#সুখ_একটি_প্রজাপতি (২৪)
অভিনবকে কল করে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল ঝিল। ওপাশ থেকে ভেতরে ভেতরে ব্যস্ত হয়ে পড়ল অভিনব। তবে বাইরেটা স্থির। ঝিল কান্নারত অবস্থাতেই বার বার বলছে, “আমি সেক্রিফাইজ করতে পারব না অভিনব। আমি পারব না হারাতে। সবকিছু চাই আমার। আমি কখনোই অপশনের মুখে পড়তে চাই না। আমি ম রে যাব তাহলে। আমি ম রে যাব। সত্যিই ম রে যাব।”
ঝিলের কান্না যেন আজ বাঁধ ভেঙেছে। এত এত কষ্ট হচ্ছে ওর। হৃদয়ের মধ্যভাগ যেন আজ উজাড় করে দিয়েছে কষ্ট নামক অনুভূতির সবটুকু। এত অনুভূতি আসলেই ভালো নয়। ওর কান্না ভেজা কণ্ঠটা নিশ্চয়ই অভিনবর চিত্ত কাঁপিয়ে তুলছে। তবু সে ধীর স্থির অনড়।
“কাঁদছেন কেন প্রজাপতি?”
কারো কণ্ঠে এত ভালোবাসা থাকতে পারে? অভিনবর কণ্ঠটা এই মুহূর্তে ঝিলের জন্য স্বর্গীয় সুখ। ছেলেটার বাহুডোরে নিজেকে মেলে ধরতে পারলে বোধহয় ভালো লাগত। অভিনব পুনরায় বলল, “পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন আমায় ছাড়বেন না প্রজাপতি। আমায় ছেড়ে দিলে পুনরায় ফিরে পাওয়া কঠিন হয়ে উঠবে।”
ধক করে উঠে ঝিলের বুক। অভিনবর কণ্ঠটা আজ এমন কেন? ওর গলায় একটা তেতো তরল এসে ঠেকে। অভিনবর মুখটা ভেসে উঠে দু চোখে। হারিয়ে ফেলার ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে রয়।
“প্রজাপতি, শুনছেন আমার কথা?”
“হুম।”
“এখনো কান্না করবেন?”
“উঁহু।”
“গুড। একটা কথা প্লিজ স্মরণে রাখবেন। আমরা চাইলেই সব হবে না। সময় কে সময় দিতে হবে। তবেই না পরিস্থিতি সুন্দর হবে।”
“আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না। ভয় হচ্ছে খুব। মনে হচ্ছে আমি হারিয়ে ফেলব।”
“ভালোবাসেন তাই ভয় হয়। একই ভাবে আমার আপনার পরিবার ও আমাদের ভালোবাসে। তাই ভীষণ ভয় পায়। দু পরিবার একে অপরকে ক্ষতিকর ভেষজ মনে করছে। তাই তো একে অপরের থেকে লুকানোর প্রচেষ্টায়। অথচ এক কালে এদের সম্পর্কটা খুব সুন্দর ছিল।”
সবগুলো কথা মনোযোগ দিয়ে শুনল ঝিল। এবার ওর মনে কিছুটা শক্তি এসেছে। ভালো লাগছে এখন। অভিনব ওকে সাহস দিতে পুনরায় বলল, “পরিস্থিতি যেমনই হোক, যেভাবেই হোক না কেন, আমাদের তো বিয়ে হয়েছে ঝিল। আমরা একে অপরের জন্য সর্ব উৎকৃষ্ট। যেখানে প্রেম আছে, মনের মিল আছে। একে অপরকে হারানোর ভয় আছে সেখানে আদৌ কি বিচ্ছেদ হয়? এটা কি সম্ভব প্রজাপতি। কখনোই সম্ভব নয়। মনে রাখবেন শারীরিক বিচ্ছেদ কেবল একটা গণনযোগ্য দূরত্ব।”
এবার ঝিলের মন ভালো হতে শুরু করেছে। ভেতর থেকে স্বস্তি আসছে। মেয়েটি বলল,
“একটা কথা বলবেন অভিনব।”
ওর কণ্ঠটা পেয়ে হাসল অভিনব। চারপাশ থেকে মৃদু সমীরণ এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে শরীর।
“বলেন প্রজাপতি।”
এই প্রজাপতি শব্দটা ঝিলের অন্তরে কেমন কম্পন ধরিয়ে দেয়। শ্বাস হয় ভারী। অদৃশ্য এক শান্তিতে পুলকিত হয় বুক।
“প্রশ্ন করলেন না তো ঝিল। কোন রাজ্যে হারালেন?”
“আচ্ছা, আপনি আমায় কেন প্রজাপতি ডাকেন?”
শব্দ করে হেসে ফেলল অভিনব। ঝিল এবার কিছুটা লজ্জা পেয়েছে। কল রাখতে চাইলেই অভিনব বলে, “লজ্জা পাবেন না প্রজাপতি।”
“উহু লজ্জা কেন পাব।”
“তাহলে ঠিক আছে।”
“হুম। রাখছি আজ।”
“সেকি, শুনবেন না?”
“কি শুনব?”
পাল্টা প্রশ্ন করে ঝিল যেন কিছুটা বোকা বনে গেল। আমতা আমতা করে বলল, “না মানে, মানে হচ্ছে।”
“মানে মানে করছেন কেন? আপনি কি ভয় পাচ্ছেন।”
“না।”
“তাহলে।”
“জানি না। ধ্যাত, আপনি ইচ্ছে করে এমনটা করলেন।”
“কেমন করলাম?”
“উফ। প্লিজ থামেন তো।”
“না থামব না।”
“তাহলে বসে থাকেন।”
“বসে ও থাকব না।”
“তাহলে কি করবেন?”
“ভালোবাসব।”
কেমন একটা অনুভূতি হলো ঝিলের। মেয়েটি এবার কথা বলল না। অভিনবর কণ্ঠের স্বরটা এবার শীতল হয়ে এল।
“নিচে নেমে আসবেন প্রজাপতি? ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।”
“কেন? আপনি এসেছেন নাকি।”
“হুম। নামতে পারবেন?”
“মজা করছেন?”
“একদম ই না।”
ঝিল এবার হেসে ফেলল। অভিনব বলল, “সত্যিই এসেছি প্রজাপতি।”
অভিনবর রসিকতা বুঝতে পেরে বিশ্বাস না হওয়া স্বরে ঝিল বলল,
“এসেছেন যখন তো উপরে উঠে আসুন। আপনি তো আগে উঠে আসতেনই। ইনফেক্ট বারান্দা খোলাও আছে।”
“আপনার কি মনে হয় আমি দেয়াল বেয়ে বারান্দা দিয়ে আসতাম?”
“কেন। বারান্দা দিয়েই তো যেতেন আপনি।”
“যেতাম তবে আসতাম না।”
ঝিল যেন কিছু বুঝতে পারছে না। অভিনব বলল, “আপনার বাড়ির গার্ডকে টাকা খাইয়ে বাড়ির ভেতরে মেডিসিন ছড়িয়ে সবাইকে ঘুমন্ত করতাম। তারপর ভেতরে চলে আসতাম। বারান্দার দরজা খুলে রাখতাম। যাতে আপনি ভাবেন আমি বারান্দা দিয়ে এসেছি। যাওয়ার সময় বারান্দা দিয়ে নেমে যেতাম। নামা যতটা সহজ উঠা ততটাই কঠিন।”
“এমন কেন করতেন?”
“স্পেশাল ফিল করানোর জন্য। সিনেমার নায়কদের মতো প্রেমিক এসে দেয়াল বেয়ে প্রেমিকার সাথে দেখা করবে এটা সব মেয়েরই স্বপ্ন।”
“কচু।”
“কেন? সত্যি না। আপনি কিছু অনুভব করেন নি?”
“অনুভব করি নি তেমন নয়। তবে এই যুক্তিটা ভীষণ অদ্ভুত।”
“তাই?”
“হুম। আর এসব গল্প কে বলেছে আপনাকে?”
“তরুণ বলেছিল। ভার্সিটিতে থাকাকালীন বাংলাদেশের মেয়েদের মন নিয়ে আমাদের বন্ধুদের বলত এসব।”
অভিনব ও তার বন্ধুমহলের বোকামি শুনে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাচ্ছে ঝিলের। মেয়েটির এমন হাসি অভিনবর ভালো লাগে। ইচ্ছে হয় আরেকটু শুনতে।
“বলদ হয়েছে আপনারা। এগুলো সব গুল। তবে কারো কারো এমন অনুভূতি থাকতেও পারে। আমি এসবের ধারে নেই। আমার মন বলে শুধু মনের কথা। সিনেমার গল্প তো সিনেমাতেই সুন্দর।”
“এই জন্যেই তো এত ভালোবাসি ঝিল। আপনি আমার প্রজাপতি। যাকে নিজের করতে হলে প্রজাপতির মতো কষ্ট করতে হবে। জানেন তো প্রজাপতির ডিম থেকে প্রথমে একটি শুঁয়োপোকা বের হয় তারপর ধীরে ধীরে সেটা থেকে তৈরি হয় প্রজাপতি। ঠিক তেমনি ভাবে আমাদের জীবনের সুখ একটি প্রজাপতি। প্রথমেই ফল পাওয়া যায় না ধীরে ধীরে আসে আমার মাঝে। আপনি আমার কাছে তেমনি ঝিল। তাই আপনাকে প্রজাপতি বলে ডাকি। আমি জানি আপনি হবেন আমার। তবে এর মাঝে অনেকটা সময় দিতে হবে। সুখের জন্য অপেক্ষা করতে হবে ঝিল। ভালোবাসি আপনাকে। আপনি কখনো পথচ্যুত হবেন না প্রজাপতি।”
ঝিলের বুক ভারী হয়ে এল। নিশ্বাস গুলো কেমন দাপাদাপি করছে। অভিনবর বুকে ঝাপিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়। তবে সব চাওয়া তো আর সম্ভব নয়। ওর কণ্ঠটা কিছু বলার পূর্বেই পেছন কেউ এসে দাঁড়ায়। অবয়বটা দেখে ঝিলের চিত্ত কেঁপে উঠে। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটা ওকে বেশ নড়বড়ে করে দেয়।
চলবে….
#সুখ_একটি_প্রজাপতি (২৫)
ফোনের এপাশ থেকে ক্রমাগত হ্যালো হ্যালো করে চলেছে অভিনব। কিন্তু ঝিল সাড়াহীন। মেয়েটি যেন কোনো ঘোরের মধ্যেই চলে এসেছে। চিন্তায় দম বন্ধ হয়ে আসছে। অসুস্থ শরীরটা উঠানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো সে। হাক ছেড়ে ডাকতে শুরু করেছে, “তরুণ, তরুণ কোথায় তুই।”
তরুণ সাড়া না দিলেও ছুটে এসেছে তুহিন। হাপাচ্ছে সে। অভিনবর ব্যস্ততা দেখে সে নিজেও বিচলিত হয়ে পড়ল। উৎকণ্ঠা যেন ঠিকড়ে পড়েছে।
“কি হয়েছে অভিনব। এমন করছো কেন? কোনো কিছু প্রয়োজন।”
“ভাইয়া আমাকে একটু উঠে বসতে সাহায্য করুন।”
বিনাবাক্যে কাজটি করে ফেলল তুহিন। অভিনব মেঝেতে পা রাখতেই একটা শিরশির অনুভূতি পা থেকে উঠে গিয়ে ছড়িয়ে গেল মস্তিষ্ক অবধি। যন্ত্রণায় মুখ থেকে বের হয়ে এসেছে আ র্ত না দ।
“অভিনব। আর ইউ ওকে?”
“তরুণ, তরুণ কোথায় ভাইয়া।”
“ও তো এখন বাসায় নেই।”
“উফ ওকে প্রয়োজন আমার।”
“কি হয়েছে তোমার? এমন অশান্ত হয়ে পড়েছ কেন!”
“জানি না। আমার মস্তিষ্ক কাজ করছে না।”
মাথা চেপে রইল অভিনব। তুহিন ভয় পেয়ে গেছে। চটজলদি বেরিয়ে এল সে। ক্রমাগত কল করতে লাগল তরুণের নাম্বারে।
রোহনের মুখের পেশি গুলো শক্ত হয়ে উঠেছে। বোনের প্রতি ওর ভালোবাসা কোনো ভাষাতেই প্রকাশ সম্ভব নয়। কিন্তু এভাবে ওর বিশ্বাস ভেঙে দিবে তা কখনোই ভাবে নি সে। একটা কষ্ট ওর বুক ভারী করে দিল।
“ভাইয়া, আমার কথাটা শুনো।”
“আর কিছু বলার আছে?”
মাথা নিচু করে ফেলে ঝিল। চোখ থেকে বের হয়ে আসে দু ফোঁটা নোনা জল।
“স্যরি ভাইয়া। এভাবে কষ্ট দিতে চাই নি।”
“কবে এত বড় হয়ে গেলি বনু? তোর লাইফে এমন কিছু কি আছে যা আমার জানা নেই। অথচ এত বড় সত্যিটা।”
“আমি খুব স্যরি ভাইয়া। প্লিজ আমায় ভুল বুঝো না।”
“ভুল বুঝি নি। তবে খুব কষ্ট হচ্ছে রে। মনে হচ্ছে কোথাও একটা ক্ষত।”
“ভাইয়া!”
“মায়ের দূর্ঘটনার পর সবথেকে বেশি একটা কথাই স্মরণ হয়েছে। আমাদের ছোট্ট বোনটা কেমন করে এই ব্যথাটা সইবে। তোর ব্যথার কথা ভেবে আমরা কষ্ট পাওয়া বন্ধের অভিনয় করেছি। আমরা পাঁচ ভাই সর্বদা একটা কথাই মনে রেখেছি। আমাদের বোন ছোট, তাকে সামাল দিতে হবে। দিতে হবে মায়েদের সবটুকু আদর। তুই ই তো বলিস আমি আর আহনাফ তোর বেস্ট ফ্রেন্ড তাহলে,তাহলে কেন লুকালি এত সব?”
এবার কান্নায় ভেঙে পড়ল ঝিল। ওর কান্নার শব্দে চারপাশ আন্দোলিত। রোহন নিজেকে শক্ত করতে পারছে না। ওর ভেতরের কষ্টটা কেমন নুইয়ে পড়ল মেয়েটির চোখের জলে।
দু হাত বাড়িয়ে বুকে আগলে নিল বোনকে। ঝিলের কান্না এবার কয়েকগুণ বেড়ে গেল।
“আমি আর কখনো কিছু লুকাব না ভাইয়া। প্লিজ আমায় ভুল বুঝো না। আমার কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে।”
তরুণ আসতে না আসতে অভিনব বলল, “তুই একটা হেল্প কর দোস্ত।”
“কি হয়েছে তোর?”
“ঝিলের সাথে দেখা করতে চাই। মনে হচ্ছে ওর কিছু হয়েছে।”
“এত হাইপার হচ্ছিস কেন। তুই তো উঠতেই পারছিস না। বোস শান্ত হয়ে।”
“আহা তুই বুঝতে পারছিস না।”
“কথা নয়। আগে বোস।”
স্থির হতে পারল না অভিনব। ভেতরে ভেতরে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে রয়েছে।
“সবটা ক্লিয়ার করে বল।”
“আমার মনে হচ্ছে কথা বলার সময় ওর ফ্যামেলির কেউ ধরে ফেলেছে।”
“কি বলিস!”
“হুম। ভয় হচ্ছে এবার। সন্দেহ হয়েছিল তখনি মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিল। আর যদি ধরা পড়ে তাহলে নিশ্চয়ই ওকে আমার থেকে পুরোপুরি আলাদা করে দিবে।”
চিন্তিত হয়ে গেল তরুণ। অভিনব অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। ঠিক সে সময় একটা কল এল। নাম্বারটা অচেনা।
“হ্যালো।”
“অভিনব ভাইয়া বলছেন?”
“জী। আপনি কে?”
“রোহন, ঝিলের ভাই।”
শক্ত হয়ে এল অভিনবর মুখশ্রী। মনে মনে প্রস্তুত হয়ে রইল। রোহন খুব সংক্ষিপ্তে কথা বলল, “আপনি বোধহয় এতক্ষণে বুঝে গেছেন আমি কিছুটা হলেও অতীতের ঘটনা জানতে পেরেছি। ফোনে কথা বলে মনের দিক থেকে শান্তি মিলে না। সরাসরি কথা হলে ভালো হয়। কাল বিকেলে দেখা করতে চাই।”
“হ্যাঁ নিশ্চয়ই। কোথায় আসতে হবে?”
“আমি লোকেশন ম্যাসেজ করে দিব।”
“ওকে।”
ফোন রাখতেই তরুণ ভ্রু কুচকে তাকাল।
“এমন করে তাকিয়ে আছিস কেন?”
“তুই বিছানা থেকে উঠতে পারছিস না। আর কাল দেখা করার কথায় রাজি হয়ে গেলি।”
ঠোঁট দুটো প্রসারিত হয়েছে ছেলেটার। অভিনবর এই মৃদু হাসিটা মারাত্মক। তরুণ নজর ঘুরিয়ে নিল।
“কিছু কিছু লড়াই এর জন্য শারীরিক অসুস্থতা হারাম হয়ে যায়।”
.
২৪ বছর বয়সী রোহন সুপুরুষ ই বটে। ওর সমবয়সী আহনাফ ও কম কিসের। চাচাতো ভাই হলেও ওদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা বেশি। আর ঝিল হলো ওদের প্রাণ। ৫ ভাইয়ের একটি মাত্র বোন। রোহনের বড় ভাই রাফাত। সে বর্তমানে পারিবারিক বিজনেসে সময় দিচ্ছে। আহনাফ বেশিরভাগ সময় শহরের বাহিরে থাকে। ছেলেটার বাহিরভাগ অতিরিক্ত শান্ত। কিন্তু সে মোটেও তেমন প্রকৃতির নয়। লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে চুল সেট করে নিচ্ছে। রোহন ড্রাইভিং সিটে বসেছে। কিছুক্ষণ পর পর গভীর ভাবনায় ডুবে যাচ্ছে। ওর ভাবনায় হারিয়ে যাওয়া দেখে প্রশ্ন ছুড়ল আহনাফ।
“কি ব্যপার? অন্য মনস্ক দেখাচ্ছে!”
“হুম। ভাবছি একটা বিষয়।”
“কোন বিষয়?”
“অভিনব ভাইয়ের বিষয়টা।”
“ও আচ্ছা। বুঝতে পেরেছি। ওনার বয়সের বিষয় নিয়েই তো ভাবছিস?”
“একদম। বনু আর ওনার বয়সের ফারাক ১০ বছর। এটা একটু বেশিই হয়ে গেল না?”
রোহনের দীর্ঘশ্বাসটা স্পষ্টত শুনতে পেল আহনাফ। ওর নিজের মস্তিষ্কেও এসেছে বিষয়টা। ১৯ বছর বয়সী ঝিল আর ২৯ বছর বয়সী অভিনব! দুজনের বয়সের ফারাকটা একটু বেশিই বলা চলে। সাধারণত এই বয়সের ছেলেরা মনের দিক থেকে অন্য রকম হয়ে থাকে। ঝিল আর অভিনবর জেনারেশনের পার্থক্য রয়েছে। দুই জেনারেশনে নিশ্চিতভাবে মতের অমিলের সম্ভাবনা থাকে। এই যে আহনাফ আর রোহন। দুজনের সাথে ঝিলের বন্ডিং খুবই সুন্দর। কিন্তু তাদের বড় ভাইদের সাথে বন্ডিং এত ভালো নয়। তারা সন্দেহহীনভাবে বোন কে ভালোবাসে। তবু কোথাও একটা বয়সের ফারাকটা বাঁধা দিয়েছে। ঝিলের বড় চাচার বড় ছেলে অর্থাৎ আহনাফের বড় ভাই মাহিন আর অভিনব সমবয়সী হবে। সেই দিক থেকে তুলনা করলে ঝিলের ভবিষ্যৎ বড্ড ভোগান্তির বলেই মনে হচ্ছে। দুই ভাই ভাবনাটা সরাতে পারছে না। বার বার মনে হচ্ছে সম্পর্কটা সঠিক হয় নি।
“আমাদের হাতে কোনো অপশন নেই। একটাই চয়েজ রয়েছে।”
“হুম। তবু যদি ছেলেটাকে বনুর জন্য পছন্দ না হয় তবে আমি অন্যরকম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবো আহনাফ। বনুর জন্য আমরা নিশ্চয়ই খারাপ চাইব না?”
“হুম। দেখা যাক কি হয়।”
রোহন আনমনা হয়ে উঠল। গাড়ি ড্রাইভিং এ মন বসছে না। একটা চিন্তা ওকে আড়ষ্ট করে দিচ্ছে। অভিনব সম্পর্কে অন্যরকম ধারণার জন্ম নিয়েছে। ছেলেটার কণ্ঠে বলিষ্ঠতা থাকলেও বয়সটা বড্ড ভাবিয়ে তুলছে। ঝিলের বয়সের তুলনায় ঊনিশ বয়স মানে অনেক বয়স। ওরা ভাই হিসেবে নিশ্চয়ই চাইবে বোনের জন্য সেরা পাত্র বের করার। কিন্তু এখন, এখন কি উপায়?
অভিনব সময়ের আগেই চলে এসেছে। ওর শরীরে ভীষণ জ্বর। তবু মুখের হাসিটা শারীরিক অসুস্থতার প্রকাশ দিচ্ছে না। পাশে বসেছে তরুণ। ঝিলের ভাইদের দূর থেকেই চিনতে পারল সে। ওদের দেখে এগিয়ে এলো। কুশলাদি করতেই আহনাফ বলল, “কি ব্যপার তরুণ ভাই। এমন শুকিয়ে এসেছেন কেন?”
“শুকাই নি ভাই। অনেকদিন বাদে দেখলে তো তাই এমন লাগছে।”
“হয়ত। আমাদের বাড়িতে আসেন না কেন?”
“যাব ভাই। খুব দ্রুতই যাব।”
কথাটা শেষ করে হাসল তরুণ। মাস কয়েক পূর্বেও মির্জা বাড়িতে গিয়েছে সে। তাও ওদের বোনকে পাত্রী হিসেবে দেখার জন্য! তারপর ওদের মায়েদের জন্য দোয়ার অনুষ্ঠানেও লুকিয়ে গিয়েছে। ভাগ্যিস এদের সাথে দেখা হয় নি। নতুবা প্রথমদিনের ঘটনাতেই এসপার-ওসপার ঘটে যেত। পাঁচ ভাই নিশ্চয়ই ছেড়ে কথা বলত না অভিনবকে।
চলবে….
#সুখ_একটি_প্রজাপতি (২৬)
ঝিল বড্ড অশান্ত হয়ে পড়েছে। তার দুই ভাই গিয়েছে অভিনবর সাথে দেখা করতে। নিশ্চয়ই অভিনব ফেলে দেবার মতো পাত্র নয়। বরং অত্যন্ত সুপুরুষ। তবু একটা ভয় হচ্ছে। এই ভয়ে সে প্রায় কেঁদে ফেলল! দু হাতে আগলে নিল মৌনতা।
“কিচ্ছু হয় নি সোনা। ভাইয়ার মতো মানুষকে কেউ অপছন্দ করতে পারে?”
“তবু ভয় কেন হয় মৌন?”
নিরুত্তর রয় মৌনতা। সে নিজেও ভেতরে ভেতরে ভীত হয়ে আছে। এর কারণ অভিনবর বাহ্যিক সৌন্দর্য নয় বরং মানুষটার পরিবার। যদিও বা রোহন আহনাফ সবটা জেনেছে। তবু মত বদলে গেলে? যদি দেখা করতে গিয়ে শত্রুতার কথা স্মরণ হয়। বোনের স্নেহ যদি ভুলে যায়। সবটা কেমন গুলিয়ে আসছে। চিন্তায় ওর নিজের ই মাথা নষ্ট। মেয়েটি ধৈর্যহীন হয়ে পড়েছে।
“একটা কল করে দেখ।”
“যদি ভাইয়ারা থাকে।”
“উম। সেটাও কথা। তবু কল করে দেখতে পারিস।”
“হুম।”
কলটা অল্প সময়েই রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে অভিনবর ভারী মিষ্টি কণ্ঠ, “কেমন আছেন প্রজাপতি?”
“ভালো। আপনি, আপনি এখন কোথায়?”
“লাঞ্চ করছি। আপনার ভাইদের সাথে। তারা কেউই খেয়ে আসে নি। আপনার চিন্তায় খাওয়া দাওয়া ভুলে গিয়েছে।”
“ভাইয়ারা পাশে?”
“হুম। কথা বলবেন?”
ঝিলের চোখ বড় হয়ে এল। ছেলেটা ওর ভাইদের সামনে বসে প্রজাপতি বলে ডেকে যাচ্ছে! সাহস লজ্জা দুটোই কি লোকটার জন্য সহজ বিষয়। ঝিল তিক্ততার সাথে বলল, “মাথা নষ্ট হয়ে গেছে? ভাইয়াদের সামনে বসে প্রজাপতি বলে ডেকে যাচ্ছেন!”
শব্দ করে হাসল অভিনব। ঝিল যেন বোকা প্রাণী। মেয়েটির মুখশ্রী কেমন রক্তিম হয়ে এল। চিন্তায় মস্তিষ্কের অবস্থা খারাপ।
“আপনি বড্ড বোকা ঝিল।”
“কেন?”
“আপনার ভাইদের সামনে প্রজাপতি বলে ডাকব আমি? যদিও বা ডাকতে সমস্যা নেই। ওরা বয়সে আমার বেশ কিছুটা ছোট। কিন্তু সম্পর্কে বড় বনে গেছে। একটা সম্মানের বিষয় আছে না।”
“হুম।” অনেকটা অন্যমনস্ক হয়ে জবাব দিল ঝিল। ক্রমশ মেয়েটি হারিয়ে যাচ্ছে। ভাবণা গুলো কেমন আন্দোলন শুরু করেছে। কান্না পাচ্ছে খুব। ওর ভাইরা অভিনবকে পছন্দ করেছে তো?
ভাইয়েরা ফিরা অবধি একটুও শান্ত থাকতে পারল না ঝিল। একবার উঠছে তো একবার বসছে। এমন করতে করতে অনেক সময় পেরিয়ে গেল। পুনরায় অভিনবর ফোনে কল করল। সময় নিয়ে রিসিভ হয়েছে। কিছুটা ক্লান্তি অনুভব হয় কণ্ঠটাতে। ওর মন খারাপ হলো। মানুষটা অসুস্থতার মাঝেও কেমন ছুটে চলেছে।
“ভাইয়ারা চলে গেছে?”
“হুম। মাত্রই গিয়েছে।”
“ওরা কি বলেছে?”
“কি বলবে ঝিল?”
“কিছু বলে নি। আমাদের সাপোর্ট করল নাকি….”
“আপনি বড্ড চিন্তা করছেন প্রজাপতি। এমন করলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন।”
“আমি আসলেই শান্তি পাচ্ছি না।”
“শান্ত হোন।”
তারপর কিছু সময় নিস্তব্ধ হয়ে রইল মেয়েটি। অভিনবর শরীরটা বিশেষ ভালো লাগছে না। তবু মেয়েটির চিন্তিত মুখ কল্পনা করে নিজের শারীরিক অসুস্থতার কথা ভুলে বসল।
“ওরা পজেটিভ রিয়্যাকশন দিয়েছে। আমি নিশ্চয়ই অপছন্দ করার মতো নয়?”
শেষ কথাটা বলে অভিনব কিছুটা হাসল। ঝিল যেন এবার নড়েচড়ে বসেছে। উত্তেজনা আরেকটু বেড়ে গেল। পুরো ঘটনা শোনার জন্য পেটের ভেতর গুড়গুড় করছে।
রোহন আর আহনাফের ধারণাটা ভুল ছিল। ঊনত্রিশ বছর বয়সী অভিনব চমৎকার ও অত্যন্ত সুপুরুষ মানুষ। বয়স কেবল সংখ্যা কথাটা যেন অভিনবর জন্যেই সৃজন হয়েছে। ছেলেটার বাহ্যিক রূপ মুগ্ধ করার মতো। তার থেকেও স্নিগ্ধ ছিল ব্যবহার। অসুস্থ অভিনব নিজের থেকে ছোট রোহন আর আহনাফের সাথে মোলায়েম ব্যবহারে সিক্ত ছিল পুরো সময়। ছেলেটাকে দেখে ওরা প্রায় অবাকই হয়েছিল। একটা সময় পর বুঝেছে ওদের মায়েরা নিজেদের মেয়ের জন্য সেরাটাই নির্বাচন করে দিয়ে গেছে। মনে মনে ওরা খুশি থাকলেও উপরিভাগটা অতোটা বিনয়ী ছিল না। এর কারণ অবশ্য দাম্ভিকতা নয়। ওরা চাইছিল আরেকটু সময় নিতে। অভিনব সম্পর্কে খোঁজ নিবে। তার পরই পুরোপুরি চিন্তামুক্ত হবে। ঝিল অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। ওর ভাইয়েরা যেন আজ অপেক্ষার সমুদ্রে ভাসাচ্ছে। ওর ছোট মন ছটফট করছে। পেছন পেছন ঘুরঘুর করছে মৌনতাও। মেয়েটির চিন্তিত পদক্ষেপ মনোযোগ দিয়ে গুণে নিচ্ছে। রোহন প্রবেশ করেই দৃশ্যটি দেখতে পেল।
“রাত তো অনেক হয়েছে। ঘুমাসনি কেন?”
ঝিল উত্তর দিতে পারল না। মৌনতার সাথে চোখাচোখি হতেই চোখ ঘুরিয়ে নিল রোহন। আহনাফ সবে সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছে।
“কি ব্যপার বনু? এত রাত জাগা তো ঠিক নয়। দুটো বেজে গেছে!”
অশান্ত ঝিল শান্ত হতে পারছে না। ক্রমাগত হাত কচলাচ্ছে। আহনাফ ঝিলের মাথা হাত বুলিয়ে দেয়।
“চিন্তার কারণ নেই। আমরা আছি।”
মেয়েটার এত কান্না পেল যে চোখ থেকে পানিই পড়ল না। বুকের ভেতর কেবল শব্দ হচ্ছে। আহনাফ বোনকে নিয়ে চলে গেছে। ড্রয়িং রুমে এখন রোহন আর মৌনতা। একটা শীতল বাতাসে উড়ছে মেয়েটির খোলা চুল। উন্মুক্ত হয়ে আছে কাধের অংশটা। ভীষণ আকর্ষণে রোহনের মন চঞ্চল হয়ে উঠল। কখন মৌনতার কাছাকাছি চলে এসেছে খেয়াল নেই। মৌনতা নিজেও অনুভব করতে পারছে শরীরের মৃদু ঘ্রাণ। কিছু সময়েই রোহনের বলিষ্ঠ বুকের মাঝখানে চলে এল সে। দৃষ্টি সমতলে। হাত দুটো রোহনের শার্ট খামচে ধরেছে। একটা অভিমান ওর গলায় তিক্ততা দিচ্ছে।
“কেন আমায় ছেড়ে দিলে তুমি? কেন আমায় ফিরিয়ে দিলে সেদিন। আমি আজও তোমায় ঘৃণা করতে পারি না মৌন। আজও পারি না ঘৃণা করতে। অথচ আমি চাই তোমায় ঘৃণা করতে। খুব করে চাই।”
সময়ের স্রোত খুব বেশি ছিল কিনা কে জানে। তবে চোখের পলকেই কেটে গেল পরবর্তী একটা সপ্তাহ। অভিনব পুরো দমে সুস্থ হয়ে ফিরল শিকদার বাড়ি। ওর তিন মামা ইববান,লিটন, মুজাহিদ বসে আছেন গার্ডেনে। কাজে ব্যস্ত থাকলেও ভাগ্নেকে দেখে বেশ বিচলিত হয়ে পড়লেন।
“এত দিনে আসার সময় হলো? শরীর ভালো এখন?”
“জী মেঝো মামা। আমি ঠিক আছি। দানেশ এর বিষয়টা?”
ছেলের নাম শুনে বুকের ভেতর কেমন করে উঠে লিটনের। তিনি অব্যক্ত দৃষ্টিতে বড় ভাইয়ের পানে তাকান। ভদ্রলোক মুখ শক্ত করে রেখেছেন। দিন কয়েক পূর্বে দানেশ কল করেছিল। বলেছে সে একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে। চৌকস ইববান শিকদার মুহূর্তেই বুঝে নিয়েছে সবটা। মির্জা বাড়ির ঘরের খবর তিনি রাখেন কিংবা রাখতে হয়। ভাতিজার প্রতি খুব চটে আছেন। সোজাসাপ্টা বলেছেন ঐ মেয়ে নিয়ে যেন এ বাড়ি না আসে। লিটন শিকদার ও ছেলেকে একইভাবে ধমকেছেন। কিন্তু বাবার মন কোথাও একটা নরম হয়েছে। ইববান শিকদার অভিনবকে নাস্তা করতে বলে চলে গেলেন। সকলেই ওনাকে ভুল বুঝে। কিন্তু তিনি তো সর্বদা ভালোই চেয়েছেন।
মাঝের দিন গুলো আরও দ্রুত পেরিয়ে গেল। এখন অভিনব আর ঝিলের প্রেম চলে রাতের আঁধারে। খুব রাতে ছাড়া ওরা কথা বলে না। দিনের বেশিরভাগ সময় ওরা ব্যস্ত থাকে। ঝিল পড়াশোনায় আর অভিনব চারপাশের কোলাহলে। আরফান বেপরোয়া ভাবে চলা ফেরা করছে এখন। ওকে দেখলে অভিনবর মায়া হয়। ছেলেটা খাঁটি জিনিসের মর্ম বুঝল না। মুনতাহা আজ এত গুলো মাস বাসায় নেই। দু পরিবারের দারুণ সম্পর্কটাও ভেঙে গেছে। মুনতাহার বাড়ির লোক বেশ রেগে আছেন। ইববান শিকদার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুনতাহাকে কন্যা স্নেহে রাখবেন বলে। কিন্তু তিনি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। মুনতাহার সাথে তিনি কথা বলেছেন। মেয়েটির সরল গলা। “ভালো আছি বাবা। আপনি নিজেকে দোষ দিবেন না।”
ইববান শিকদার সেদিন আর কথা বলতে পারেন নি। ওনার স্ত্রী সেদিন বেশ কান্নাকাটি করেছেন। মুনতাহাকে ওনি নিজের মেয়ের মতো দেখে এসেছেন। অথচ ওনার ছেলেটা মেয়েটাকে অবহেলা করল। তারপর থেকে আর যোগাযোগ হয় নি দু পরিবারের মধ্যে। আরফান নিজের মতো চলাফেরা করে। মাঝে মাঝে ইববান শিকদারের ইচ্ছে হয় ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে। কিন্তু বাস্তবে সেটা পারেন না। আজকাল ওনার মস্তিষ্কে চিন্তার পর চিন্তা। রাতের আঁধারে লাইব্রেরির ঘরে রকিং চেয়ারে বসে আছেন তিনি। অভিনব পানি নেওয়ার জন্য বের হয়েছিল। তখুনি মামাকে দেখতে পেল। ভদ্রলোকের বিষণ্ন মুখটা ওর ভীষণ মন খারাপ করায়। ধীরে ধীরে দরজার কাছটায় আসে।
“আসব মামা?”
“ইহান?”
“হুম।”
“আয়।”
নড়েচড়ে উঠলেন ইববান শিকদার। মলিন মুখটাত ইষৎ হাসি ফুটিয়ে বললেন, “এত রাত অবধি জেগে আছিস।”
“পানি শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই উঠে এলাম।”
“ও। বোস পাশে।”
“মামা, একটা কথা বলব?”
“হুম বল।”
“তোমার মন খারাপ?”
“এমন কেন মনে হলো?”
“জানি না। আমার মনে হচ্ছে তুমি ভেঙে পড়েছ।”
ভদ্রলোক হাসলেন। গুমোট, রুক্ষ এক হাসি। অভিনবর হৃদয়টা ছটফট করছে।
“জানিস তো ইহান। টাকা পয়সার চিন্তা কখনোই করতে হয় নি আমাদের। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর হুট করেই চারপাশের মানুষ গুলো পর হতে লাগল। মির্জারা কখনোই আমাদের দুশমন ছিল না। বরং ভরসার হাত ছিল। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর ওরা কেমন বদলে গেল। ক্ষমতা আর সম্পত্তির দিকে হাত বাড়াল। এই সেই ঝামেলায় মেতে উঠল। কেমন যেন হয়ে গেল। আমি তখন সবে বিয়ে করেছি। লিটন আর মুজাহিদ পড়াশোনা করছে। কিছুদিনের মধ্যে মা ও মারা গেলেন। আমি দু চোখে অন্ধকার দেখি। টাকা পয়সার ঝামেলা আমার জীবন থেকে তিনটা বছর কেড়ে নেয়। আমি কাউকে বলি নি কথাটা। বাবার কাছের মানুষ গুলো প্রতারণা করেছিল। প্রত্যেকটা জমিতে ভেজাল ছিল। সেসব ঠিক করতে করতে কেমন পাথর বনে গেলাম। তোর মামি কে আজীবন আমি ধন্যবাদ দিব। সে বিয়ের প্রথম মাসের পর থেকে তিনটা বছর স্বামীর থেকে দূরে ছিল। তবু একটি বার অভিযোগ করে নি। তখন তো ফোন ছিল না। তোদের মতো প্রেমের আলাপ ও ছিল না আমাদের। কিন্তু সে সংসারটা সামলে নিয়েছে। আরেকটা সত্য জানিস তিন বছরে তোর মামির হাতে একটা টাকাও দিতে পারি নি আমি। কিন্তু সে অনায়াসে চারজনের সংসার সামাল দিয়ে গেছে। লিটন,মুজাহিদের পড়াশোনার খরচ ছিল অনেক। ওরা তো সবসময় রাজার মতো চলাফেরা করেছে। কেমন করে এসব চালিয়েছে এসব আমি জানি না। তোর মা তখন যুবতী। চারপাশের মানুষের নজর থেকে কেমন করে রক্ষা করেছে সেটাও আমি জানি না। তারপর তিন বছর পর আমি ফিরে আসি। ভীষণ ক্লান্ত আমার মুখের পানে তাকিয়ে তোর মামি কান্না করত শুধু। এসব আমার অগোচরে করলেও আমি বুঝতাম। আমাদের বিয়ের ছয় বছর পর আরফান হলো। তত দিনে লিটন ও বিয়ে করেছে। এর মধ্যেই ঘটে গেল আরেক বিপত্তি। আমার আদরের বোন ইহরিমা পালিয়ে গেল এক বিদেশী ছেলের সাথে। যন্ত্রণায় আমরা কাতরাচ্ছিলাম। সব থেকে কষ্টে ছিল তোর বড় মামি। মেয়ের মতো লালন করেছে কি না। এই সেই ঝামেলার মধ্যে শিকদাররা পুনরায় ক্ষেপে উঠল। তখন আমি একা নই। আমরা তিন ভাই ই তখন কর্মঠ। সামাল দিতে খুব কষ্ট হয় নি। ধীরে ধীরে তোর মায়ের সাথে যোগাযোগ হয়। তুই যখন এলি তখন রাহিন আর দানেশ তোর সমবয়সী। তিনজনের কি মিল। দেখে ভালো লাগল। তুই বিদেশীদের মতো দেখতে বিধায় আমার সন্তানেরা গর্ব করে চারপাশে বলে বেড়াত। আমরা সকলেই তোকে ভীষণ ভালোবাসি। যেমন ভাবে ইহরিমাকে বড় করেছি তার থেকে দ্বিগুণ ভালোবাসায় তোকে আগলে রেখেছিলাম। সবই ঠিক ছিল। হঠাৎ করেই তোর মায়ের মনে উদয় হলো মির্জাদের সাথে সম্পর্ক ঠিক করার কথা। কারণ ততদিনে মির্জাবাড়ির বউদের সাথে তোর মায়ের ভাব জমেছে। আমরা শুরুতে দ্বিমত করলেও মেনে নিয়েছিলাম। পরবর্তীতে মির্জারাই বদলে গেল। আমরা তো গিয়েছিলাম কিন্তু ওরাই ফিরিয়ে দিয়েছে। আত্মসম্মানের কথা বাদ ই দিলাম তবে বার বার আমার বাড়ির ছেলেরা কেন ওদের কাছে নত হয় বলতে পারিস?”
অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠল অভিনবর শরীর। ইবাবন শিকদার নিশ্চুপ হয়ে রইলেন। খানিক বাদে বললেন, “অনেক রাত হয়েছে ঘুমাও গিয়ে।”
অভিনব স্বীয় কক্ষ ফিরে ঘুমাতে পারল না। ওর চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা করছে। সেই সময়ে ঝিলের কল এল। একটা অলৌকিক শক্তি ওকে কল রিসিভ করতে বাঁধা দিল।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি