#সুখ_একটি_প্রজাপতি (৪১-সমাপ্তি পর্ব)
ভোরের প্রথম কিরণের ন্যায় জীবন্ত লাগছে ঝিলকে। তার মসৃণ ঠোঁট রঙিন হয়ে উঠেছে। চোখে মুখে ভালো লাগার নরম ছোঁয়া। জীবন নিয়ে তার আসলেই অভিযোগ নেই। আজকের এই সুখ অর্জন অতোটা সহজ ছিল না। সে মনে মনে নিজের অতীত ঘুরে এল। কত কান্নাভেজা রাত গত করেছে। পরিবার পরিজন ছাড়া আসলেই কি ভালো থাকা যায়?
আজকের দিনে সবথেকে ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে মৌনতার মাঝে। তার প্রিয় বান্ধবীর বিশেষ অনুষ্ঠান বলে কথা। মেয়েটির জন্য ওর অন্তঃকরণে বরাবরই ব্যথা ছিল। বড্ড ভালোবাসে কীনা। সে তড়িঘড়ি করে তৈরি হচ্ছে। একটু পরই ছেলের বাড়ি থেকে লোক আসবে। তাদের সাথে আমোদ করার প্ল্যান আছে। চুল গুলো চট করেই খোঁপা করে নিল। মিষ্টি রঙের একটি শাড়ি পরেছে। সুন্দর চকচকে কানের দুল। চোখের নিচে কাজল লেপ্টে আছে বিধায় মুখটা গোমড়া করে নিল। কাজল ঠিক করে নিয়ে বেরোতেই রোহনের সাথে দেখা। ছেলেটা শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি পরেছে। সুন্দর মসৃণ চুল গুলো জেল দিয়ে এক পাশে সেট করা। বুকের কাছের দুটো বোতাম খোলা। সম্মোহন লেগে যায় ওর। রোহন নিজেও আজ অসভ্যের মতো তাকিয়ে আছে। এককালে মেয়েটি ওকে ভীষণ যন্ত্রণা দিয়েছে।
“এত সেজেছ কেন?”
“তুমিও তো সেজেছ।”
“কোথায়? আমি নিশ্চয়ই আটা ময়দা মেখে ঘুরছি না।”
“মেকাপ কে বলে আটা ময়দা তাকে আর কি বোঝাব! এসব বুঝবে না তুমি।”
“বুঝে কাজ ও নেই।”
“হু,সরো আমার অনেক কাজ।”
“তোমায় ধরে রেখেছি মনে হচ্ছে!”
মৌনতা চোখ ছোট করে তাকাল। ছেলেটা কি আজ একটু বেশিই করছে? পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার পথে আটকে বলল, “শুনে যাও। কথা আছে।”
মৌনতা না দাঁড়িয়ে পারল না। তার নিজের ও অনেক কথা আছে। রোহন কাছে আসতেই ওর বুকের ভেতর ছটফট শুরু হয়ে গেল। ছেলেটা এক মনে দেখে চলেছে। কি সুন্দর লাগছে মেয়েটিকে।
“খুবই বাজে দেখাচ্ছে। এভাবে বাইরে যেও না। মানুষ ভয় পাবে। ভাববে ভীনগ্রহের প্রাণী ঢুকে পড়েছে।”
অবাক চোখ তাকিয়ে রইল মৌনতা। রোহন গটগট শব্দ করে চলে গেল। সে ভেবেছিল অন্য কিছু বলবে। অথচ এমন অদ্ভুত কথা বলে গেল! নিশ্চয়ই ওকে জ্বালানোর জন্য।
গত কয়েকদিন অভিনবর উপর দিয়ে রীতিমতো ঝড় গিয়েছে। সে বহু কষ্টের পর মামাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছে। ভদ্রলোক এর আগে দু বার গিয়েছিল মির্জাদের নিকট। কিন্তু তাদের অপমান করে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাই বোধহয় এত সংকোচ আর আত্মসম্মানবোধ তৈরি হয়েছে ইববান শিকদারে হৃদয়ে। তবু তিনি আজ পুনরায় যাবেন বলে স্থির হয়েছেন। নিজ সন্তানের থেকে অনেকটা ব্যথা পেয়েছেন কীনা। সে শোকে বুকের ভেতর মাতম বইছে। এর মাঝেও আরেকটি সুন্দর সংবাদ রয়েছে। রজনী আর দানেশ বাড়ি ফিরবে। তাদেরকে বাড়ি না ফেরানোর পেছনে অনেক গুলো কারণ ছিল। এর মধ্যে অন্যতম সম্মানবোধ। একবার খুব বড়ো মুখে বলে এসেছিল মির্জাদের ছায়াও প্রবেশ করাবেন না ওনার গৃহে। অতীত ভুলে গিয়ে যেহেতু সব ঠিক হতে চলেছে তাই আর বাধা নেই। মনে মনে এই বিষয়টা নিয়ে সকলেই বেশ উত্তেজিত। সন্তানদের ছাড়া কোনো পরিবারই সুখে থাকে না। এত আনন্দ থাকা সত্ত্বেও প্রকাশ করতে পারছে না অব্যক্ত সংকোচে। অভিনব নিজের কক্ষে বসে বসে সব কিছুই স্মরণ করল। একটা বিষয় সে লুকিয়ে রেখেছে। আরফান সুখে নেই! তার স্ত্রীর এতশত আবদার পূরণে সে অপারগ। মোটা বেতনে চাকরি করা সত্ত্বেও দুজনের সংসারে অভাবের শেষ নেই! এসব সে গোপন সূত্র থেকে জানে নি। আরফান নিজেই জানিয়েছে। কথায় আফসোসের শেষ ছিল না। অভিনব বুঝতে পারছিল সব। তবে বিশেষ কিছু করার তো নেই। নিজ দোষে আজ এ অবস্থা। মুনতাহার প্রতি হওয়া অন্যায় স্মরণ করে অভিনব নিজেই কেঁপে উঠে। তবু ভাইকে সান্ত্বনা দিয়েছে সব ঠিক হয়ে যাবে বলে। সে জানে এই সংসারে আর সুখ হবে না। মুনতাহার জীবন এখন থেমে নেই। বর্তমানে সে ফ্যাশন নিয়ে কাজ করছে। যদিও তাদের সম্পর্কটা এখনো ভাঙে নি তবে ফের শুরু হওয়ার সম্ভাবনাই বা কতটুকু?
“ভাই তোমাকে কিন্তু দারুণ লাগছে।”
সাদাদের কথায় না হেসে পারল না অভিনব। ফুল বসেছে ওর কোলে। মেয়েটি এই বাড়ির সব থেকে কনিষ্ঠা সদস্য।
“ইহান ভাইয়া ভাবিমনি কি খুব সুন্দর?”
“সুন্দর না হলে কি ইহান ভাইয়া এত পাগল হয়?”
ফুলের গাল টিপে দিল তামীম। বাচ্চাটা ইষৎ রাগ দেখিয়ে বলল, “তুমি সব সময় এমন করো কেন?”
“ঠিকই তো তামীম। এমন করিস কেন?”
“স্যরি ভাই।”
“ফুলঝুঁটি তোমার ভাবিমনিকে দেখবে?”
“দেখাবে তুমি?”
“কেন দেখাব না।”
অভিনব ছবি দেখাত চাচ্ছিল। ঝিল তখুনি কল দিয়ে বসল। অভিনব কল কেটে ভিডিও কল দেয়। সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রিনে ঝিলের মুখটা ভেসে উঠে। অনেক গুলো চোখ হুমরি খেয়ে পড়ল। পাশ থেকে রূপা বলল, “হায় ভাবিমনি। তোমাকে তো দারুণ লাগছে। আমি হচ্ছি তোমার কিউটি ননদিনী রূপা। আর এই যে আমাদের ফুল সোনা। সে কিন্তু তোমার সতীন।”
এত গুলো কথা বলে থামল রূপা। মিটিমিটি হাসছে ঝিল। পাশ থেকে সাদাদ আর তামীম ও কথা বলল। ফুল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ঝিলের হাসিটা ভীষণ সুন্দর।
“ফুল সোনা,কি আমার সাথে রাগ করেছ? পছন্দ হয় নি? কথা বলছো না কেন?”
“রাগ করেছি।”
“কেন সোনা?”
“তুমি আমার থেকে বেশি সুন্দরী। ইহান ভাইয়া তোমাকে বেশি ভালোবাসবে।”
ঝিল হো হো করে হেসে উঠল। ফুলের গালে চুমু খেল অভিনব। বাচ্চাটি ভীষণ আদুরে।
“উহু। আমি তো আমার ফুলঝুটিকেই বেশি ভালোবাসব।”
“প্রমিস?”
“প্রমিস। ওকে তো অল্প অল্প ভালোবাসব।”
“তাহলে ঠিক আছে।”
ফুল রূপার কাছে চলে এল। ঝিল আপনমনে হাসছে। অভিনব সেদিকে তাকিয়ে। মেয়েটি তার নিকট সব থেকে সুন্দর।
“দ্রুত চলে আসো তো। আমার সমস্ত সাজ চলে যাচ্ছে।”
“তুমি এমনিই সুন্দর প্রজাপতি।”
“সারাক্ষণ পাম দিচ্ছ। ফুলে না যাই।”
“নো চান্স। এত দিনের ভালোবাসায় যে মেয়ে ফুলল না। সে কথায় ফুলে যাবে!”
“আমি মোটা হলেও তোমার নিকট শুকনাই লাগবে। কোনো দিন এই কথার বদল হবে না। সাবধানে দেখে এসো। আর শোনো,তোমাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। কালো টিপ লাগিয়ে নাও। নজর না লেগে যায়।”
খিটমিটে হাসল অভিনব। তার এই হাসির অর্থ জানে মেয়েটি। তাই চটপট কল রেখে দিল। ছেলেটা চরম অসভ্য!
মির্জা বাড়িতে উৎসব লেগেছে। নিমন্ত্রিত আশে পাশের সকলে। মির্জা আর শিকদারদের মিলনমেলা দেখার জন্য উৎসুক জনগন। পর পর তিনটে পুলিশের গাড়ি এসে থামল। পুলিশ কমিশনার মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। দুই পরিবারের এই দ্বন্দ্বে ওনার জীবন অতিষ্ঠ ছিল। আজ ওনার সুখের দিন। রগচটা জাফর মির্জা হুট করেই বেশ মেজাজে রয়েছেন। কমিশনারের সাথে হাত মিলালেন।
“শুকিয়ে গেছেন কমিশনার সাহেব।”
“কিছুটা। তবে আমি বড়ো খুশি হয়েছি জাফর ভাই। আজ কব্জি ডুবিয়ে আপনার বাসায় খাওয়া দাওয়া করব। মোটা হতে সময় লাগবে না।”
কমিশনার হাক ডেকে হাসতে লাগলেন। জাফর মির্জা অতিথিদের রিসিভ করছেন। ঝিলের পাঁচ ভাই ব্যস্ত নানান কাজে। কিছু সময় পর শিকদারদের গাড়ি এসে থামল। একে একে ছয়টা গাড়ি। জাফর মির্জার অন্তঃকরণ থেকে বের হয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। দুদিন পূর্বেও যাদের বিরুদ্ধে লড়েছে আজ তাদেরই আপ্যায়নে মেতেছে। জীবন কতভাবে বদলে যায়! তিনি নিজ থেকেই গেলেন। কুশলাদি শেষ করলেন। ওনার এই আচারণে তুষ্ট শিকদার পরিবার। এতদিন পর মনে হলো সত্যিই সুখ এসেছে বুকের ভেতর। সকলেই সহজ হওয়ার চেষ্টা করছেন। মা বাবার সাথে এল অভিনব। ওনারা গত কালই বাংলাদেশে এসেছেন। ইহরিমার চোখ জ্বালা করছে। মির্জা বাড়ির তিন বউ এর সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল ওনার। দু পরিবারের মিলনমেলা দেখার কত শখ ছিল মনে। অথচ আজ সব আছে শুধু তারা নেই।
“মন খারাপ করে লাভ নেই মম।”
“কি থেকে কি হয়ে গেল অভিনব। তিনটে ভালো মানুষ আজ কত দূরে।”
চোখের জল মুছলেন তিনি। অহেদ সরকার স্ত্রীকে সামলালেন। তরুণের শরীর মেজ মেজ করছে। গত কিছুদিন ধরেই মনটা খারাপ। মাহেরার প্রতি অনুভূতি তৈরি হয়েছে ইদানীং। অথচ মেয়েটা তার সাথে সহজ নয়। তবু সে চেষ্টায় আছে। দুজনেই ভাঙা নৌকার মাঝি। অভিনবর জন্য আসতে হলো। শুরুতেই মৌনতার সাথে দেখা হয়। মেয়েটি আসলেই মারাত্মক সুন্দরী। সে নরম রোদের মতো দুই ঠোঁট প্রসারিত করে হাসল। যেদিন থেকে জেনেছে মৌনতা আর রোহনের সম্পর্কের কথা,ঠিক সেদিনই সরে এসেছে হৃদয়ে জন্ম নেওয়া এক পাক্ষিক সম্পর্ক থেকে।
ঝিলের বন্ধুমহলের সাথে নেমে এসেছে ঝিল। লাল রঙের চাদরে তাকে আড়াল করে রাখা। টাকা দিলেই দেখতে পাবে। অভিনবর ভাই গুলোও টাকা দিবে না বলে স্থির করেছে। এদিকে দানেশকে নিয়ে টানাটানি চলছে। সে বুঝতে পারল ছেলে পক্ষে থাকলে টাকা খসবে তাই সুযোগ পেয়ে মেয়ে পক্ষে চলে এসেছে। এই নিয়ে হাসাহাসির শেষ নেই। ভাইদের অভিযোগ শুনতে হচ্ছে। তবু টাকা বেঁচে যাওয়ার লোভে সে মেয়ে পক্ষেই স্থির হয়ে রইল। ওদের এই কান্ডে অভিনব অশান্ত হয়ে পড়ল। সে উঠে এসে বলল, “আমার বউ আমি দেখব তাতে টাকা কেন দিব?”
ঝিলের বান্ধবীরা চিল্লিয়ে উঠল। অতো সহজ নয় তাদের মেয়েকে নেওয়া। অভিনব এক কান্ড করে বসল। সকলকে ভেদ করে ঝিলের নিকটে এসে মেয়েটিকে কোলে তুলে নিল। হঠাৎ করেই ঘটে গেল ঘটনাটা। সকলে হা হয়ে গেছে।
“আমার বউ আমি নিয়ে যাচ্ছি। আমার ভাইদের থেকে টাকা নিয়ে নিও দুষ্টু শ্যালক শ্যালিকার দল।”
হৈ হৈ শুরু হয়ে গেল। ঝিল হেসে যাচ্ছে। এই ছেলেটা একটু বেশিই লজ্জাহীন হয়ে যাচ্ছে না?
“পাগল হলে তুমি?”
“তোমার জন্যেই তো প্রজাপতি।”
ওদের এই দুষ্টুমিষ্টি ভালোবাসা দেখে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল আয়ুশ। নিজের অনুভূতিকে হ ত্যা করেছে সে। অনেকটা নিজ হাতেই তৈরি করে দিয়েছে ঝিল আর অভিনবর ভাঙা সম্পর্কটা। দুটো মানুষ যখন একে অপরকে সবটুকু দিয়ে চায় তখন তৃতীয় পক্ষের উচিৎ সরে আসা। ঠিক তেমনটাই করেছে সে। তাছাড়া সবার জীবনে পূর্ণতা থাকে না। যদি অপূর্ণতা না থাকত তবে পূর্ণতার সুখ বলে কিছু থাকত না আর।
পরিশিষ্ট:
মৃদু বাতাসে ঝিলের মসৃণ চুল ভেসে যাচ্ছে। শরীরে পাতলা একটি শাড়ি। জলাশয়ে পা ডুবিয়ে আছে সে। ঠান্ডা পানি পা থেকে মস্তিষ্ক অবধি অদ্ভুত ভালোলাগার এক শিহরণ দিয়ে যাচ্ছে। অভিনব মুঠো ভরে পদ্মফুল তুলছে। ঝিল সে পথেই তাকিয়ে রইল নির্নিমেষ। এক একটা পদক্ষেপ মন প্রাণ ভরে দেখছে সে। হিমেল হাওয়ায় পরিবেশে ছন্দ তুলেছে। নাকে এসে লাগছে আম কুঁড়ির ঘ্রাণ। মুগ্ধতা বয়ে চলেছে সর্বাঙ্গে। অভিনব চেচিয়ে উঠল।
“আই লাভ ইউ প্রজাপতি। আই উইল লাভ ইউ টিল দ্যা এন্ড অফ মাই লাইফ। ইউ আর মাই সানসাইন এন্ড হ্যাপিনেস।”
~সমাপ্ত~
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি