#সুখ_একটি_প্রজাপতি(২)
তিন বছর পূর্বে অভিনব যখন বাংলাদেশে এসেছিল তখন তাঁর বয়স ছিলো প্রায় ছাব্বিশ এর আশে পাশে। আর তিন বছর পর এখন তার বয়স হলো উনত্রিশ। দেখে বোঝার উপায় নেই এই ছেলেটা আমেরিকার স্বনামধন্য ইউনিভার্সিটির লেকচারার পদে ছিল দু বছর। বরং যদি বলা হয় অভিনব সবে অনার্স শেষ করেছে তাহলে সেটা হবে বিশ্বাসযোগ্য। সবে বর্ষার প্রথম সপ্তাহ। এর ই মাঝে আকাশ কালো ঘন মেঘে আবৃত। ঠান্ডা শীতল মিহি এক বাতাসে অভিনবর টনক নড়ে। আনমনেই হেসে উঠে ছেলেটি। দোতলার ছাদ থেকে নেমে পড়ে দ্রুত পায়ে। মাথাটা সামান্য উঁচু করতেই বৃষ্টির বৃত্তাকার ফোটা পড়ল নাক বরাবর। তারপর পড়ে চোখ,কান, গালে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যায় সর্বাঙ্গে। অভিনবকে ভিজতে দেখে ছুটে আসে তরুণ। এতে বিন্দু মাত্র পরিবর্তন দেখা গেল না অভিনবর। সে আপনমনে বৃষ্টি অনুভবে ব্যস্ত। প্রকৃতি তার ভীষণ প্রিয়। এর সাথে মিশ্রিত ওর আবেগ। তরুণ ব্যগ্র কণ্ঠে বলে
“এই অভিনব! কি করছিসটা কি? বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছিস তো।”
“ভেজার জন্য ই তো এসেছি।”
“বর্ষার প্রথম বৃষ্টি। সর্দি জ্বর লেগে যাবে।”
“উহু কিছু হবে না।”
“এটা কিন্তু আমেরিকা নয় যে সর্দি জ্বর লাগলে ডজন খানেক ডাক্তার এসে হাজির হবে। ভেতরে আয় বলছি।”
“বাংলার হাওয়া আমায় কাবু করতে পারবে না। এ দেশ, দেশের মাটি, মানুষ সব কিছুকে নিশ্চয়ই আপন করে নিব আমি।”
কথা শেষ করেই বৃষ্টিতে নেমে গেল অভিনব। তরুণ তখন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে। যখন বিষয়টা খেয়াল হলো তখনি ধপ ধপ পা ফেলে ঘরে চলে গেল। আর ফিরে এলো ছাতা নিয়ে। অভিনব ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে। র ক্তে জেগেছে মাতাল করা প্রেম। পা খিচে চলতে চলতে তরুণ ওর কাছে এলো। অভিনব উপস্থিতি অনুভব করতে পারল ঠিক, তবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। তরুণের শ্বাস ভারী। ছেলেটা বিদেশ থেকে এসেছে। এই আবহওয়া কিছুতেই নিতে পারবে না। নিশ্চিত ভাবে জ্বর লাগাবে। আর তখন হবে আরেক বিপদ! তাছাড়া এই বৃষ্টিতে ছেলেটা যাচ্ছেই বা কোথায়?
“এই অভিনব। এই বৃষ্টিতে যাচ্ছিস কোথায়? আর তুই এখানে চিনিস নাকি। হারিয়ে গেলে তো আরেক ঝামেলা।”
“কে বলল আমি চিনি না? আর আমি দু বছরের বাচ্চা নই যে হারিয়ে যাব। বোকার মতো কথা বলিস না।”
“তুই চিনিস!”
তরুণের কণ্ঠে বিস্ময়। অভিনব একটু হাসল। তবে মুখে বলল “বাসায় যা। আমার ঠান্ডা জ্বর না এলে ও তোর ঠান্ডা লাগবে নিশ্চিত।”
“অভিনব তুই…”
তরুণের মুখের কথা মুখে রইল তার পূর্বেই মুখ চেপে হাঁচি বের হয়ে এলো। ফিক করে হেসে উঠে অভিনব। ভেজা হাতটা তরুণের বাহুতে রেখে বলে ফিরে যেতে। ছেলেটার ঠান্ডার ধাঁচ রয়েছে। একটু বৃষ্টিতেই কাবু!
হাঁচি দিতে দিতে ঘরে এলো তরুণ। তুহিন সোফায় বসে কাজ করছিল। তরুণকে দেখে অনেকটা বিরক্তি নিয়ে শুধায়।
“বৃষ্টি সহ্য হয় না তো যাস কেন?”
“আরে ভাই অভিনব কোথায় যেন চলে গেল।”
“কোথায় গেল? এখানে তো নতুন। কুল হারিয়ে ফেলবে। কি একটা অবস্থা!”
“সে নাকি চিনে।”
তুহিন এবার চোখ ছোট করে তাকায়। অভিনব ছেলেটা কে বোঝা সত্যিই দুষ্কর! এ যেন অসীম কোনো রহস্যের জাল।
অভিনব এখন যে স্থানে দাড়িয়ে আছে সে স্থানটা মির্জা বাড়ি থেকে এক মাইল দূরে। একটু দূরেই সাদা রঙের এক তলা বাড়ি। সেই বাড়ির দিকে বুকে হাত রেখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনেকটা সময়। আচানাক ঘটল বিষয়টা। অপেক্ষার অবসান হলো। এতক্ষণ পর ঝিল বেরিয়ে এসেছে। সাথে মৌনতা ও। দুজনের মাঝে টানা হেঁচকা চলছে। নির্লিপ্ত তাকিয়ে আছে অভিনব। ঝিল মৌনতাকে টেনে বাইরের করিডোরে দাঁড় করায়।
“ঝিলি প্লিজ আমি যাব না। আই হেইট সর্দি।”
“কিছু হবে না রে। একটু ভিজে দেখ।”
“নো ওয়ে। এক সপ্তাহ ভোগা সম্ভব না।”
“মৌন দেখ….”
ঝিলের কথা অগ্রাহ্য করে মৌনতা ঘরে ছুট লাগিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে দুজনে এসেছে এক বান্ধবীর সাথে দেখা করতে। আর তারপর ই শুরু হয়ে গেছে বৃষ্টি। বছরের প্রথম বৃষ্টি। এই লোভ সামলাতে পারবে না ঝিল। আজ এই বৃষ্টির প্রতিটা ফোটা গায়ে মেখেই ছাড়বে। ত্রস্ত পায়ে এগোয় ঝিল। শীর শীর হাওয়ায় কেঁপে উঠে শরীর। মুখে ফুটে লাজুক হাসি। হঠাৎ করে এক ভেজা হাত পেছন থেকে ওকে আকড়ে ধরল। এক রাশ ভয় নিয়ে চমকে তাকায় ঝিল। অভিনবর মুখে লেগে আছে পৃথিবীর সমস্ত মুগ্ধতা। ছেলেটার হাত মেয়েটির বাহুতে। ঝিলের কণ্ঠ কাঁপে।
“আপনি!”
“আপনার জন্য চলে এসেছি। খুশি হোন নি?”
“ছাড়ুন, ছাড়ুন বলছি।”
“ছাড়ার জন্য তো ধরি নি প্রজাপতি।”
ঝিলের চোখে এবার বিস্ফোরণ। অভিনব সামান্য ঝুকে দুজনের হাইট ব্যালেঞ্ছ করে নিল। ঝিলের চোখ বড় হয়ে গেছে। হাত পা ছুড়োছুড়ি করছে রিতিমতো। বিরক্ত হয়ে আরেকটু আগলে নিল অভিনব।
“ছাড়ুন প্লিজ।”
“আচ্ছা ছাড়ছি তবে এক মুহূর্তের জন্য।”
হাত আলগা করতেই ঝিল সেটার সুযোগ নিতে চাইল। তবে লাভের লাভ কিছুই হয় নি। অভিনবর লম্বা হাত ওকে চেপে ধরল আরও একবার। অভিযোগের কণ্ঠে বলল
“এর জন্যই প্রজাপতিকে খাঁচায় রাখতে হয়। যতক্ষণ না অবধি নিশ্চিত হওয়া যায় ছেড়ে দিলেও গোল চক্রের মতো ফিরে আসবে।”
ঝিল শান্ত হতে পারছে না। অস্বস্তিতে নুইয়ে যাচ্ছে। বার বার চারপাশে চোখ বুলায়। ছুটোছুটি করার চেষ্টা করে।
“আপনি এমন কেন প্রজাপতি। আমায় ছেড়ে যেতে চাচ্ছেন কেন?”
নিরুত্তর ঝিল। সে নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালানো বন্ধ করল না। অভিনব আগেই লক্ষ্য করেছে এ দিকে মানুষ জন নেই। তবু ও হুটহাট চলে আসতেই পারে। তাছাড়া ঝিলের বান্ধবীর বাসার ছাদ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রিক্স নিতে চাইল না। সেই কারনে মেয়েটি কে টেনে অন্য দিকে নিয়ে এলো। এখানটা নিরাপদ। ঝিলের বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটার মতো শব্দ হয়। অভিনব মেয়েটিকে পেছন ঘুরিয়ে নেয়। বৃষ্টির ফোটাতে ঝিলের শরীর ভিজে একাকার। দৃশ্যমান হয়েছে মশ্রিন পাতলা কোমর। একবার চোখ চলে যায় অভিনবর। শুরুতেই নিজেকে শাসন করে। ঝিলের কানের কাছে এসে বলে
“প্রজাপতি আপনার বৃষ্টিতে ভেজার অভ্যেস আছে?”
বৃষ্টি ভালো লাগলে ও ঝিল অভ্যস্ত না এতে। তাই চুপ করে রইল। অভ্যস্ত হলেও উত্তর দিত না। মৌনতাকেই সম্মতি মেনে নেয় অভিনব।
“অভ্যেস করে নিন প্রজিপতি। আপনাকে ভিজতে হবে। কখনো প্রকৃতির মায়াতে, কখনো বা প্রাপ্তি তে কখনো বা আমার ভালোবাসা তে।”
ঝিল কেঁদে দেয় প্রায়। হাতে ব্যথা লাগছে ঈষৎ।
“ব্যথা পাই।”
“আলগা করে দিচ্ছি।”
হাত আলগা করে রাখল অভিনব। ঝিল হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তবে ছেলেটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে ওর নিকট। ভেজা চুল গুলো ঘাড়ের এক পাশে দিয়ে দেয়। কানের কাছ থেকে মুখ সরিয়ে ঘাড়ের দিকে অগ্রসর হয়। গরম নিশ্বাসে জামা চেপে ধরে ঝিল। ভেজা শরীরটা মোচড় দিয়ে উঠে। অভিনবর উষ্ণ অধর ঘাড় ছুই ছুই। তখনি পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায় ঝিল। অভিনব তাকিয় থাকে কেবল। মেয়েটা চালাকি করেছে। হাত আলগা না থাকলে কোনো ভাবেই ছাড়াতে পারত না। অনেকটা চলে গেছে ঝিল। সে জন্য আর পিছু নেয় নি অভিনব। ঠোঁট কামড়ে হাসে। আজকের জন্য এই টুকুই এনাফ।
ঝিল হাঁপিয়ে গেছে। মৌনতা বসে বসে চিপস খাচ্ছিল। মেয়েটি কে দেখে মৌন ব্যস্ত হলো।
“কি রে ঝিল। হাপাচ্ছিস কেন? একটু আগেই তো ঠিক ছিলি।”
“শাওয়ার নিব। তুলি কে বল জামা বের করতে।”
“কিন্তু.. ”
মৌনতার কথা পরিপূর্ণ হলো না। তার পূর্বেই ঝিল চলে গেছে। মেয়েটিকে বুঝতে পারে না মৌনতা। এই যে জরুরি তলবে ওকে তুলে নিয়ে এসেছে। অথচ কারণ হিসেবে এখন অবধি কিছুই বলে নি।
কাক ভেজা হয়ে সন্ধ্যার পূর্বে ফিরে এলো অভিনব। পুরো ঘর ময় পায়চারি করছিল তরুণ। অভিনবর জন্য বেশ চিন্তিত ছিল। ছেলেটার ফোন ও বন্ধ। ঘরে ঢুকতেই তরুণ চেপে ধরল এক প্রকার।
“এই তুই তো ভেজা কাক হয়ে গেছিস। কি করি এখন! নিশ্চিত আজ জ্বরে ভুগবি।”
অভিনব স্বচ্ছ চোখে তাকায়। মনে মনে কাউন্ট করল ১,২,৩ সঙ্গে সঙ্গে হাঁচি দিয়ে উঠল তরুণ। অভিনব হেসে কুটি কুটি। নাক মুছে তরুণ কিছু বলবে আবার সেই হাঁচি! অভিনব নিজ থেকে সহজ করে দিল।
“তোয়ালে দে। মাথা মুছতে হবে।”
তরুণের প্রয়োজন পরে নি। তুহিন ই তোয়ালে নিয়ে হাজির হয়েছে। বিন্দু মাত্র রিক্স নিতে চায় না এই ছেলেটার বিষয়ে। এই অর্ধ বিদেশী ছেলের শরীর খুব নাজুক না হলে ও ওর মনের ভয়টা নাজুক। অভিনবর মতো আদরের দুলালের এক চিলতে সমস্যা হতে দিবে না। কিছুতেই না।
অভিনব শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে মাত্র। তুহিনকে দেখে হতাশ ভঙ্গিতে বলল
“আমি ঠিক আছি তুহিন ভাই। আপনি শুধুই ব্যস্ত হচ্ছেন।”
“মেডিসিন খেয়ে নাও। রিক্স নেওয়ার কি দরকার?”
বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশ এখন লাল আভাতে পরিপূর্ণ। ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধে মম করছে পরিবেশ। লালটে গগন অপূর্ব দেখাচ্ছে। যেন সাদা ক্যানভাসে সবে রঙের ঝড় উঠেছে। বৃষ্টির পর মূহুর্তটা খুব প্রিয় ঝিলের। নরম পাতাতে কেমন যেন আলোকরশ্মি খেলা করে। দারুণ লাগে তখন। মৌনতা অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ। গলা চুলকোচ্ছে কথা বলার জন্য। তবে ঝিল গাড়ির জানালা ভেদ করে বাহিরের পরিবেশে মত্ত। এই ধরা, এই বৃষ্টি, আর অপরূপ সৃষ্টি সব কিছুই ওকে মুগ্ধ করে। চারপাশ টা কে স্থির নয়নে অবলেকন করছে। মৌনতা এই মৌন সহ্য করতে পারছে না। পেটের ভেতর সুরসুরি লাগে। মেয়েটি নীরবতা ভেঙে বলল
“কি হয়েছে বল না।”
“কই কি হয়েছে?”
“তোকে কেমন যেন চিন্তিত ঠেকছে।”
“উহু আমি চিন্তিত নই। ভুল ভাবিস তুই।”
“সে না হয় বুঝলাম। তবে আমাকে এই জরুরি তলব করে নিয়ে এলি সেটার কারণ তো বললি না।”
“এমনিই নিয়ে এলাম। এখন চুপ কর তো। দেখ পরিবেশ টা কি সুন্দর।”
ঝিলের কণ্ঠে দৃঢ়তা। মৌনতা কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই ঝিল চোখে শাসালো। নুইয়ে পরল মৌনতা। ঠোঁটে আঙুল চেপে নিয়েছে।
“যা কথাই বলব না।”
বাসায় এসে সারপ্রাইজ পেল ঝিল। পাঁচ ভাই এসে হাজির। কিছু কাজের জন্য মেঝো পাপা আসেন নি। ভাইয়েরা আগলে নিচ্ছে বোনকে। এ দৃশ্যে যেন মৌনতার চোখ জুড়িয়ে যায়। রোহনের সাথে চোখাচোখি হলো একবার। ছেলেটা ভোতা মুখ করে আছে। চেহারায় রাগ স্পষ্ট। ছেলেটা এত রেগে আছে কেন? ফোন রিসিভ করে নি বিধায়? মৌনতার ভেতর ডিঙিয়ে বের হয় তপ্ত শ্বাস। সেসবকে পাত্তা না দিয়ে চলে গেল। ঝিল ভাইদের থেকে সরে এসে বলল
“আমি খুব টায়ার্ড।”
“ঘরে গিয়ে রেস্ট নে।”
হু। তোমরা ও যাও। এতটা জার্নি করে এলে। আর এসেই আমার যত্নের পেছনে নেমে এসেছ!”
“আগে তুই যা।”
“ওকে।”
মৃদু হেসে চলে যায় ঝিল। মাঝ রাত্রিতে ঝিলের কাঁচা ঘুমে ব্যঘাত ঘটাচ্ছে আননোন ফোন কল। বিরক্তিতে কুচকে যাচ্ছে চোখ মুখ। ফোনের স্ক্রিন দেখে রেখে দিল ঝিল। কোন মানব তার ঘুমে আ ঘা ত করে! ব্যক্তিটির ধৈর্য্য পরীক্ষা শেষে মায়া হয় ওর। একটা মানুষ এই রাত্রিতে এত করে কল কেন করছে? টুলুটুল চোখে কল রিসিভ করল। এক হাতে চোখ কচলে নিচ্ছে।
“হ্যালো। কে বলছেন।”
“আমি বলছি প্রজাপতি।”
চলবে…..
#সুখ_একটি_প্রজাপতি(৩)
ক্লান্তির ঘুম সব উবে গেছে। টুলুটুলু চোখ এখন সটান। বড় রসগোল্লার মতো করে তাকানো। রাতের নিস্তব্ধতা অভিনবর এক একেকটা ব্যকুল ছোট নিশ্বাসের স্বাক্ষী। বারংবার বুকে থু থু দিচ্ছে ঝিল। চোখে ভরপুর এক আকাশসম অবিশ্বাস। এই মানব সেলফোন নাম্বার পেল কোথায়! তাছাড়া কল, মাঝ রাতে কল করেছে কেন? ঘুমে জড়ানো কণ্ঠ সতেজ করে ঝিল। না না ভয় পেলে চলবে না। সাহসিকতার পরিচয় দিতে হবে। করতে হবে তীব্র প্রতিবাদ। তবে অন্তরে যে সয় না সে বানী। সমস্ত কাঠিন্য উড়ে যায় প্রজাপতির মতো ডানা ঝাপটে। শ্বাস ধরে রাখে ঝিল। তেজ মেশানো কণ্ঠটা ধীরে ধীরে নুইয়ে যায়।
“কেন কল করেছেন?”
“আপনার খোঁজ নিতে কল করেছি প্রজাপতি।”
“খোঁজ!”
“হু। আপনার তো অভ্যেস নেই। এই যে অতো সময় ধরে আমার বাহুডোরে ডানা ছাটা পাখির মতো ছটফট করলেন। বৃষ্টির গোল গোল ফোটা ভিজিয়ে দিল গাল। আপনার চিবুকের রক্তিমতা। ঠোঁটের উষ্ণতা। সর্বাঙ্গে কাতরতা। সব মিলিয়ে আপনি অশান্ত হয়ে গেলেন। আপনার খোঁজ তো নিতেই হয় প্রজাপতি।”
ঝিলের বুকের ভেতর ধক করে উঠল। ছেলেটা এমন করে কথা বলে কেন?
“আপনি কি শুরু করেছেন। এগুলো কেমন অসভ্যতা! কোনো কথাতেই লাগাম নেই।”
“এগুলো প্রেমের অসভ্যতা প্রজাপতি।”
কান্না পাচ্ছে ঝিলের। এই লোকটা এত মায়া দিয়ে কথা বলছে কেন? এত খানি আবেগ মিশে আছে কেন এই কণ্ঠে। অভিনব নিশ্চুপ। ঝিল ধরা গলায় বলে,
“দেখুন খুব খারাপ হচ্ছে। আমি বিরক্ত হচ্ছি।”
“কোনটায় বিরক্ত প্রজাপতি? আমার ফোন কলে নাকি আমার কণ্ঠে?”
নিরব হয়ে গেল ঝিল। চোখ দুটো পিট পিট করছে। অভিনব দৃঢ় গলায় ফের শুধালো।
“ঔষধ খেয়েছেন?”
“উহু।”
“জানতাম এমনটাই করবেন। দ্রুত ঔষধ খাবেন প্রজাপতি। আপনি অসুস্থ হলে আমি কিন্তু হুট করে চলে আসব।”
উত্তরের আশা না করে কল কেটে দিয়েছে অভিনব। ঝিলের হাত থেকে শব্দ করে ফোন পড়ে গেল। অথচ বিন্দু মাত্র ব্যকুলতা নেই এই ফোন উঠানোর। ঠায় বসে রইল মেয়েটি। আর বেমালুম ভুলে গেল মেডিসিন নেওয়ার কথা।
ইববান শিকদার ফাইল হাতে ছুটোছুটি করছেন। একটা জমি নিয়ে দারুণ ঝামেলা চলছে। নেহাত ই বাপ দাদার সম্পত্তি! না হলে কিছুতেই এতটা কাঠ খড় পোড়াতেন না তিনি। বাড়ির সব থেকে ছোট সদস্য ফুল। আদুরে কন্যা এসে কাছে দাড়িয়েছে। ইববান সাহেব আড়চোখে তাকালেন ভাতিজির দিকে।
“কি হয়েছে মামুনি?”
“ইহান ভাইয়া ফোন করেছে।”
কপালে বিষদ ভাজের উদয় হলো। একটা মানুষের এত খানি ধৈর্য্য! তিনি উদাস হলেন। ফুলের থেকে ফোন নিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
“তুমি যাও ফুল ঝুটি।”
মামার কণ্ঠে অভিনব হাসল। ভদ্রলোক নিজেকে কঠোর দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলে, অভিনব জানে ভেতরটা ঠিক ডাবের সাস এর মতো তুলতুলে।
“কেমন আছ মামা? ”
“ভালো আছি।”
“জিগ্যেস করবে না আমি কেমন আছি?”
বুকে হাত দিয়ে দাবানল শীতল করলেন ইববান সাহেব। অভিনব আদুরে গলায় ফের বলে,
“আমার কি দোষ মামা? আমি তো তখন সবার গুড বয়। না করতাম কি করে?”
“বাড়ি আসবে কবে?”
“আসতে তো চাই। তুমি যদি অনুমতি না দাও তাই আসি না।”
“চলে এসো। তোমার বাড়ি তুমি আসবে বারন করবে কে?”
চোখ টলমল করছে ইববান শিকদারের। ভাগ্নে কে খুব ভালোবাসেন তিনি। কতদিন পিঠে চরিয়ে এই ঘর ঐ ঘর ঘুরেছেন। কল না রেখেই হাঁকডাক ছাড়লেন,
“রাতুল, ঠান্ডা পানি নিয়ে আয় তো।”
ওপাশ থেকে এক বিস্তর হাসল অভিনব। কতটা শান্তি লাগছে ভাষায় বোঝানো যাবে না। আসলেই তো, অভিনব বাবা মায়ের গুড বয়। এখন মামাদের ও গুড বয় হবে।
ভাঙা টেপরেকর্ডার এর মতো বেজে চলেছে মৌনতা। ঝিলের জ্বর এসেছে ভোর রাতে। খুব বেশি না তবে সকলের মাঝে উদয় হওয়া ব্যকুলতা দেখে মনে হয় জ্বর এর মাত্রা ১০৪! বকবকানিতে মুখ থেকে থার্মোমিটার নামিয়ে নেয় ঝিল।
“একটু চুপ থাক মৌন।”
“কেন চুপ থাকব। তখন তো অনেক বার বললাম ঝিলি যাস না রে। বছরের প্রথম বৃষ্টি। সহ্য হবে না শরীরের। তুই শুনলি না আমার কথা।”
চোখ রাঙালো ঝিল। মৌন কিছুটা চুপ হলো। রোহন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে। নুইয়ে যায় ঝিল। নিজেকে বাঁচাতে ইনিয়ে বিনিয়ে বলে,
“ইচ্ছে করে ভিজি নি। পড়ে গিয়েছিলাম আর তখনি”
“মিথ্যে বলা লাগবে না। যা বোঝার বুঝে নিয়েছি আমি। চুপচাপ শুয়ে থাক।”
“ভাইয়া আমি আসলেই বুঝতে পারি নি।”
“যা হবার তা হয়ে গেছে। ঔষধ খাবি হা কর।”
নাক কুচকে ঔষধ মুখে নেয় ঝিল। কি বিশ্রি এর স্বাদ! ভেতরটা তিক্ত হয়ে আসে। তবে বারণ করার সাধ্য নেই। ইদানিং ঝিল বড় শান্ত হয়ে গেছে। সবাই কে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরায় না। বলতে গেলে আমূল পরিবর্! এ যেন আকাশ মাটির বন্ধুত্ব।
দুদিনের মাথায় জ্বর বাড়লো দ্বিগুণ। এর মাঝে একটা বারের জন্য ও অভিনব কল করল না। এতে অজান্তেই মনের ভেতর চাঁপা অভিমান জেগেছে মেয়েটির। টিস্যু বক্স খালি করে ফেলল নাকের পানি মুছে। ভয়ে তটস্থ হয়ে রইল কখন না আবার চোখের পানি বেরিয়ে আসে। ভেতরে ভেতরে কান্নার বর্ষণ নেমেছে।
“আমার কথা অমান্য করেছেন প্রজাপতি। এটা কি উচিত হলো?”
“আপনি!”
“হুস কথা না। চুপচাপ শুয়ে থাকুন।”
“সরুন, সরুন বলছি।”
“চাতক পাখির মতো ছটফট করছেন কেন প্রজাপতি। আপনি তো আমার মনে ঝড় তুলে দিয়েছেন। জানেন না বুকের বা পাশটায় ব্যথা হয়।”
চোখ বুলায় ঝিল। দু ধারে তাকিয়ে ঠিক অভিনবর বুক বরাবর ধাক্কা দিল। একটু দূরত্ব সৃষ্টি হতেই ঝিল উঠে পড়ল। লাইট অন করতে যেতেই বাহু ধরে টেনে ধরল। এই নির্জন রাত্রিতে দু একটা শব্দ কানে এসে বারি খায়। সচকিত হয় ঝিল।
“ভাইয়া, ভাইয়া নাইট ওয়াক করে। এখন কি হবে! আপনি লুকান। প্লিজ লুকান।”
“প্রজাপতি, আপনি ব্যস্ত হবেন না। কিছু হবে না। আপনার শরীরে তাপমাত্রা বেশি। বসুন স্থির হয়ে।”
“আহ আপনি বুঝতে পারছেন না।”
“চুপ থাকেন ঝিল।”
“কিন্তু ভাইয়া যে”
“আর একটা টু শব্দ হলে আমি কিন্তু সেই কাজ আবার করব। তখন তো অল্পতে ছেড়েছি আজ ছাড়ব না একদম।”
কড়া হুমকি। অথচ ঝিলের খেয়াল হলো না। এদিক সেদিক তাকালো। চোখ দুটো ব্যলকনিতে গিয়ে থেমে গেল। তবে এদিক দিয়েই এসেছেন তিনি। ঝিলের হাত পা ঠান্ডা। মোটে ও চায় না অভিনবর সাথে ধরা পড়তে। ছেলেটাকে দেখলে অবাক হতে হয়। সাথে জমে এক রাশ প্রশ্ন! কে এই অভিনব? কেন নিয়েছে তাঁর পিছু। কোথাও উত্তর মেলে না। অবাক করার মতো হলে ও ঝিল মনে মনে অভিনবর ভালো চায়। ছেলেটার ক্ষতি হোক মোটে ও আশা করে না। রুগ্ন শরীরে ধাক্কালো কয়েক বার। ব্যর্থ প্রচেষ্টায়! এমন সুঠাম শরীরের সাথে ঝিলের পুচকে শরীর পারবে কি করে? অভিনব নিশব্দে হাসল। একটু আলগা করে রইল হাত। ঝিল আবার চেষ্টা করল। উহু পারল না!
“ছুটোছুটি করে লাভ নেই প্রজাপতি। আপনি স্থির করে বসেন।”
“দয়া করে ছাড়েন আমায়।”
“ছাড়ার জন্য তো ধরি নি ঝিল। আপনি তাকান আমার দিকে।”
সরাসরি চোখ রাখে না ঝিল। তবে আঁধার আলোতে অভিনবর সাদা চোখে বাদামি রঙের মনি দেখে বুকটা ধুকপুক করছে। লাল হয়ে আছে সাদা অংশটি। মনে হয় ঘুম হয় না অনেকদিন।
“প্রজাপতি আপনার ত্বকের তাপমাত্রা আমার সহ্য হচ্ছে না। বুকের ভেতর যন্ত্রণা হয়।”
শীতল কণ্ঠস্বর। লোকটা নিশ্চিত ভাবে পাগল! ঝিল ব্যর্থ চেষ্টাটা আর করল না। শুধু মুখে বলল।
“কে আপনি? কেন আমার সাথে লেগে আছেন। এগুলো আমার সহ্য হয় না। ছাড়েন বলছি, আমায় এভাবে স্পর্শ করবেন না।”
“আগেই বলেছি ছাড়ব না। আর স্পর্শের ব্যপারটা না হয় তোলা রইল।”
“প্লিজ ছাড়েন।”
“একদম ইমোশনালি আ ঘা ত করবেন না ঝিল। তাহলে আমি বাধ্য হব আপনার ত্বকে নিজের উষ্ণতা ছড়িয়ে দিতে।”
প্রশ্ন নিয়ে তাকায় ঝিল। অভিনব স্মিত হাসে। ঝিলের কোমর জড়িয়ে মেঝেতে বসে। অস্বস্তি হয় খুব। নড়ে উঠে ঝিল। অভিনব এবার কোলে মাথা রাখে। বিদ্যুৎ লাগার মতো করে পিছিয়ে যায় মেয়েটি। তবে সেই পুরুষালি বাঁধনেই আটকা পড়ে। ঝিলের দৃষ্টি ব্যকুল। এধার ওধার তাকায় ভয় লুকাতে। কিয়ৎক্ষন অপেক্ষা করে অভিনব বলে,
“শুয়ে পড়েন।”
“আপনি?”
“পাশে আছি।”
“আল্লাহর ওয়াস্তে চলে যান। না হলে আমি সত্যিই চেঁচামেঁচি করব।”
“মুখে কস্টেপ লাগিয়েছি বলে তো মনে পড়ছে না। করেন না চিৎকার। অভিনব এক চুলও নড়বে না।”
কান্না আসে ওর। ভীষণ বদ লোক এই ছেলেটা! অভিনব ত্রস্ত হাতে ঝিলকে শুয়ে দেয়। হাত দিয়ে মুখের ত্বকে স্পর্শ করে। ঝিল চোখ খিচে রাখে। দম বন্ধ হয়ে আসে। এ কেমন অত্যচার?
খুব ভোরে ঘুম ভেঙেছে ঝিলের। হাত দুটো টান টান করে ক্লান্তি হটায়। হাই তুলে পাশ ফিরতেই মনে পড়ে অভিনবর কথা! দ্রুত বেগে ব্যলকনিতে আসে। যাক তবে চলে গেছে ছেলেটা। কাল রাতের করা অদ্ভুত সব পাগলামি চড়াও হয় মস্তিষ্কে। ত্বকে হাত রেখে বুঝতে পারে জ্বর নেমেছে। ঝিলের পুরোপুরি স্মরণে রয়েছে, ঔষধ খাইয়ে দিয়ে কপালে জল পট্টি দিচ্ছিল অভিনব। চোখ দুটো ছিল অবিন্যস্ত আর বিচলিত। যেন প্রাণ বেরিয়ে আসবে। আর তারপর হঠাৎ করেই ঘুমিয়ে পড়ে ঝিল। খুব সম্ভবত ভোর রাত্রিতে প্রস্থান করেছে ছেলেটা। কারণ টেবিলে রাখা পট্টি এখনো ভেজা। দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ। ঝিল বুঝে এটা মৌন। ভাগ্যিস অভিনব থাকাকালীন আসে নি। না হলে কি হতো সেটা আল্লাহ মাবুদ ই ভালো জানেন। দরজা খুলে ঝিল। মৌনের টুলুটুলু চোখ। ভেতরে ঢোকার পথে হাই তুলল বেশ কয়েকবার। হঠাৎ ই খেয়াল হলো পট্টির কথা। আর তখনি প্রশ্ন করে উঠে মৌন।
“কাল রাতে পানি পট্টি দিল কে? আমি তো কত রাত্রি তে গেলাম।”
“আমিই দিয়েছি।”
ঝটপট উত্তর। মৌন কি বুঝল কে জানে তবে প্রশ্ন করে না দ্বিতীয় বার। মুখের কাছে দু আঙুল দিয়ে শব্দ করে হাই তুলে। তারপর ই গা ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে সটান হয়ে। ঝিল অবাক ই হলো। মেয়েটার কান্ড দেখে কে অসুস্থ এ নিয়ে মনে জাগ্রত হয় জটিল প্রশ্ন!
চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি