সুখ একটি প্রজাপতি পর্ব-৪+৫

0
3025

#সুখ_একটি_প্রজাপতি (৪)

টিনেজ বয়সে সাধারণত এমন পাগলামি করে থাকে ছেলেরা। পছন্দের মানুষটির স্কুল, কলেজের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকা কিংবা কোচিং টাইমে পিছু নেওয়া টিনেজদের জন্য খুবই কমন ব্যপার। তবে এসব কি ঊনত্রিশ বছর বয়সী অভিনবকে মানায়? হয়ত বা মানায়। না হলে ছেলেটা কেনই বা অপেক্ষা করছে ঝিলের ভার্সিটি গেটে! আজকের আকাশ অত মেঘলা নয়। রৌদ্র উঠেছে। ফালি ফালি রোদ এসে স্পর্শ করছে ত্বক। এতে অভিনবর ত্বকে ইষৎ অস্বস্তি অনুভব হয়। বাংলাদেশে এসে এই সমস্যাটা অনুভব হয়েছে শুরুর দিকেই। ধীরে ধীরে এর প্রভাব কমে যাবে। অভিনবর ত্বক অনেকটাই সংবেদনশীল। অথচ ছেলেটা ঘুরাঘুরি করতে অতিরিক্ত পছন্দ করে। এদেশ ওদেশ ঘুরে বেড়ায়। শুরুর দিকে ত্বকে লাল লাল দাগ উঠে যেত। তবে সময়ের সাথে সাথে সবটাই বসে গেছে। মানিয়ে গেছে পরিবেশ। এখন আর অতো সমস্যা হয় না। অনেকক্ষণ ধরেই গেটের কাছে ঘুরঘুর করছে ঝিল। বের হতে পারছে না। অভিনব কে দেখতে পেয়েছে অনেক পূর্বেই। ছেলেটা আবার কেন এসেছে! এভাবে চলা মুশকিল। কি হবে জানা নেই। এমনিতেই ওমন ঘটনার পর পাপাদের সামনে যেতে লজ্জা হয়। মনে পরে সেদিনের কথা। অনেকটা দিক ব্যকুল হয়ে পড়ে ঝিল। মৌন এসে ধাক্কা দেয়। সম্ভিৎ ফিরে মেয়েটির।

“এমন করছিস কেন?”

“কেমন করলাম।”

“তখন থেকে দেখছি হাত কচলেই যাচ্ছিস। আর এই তিন ফুট জায়গাতেই পায়চারি করেই যাচ্ছিস। থামার কোনো নাম গন্ধ নেই। ব্যপার কি বল তো।”

“কিছুই না। আমি আসলে তোর জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।”

“আচ্ছা, তাহলে দাঁড়িয়ে কেন? চল যাওয়া যাক।”

আলগোছে হেঁটে আসে ঝিল। কপালে বিন্দু কয়েক ঘাম। নাক জ্বালা করছে। চোখ দুটো বিরস হয়ে আছে। আর একটু এলেই অভিনবর সাথে চোখাচোখি হয়। ওমন সময় ঝিলের এক বন্ধু এলো। কিছু কথা চলে। রুদ্রম জানায় দুদিন বাদে এক ট্যুর অ্যারেঞ্জ করা হচ্ছে। যেতে চাইলে টাকা দিয়ে আজই কনফার্ম করতে হবে। প্ল্যান এক সপ্তাহ পূর্বের। ওরা আসে নি বিধায় জানে না। অনেকটা মন খারাপ নিয়েই মৌনতা বলল “আমাদের বোধহয় আর যাওয়া হচ্ছে না।”

“কেন?”

“কাল বাদে পরশু ট্যুর। একদিনে কি ব্যাগপ্যাক করা পসিবল?”

“কেন পসিবল হবে না। তোকে বলে লাভ নেই। অলস একটা। ঝিল তুই বল, যাচ্ছিস কি না।”

ঝিলের মন এমনিতেই ভালো নেই। একটু ঘুরাঘুরি করলে ফুরফুরে অনুভব হবে। প্রকৃতির সান্নিধ্য পেলে অন্তত কিছু দিনের জন্য হলেও ভুলে থাকা যাবে অভিনব নামক রহস্যময় মানবকে। এ সুযোগ ছাড়ল না মেয়েটি। কোনো প্রকার না ভেবেই হ্যাঁ বলে দিল। টাকা দিয়ে কনফার্ম করে নিল দুজনের যাওয়া। মৌনতা অবাকের সপ্তম আকাশে! যে মেয়ে নখ কাটতে গেলেও ভাইদের জিজ্ঞাসা করে সেই মেয়ে ট্যুরের জন্য হ্যাঁ বলে দিচ্ছে বিনা সংকোচে!

“একটা কথা বলবি তুই।”

“বল।”

“ইদানিং তোকে দেখলে আমার ভয় হয়।”

“ওমা ভয় কেন হয়! আমার মাথায় তো শিং গজায় নি।”

“আজকাল সব কিছুতে ফাজলামি করিস তুই।”

হেসে উঠে ঝিল। মৌনতার কাঁধে হাত রেখে বলে “রাগ করিস না বাবু। সিরিয়াস হচ্ছি আমি।”

“তাহলে বল, ট্যুরের জন্য রাজি কেন হলি। আগে তো কত বাহানা করতি।”

“বড় হয়েছি। একটু আধটু সাহস ও বেড়েছে। এই তো, তাছাড়া ট্যুরটা আমার প্রয়োজন। কোলাহল, আর ইট পাথরের দেয়ালে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মাত্র এক দিনের ট্যুর। প্যাকিং করতে হবে না তেমন কিছুই।”

ঝিল একদম ই খেয়াল করে নি। বিষয়টা খুব ই বিব্রত করল ওকে। গসিপের এক পর্যায়ে অতর্কিতভাবে অভিনবর বুকে গিয়ে ঠেকে মাথাটা। মৌনতার মুখে হাত। মেয়েটি মিটিমিটি হাসে। অভিনবর লম্বা সুঠাম দেহের সামনে পুচকে ঝিল অনেকটাই অসহায় হয়ে পড়ে। গুটিয়ে থাকা বিড়াল ছানার মতো লাগে। মেয়েটি কয়েক সেকেন্ডেই সরে দাঁড়ায়। নত করে মাথাটা। চোখ বন্ধ করে বার কয়েক শ্বাস নেয়।

“স্যরি। আমি আসলে দেখতে পাই নি।”

চটপট চোখ খুলে ঝিল। অভিনবর বলা সহজ স্যরিটাই হজম হলো না।

“আরে আরে। হিরো তো চলে গেল। উফ কি সিন রে দোস্ত।”

মৌনতা আরও কিছু বলল বোধহয়। তবে ঝিল বিস্মিত! এক ঘর লোকের সামনে যে ছেলে ওকে জড়িয়ে ধরতে পারল। সে ছেলেটি শুধুমাত্র মৌনতার উপস্থিতে এত পরিবর্তন ঘটালো! আগা গোড়া কিছুতেই পার্থক্য হচ্ছে না। অভিনব নামের ছেলেটি ধীরে ধীরে রহস্যের রাজপ্রাসাদ তৈরি করে চলেছে। মস্তিষ্ক বুনে যাচ্ছে রহস্যের জাল। না জানি কি হতে চলেছে সামনের দিন গুলোতে। ভেতরটা দুমড়ে আসে। চোখের পাতাতে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ দেখতে পায় ঝিল।

অনেক রাতে কল করল অভিনব। ঝিল চাইছে না কল রিসিভ করতে। তবে মস্তিষ্ক আর মনের মাঝে সংঘর্ষ ঘটে যায়। সমস্ত দ্বিধা পেরিয়ে ফোন হাতে নেয় মেয়েটি। অভিনবর শীতল কণ্ঠ শোনার জন্য বুকের ভেতর ধীম ধীম আওয়াজ হয়। এখন প্রায় দুটো বাজে। এত রাত অবধি ঝিল কি কখনো জেগেছে! তবে আজ কেন জেগে? অনেকক্ষণ ভেবে মেয়েটি স্বীকার করতে বাধ্য হয় অভিনবর কলের অপেক্ষাতেই ছিল হতচ্ছড়া মন! দু চোখের পাতার সাথে ঘুমের আবার ভীষণ আড়ি। মেয়েটি ভাবনার অতলে হারিয়ে কল রিসিভ করতে ভুলে যায়। যখন ধ্যান ফিরে তখন কল কেটে গেছে। সে রাতে আর কল এলো না। ঝিল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পারল না নিজ থেকে কল দিতে। অনেকটা অস্বস্তিতেই গত হয় রাত। পরদিন শপিং করতে আসে। কিছু টপস দেখছিল। ঠিক সেই সময়েই হাতে টান পড়ে।

“কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস মৌন?”

“দোস্ত, সেই হিরো চলে যাচ্ছে।”

হিরো কথাটা বুঝতে সময় লাগল ঝিলের। অভিনব ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে। মৌন ছুটে এসেও পারল না লিফ্ট ধরতে। ঝিল লক্ষ্য করল অনেকটা পালিয়ে বাঁচল অভিনব! মেয়েটির পুরো দিন অসহনীয় যন্ত্রণায় পার হয়। সন্ধ্যায় ফিরে নিজ রুমে আটকে থাকে। পরিশ্রান্ত দেহ। ক্ষণিকেই ঘুমে হারায়।

.

আরফানের স্ত্রীর নাম মুনতাহা। মেয়েটি শিকদার বাড়ির বউ হয়ে এসেছে প্রায় চার টি বছর। স্বভাবে নম্র,ভদ্র। বড়দের সামনে মাথা তুলে কথা অবধি বলে না। এমনকি আরফান যখন রেগে যায় তখন চুপ করে থাকে। মুখের উপর দুটি কথা নেই। এসব দেখেই হয়ত ইববান শিকদার নিজের বড় পুত্র বধু হিসেবে মুনতাহাকে চয়ন করেছেন। অথচ শুরুর দিকে আরফানের ঘোর আপত্তি ছিল! সে চাচ্ছিল না এমন আনস্মার্ট সাদামাটা মেয়েকে বিয়ে করে বন্ধুদের কাছে বিব্রত হতে। অথচ বিব্রত হওয়া তো বহুদূর দিন শেষে প্রত্যেকেই বলেছে মুনতাহার মতো বউ পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার। এতে অবশ্য আরফানের ধারণা বদলায় নি। সে সর্বদা চেয়েছে ক্লাসি মেয়ে। যে ওর সমানে সমান। এ দিক থেকে মুনতাহা একেবারেই শূন্য। দেখতে সুন্দরী বিধায় চার বছর ধরে টিকে আছে সংসারটা। নচেৎ বহু আগেই চুকে যেত আগা গোড়ায় ব্যন্ডেজে টিকে থাকা সম্পর্ক। আজকের আয়োজন একটু ভিন্ন। মুনতাহার বাপের বাড়ি থেকে লোক আসবে। লোক বলতে ওর ভাই বোনরা আসবে। এ বাড়িতে ওদের সুনাম বেশ। হয়ত মুনতাহার গুণের কারণেই আদর যত্নের পরিমান একটু বেশি। সকাল সাড়ে ছয়টায় লাল রঙের গাড়িটা এলো। খবর পেয়ে ছুটে এসেছে মুনতাহা। ভাই বোনদের জড়িয়ে ধরে আবেগপ্লুত হয়ে যায়।

“কেমন আছিস তোরা?”

“খুব ই ভালো আপু। বাট তুই বরাবর ই কেঁদে আমাদের মন খারাপ করে দিস।”

চোখের পলকে চোখ মুছে নেয় মুনতাহা। মাহেরের ভীষণ গরম লাগছিল। তাই বহু পূর্বেই ভেতরে চলে এসেছে। বরফের দেশে থেকে থেকে শরীরে হীম ধরেছে। একটু গরমেই ঘেমে নেয়ে একাকার!

এ বাড়িতে আফরা প্রথম বার এসেছে এমন নয়। তবু ভীষণ লজ্জা লাগছে ওর। বিষয়টা লক্ষ্য হতেই ধাক্কায় মাহেরা। দাঁত কামড়ে বলে “এমন করছিস কেন?”

“চলকেট বয়ের জন্য। ওর কথা ভাবলেই আমার হৃদয়ে হাওয়া লাগে।”

কথাটা নীচু স্বরে বললেও শুনে ফেলে মুনতাহা। ঠোঁট টিপে হাসে। সরবতের গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে বলে “তোর চকলেট বয় এক মাস ধরে বাসায় নেই।”

বৈশাখের কালো মেঘ এসে রাঙিয়ে দেয় আফরার মুখ। মাহেরা খোঁচা মেরে বলে,
“দিলে তো মন ভেঙে। প্রিন্সেস আফরার হৃদয় যে ব্যকুল হয়ে আছে। তার চকলেট বয়ের সাথে স্বাক্ষাৎ করবে বলেই তো এসেছে।”

“মিথ্যে। আমি কারো সাথে দেখা করতে আসি নি।”

ঘোর প্রতিবাদ করে আফরা। হেসে উড়িয়ে দেয় মাহেরা। সোফাতে আরাম করে বসে। ফোন নিয়ে বসে সেল্ফি তুলতে। দু একটা তুলে নানান পোজে। ছবি দেখার সময় লক্ষ্য করে দোতালার সিঁড়ি দিয়ে নামছে অভিনব। এর আগে ওদের দেখা হয় নি। এক মুহূর্তের জন্য চোখ আটকে যায়। মন হারিয়ে ফেলল মেয়েটি। অভিনব কোথাও বের হচ্ছে।
“কোথাও যাচ্ছেন ভাইয়া?”

“হ্যাঁ ভাবি। একটু ঘুরে আসি। ঘরে থেকে বোর লাগছিল। নাস্তা বাহিরে করব।”

অভিনব চলে যায়। তবে তার রেশ থেকে যায়। মাহেরার চোখে ভাসে অভিনবর দৃঢ় সুঠাম দেহ। স্লিকি হাল্কা ব্রাউন চুল। কোমল ত্বক। সব মিলিয়ে অপূর্ব সুন্দর ছেলেটি মাহেরা নামের চুজি মুডি মেয়েটিকে কাত করে ফেলে!

বাংলাদেশে এসেই বাইক নিয়েছে অভিনব। বিদেশের মাটিতে সাইকেল দারুণ চললেও বাংলাদেশের মাটিতে মলিন লাগে। এখানে সাইকেল চালানোর মতো রাস্তা নেই। সবটাই ভীষণ ব্যস্ত। একমাত্র বাইকটাই মানানসই। দূরন্ত গতিতে ছুটছে বাইক। ভোর রাতে বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ অভিনবর একটু বেশিই ভালো লাগে। মনমাতানো গন্ধ ওকে আকুল করে তুলে। সে সময়টায় চারপাশের সবকিছুই হারিয়ে যায় কোথাও একটা। অভিনবর মনে হয় এ পৃথিবীতে এত এত সৌন্দর্য্য রয়েছে তার একাংশ যদি মানুষ অনুভব করতে পারত তবে উপলব্ধি হতো জান্নাতের সৌন্দর্য্য কত ভয়াভয় সুন্দর। কিন্তু আপসোস মহান আল্লাহর সৃষ্টির একাংশ আমরা অনুভব করতে পারি না। বাইক থামালো অভিনব। আর মাত্র কয়েক কদম। এর পরেই শুরু হয়েছে মির্জাপুর। এই অঞ্চলের সৌন্দর্য্য বাংলাদেশের যে কোনো অঞ্চলের সাথে লড়াইয়ের উপযুক্ত। তিন বছর আগে এই অঞ্চলটি অভিনবর নিকট অতি সামান্য ঠেকলেও এ সময়ে দাঁড়িয়ে বড্ড আপন মনে হয়। তরুণ এলো ঠিক দশ মিনিট পর।

“মামা বাড়ির পিঠা খাইতে লাগে মিঠা। বাহ ভাই বা। এতদিনে আমি নামক বন্ধুটি স্মরণে এসেছে।”

“স্মরণে তো সব সময় আছিস। আজ একটু সময় নিয়ে স্মরণ করলাম।”

হেলমেট খুলে ফেলেছে তরুণ। চুল গুলো বড় হওয়ায় হাতের সাহায্যে তা গুছিয়ে নিল। একটু সময় নিয়ে জবাব দেয়।
“বলুন জাহাপানা আপনার জন্য কি করতে পারি।”

“আপাতত ঘুরতে গেলেই হবে।”

“ঘুরতে! এই অসময়ে?”

“অসময় দেখিস কোথায়! এখনি তো সুইট টাইম। দেখ গাছের পাতাতে এখনো পানি। পাখির কলরব। এই যে ভেজা নরম মাটি। চিকন রোদ। এসব ই তো আমাদের মুগ্ধতা।”

চলবে…..

#সুখ_একটি_প্রজাপতি (৫)

লেট লতিফ মৌনতা! বরাবর ই ঘুম থেকে উঠতে লেট হয়ে যায়। সেই জন্যেই ঝিল ওকে ভোর থেকে কল করছিল। অবশ্য মৌনতা জেগেওছিল। তবে কল কেটে বালিশকে আগলে নিতেই এক রাশ ঘুম এসে পিঠে হাত বুলায়। আর তারপর এক ঘন্টা লেট! কথা ছিল ৮ টায় ঝিলের বাসাতে চেক ইন করবে অথচ মৌনতা এখনো বাসা থেকেই বের হতে পারল না! ঝিল লাগাতার কল করে যাচ্ছে। কিন্তু রিসিভ করছে না। সে সাহস নেই ধরে। ব্যাগপত্র নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার পথে কল রিসিভ করল।

“ঝিলি, এই তো এসে গেছি বাবু। জানিস তো প্রচন্ড জ্যাম। উফ কি যে গরম। আর একটু অপেক্ষা কর বাবু।”

ওপাশ থেকে দাঁত কিড়মিড় করে ঝিল। মৌনতা একের পর এক মিথ্যে বলছে। সাথে এমন কিছু সাউন্ড করছে যেন সে সত্যিই ঢাকা শহরের অলিগলিতে ভীষণ জ্যামে আটকে আছে!

“কথা কম বলে দ্রুত নেমে আয়। ভাইয়া অপেক্ষা করছে।”

“ওকে।” বলেই থেমে যায় মৌন। একটু সময় নিয়ে বিষয়টা বুঝে। পরপর ঢোক গিলে।

“হয়েছে আর ঢং করতে হবে না। আমি জানি তুই লেট করবি। তাই এক ঘন্টা আগেই ভাইয়াকে পাঠিয়ে দিয়েছি।”

বিড়াল পায়ে নামছে মৌনতা। কাঁধে বেশ মোটা ব্যাগপ্যাক। হাতেও আছে একটা। চোখে সানগ্লাস। সেমি লং শার্ট গায়ে। একটু বেশিই সুন্দর লাগছে ওকে। অথচ রোহন দেখছে না। তাকাবে না কোনোভাবেই। মেয়েটির এই জ্বালাধরা রূপ যৌবন কাবু করতে পারবে না রোহন মির্জাকে। কোনো কালেই পারবে না! এ যেন ধনুক ভাঙা পণ!

“হাবার মতো না দাঁড়িয়ে গাড়িতে বসলে সময় বেঁচে যায়।”

কঠিন আর দৃঢ় কণ্ঠের কোপে পড়ে চটপট উঠে বসে মৌন। ব্যাগপত্র পেছনে রেখে সামনে বসতে যেতেই মাথা ঠুকে যায় গাড়ির দরজাতে। রোহন একবার তাকিয়েছিল বোধহয়। মৌন ভীষণ অস্বস্তিতে। গাড়ি স্টার্ট করার সময় রোহনের মুখে কালো মেঘ। ম‍ৌনতার পেটের ভেতর জমে আছে হাজার খানেক কথা। একটু ও শান্তি পাচ্ছিল না। তার উপর জ্যামে আটকে আছে। এমতাবস্থায় মেয়েটি ভীষণ ঘামতে শুরু করেছে। লুকিং গ্লাসে সেটাই দেখছিল রোহন। এসি অন করল। স্বস্তি লাগে কিছুটা।

“থ্যাংকস।”

এক পলক তাকায় রোহন। তারপর গাড়ি চালনায় মননিবেশ করে। মৌন ভেবেছিল কিছু বলবে তবে ওকে ভুল প্রমান করে ছেলেটা ফিরেও তাকালো না। হতাশ হয় মৌন। বুক চিরে বের হয় তপ্ত শ্বাস। হয়ত একেই বলে হাতের লক্ষী পায়ে ঠেলা।

ট্রিপে যাচ্ছে পনেরো জন। এদের আবার তিনটে টিম। তবে গাড়িতে যাবে একসাথেই। ঘুরাঘুরি হবে তিন ভাগে। ঝিল,মৌনতা, রুদ্রম, মায়রা, আর নিয়ন এক টিমে। ঝিল আর মৌনতাকে দিতে এসেছে রোহন। আহনাফ বাসায় নেই। কথা হয়েছে। জানিয়েছে আজ বিকেলেই ফিরবে। ঝিল আর ম‍ৌন ব্যাগ পত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে। ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া গাড়িতে উঠার সাহস পাচ্ছে না। মৌনতা এসবে বিরক্ত। সে বুঝতে পারে না এত ভয়ের কি আছে! রোহন রগচটা এমন নয় তবে ওর ব্যক্তিত্ব বড়ই শান্ত। অনেকটা ঝড় হওয়ার আগের সেই গুমোট মুহূর্ত। রুদ্রম নেমে এলো। ট্যুর নিয়ে আলোচনা করছে। ওদের কথার মাঝে যেতে ইচ্ছে হলো না মৌনতার। আনমনেই হাঁটতে শুরু করেছে। এই যে রোহন, কোনো এক কালে মৌনতার প্রতি ভীষণ আসক্ত ছিল। তখন তো মৌনতা সবে কলেজে উঠেছে। সে সময়ে মেয়েটির তথাকথিত একজন নিজের মানুষ ও ছিল। রোহন যখন ওর আশে পাশে ঘুরঘুর করত তখন বড়ই বিরক্ত লাগত। ফিরিয়ে দিয়েছিল রোহনের উত্তপ্ত হৃদয়ের ভালোবাসাকে। অথচ বছর ঘুরতে না ঘুরতে মৌনতার সম্পর্কটা চুকে গেল। পথ চলা হলো না একসাথে। সে সময়টা রোহন কে ভীষণ মনে পড়ত মৌনতার। ছেলেটার গুমোট হওয়া মুখ আর ভালোবাসা ভরা চাহনি। সবটাই অনুভব হতে শুরু করে। কিন্তু ভাগ্য, সে কি চেয়েছিল? সে চেয়েছিল ওদের না হওয়া সম্পর্কটার করুণ বিচ্ছেদ। তাই হয়ত এক প্রকার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল রোহন। এসব ভাবলে এখন কষ্ট হয়। ভীষণ যন্ত্রণায় ধরে আসে গলা। এমন নয় মৌনতা মুভ অন করতে পারত না। ওর লাইফে অনেক ভালো ছেলে এসেছে। তবে ততদিনে ওর মন প্রাণ রোহনের প্রতি ঝুঁকে গেছে। প্রেমিকের সাথে বিচ্ছিন্নতার পর ছেলেটার প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়েছে। তবে রোহন চাইল না। আর সেই জন্যেই মৌনতা আজ একা। ভীষণ একা।

হাতে প্রচন্ড চাপ অনুভব হলো মৌনতার। কয়েক ইঞ্চি পাশ দিয়ে চলে গেল মালভর্তি ট্রাক! রোহনের হাত কাঁপছে। অথচ মৌনতা নির্বাক। কি হয়েছে ওর জানা নেই। ও শুধু তাকিয়ে।

“পাগল হয়েছ? মাথাটা গেছে পুরো! একটু হলেই তো চাপা পড়তে। কি হলো মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না এখন! রা স কেল, এভাবেই টেনশনে ফেলতে ভালো লাগে।”

এই যে এত গুলো কথা শুনালো রোহন অথচ ম‍ৌনতা কোনো কথাই বলল না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রোহনের চোখে থাকা ভয় ওকে আনন্দ দিচ্ছে। অনেক দিন পর এ চোখে ফের মায়া অনুভব হয়েছে। ভেতরে অদ্ভুত শীতল সমীরণ অনুভব হয়। ঝিল এসে ধাক্কালো।
“কোন জগতে তুই?”

তাকালো মৌন। একটুখানি হাসার চেষ্টা করল।
“ভাইয়া বলল একটুর জন্য ট্রাকের নিচে পড়িস নি। মন কোথায় থাকে? দেখি ব্যথা পেয়েছিস কতটুকু।”

ঝিলের কথায় মৌনতা প্রায় বিস্মিত হলো! হাতের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল ক্ষ ত টা। রোহন যখন টেনে সরিয়েছিল তখনি হাত লাগে গাছের সাথে। কাঁটাযুক্ত গাছে লেগে ছিঁলে যায় হাত। অথচ এসবে ওর ধ্যান ই নেই। ঝিল ক্ষ ত স্থান পরিষ্কার করে মলম লাগালো। মৌনতা ইষৎ ব্যথায় চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে রোহন। চোখে মুখে বিরক্তি। ঝিল হাসছে। সে লক্ষ্য করল তার ভাইয়ের বিরক্তি ভরা চাহনি আর বির বির। সম্ভবত মৌনতার ফোর্টিন জেনারেশন উদ্ধারে ব্যস্ত! তবে ঝিল জানে এর মাঝেও রয়েছে এক আকাশ সমান ভালোবাসা। অথচ চাপা অভিমানের রোষানলে লুকিয়ে রাখার এক বৃথা চেষ্টা।

মাইক্রোবাসে উঠে বসেছে সবাই। ওদের যাত্রা শুরু হয় ঢাকা সায়েদাবাদ বাস স্ট্যান্ড রোড থেকে। এখন বাজে প্রায় সকাল এগারোটা। মৌনতা বসেছে ঝিলের পাশে। তবে ঝিল জানালার পাশের সিটের দখল নিয়েছে বহু পূর্বে। নানান নির্দেশনা দিচ্ছে রোহন। সাধারণত ঝিলকে একা ছাড়া হয় না। তবে বন্ধুমহলের সাথে একদিনের ট্যুর হওয়াতে যেতে দেওয়া হলো। অনেকগুলো কথা বলল রোহন। এর মাঝে একবার ও তাকায় নি মৌনতার দিকে। মৌনতা চাতক পাখির মতো চেয়ে। অন্তত একটি বার রোহন বলুক ‘ভালো ভাবে যেও।’ তবে সে ভাগ্য নেই মেয়েটির। রোহন নেমে গেল চটপট। মৌনতার একটু মন খারাপ। তবে এর রেশ বেশিক্ষণ রইল না। সকলে গান শুর করেছে।
‘কালো জলে কুচলা তলে ডুবল সনাতন,
আজ সারা না, কাল সারা না পাই যে দরসন।
লদীধারে চাষে বঁধু মিছাই কর আস,
ঝিরিহিরি বাঁকা লদি বইছে বারমাস।’

গান শেষ হতেই সবাই একসাথে চেচিয়ে উঠে। ট্যুরে কিংবা বন্ধুমহলে এসব গান বেশ জমে। মৌনতার মন ভালো হয়ে এসেছে। সবাই চেচামেচি করছে বিধায় রুদ্রম মাইক হাতে নিল। “এটেনশন এভরিওয়ান,গান বাজনা তো চলবে চলতেই হবে। এখন ফটোগ্রাফি হলে কেমন হয়।”

ফটোসেশনের কথা শুনে সবাই ফের চেচালো। এতে রুদ্রম হেসে উঠে। ঝিলকে টেনে উঠায় মৌন। মেয়েটি জানালার পাশে বসে প্রকৃতির হাওয়া অনুভব করছিল। সায়েবাদ থেকে ফরিদপুর ভাঙা এক্সপ্রেসওয়ের এর দূরত্ব প্রায় ৭০-৭৫ কিলোমিটার। মোটামুটি দেড় ঘন্টার মতো সময় লাগে। ওদের ফটোসেশন শুরু হয়ে গেছে। একেকজন নানান ভঙ্গিতে ছবি তুলছে। নিয়ন একটু অদ্ভুত প্রকৃতির ছেলে। বন্ধুমহলকে একাই মাতিয়ে রাখে। সে রুদ্রমের কোলে উঠে যাচ্ছে প্রায়।

“শালা,বউকে এখনো কোলে তুললাম না। আর তুই কোলে উঠে যাচ্ছিস।”

“এগুলো স্মৃতি থাকবে দোস্ত। একটু ওয়েট কর এই মৌন ছবিটা তোল।”

মৌনতা তৎক্ষণাৎ ছবিটা তুলে ফেলল। ছবিতে রুদ্রমের মুখটা হয়েছে দেখার মতো। ওর আলাভোলা, ভঙ্গিমায় বিরক্তিমাখা ছবি দেখে এক চোট হাসল সবাই। বেশ আমোদে গত হলো সময়। আকাশ কিছুটা মেঘলা। ঝিল হাঁপিয়ে উঠেছে। মেয়েটি এবার আরাম করে বসল স্বীয় সিটে। ইষৎ মেঘে ঢাকা আকাশটা ভীষণভাবে টানছে নিজের কাছে। ঝিলের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে রঙ মেশানো হাসি। মেয়েটি চোখ বন্ধ করেছে। মৌনতা ও বসেছে পাশে। সবাই এখন যে যার মতো সময় কাটাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাঙা এক্সপ্রেসওয়েতে উঠবে ওরা। গ্রামীণ ছোঁয়ার শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে। চারপাশে সবুজে ঘেরা। সবে বর্ষার শুরু। এখনো পানি উঠে নি। তবে কিছুদিনের মাঝেই চারপাশ ভরে যাবে টলটলে পানিতে। সেসব কল্পনা করেই ঝিলের মনে প্রজাপতি উড়তে লাগল। মনের মধ্যে এক ভালোলাগা। বাতাবরণের শিহরণে হারিয়ে যায়। ঝিল তখনো ঘোরে ডুবে। তখনি চেচিয়ে উঠল সবাই। ঝিল লক্ষ্য করল ভাঙা এক্সপ্রেসওয়ে দেখা যাচ্ছে। চারপাশটা এত পরিষ্কার আর উজ্জ্বল যে কয়েক সেকেন্ড থমকে থাকে মেয়েটি। ভাঙা মোড়ের রাস্তা গুলো বাংলার বুকে অনন্য সৃষ্টি। এখানে তাকালে মনে হয় এক টুকরো বিদেশী ছোঁয়া। চারপাশের সজীবতা যেন এর সৌন্দর্য্য দ্বিগুণ করে দিয়েছে। ঢাকা থেকে মাওয়া যাওয়ার অনেক গুলো পথ রয়েছে। ওরা ট্যুরের পরিধি বৃদ্ধির জন্যই ফরিদপুর ভাঙা এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে উঠেছে। তাছাড়া ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ওয়ের সব থেকে সুন্দর অংশ ভাঙা মোড়। চার লেনের রাস্তাটি মুগ্ধ করেছে সবাইকে। ঝিলের প্রথম মাওয়া যাত্রা। ভীষণ আকর্ষণ অনুভব হয়। মাইক্রোবাসের টোল ২২০ টাকা। টাকা দেওয়ার পর ই সড়কে উঠতে পারল ওরা। ফের দল বেঁধে গান শুরু হয়েছে। একে একে সবাই গান গাইছে। ঝিল কেবল ইনজয় করছে। মেয়েটির ভালো লাগায় পানি ঢালতে কল করল অভিনব। ধক করে উঠে মেয়েটির হৃদয়। না চাইতেও কলটা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে নিঃশব্দে হাসছে অভিনব।
“গত দিন কল করেছিলাম। অথচ আপনি রিসিভ করেন নি। এটা কি ঠিক হয়েছে প্রজাপতি?”

কি বলবে বুঝতে পারে না ঝিল। প্রজাপতি ডাকটি ওর হৃদয়ের গভীরে আন্দোলন তুলে দিয়েছে। অনুরণন হয়ে দখল নিয়েছে মস্তিষ্কের। অভিনব নামের ছেলেটি ওকে ভীষণ জ্বালায়। অথচ ঝিল জানে এই মানুষটির দেওয়া য ন্ত্র ণা গুলো অদ্ভুত ভাবে ওকে আনন্দ দেয়। ঝিল মনের দিক থেকে একটু নরম হলো। তবে কণ্ঠে দৃঢ়তা।
“আপনি কল করলেই রিসিভ করতে হবে এমন কোনো চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করেছি বলে মনে পড়ছে না।”

ফট করেই উত্তর করে না অভিনব। একটু সময় নিয়ে কণ্ঠে রসিকতার মিশ্রণ ঘটায়।
“তাহলে চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করতে চাচ্ছেন?”

নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে যায় মেয়েটি। খানিকটা তুতলে উঠে। অভিনব ফের বলল
“জানেন প্রজাপতি,আপনাকে জ্বালাতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। আপনার লাল হওয়া নাক, কোমল ঝিম ধরা ঠোঁটের কাঁপুনি আর দিশাহীন চাহনি। এসব এত কাছে ডাকে আমায়, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে।”

ওমন সময় ডেকে উঠে তরুণ। ছেলেটার প্রতি বিরক্ত হলেও স্থির রয় অভিনব। ঝিল এখনো ফোন কানে লাগিয়ে। শেষোক্ত কথাটা শুনতে চাইছে। কেন চাইছে জানে না। তবে মন বলছে ও কথা না শুনতে পেলে তোর ম র ণ হবে। তুই শেষ হয়ে যাবি ঝিল।

চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে