড়িয়ে নোহার দিকে ফিরে।নোহা আবারো আদুরে গলায় বলে,”আর কখনো এমন করব না”।
রাফির খুব ইচ্ছে হচ্ছে নোহাকে জড়িয়ে নিয়ে বলতে,”কাঁদবে না একদম কাঁদবে না”।কিন্তু বলে না।নোহা আবারো জড়িয়ে ধরতে আসলে রাফি বাধা দেয়।গলার স্বর গম্ভীর করে বলল,
—“নোহা এসব করতে নিষেধ করেছি তো।”

নোহা অপলক দেখে চাঁদের আলো মেখে দাঁড়িয়ে থাকা অসহ্যরকম শ্যামা পুরুষটি তার দিকেই কেমন ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে আছে।নোহা চোখে চোখ রেখে বলল,
—“ভালোবাসায় এসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা বৃথা।”

রাফি বুঝানোর জন্য বলল,
—“আমি কখনই তোর না।আর না তোর ভালোবাসা।”

নোহা প্রেমে-কাতর হয়ে বলে,
—“আমি আপনার।”

—“আমি চাই না।”

—“কেন?”

—“এমনি।”

নোহা কেঁদে দিল।ফুপিয়ে উঠে বলল,
—“কি কারনে আমায় ভালোবাসেন না একবার বলবেন প্লিজ।”

রাফি গলায় কৃত্রিম রাগ আনার চেষ্টা করে,তা না হলে নোহা যাবে না।
—“নোহা একটা সহয কথা বুঝতে তর এত সময় লাগে কেন?তোকে আমার ভালো লাগেনা।একদম সস্তা মেয়েদের মতো যখন তখন গায়ে পড়বি না।”
একটু থেমে বলে,
—“আরেকবার এমন গায়ে পড়লে আমি সত্যিই বাসা ছেড়ে চলে যাব।এখনি রুম থেকে বেরিয়ে যা।গো ফাস্ট।”

নোহার কাঁদল না।স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল।একটা পুরুষমানুষ এতটা নিষ্ঠুর কিভাবে হতে পারে?এত ভালোবাসা গ্রহন না করে কিভাবে থাকতে পারে?নড়বড়ে পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে যায়।
রাফি ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে চুমুক দেয়।এটাই তার প্রশান্তি।

★★★★★★
শুক্রবার বিকালের দিকে নিশি সারা দিন রুম থেকে বের হয়নি।মান্থলি পিরিয়ড চলছে।তার দরুন ব্যাথায় বিছানায় সুয়ে আছে।নাহার ইসরাতকে নিয়ে বাজারে গিয়েছেন।নুরজাহান বেগম কতক্ষন আগে এসেছিলেন।নাহার বলেছিল যে নিশির পেট ব্যাথা।দু’দিন ধরে ঠিকমতো খাচ্ছে না।তাই তিনি তার বাসায় গিয়েছেন সাময়িক ব্যাথা উপশমের ওষুধ আনতে।গিয়ে দেখলেন তার স্বামী আমিন সাহেব সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে পায়ে ব্যাথা পেয়েছেন।তিনি স্বামীর পায়ে মালিশ করতে বসেন আর শিহাবকে দিয়ে পেট ব্যাথার ওষুধ নিশির কাছে পাঠায়।নুরজাহান এসেছিল বিধায় দরজা ভেজানো ছিল শিহাব নিশির রুমে যায় গিয়ে দেখে নিশি ওপাশ হয়ে ডান হাত দিয়ে পেটে ধরে কাঁদছে।শরীর মৃদু কেঁপে উঠা দৃশ্যমান।!নিশি শব্দ পেয়ে ভাবল তার খালামনি এসেছে।কাতর গলায় বলল,
—“খালামনি ওষুধ এনেছ?তাড়াতাড়ি দাও প্লিজ।আর সহ্য করা যাচ্ছে না।”

শিহাব কোন শব্দ না করেই ওষুধ খুলে জগ থেকে গ্লাসে পানি নিল।তারপর বলল,
—“উঠে যা।”
নিশি শিহাবের গলা পেয়ে ধরফরিয়ে উঠে বসল।একনজর শিহাবকে দেখে নিজের দিকে তাকায় একটা পালজ্জু আর টিশার্ট পড়নে।ওরনা যে কই আছে তার ঠিকানা আপাতত নিশির জানা নেই।সে আরেকবার চোরাচোখে শিহাবকে দেখে “ইশ কেমন করে তাকিয়ে আছে”।
শিহাব নিশির মনের ভাব বোধহয় বুঝতে পারল,দূরে ওয়ারড্রব থেকে ওরনা এনে নিশির সামনে রাখল।নিশি ঝটপট উরনা গায়ে জড়িয়ে বলল,
—“খালামনি এল না যে!”

শিহাব পানির গ্লাস হাতে নিতে নিতে বলল,
—“আব্বু পায়ে ব্যাথা পেয়েছে তাই আসেনি।”

নিশি ছোট করে বলল,
—“অহ।”

শিহাব তাচ্ছিল্য করে বলল,
—“আমি এসেছি বলে কি কোন সমস্যা?”

নিশি অবাক হয়ে বলল,
—“না না কোন সমস্যা না।”

শিহাব আয়েশ করে বিছানায় বসল,
—“তাহলে পানির গ্লাস নিয়ে যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যাথা হল তারপরেও তুই ওষুধ খাওয়ার নাম নিচ্ছিস না।”

নিশি অপ্রস্তুত ভাবে গ্লাস নিয়ে ওষুধ খেল।শিহাব বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে হাটুতে হাতের কনুই ঠেকিয়ে গালে হাত রেখে নিশিকে দেখে।

—“হঠাৎ এত পরিমান পেট ব্যাথা হল কেন?”

নিশি এবার লজ্জায় পারেনা বিছানার নিচে লুকিয়ে যায়।কোন উত্তর না দিয়ে গ্লাসের দিকে তাকিয়ে থাকে যেন গ্লাসে মূল্যবান কিছু আছে।নিশির উত্তর দিতে না দেখে শিহাব আবারো বলে,
—“বাহিরের খাবার খেয়েছিলি?”

নিশি আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকে।তার খুব লজ্জা করছে।পিরিয়ড এর ব্যাপারটা এখন সবাই খুব ইজিলি বললেও তার যে পিরিয়ডয়ের কারনে ব্যাথা এটা কোনভাবেই বলতে পারবেনা।বড়ভাই না থাকার কারনে এসব পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি।
নিশির লজ্জায় অবনত মুখ দেখে শিহাব বোধহয় বুঝল।ঠোঁটের কোনে আলতো হাসির রেখা খানিকটা ছোয়ে আবার মিলিয়ে গেল।তারপর নিশির একটা হাত টেনে নিজের হাতের মুঠোয় নিল।নরম কন্ঠে বলল,
—“এটার জন্য এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে?এটা তো স্বাভাবিক।”

শিহাবের কথার ধরন দেখে নিশি বুঝল পাজি লোক বুঝতে পেরে গেছে এবার নিশির কান দিয়ে গরম ধোয়া বের হয়।নিশির শুকনো মুখ,বিবর্ন চেহারা দেখে শিহাব নিশির হাতটা আরেকটু টেনে বলল,
—“খুব বেশি ব্যাথা করছে?”
নিশি মাথা নেড়ে বুঝাল ব্যাথা নেই।
শিহাব গভীরভাবে তাকিয়ে বলল,
—“তাহলে কাঁদছিলি কেন তখন?”

নিশি আবার কেঁদে দিল।শিহাবের আদুরে কথায় ব্যাথাতুর মন আবার কেঁপে ওঠে।টলটল চোখ নিয়ে শিহাবের দিকে তাকিয়ে বলে,
—“খুব ব্যাথা করছে।”
শিহাব আজলার মতো করে নিশির মুখ তার হৃষ্টপুষ্ট হাতের তালুতে নিয়ে তার দিকে মুখ করে বলল,
—“ঠিক হয়ে যাবে।আর একটু শুয়ে থাক আমি আসছি।”

শিহাব বাসায় গিয়ে পানি গরম করে হট ব্যাগে নিল।নুরজাহান নিশির জন্য সুপ্য বানিয়েছে একবাটি সুপ্য নিল।নুরজাহান ছেলের পাগলামি দেখে হাসেন।
শিহাব মায়ের হাসাহাসি পাত্তা দেয় না।আবার নিশিদের ফ্লাটে এসে নিশির বিছানার পাশে দাঁড়ায়।নিশি আধশোয়া হয়ে বসে আছে।শিহাব কিছু একটা ভেবে হট ব্যাগ দেখিয়ে তলপেট ইঙ্গিত করে বলে”এখানে দেব।”
নিশি কিছু বলল না অপলক সামনের পুরুষটির দিকে তাকিয়ে রইল।তার অসুস্থতায় কতটা ব্যাকুলতা তার মাঝে।এটা কি শুধুই খালাতো বোনের খাতির নাকি অন্যকিছু?নিশির নারীসুলভ মন শিহাবের চোখে অন্যকিছু দেখতে পায়।কখনো পাত্তা দেয় না কিন্তু এখন সে নিজে’ও ওই চোখের গভীরে হারায়।নিশি কিছু না বলাতে শিহাব নিজেই হটব্যাগ তলপেটের উপরে রাখে।সুপ্যবাটি হাতে নিয়ে বলে,
—“সারাদিন কিছুই খাস নি, এটা দেখলেই বুঝা যায়।কোন বাহানা না করে খাবি।”

নিশির কথা বাড়াতে ইচ্ছা হল না,শিহাবের আদর আদর যত্নগুলো ভালোই লাগছে।বজ্জাত লোকটা পাশের ফ্লাটে না আসলে বুঝতেই পারত না এত ব্যাকুলতা তার মাঝে।নিশি চুপচাপ খেয়ে নিল।শিহাব খাওয়ানো শেষ করে কিচেনে গিয়ে একটা স্ট্রং কফি বানিয়ে আনল।নিশির সামনে দিয়ে বলল,
—“নে এটা খা এনার্জি পাবি।”

নিশি আস্তে করে বলল,
—“আপনার জন্যও আনতেন।”
শিহাব নিশির পাশ ঘেষে বসল মোবাইল বের করে ফেসবুকে ঢুকল,পুরুষালি গমগমে গলায় খুব আস্তে বলল,”তুই খা।”
নিশি দূরে সরতে গেলে শিহাব ধমকে উঠে,
—“তোর কি ছোয়াছুয়ি রোগ হয়েছে?দূরে গেলি কেন?আগের জায়গায় আয়।”
বাধ্য হয়ে নিশি আগের জায়গায় বসে।শিহাবের গায়ের ঘ্রান নিশির ফুসফুসে ছুঁয়ে যাচ্ছে।কেমন নেশা নেশা ঘ্রান।এত কাছে বসে নিশির শরীর শিরশির করছে কেন শিরশির করছে এই ব্যাখ্যা তার জানা নেই।মাথা নিচু করে নিশি কফি খায়।কিছুক্ষণ পরে তাকে অবাক করে দিয়ে শিহাব তার কফি কাপ টেনে নিয়ে একটা চুমুক দেয়।নিশি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল,
—“ভাইয়া এটা আমার এটো করা!”

শিহাব এটার উত্তর না দিয়ে বলল,
—“পেট ব্যাথা কি কমছে? ”

—“হ্যাঁ।”

শিহাব উঠতে উঠতে বলল,
—“গুড গার্ল।আচ্ছা আমি তাহলে যাচ্ছি।”

নিশির মন খারাপ হল।চলে যাচ্ছে!ইশ আরেকটু থাকলে কি হবে?নিশি কিভাবে বলবে যে,শিহাব থাকলে তার ভালো লাগে।কিছু না বলে মুখ চুপসিয়ে মাথা নিচু করল।নিশি কিছু বলছেনা দেখে চলে যাবার জন্য পা ফেলে।শিহাব দরজা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে তাকায় দেখে নিশি কেমন আদুরে বিড়ালছানার মতো জুলুজুলু চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।শিহাব হেসে বলল,
—“কি চাই?”
নিশি লজ্জামিশ্রিত হাসি দিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে।শিহাব আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না।আবার বিছানার কাছে এসে ঝুঁকে নিশির কপালে কয়েকটা ছোট ছোট চুমু দিল।চোখে চোখ রেখে বলল,”আমার পাখি!তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যা।তর জন্য বেলীফুলের মালা গেথে রাখব।”
নিশি আজকে কিছুটা বুঝল তার সাথে শিহাব সবসময় কেন এমন করে,কেন নেশা লাগিয়ে তাকায়।শিহাব চলে যাবার পরে বালিশে মুখ গুজে লজ্জায় হাসল।চোখ দিয়ে সুখের পানি টপটপ করে পড়ল।দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে বলল,
—“আমি বেলীফুলের মালা কোথায় রাখব!এই বেলীফুলের ঘ্রানের তীব্রতা সইতে পারব তো?”

—চলবে—

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে