#সুখ_একটি_প্রজাপতি (২৭)
ঝিলকে দু হাতের সাহায্য নিজ বক্ষে চেপে ধরেছে অভিনব। যেন একটুখানি নড়চড় হলেই মেয়েটি কোথাও পালিয়ে যাবে। ঝিলের নরম দুটি হাত অভিনবর কোমর জড়িয়ে ধরা। মেয়েটি কতদিন পর মানুষটার সাথে দেখা করতে পেরেছে! ফুলের মৃদু ঘ্রাণে খুব সুন্দর অনুভূতি হচ্ছে। এদিকে লোক সমাগম নেই বিধায় এত সময় ধরে মেয়েটিকে বক্ষে স্থান দিতে পারল অভিনব। খানিক বাদে পায়ের শব্দ শোনা গেল। বিরক্ত মুখে ঝিলকে ছাড়ল অভিনব। ওর ইচ্ছে করছে অসভ্য হতে। মানুষ আসলে আসুক তাতে ওর যায় আসে না। কিন্তু বুদ্ধিমান, ভদ্র গোছের অভিনব অসভ্য হতে পারল না। মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে খানিক দূরত্ব বজায় রেখেছে। ঝিল ও নিশ্চুপ। লোক সমাগাম কমে এলে অভিনবর কাছে এসে ঘেঁষে।
“কি দিন এসেছে বলেন তো। আপনি আমার জন্য শুদ্ধ অথচ লোকের চোখে অশুদ্ধ।”
চমৎকার এক হাসির মাঝে নিজের ব্যথা লুকায় অভিনব। পুনরায় মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে। আশ্বস্ত করে বলে, “কখনো প্রেম করেছেন ঝিল? করেন নি তো। আমি ও তাই। প্রেম এল না এ জীবনে। অথচ দেখেন প্রকৃতি আমাদের প্রেম করার সুযোগ দিয়েছে। বিয়ের পর প্রেম করার মধ্যে যে অনুভূতি এটা আমি আপনি ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। ভাবুন কতটা সুন্দর এটা।”
বুকের ভেতর এসে লাগল কথাটা। প্রেমে পড়ার মতো সুন্দর অনুভূতি ঝিল পেলেও প্রেমের স্বাদ তো পায় নি। এই স্বাদ দিতেই বুঝি প্রকৃতি ওদের এমন পরিস্থিতি দিল?
রুদ্রম,নিয়ন,মায়রা আর মৌনতা পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে ঝিলকে কল করল। মেয়েটি আজ একটু আগেই বেরিয়ে গেছে। মৌনতা বুঝতে পারল ঝিল অভিনবর সাথে দেখা করবে। তাই ও ইনিয়ে বিনিয়ে বলে দিল ঝিল চলে গেছে। ওরা ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে একটা ফুড কার্ডে এসেছে। ছোট্ট স্টলের পাশে অনেকগুলো চেয়ার রাখা। সেখানেই বসেছে ওরা। আড্ডা চলছিল। ওমন সময় তরুণের সাথে দেখা।
“হায়।”
“হায়। আপনি এখানে কি করেন?”
“তোমরা যা করছো।” কথাটা বলেই ফুচকার প্লেট দেখাল। মৌনতা হাসল। তরুণ ওর সিট থেকে উঠে এসে ওদের পাশে বসল। রুদ্রম আর নিয়ন হাত মিলিয়েছে। মায়রা ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করে স্বাগতম জানায়। একটা সময় পর মায়রা বলে উঠে, “আজকের ট্রিট নিশ্চয়ই তরুণ ভাইয়ার পক্ষ থেকে আসবে।”
“একদম, আফটার অল তোমাদের সিনিয়র আমি।”
ওরা গল্প করছিল। এক ফাঁকে মৌনতার খুব ঝাল লাগে। মেয়েটি ব্যগ্র হয়ে উঠে। পানি এগিয়ে দেয় তরুণ। দ্রুত পানি পান করছে বিধায় মাথায় ইষৎ স্পর্শ করে বলে, “ধীরে ধীরে।”
পানিটা কয়েক নিশ্বাসে শেষ করে ফেলে মৌন। তারপর পুনরায় বসে যায় গল্পে। রোহন এদিক দিয়েই যাচ্ছিল। জ্যাম লেগেছে, রাস্তার পাশে মৌনতা কে দেখে চোখ ঘুরিয়ে ফেলল। কিন্তু দৃশ্যটা মাথা থেকে যাচ্ছে না। তরুণের সাথে মৌনতার আলাপচারিতা এর আগেও দেখেছে সে।
ঝিলের পরীক্ষা শেষ হতেই জাফর মির্জা বললেন শশুর বাড়ি যাওয়ার কথা। রজনীর ঘটনার পর কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে। তবে যাওয়া হয় নি। এসব শুনে ঝিলের মন খারাপ হলো। ওর বন্ধুরা ট্যুরের প্ল্যান করেছে। সেখানে গেলে অভিনবর সাথে দেখা হতো। কিছুদিন পাশাপাশি থাকতে পারত। মন খারাপ নিয়েই বাবার সাথে মামা বাড়ি গেল সে। এবার সাথে এসেছে আহনাফ। ভরসা দিয়েছে দ্রুত ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। ভাইয়ের কাঁধে মাথা রেখে পুরোটা সময় এল মেয়েটি। মামা বাড়িতে প্রবেশ করতেই শরীরটা কেমন খারাপ লাগতে শুরু করল। মায়ের মুখটা ভেসে উঠেছে। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে ভেতরে চলে এসেছে। আয়ুষের সাথে কথা হলো না সেদিন। কক্ষে এসেই ঘুম দিল মেয়েটি। পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে আয়ুষের সাথে দেখা। একটা হাসি দিয়ে ঝিল বলল।
“কেমন আছ আয়ুষ ভাইয়া?”
“ভালো আছি। খোঁজ নিলি এত সময় পর।”
“আমি ক্লান্ত ছিলাম।”
“হুম। বিকেলেই নাকি চলে যাচ্ছিস।”
ঝিল আমতা আমতা করে বলল, “হুম। ট্যুর প্ল্যান আছে তো।”
“আচ্ছা। যাওয়ার আগে দেখা করিস কিন্তু।”
আহনাফ সব ব্যবস্থা করে নিয়েছে। জাফর মির্জার সাথে কথা বলে ঝিলের রুমে এল।
“ট্যুরে অভিনব ভাই যাবে?”
“বলেছে যাবে।”
লজ্জা মিশ্রিত স্বরে বলল ঝিল। আহনাফ একটু চিন্তা করে বলল, “রোহন সাথে যাবে। কোনো সমস্যা নেই তো?”
“না। ভাইয়া গেলে বরং বেশি ভালো হবে।”
“ঠিক আছে। আমি সব দিক ম্যানেজ করে নিব। তৈরি হয়ে নে।”
ঝিল টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল। অভিনবর সাথে সুন্দর সময় কাটানোর কথা স্মরণ হতেই হাসল মেয়েটি। সন্ধ্যার মধ্যেই ওরা সবাই একত্র হলো। অন্যদিকে অভিনব তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। বিশেষ প্রয়োজনে তাকে নিউইয়র্ক যেতে হচ্ছে। যাওয়ার আগে ঝিলের নাম্বারে কল করল কিন্তু কাজ হলো না। মেয়েটি নিশ্চয়ই ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে। ওদের কথা হলো দুদিন পর। ঝিল কিছুটা অভিমান করেছিল। অভিনব ভীষণ লজ্জিত। কথা দিয়ে কথা রাখতে পারে নি যে। কিন্তু যখন বলল বাবার শরীর ভালো নেই তখন ঝিল যেন একদম নুইয়ে গেল। ব্যস্ত হয়ে পড়ল খবর নিতে। অভিনব বলল, “পাপা এখন ঠিক আছে। ছোট একটা অ্যাটার্ক হয়ে গিয়েছিল।”
“যাক আল্লাহ অল্পতেই রক্ষা করেছেন।”
“হুম।”
“আমি যদি যেতে পারতাম।”
“মন খারাপের কিছু নেই। আমি আছি মানেই আপনি আছেন।”
“আঙ্কেলের সাথে কথা বলা যাবে?”
“হ্যাঁ।”
অহেদ সরকার চোখ বন্ধ করে আছেন। অভিনব ধীর কণ্ঠে ডাকল।
“পাপা, পাপা তোমার মেয়ে কল করেছে।”
ভদ্রলোক হাসলেন। হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিলেন।
“কেমন আছ মামুনি?”
ঝিলের ভেতরটা ধক করে উঠল। কতটা সুন্দর করে ডাকলেন তিনি। ঝিল সরল গলায় বলল, “জী ভালো আছি। আপনার শরীর ভালো নেই শুনে খুব খারাপ লাগল। যদি আমি আসতে পারতাম।”
“চিন্তার কিছু নেই মামুনি। আমি ঠিক আছি এখন। আর খুব দ্রুত তোমাকে বাড়ি নিয়ে আসবে আমার অভিনব।”
ঝিলের সাথে আরও কিছু সময় কথা বলল। পুরোটা সময় অভিনব বাবার পানে তাকিয়ে ছিল। ভদ্রলোকের শ্বেত রঙা মুখশ্রী কেমন হয়ে আছে। সাদা মুখটায় র ক্ত জমে আছে যেন। কিছু সময় পর ইহরিমার সাথেও কথা হলো ঝিলের। মেয়েটির খুব কান্না পাচ্ছে। ভদ্রমহিলার সাথে একদিনের সুন্দর স্মৃতির কথা স্মরণ হলো। মায়ের স্নেহ পাওয়ার জন্য ঝিলের মনটা ভীষণ অশান্ত হয়ে পড়ল।
এবার অভিনব ফিরল তিন মাস পর। ঝিলের ভেতরটা
ঝ ল সে যাচ্ছিল কিন্তু প্রকাশ ছিল না। অভিনব ফিরেই গেল দানেশের কাছে। রজনী প্রেগনেন্ট। কথাটা শুনে না এসে পারছিল না। প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিয়েছে রাহিন। টাকা পয়সার পাশাপাশি খোঁজ খবর ও রাখে সে। যদিও সবটাই তার বাবার নির্দেশে। ইববান শিকদার ভাতিজাকে বাড়িতে ফেরার অনুমতি না দিলেও খোঁজ খবরের ক্রুটি রাখেন নি। এসব জানে না দানেশ। সবটাই হচ্ছে অগোচরে। রজনী রান্না করতে গেলে অভিনব বাঁধা দিল।
“ভাইয়া আপনি খালি মুখে ফিরে যাবেন?”
“খালি মুখে কোথায়। এই তো চা নাস্তা খেলাম। তুমি বোসো। দানেশ কি করছিস এখন?”
“ঘুরছি ফিরছি।”
“মজা না ভাই। কিছু করছিস নাকি বসে আছিস?”
“পাহাড়ি অঞ্চলে বিশেষ কিছু কি আর করব? তবে একটা ছোট বিজনেস শুরু করেছি। ভাইয়ের টাকায় আর কদিন।”
কথা শেষে হাসল দানেশ। ব্যথাটা লুকানোর প্রয়াস যেন। অভিনব ধীরে স্বস্তে উঠে পড়ল। চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলল,
“পাশেই একটা কারখানা খুলতে পারিস।”
“সেটা করা যেত। তবে এত গুলো পুরুষ মানুষ এখানে কাজ করলে রজনীর জন্য সমস্যা হয়ে যাবে।”
“পুরুষ মানুষ দিয়ে নয় মেয়ে মানুষ দিয়েই বিজনেস শুরু করতে বলেছি। চা তৈরির বিজনেস।”
আইডিয়াটা ভালো লাগল দানেশের। সেদিন বিকেল বেলা ওদের বেশ জমজমাট আড্ডা চলল। অভিনব বেশ কিছু উপহার এনেছে। সেসব পেয়ে রজনী প্রায় কেঁদে ফেলল। নিজের ভাইয়ের কথা স্মরণ হলো। আয়ুষ নিশ্চয়ই এমন উপহার দিত। কিন্তু ভাগ্য আজ কোথায় দাঁড় করিয়েছে। অভিনব অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করল দু পরিবারে মধ্যে একটা মিল করানোর। কিন্তু ব্যর্থতার উদয় হয়ে গেল তার আগেই। একটা জমি নিয়ে মামলা চলছিল। সেটা জিতে গেল মির্জারা। এতে শিকদাররা পুরো চটে গিয়েছে। হাই কোর্টে আপিল করেছে। আবার দু পরিবারের মাঝে লড়াই শুরু হলো। অথচ জমির মৃল্য খুব বেশি নয়। গত কয়েক বছরে মামলায় যে পরিমান টাকা খরচ হলো তা দিয়ে ওমন চার জমি কেনা যেত। টাকা দিয়ে যেন আত্মসম্মান কেনা হচ্ছে। অভিনব পুরো দমে পিছিয়ে এল এবার। মামাদের সাথে বৈঠক বসিয়েছে। পুরো বিষয়টা খুলে বলল। ঝিল ওর স্ত্রী এটা শুনে শিকদারটা যেন অদ্ভুত রকমের খুশি হয়েছে। ও বাড়ির মেয়েকে আনার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিল। কারণ এটা মির্জাদের উইক পয়েন্ট। কিন্তু মির্জারা নুইয়ে যাবার পরিবর্তে খেপে গেল। তারা মেয়ে দিবে না। শিকদাররা ও সুযোগ ছাড়তে চাইছে না। ঝিল পড়ল মহাবিপদে। এক দিকে ভালোবাসা আর অন্যদিকে পরিবারের সম্মান। এ নিয়ে মামলা অবধি হয়ে গেল। ঝিল যদি সায় দেয় তবে বাবা চাচাদের সম্মান মাটির সাথে মিশে যাবে। অন্যদিকে নিজের ভালোবাসা হারাতে হবে। এত চিন্তায় মেয়েটি আর সামাল দিতে পারছিল না। রাতে ঘুম হতো না। তাই ঘুমের ঔষধ নেওয়া শুরু হলো। অভিনব কল করলে সোজা সাপ্টা মানা করে দিল। এখন কিছু সময় একা থাকতে চায়। ধীরে ধীরে ওদের সম্পর্কটা অবনতির পথে যাচ্ছিল। আয়ুষ এ সময়টা কেমন করে যেন ঝিলের বন্ধু হয়ে গেল। জাফর মির্জা মনে মনে আয়ুষের সাথে মেয়ের সম্পর্ক চাইছিলেন। বিষয়টা তিনি খোলসা করে বলে দিলেন। এসব শুনে ঝিল বিশেষ কিছু বলে নি। ওর নীরবতা যেন পাহাড় সম আশ্চর্য তৈরি করে দিচ্ছে। সব শুনে অভিনব চটে গেল বেশ। ঝিলের ভার্সিটির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রাগে আক্রোশে ওর চোখ দুটি রক্তিম হয়ে উঠেছে। ইদানীং আয়ুষ ঝিলকে ভার্সিটি দেওয়া নেওয়া করে। অভিনবকে চিনতে অসুবিধা হলো না। অভিনব ঝিলের দিকে আগালে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। ঝিল নিশ্চুপ।
“ওর কাছে যাওয়ার সাহস করবেন না অভিনব সরকার ইহান।”
আয়ুষের দিকে ফিরে ও তাকাল না অভিনব। ও তাকিয়ে আছে ঝিলের দিকে। মেয়েটার শরীর দুলছে। চোখ দুটি স্থির। অভিনব এক পা এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করলেই আয়ুষের হাতটা ওর বুকে এসে ঠেকল। ওদের দেহের বলিষ্ঠতা প্রায় কাছাকাছি। দুজনের চোখাচোখি হলো এবার। অভিনবর মুখের চোয়াল ক্রমাগত উঠা নামা করছে।
“দূরত্ব বজায় রাখেন।”
অভিনবর ভীষণ হাসি পেল। যেই মেয়েটা ওর বুকের মাঝে তার থেকে কিসের দূরত্ব বজায় রাখবে? তবু ঝিলের পানে তাকাল আশা নিয়ে। ঝিল উল্টো দিকে চলতে শুরু করেছে। ছেলেটার মন তিক্ত হয়ে এল। চোখ দুটো ভয়ানক দেখাচ্ছে। ফর্সা মুখটা এতটা ভয়ঙ্কর লাগছে যে আশেপাশের মানুষ গুলোও কেমন থমকে গেল।
চলবে…
#সুখ_একটি_প্রজাপতি (২৮)
পরের একটা মাস অভিনবর জীবনের সব থেকে বাজে সময় গেল। ঝিলের সাথে একদমই যোগাযোগ নেই। ছেলেটা আজকাল কেমন নুইয়ে পড়েছে। সারাদিন ঘরের ভেতর থাকে। কখনো বা গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এদিক সেদিক। ইতোমধ্যে কয়েকবার বিভিন্ন কোম্পানি থেকে কল এসেছে। অভিনব একজন ট্রাভেলার। তার ভক্ত অনুরাগীরা দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায়। ছেলেটা ফটোগ্রাফি করতে জানে। নানান দেশের খুটিনাটি তথ্য সহ দারুণ সব ফটো তোলার অনন্য রেকর্ড রয়েছে তার। অথচ গত একমাসে এই প্রকৃতি ওকে আগলাতে পারে নি। প্রেমের নেশাটা বাকি সব কিছুকে হার মানিয়েছে। এরই মধ্যে ঘটে গেল আরেক কান্ড। আরফান যে মেয়েটির মোহে ডুবে নিজ স্ত্রীকে ভুলে বসেছে কিছুদিন পূর্বে তাকেই বিয়ে করে নিয়ে এল! সেই থেকে পুরো পরিবার রেগে আগুন। অভিনবর কানে আসলেও আমলে নেয় নি বিষয়গুলো। ওর জীবন কেমন রুক্ষ হয়ে গেছে। ঝিলের শূন্যতা ওকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। অনেক দিন পর নাস্তার টেবিলে এসেছে সে। মামিরা ব্যস্ত হয়ে খাবার দিচ্ছে। আরফানের নতুন স্ত্রীর নাম রিসা। বড়দের মাঝে হঠাৎ ই টেবিলে বসে পড়ল। অভিনব একবার পাশ ফিরে তাকিয়েছে। মেয়েটি অল্প বয়সী সুন্দরী স্মার্ট। তবে চেহারায় ভদ্রতার বিশেষ অভাব। বড়দের সামনেই খাবার খেয়ে চলেছে। নতুন বউ এর লেশ নামে মাত্র নেই! আরফানের মা আমেনা বিরক্ত হয়ে স্বামীর প্লেটে খাবার দিলেন। ইববান শিকদার এক চামচ খেয়ে উঠে গেলেন। রুচি চলে গেছে ওনার। একে একে খাবার রেখে উঠে গেল ওনার দুই ভাই লিটন ও মুজাহিদ শিকদার। অভিনব চুপচাপ খাবার খাচ্ছে। আরফান তৈরি হয়ে এসে ডাইনিং এ বসল।
“মা খাবার দাও।”
“নিজের খাবার নিজে নিয়ে নাও। না হলে স্ত্রী কে বল খাবার দিতে।”
“ও তো খাবার খাচ্ছে মা।”
“তো?”
“খাবারই তো বেড়ে দিতে বলেছি। এমন করছো যেন…। আমি নিজেই নিয়ে নিচ্ছি।”
রিসা পাশ থেকে বলল, “আমি দিচ্ছি।”
“না না তুমি খাও।”
পুনরায় খাবার খেতে লাগল রিসা। আরফান প্লেটে খাবার নিয়ে বলল, “কি অবস্থা ইহান?”
মুখ না তুলেই অভিনব বলল, “ভালো।”
“শুনেছি মির্জা বাড়ির মেয়ের শোকে ধরেছে তোকে। শোন তুই আমার ভাই। ওমন মেয়ে তোর আশে পাশে ঘুরবে। মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।”
রিসা মুখের খাবার টুকু চিবিয়ে বলল, “ইয়াহ ইয়াহ আরফান ইজ রাইট। ব্রো চিল।”
আমেনা বেগম বিরক্ত হয়ে চলে গেছেন। রিসা নামের মেয়েটি ওনার দু চোখের বি ষ। চরম অভদ্র এই মেয়ে। না হলে কেমন করে পারে অন্যের স্বামীকে বিয়ে করতে?
দুপুরে বেরিয়ে এল অভিনব। নিজেকে আর কষ্ট দিবে না বলেই স্থির করেছে। ভালো থাকার প্রয়াস নিশ্চয়ই করবে। শহর থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে সে। এখানটায় গাছপালা আর কিছুদূর পর পর ছোট ছোট ঘর। দেখতে সুন্দর লাগছে। সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে আচমকা বুকটা হু হু করে উঠল। ঝিলের মুখটা চোখে এসে ধরা দিচ্ছে। সে অশান্ত হয়ে গেল। পুনরায় গাড়ি নিয়ে শহরের দিকে এল। একে একে ঘুরতে লাগল অলিগলি। কোথাও শান্তি মিলছে না। এত অশান্তি বোধহয় আর অনুভব হয় নি। সন্ধ্যার দিকে একটা শপিং মলে এসে গাড়ি দাঁড় করায়। সেখান থেকে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নেয়। ফেরার পথে একটা দৃশ্য দেখে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। ঝিল আর আয়ুষ রাস্তা পার হচ্ছে। গাড়ির চলাচল বেশি বিধায় আয়ুষের হাত ঝিলের হাতকে আকড়ে ধরেছে। সেই সময়টা অভিনবর ইচ্ছে করল সব ধ্বংস করে দিতে। বিষয়টা মেনে নিতে পারছিল না। গাড়ির স্পীড বেড়ে গেছে কখন জানা নেই। ধুম করে একটা ট্রাকের সাথে এসে আ ঘা ত খেল। বা হাত আর হাঁটুর দিকটা জখম হলো। কপালের এক সাইট ও কেঁটে গিয়েছে। একটুর জন্য প্রাণটা হারায় নি। কিছু লোক এসে গ্লাসের বাইরে থেকে চেচামেচি শুরু করছে। অভিনব ধীর স্থিরভাবে গ্লাস খুলে দিল।
“আই এম ওকে।”
বিদেশী অভিনবকে দেখে অনেকের চোখ লাফিয়ে উঠেছে। ছেলেটা বা হাতটা চেপে ধরে বলল, “আমি ঠিক আছি। আপনারা যেতে পারেন।”
কি আশ্চর্য! বিদেশীর মুখে দারুণ বাংলা। অনেকেই থেমে রইল। অভিনব ধীরে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়েছে। ব্যথায় হাত নড়ানো যাচ্ছে না। কিছুটা সরে এসে তরুণের ফোনে কল করল। মিনিট দশেকের মাঝে পৌছে গেল তরুণ। অভিনবর বাহু চেপে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, “কেমন করে হলো এটা।”
“ট্রাকের সাথে গাড়ির ধাক্কা লেগেছে।”
“হায় আল্লাহ! ভাই ম’র’বি এভাবে।”
“ম’রেই তো গেছি।” ছোট করে বলা কথাটা তরুণের কর্ণপাত হলো না। সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে হসপিটালে কল করছে। অভিনব মাথাটা সিটে এলিয়ে বসেছে। তরুণ ঝড়সম গতিতে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। তারপর হসপিটাল থেকে ট্রিটমেন্ট করিয়ে বাসায় পৌছে দিল। ওর অবস্থা দেখে সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। আমেনা বেগম কাঁদছেন। ওর অন্য মামিরাও বেশ ব্যস্ত হয়ে গেছে। একজন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তো আরেকজন খাবারের ব্যবস্থা করছেন। কিছুটা সুস্থ হতে হতে কয়েকদিন পেরিয়ে গেল। অভিনব ভোর থেকেই বিচলিত। ক্যালেন্ডারে একটা তারিখ ঝলমল করছে। নোনা জলের কারণে দু চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।
ঝিলকে আংটি পড়িয়ে দিলেন ওর বড় মামা রাশিদ চৌধুরী। বড় মামি ডালিয়া বেগম আর ছোট মামি সুমতি বেগম একটু পর পর এসে ঝিলের রূপ গুণ ব্যবহার নিয়ে প্রশংসা করে যাচ্ছেন। মেয়েটা ওনাদের বাড়ির বউ হলে নিশ্চয়ই খুব ভালো হবে। ঘরের মেয়ে ঘরে থাকলে সমস্যা কোথায়? ঝিল নির্বিকার। এই বিয়েতে ওর যেমন মত নেই তেমনি নেই দ্বিমত। পাপারা ডিভোর্স করানোর ব্যবস্থা করে চলেছেন। কয়েক দিনের মধ্যেই ফাইনাল হয়ে যাবে সব। তারপর ঝিল আর আয়ুষের বিয়ের আয়োজন হবে। মৌনতার এবার খুব অভিমান হয়েছে। ঝিলের উপর রাগ করে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে সে। গত কাল ঝিলের বাবা ইনভাইট করেছেন। তাই ওকে একপ্রকার বাধ্য হয়েই আসতে হয়েছে। ঝিলের এই সাজ দেখে মৌনতার কান্না পাচ্ছে খুব। অভিনবর কথা স্মরণ হচ্ছে। ছেলেটার অবস্থা কল্পনা করতেই শিউরে উঠে শরীর। ওর বেস্ট ফ্রেন্ডকে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সব থেকে স্বার্থপর বলে মনে হলো। রাগে দুঃখে বের হয়ে গেল সে। রোহনের সাথে সেখানেই দেখা। দু চোখ ভর্তি জল। একটা টিসু এগিয়ে দেয় রোহন। সেটাতে চোখ মুছে নেয়।
“কেঁদে লাভ নেই। যা হচ্ছে হতে দাও।”
“এতটা পাষাণ কেন আপনারা?”
“না বুঝে মন্তব্য করবে না মৌন।”
“বুঝেই বলছি। এমন করে কেউ? ওদের এত বছরের বিয়েটা। আপনারা চাইলেই সব ঠিক হয়ে যেত।”
“ঘরে গিয়ে বোসো।”
“আসলেই আপনারা পাষাণ। মন বলে কিছু নেই।”
মৌনতার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রোহন শ্বাস ফেলল। উষ্ণ শ্বাসের ছোঁয়ায় চারপাশ ভরে উঠল। বুকের ভেতর কেমন যেন আর্তনাদ ছড়িয়ে যাচ্ছে।
ঝিলের অনেক গুলো হাস্যউজ্জ্বল ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট হয়েছে।ওর মুখশ্রীতে থাকা প্লাস্টিকের হাসিটা ধরতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না অভিনবর। বার বার ছবি গুলো দেখছে সে। যত সময় যাচ্ছে ততই অশান্ত হয়ে পড়ছে। দিন দুয়েক আগেই নোটিশ এসেছিল। মাস খানেকের মধ্যে বিচ্ছেদের কাগজ পাঠানো হবে। তারপর চিরদিনের মতো ওরা আলাদা হয়ে যাবে। অভিনব ভাবতেও পারছে না ওর সব অনুভূতি মিথ্যে হতে চলেছে। ওর স্ত্রী, ওর প্রজাপতি ওর জন্য চরম অশুদ্ধ হয়ে যাবে। এত এত কষ্ট কোথায় লুকাবে অভিনব?
রাত সাড়ে এগারোটার দিকে মৌনতা বলল,
“ভাইয়ার সাথে দেখা করবি?”
চোখ ঘুরিয়ে তাকাল ঝিল। শরীরে ইষৎ কম্পন ধরেছে। মৌনতা এবার উঠে বসল। লাইট অন করে বলল, “আমি জানি তুই এখনো ভাইয়াকে ভীষণ ভালোবাসিস।”
ঝিল নিরুত্তর। ওর বাহুটা ধরে মৌনতা বলল,
“এমন ভুল করিস না যার জন্য তুই আপসোস করবি।”
এবার ঝিল তাকাল। অভিনবর প্রতি ওর অনুভূতি কখনো ফিঁকে হবার নয়। মানুষটা যে ওর আত্মার সাথে মিশে গেছে। যার ভেজা ঠোঁটে ওর সমস্ত সুখ। বুকের মাঝে ভরসা সেই মানুষটাকে ভোলা কি আদৌ সম্ভব?
রাতের আঁধারে খুব সহজেই মামা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল ঝিল। মৌনতা জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। ঝিল সাবধানে বেরিয়ে ইশারা করতেই শ্বাস ফেলল। গ্রামের সড়ক বেয়ে ছুটছে মেয়েটি। কিছুটা পথ যেতেই একটা সাদা রঙের গাড়ি দেখতে পেল। অভিনবর লম্বা চওড়া অবয়ব দেখতে পেয়ে বুকের ভেতর ধীম ধীম আওয়াজ হতে শুরু করেছে। কত দিন পর মানুষটার সাথে দেখা হবে। কতদিন পর মানুষটার কণ্ঠ শুনবে। এই উত্তেজনা, আবেগ অনুভূতি ঝিলকে পাগল করে দিল। মাটির সাথে যেন পা আটকে গেল। এতটা কাছে এসে এখন পথ চলতে পারছে না সে। অভিনব ওর দিকে তাকাল একবার। এই দৃষ্টি যেন ওকে ভস্ম করে দিল। ওর শরীর অসম্ভব ভাবে কেঁপে উঠছে। অভিনব ধীর স্থীর পায়ে এগিয়ে এল। খানিকটা দূরত্ব রেখে বলল,”হ্যাপি সেভেন এনিভার্সারি প্রজাপতি।”
বিস্মিত ঝিলের দুটি চোখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল। নিশ্চয়ই রাত বারোটা বেজে গেছে এখন। অভিনব ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করে হাসছে। তারপর গাড়ির ভেতর থেকে কেক বের করে আনল। মেয়েটার হাত ধরতেই শিরশির অনুভূতিতে ছেঁয়ে গেল শরীর মন। দুজন মিলে কেক কাটল। তারপর সবুজ ঘাসে বসে রইল কিছু সময়। ঝিলের মাথাটা অভিনবর কাঁধে এলানো। এর মাঝে একটা কথাও হলো না ওদের। আকাশের সুন্দর চাঁদ। রূপোর থালার মতো লাগছে। মৃদু বাতাস আর শরীরের ঘ্রাণ। সব মিলিয়ে রূপকথার মতো লাগছে পরিবেশটাকে। ঝিল দু চোখ বন্ধ করে নিল। মাথাটা কাঁধ থেকে একটু একটু করে বুকের দিকে অগ্রসর করছে। সময় যেন চোখের পলকে চলে যাচ্ছে। ভোর হবে তখন। অভিনব বলল,
“উঠুন প্রজাপতি। ভোর হওয়ার আগেই গ্রাম ছাড়তে হবে।”
আশ্চর্যজনক ভাবে পিছিয়ে এল ঝিল। ওর চোখের ভাষা ভিন্ন। অভিনব কষ্ট পেল। দু হাত বাড়িয়ে বলল, “আমায় ছেড়ে দিবেন ঝিল?”
এত আকুলতা নিয়ে কখনো কথা বলে নি অভিনব। ঝিলের ভেতরটা শূন্য হয়ে এল। খুব কান্না পাচ্ছে ওর। খোলা চুল গুলো উড়ছে। চোখের জল গুলো শুকিয়ে এসেছে। সুন্দর অনুভূতি গুলো তিক্ততার সাথে খেলা করছে। উত্তেজনা পেরিয়ে গেছে। এখন কেবল ঝিল পড়ে আছে। সে চায় না মানুষটাকে ছাড়তে। কখনোই চায় না। অভিনবর ভরাট হাত দুটি ঝিলকে বুকের কাছে টেনে নিল। শক্ত করে চেপে ধরল। এতটা অনুভূতি এসে ঠেকেছে যে ওর কথা হারিয়ে গেছে। বুকের ভেতরে থাকা হৃদপিণ্ড লাবডাব শব্দ করছে। সেসব মনোযোগ দিয়ে শুনল ঝিল।
“চলেন প্রজাপতি। ভোর হলে সমস্যায় পড়ব।”
ঝিল উত্তর করল না। অভিনব ওর হাতটা ধরে চলতে গেলেই বাঁধা প্রাপ্ত হলো। অবাক নয়নে তাকাল মেয়েটির মুখে। ঝিল নজর সরালো। হাতটা সরিয়ে নিয়েছে। অভিনব ক্ষণে ক্ষণে অবাক হচ্ছে।
“আপনি নিশ্চয়ই নেগেটিভ উত্তর দিবেন না প্রজাপতি।”
ওকে ভুল প্রমাণ করতেই বোধহয় উত্তরটা দিল ঝিল। অভিনব পিছিয়ে গেল। দুটি চোখ রিক্ত। বুকের ভেতরের শূন্যতা। মাথার উপর আঁচড়ে পড়া ঢেউ। বাতাস যেন সা সা করে বয়ে চলেছে। তীব্র বজ্রপাতে ভস্ম হয়ে যাবে যেন। অবিশ্বাস্য ভরা কণ্ঠ, “সত্যিই ডিভোর্স দিতে চান আপনি?”
ঝিলের হৃদয় ধক করে উঠল। বিষণ্ণ দুটি চোখ রক্তিম হয়ে আছে। গলায় জোর নেই বিন্দু মাত্র। শুষ্ক দুটি ঠোঁট চেপে ধরল সে।
“আপনার কাছে যেমন পরিবার সবার আগে আমার কাছেও আমার পরিবার সবার আগে। আপনি যেমন পরিবার ছাড়তে পারবেন না আমিও তেমন পরিবার ছাড়তে পারব না।”
“এসব কেন বলছেন ঝিল? তবে আমি আপনার কেউ না?”
নজর সরায় ঝিল। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। জোনাকিরা উড়ছে। মাথার উপর ভোরের পাখির কলতান। পাশেই বহমান নদী। স্রোত আর ভাটায় মেতে আছে। সব এত সুন্দর অথচ ঝিলের বুকের ভেতর ঝড়। যে ঝড়ে সবটা ধ্বংস হতে শুরু করেছে। ভোরের আলো উঠার সাথে সাথে অভিনব আর ঝিল আলাদা হয়ে গেল। সমস্ত সুখ,অনুভূতি আজ বড্ড হেলায় পড়েছে। চোখের পলকে শেষ হয়ে গেল সাজানো গোছানো সুখময় সম্পর্কটা।
চলবে….
#সুখ_একটি_প্রজাপতি (২৯)
কানাডার হীমশীতল বাতাসে ঝিলের শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠল। বরফ শীতল বাতাসটা সোজা নাক দিয়ে প্রবেশ করে হৃদপিণ্ড অবধি পৌছে যাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে শ্বাস ফেলছে সে। রাস্তা, গাছ, বাড়ি সব কিছু তুষারের নিচে। কয়েক দিন ধরেই বেশ তুষারপাত হচ্ছে। শহরের রাস্তা গুলো জ্যাম হয়ে আছে বরফে। এই বরফকে জয় করে কানাডিয়ানরা বের হয়ে এসেছে। ঝিলের শরীরে মোটা জ্যাকেট। তবু ঠান্ডায় কম্পন ধরে গেছে। ছোট ছোট বাচ্চারা চলছে স্কেটিং বোর্ড হাতে। কেউ কেউ আবার বাড়ির সামনে তৈরি করে রেখেছে ছোট বড় তুষার মানব। এসব দেখে ঝিলের বাচ্চা মন নড়ে উঠল। বিকেলের শেষ ভাগ নির্বিঘ্নে বাইরেই পার করল সে। সন্ধ্যার আলো যখন কানাডার টরন্টো শহর স্পর্শ করেছে তখন বরফ গুলো অন্যরকম দেখতে লাগল। কিছুটা রক্তিম হয়ে ধরা দিচ্ছে। এই সৌন্দর্য আগে দেখেনি ঝিল। আরও কিছু সময় বাইরে থাকতে পারলে ওর ভালো লাগত। তবে রাত বৃদ্ধির সাথে সাথে ঠান্ডার প্রকোপ ও বাড়ে। মেয়েটি তড়াক গতিতে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। ড্রয়িং রুমে এ হিটার জ্বালানো হয়েছে। পুরো ঘর উষ্ণতায় ভরে উঠেছে। লম্বা করে শ্বাস নিতে গিয়ে অনুভব হলো নাক বন্ধ হয়ে আছে। এই বিষয়টা ওর নিকট মারাত্মক বাজে। শ্বাস না নিতে পেরে মেয়েটি মুখ হা করে রইল। কি যন্ত্রণা! এমি সুস্বাদু রান্না বসিয়েছে। সেটা থেকে সুন্দর ঘ্রাণ বের হচ্ছে। হাল্কা একটু নাকে এসে লাগলেও পরে আর ঘ্রাণটা বুঝতে পারল না ঝিল। এমি ইশারায় ডেকে নিল। কাছে যেতেই স্পষ্ট ইংরেজিতে বলল, “অনা দেখ তো খাবারটা কেমন হয়েছে।”
ঝিল মৃদু হেসে বাটিটা তুলে এক চামচ স্যুপ মুখে তুলল। খাবারটা নিশ্চয়ই ভালো হয়েছে। তবে ঘ্রাণটা ঠিক মতো নাকে যাচ্ছে না। এটাই সমস্যা। তবু সে হেসে প্রশংসার সাথে জবাব দিল।
“আমেজিং,তোমার হাতে রান্না সত্যিই অসাধারণ এমি।”
প্রশংসা শুনে হাসল এমি। ঝিল বাটিতে থাকা খাবারটুকু শেষ করে ডিভানে এসে গা এলিয়ে দিল। এত সময় বাইরে থেকে শরীর বরফ শীতল হয়ে গিয়েছে। এমি খাবার রান্না শেষে কিচেন গুছিয়ে দিল। তারপর ডাইনিং এ সব রেখে ঝিলের পাশে বসল। টিভি অন করে কিছু সময় এক সাথে ইংলিশ সিরিজ দেখল।
“অনা তুমি কানাডা ইনজয় করছো?”
“খুব। কানাডা আমার সত্যিই ভালো লেগে গেছে। তবে একটু বেশি ঠান্ডা।”
এমি হাসল। ঝিলের সাথে ওর বন্ধুত্ব হয়ে গেছে খুব দ্রুতই। মেয়েটির নাম উচ্চারণ করতে কিছুটা সমস্যা হয়। তাই অহনা নামটা থেকে অনা বলে শর্ট করে নিয়েছে। ঝিল নামটি সে কিছুতেই বলতে পারে না। প্রথম দিন নিজের নামের বিকৃতি শুনে ঝিলের দু চোখ বড় বড় হয়ে গিয়েছিল। অনা কয়েকবার ইংলিশে অহনা মির্জা ঝিল লিখে প্র্যাকটিস ও করেছে। কিন্তু লাভের লাভ হলো না। উচ্চারণটা কিছুতে হলো না। হতাশ হয়েছিল সে। ঝিল কিছুটা বিরক্ত হলেও পরে অবশ্য সামলে নিয়েছে। কানাডার বরফ শীতল বাতাস এখন ঝিলের কাছে ভীষণ প্রিয়। চারপাশের অচেনা রূপ লাবণ্য ওকে আকৃষ্ট করছে। শুধু মনে হয় আল্লাহর সৃষ্টি কত সুন্দর!
এমি আর ঝিল গল্প করতে করতে বেশ কিছুটা রাত হয়ে গিয়েছে। অভিনবর গাড়ির শব্দ শোনা গেল। ঝিল ধরমরিয়ে উঠে পড়ে। দরজা খুলেই নজরে এল চওড়া বুক। লম্বাটে অভিনবর গায়ে সেমি লং জ্যাকেট। গলায় লাগানো আছে শুভ্র রঙা মাফলার। হাতে ব্যাগ। সব মিলিয়ে মানুষটাকে অতিরিক্ত সুন্দর লাগছে। পুরো দমে বিদেশী! ঝিল হা হয়ে তাকিয়ে। অভিনব ভেতরে এসে ডোর অফ করে দিল। এমির সাথে কুশলাদি করতেই এমি বলল, “আই হ্যাভ টু গো নাউ।”
অভিনব ভদ্রতার খাতিরে বলল, “আজকে থেকে যাও এমি। অনেক রাত হয়েছে।”
“নো। ইনজয় ইউর টাইম। বাই অনা। মিট ইউ টুমোরো।”
হাত নাড়িয়ে বিদায় জানায় ঝিল। অভিনব কিছুটা ক্লান্ত। হাতের ব্যাগটা সোফায় রেখে জ্যাকেটটা খুলে ফেলে। ভারী পোষাকে অতিষ্ঠ সে।
“ক্লান্ত লাগছে?”
“কিছুটা।”
ঝিল পানি এগিয়ে দিল। অভিনব পানিটা শেষ করে বলল, “খাবার খাও নি কেন?”
“একা খেতে ইচ্ছে করে না।”
“এমি তো ছিলই।”
“তবু ভালো লাগছিল না।”
“বুঝেছি। আর লেট করবে না। আজই শেষ,ওকে?”
“হুম।” বরাবরের মতোই হুম বললেও অভিনব জানে ঝিল অপেক্ষা করবে। ওর ফেরা অবধি না খেয়ে থাকবে। স্যুপ আর রুটি করে গেছে এমি। শুরুর দিকে টেস্ট মিলাতে সমস্যা হচ্ছিল ঝিলের। কিছু দিন যেতেই সবটা মানিয়ে নিল। অভিনব ধীর স্থির ভাবে খাবার খেল। পুরোটা সময় সে খাবারে মনোযোগ দিয়েছে। খাবার শেষ হতেই ঝিল বলল, “তুমি কোনো ভাবে রেগে আছ?”
“না।”
“তাহলে?”
“তাহলে আবার কি?”
“কেন যেন মনে হচ্ছে রেগে আছ।”
“রেগে কেন থাকব!”
“আগের মতো ভালোবাসো না আমায়।”
“সত্যিই বাসি না?”
“হুম।” মাথা নুইয়ে ফেলল ঝিল। অভিনব অগোচরে হাসল। জ্যাকেট গুছিয়ে রেখে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে এল। এদিকে ছটফট করছে ঝিল। গত দু মাসে অনেক কিছুই বদলে গেছে। ঝিল সেদিন পারে নি অভিনবকে ছেড়ে দিতে। পরিবারের সম্মানের সাথে সাথে অভিনবর প্রতি ভীষণ আসক্ত সে। পরিবারের মায়া ফেলে সেদিন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেছিল নিজের ভালোবাসাকে। বলেছিল দূরে কোথাও নিয়ে যেতে। যেখানে কোনো পরিবারের মোহ থাকবে না। থাকবে না কোনো দ্বন্দ্ব। মেয়েটির কথায় সায় জানায় অভিনব। পালিয়ে আসে ওরা। চোখের পলকে পাসপোর্ট ভিসা তৈরি করে ফেলে। দশ দিনের মধ্যে চলে আসে কানাডা। কেউ জানে না ওদের খবর। পারিবারিক দ্বন্দ্বের রোষানলে পুনরায় গা ভেজাবে না ওরা। এখানে এসেই ব্যস্ত হয়ে যায় অভিনব। ঝিল বুঝতে পারে ছেলেটির ব্যস্ততা। তবু কোথাও একটা শূন্যতা কাজ করে। কতদিন হয় একে অপরের সাথে ঠিক ঠাক গল্প জমানো হয় না। দিনের বেলা এমির সাথে কাটিয়ে দিলেও রাতের আঁধার ওকে একাকিত্ব বোঝায়। এই নিয়ে কখনো অভিযোগ করে না মেয়েটি। ও বুঝতে পারে সব। তবু আজ অভিমান হলো। পুনরায় ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে ছেলেটা। ঝিলের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। মেয়েটি চাতক পাখির মতো চেয়ে। মানুষটা দেখছে না একটিবার! ওর মন খারাপ হলো। রুম থেকে বেরিয়ে ট্রেরেসে এসে দাঁড়াল। টরন্টো শহরটা তখন আলোয় ঝলমল করছে। ভীষণ রকমের সুন্দর লাগছে। বরফে ঢাকা গাছ গুলো থেকে থেকে ঝলকানি দিচ্ছে। কোথাও কোথাও আগুন জ্বালানো হয়েছে। সেই হলুদ আলোতে সিক্ত হয়ে আছে চারপাশের পরিবেশ। ঠান্ডা বাতাসটা একেবারে শরীর মন স্পর্শ করে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করল ঝিল। সবুজ সোনালি বাংলার বুক ভেসে উঠল। হঠাৎ করেই মনে হলো বাংলাদেশের থেকে সুন্দর বুঝি কিছু নেই। পাখির কিচিরমিচির, লোকজনের সমাগম। থেকে থেকে জঙ্গল নদী নালা পুকুর ঘাট। সবটাই ভীষণ সুন্দর। ঠান্ডা শক্ত পুরুষ হাতটি ঝিলের ঘাড় স্পর্শ করে গেল। এই স্পর্শটা ওকে নুইয়ে ফেলল মুহূর্তেই। চুল গুলো রাবার ব্যান্ডে বাঁধা ছিল। সেটা খুলে দিয়ে ঘ্রাণ নিচ্ছে অভিনব। ধীরে ধীরে নাক ঘষতে শুরু করেছে উন্মুক্ত ঘাড়ে। ঝিলের শরীর দৃশ্যমান ভাবে কাঁপছে। অভিনবর একটা হাত আচমকা তুলতুলে কোমরটা ছুঁয়ে গেল। ঝিলের বুঝি ম র ণ এসে গেছে। এই অনুভূতিটা ওকে একদম মিইয়ে ফেলেছে। ছেলেটার বাহুডোরে আটকে আছে ঝিল! ধীরে ধীরে কাছিয়ে এসেছে মুখটা। উষ্ণ ঠোঁটের আন্দোলনে ঝিল নিজের সত্তা হারিয়ে ফেলল। খামচে ধরল ছেলেটির বাহু। ততক্ষণে অভিনব নিয়ন্ত্রণহীন। মেয়েটি আজ ওকে বাধ্য করেছে কাছে আসতে, সবটুকু দিয়ে ভালোবাসতে!
অভিনবর বুক জুড়ে প্রশান্তি। চিন্তাহীন ঘুমিয়ে আছে ঝিল। মেয়েটির ফর্সা উন্মুক্ত পিঠে ভালোবাসার চিহ্ন বসে গেছে। অভিনবর ক্ষেত্রেও তাই। মেয়েটি যেন ভেবেই রেখেছিল আজ নিজের উত্তাপে ভস্ম করে দিবে ওকে। এত যন্ত্রণা দিয়ে স্বার্থপরের মতো ঘুমিয়ে আছে মেয়েটি। অভিনবর হাসির রেখা লম্বা হলো। মেয়েটাকে বুকের সাথে আরেকটু মিশিয়ে ফেলল। পর পর চুমু খেল চোখে মুখে। ঝিল কিছুটা নড়ল। ঘুমুঘুমু দুটি চোখ। চাইল একবার। তারপর আবার আগের মতোই জড়িয়ে ধরল। ধীরে ধীরে অভিনবর হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরল। বুকে মাথা এলানো। এক হাত গলা জড়িয়ে। অভিনব একটু নড়তেই বিরক্তি প্রকাশ করল।
“এত নড়ছো কেন? ঘুমাতে দাও প্লিজ।”
হেসে ফেলল অভিনব। মেয়েটির খোলা চুলে হাত গলিয়ে বলল, “সারা রাত আমাকে অশান্ত করে দিয়ে শান্তির ঘুম দিচ্ছ প্রজাপতি।”
ঝিল শুনল না। সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ভোর হতে শুরু করেছে। অথচ অভিনবর ঘুম হারিয়ে গেছে। ঝিলের তুলতুলে পেটে হাত রাখতেই অভিনব চোখ বন্ধ করে নিল। মেয়েটা বুঝি ওকে সত্যিই মে রে ফেলবে!
দেড়ি করেই ঘুম ভাঙল ঝিলের। কানাডায় সূর্য কবে উঠবে কে জানে! সারাক্ষণ তুষার পাত হতে থাকে। এই সময়টা কিছু মানুষের জন্য আসলেই কষ্টের। কাজ কর্ম ফেলে ঘরে থাকতে হয় প্রায় সকলের। কম্বলের নিচে থাকা ঝিলের ছোট্ট দেহটা নড়েচড়ে উঠল। ধীরে ধীরে দিনের আলো দৃশ্যমান হলো। চোখ পিট পিট করে চাইল সে। উঠতে গিয়ে নিজেকে অনেকটাই উন্মুক্ত মনে হলো। লজ্জায় নুইয়ে পড়ল সে। পাশে তাকিয়ে বুঝল অভিনব নেই। চটপট উঠে পড়ল। সাইট টেবিলে একটা চিঠি। সাথে আছে এক কাপ চা। চিঠির ভাঁজ খুলল সে।
‘আমার লজ্জাবতীর মুখটা মিস করতে চাইছিলাম না। পরে ভাবলাম থাক আর লজ্জা না দেই। এমনিতেই গত রাতে আমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। নখের দাগ বসে গেছে শরীর বেয়ে। ভাগ্যিস কানাডায় আছি নতুবা নিশ্চিত ধরে ফেলত বন্ধুরা।’
লেখাটা পরে আরেক দফায় লজ্জা পেল ঝিল। নুইয়ে পড়ল কম্বলের উপর। মানুষটা লজ্জা দেবার জন্যেই বুঝি এভাবে লিখেছে। চা টা ঠান্ডা হয়ে গেছে। সেটা গরম করে নিল সে। তারপর জ্যাকেট জড়িয়ে বের হলো। অনেকেই উঠে গেছে। উঠার ই কথা। কম তো নয়। দশটা বাজে! রাস্তা গুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে। যথাসম্ভব বরফ সরিয়ে রাখছে। প্রতিটা বাড়ির উঠোনেই রয়েছে ম্যাপল গাছ। সেগুলো এখন বরফে ঢাকা। দু একটা পাতা তবু উঁকি দিচ্ছে। বিষয়টা খুবই সুন্দর লাগে। ঝিল মুগ্ধ নয়নে তাকাল। এই সময়ে ওর মনে হলো কানাডার সব সৌন্দর্য বুঝি এই ম্যাপল গাছেই!
চলবে….