সুখের খোঁজে পর্ব-১২+১৩

0
700

#সুখের খোঁজে….(পর্ব -১২)
#মৌমিতা হোসেন

তৌসিফ রিকশায় উঠে ইচ্ছে করেই ফোন দিয়েছিলো। দেখতে চেয়েছিলো নিতু ফোন ধরে কিনা। কিন্তু নিতুর ফোন কেটে দেয়ায় তৌসিফ একটু মেজাজ খারাপ করে। মোবাইলটা পকেটে রেখে দেয়।বাসস্ট্যান্ড এ গিয়েই বাস পেয়ে যায়। বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

নিতু মোবাইল নিয়ে রুমে এসে কাপড় বের করে ফ্রেশ হতে চলে যায়। নাম্বারটা ইচ্ছে করেই সেইভ করেনা।ফ্রেশ হয়ে এসে সাজিদ আর সেতুর সাথে গল্প জুড়ে দেয়। সালেহা এতো দিন পর মেয়েকে পেয়ে মেয়ের পছন্দের খাবার রান্না করে । সবাই একসাথে খায়। তবে জ্বর থাকায় নিতু তেমন খেতে পারেনা। বিকেলে আবার জ্বর আসলে সালেহা মাথায় পানি ঢেলে ঔষধ খাইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।নিতু অনেক দিন পর মায়ের ভালোবাসা পেয়ে গভীর ঘুমে নিমজ্জিত হয়। ঘুম থেকে উঠে দেখে সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে।জ্বর একটু কমেছে তাই একটু সুস্থ বোধ হচ্ছিলো। সাজিদ, সেতু পড়াশোনা করছে তাই ওদের কাছে না বসে মায়ের রুমে যায়।আসার পর থেকে মায়ের সাথে তেমন কথা হয়নি নিতুর।

এদিকে রাস্তায় অনেক যানজট থাকায় তৌসিফ এর বাড়ি ফিরতে প্রায় দু ঘন্টার বেশি সময় লাগে। নিতু কে রেখে আসতে ওর কেমন জানি লাগছিলো।কেমন এক অস্থিরতা, আশেপাশের সবকিছু বিরক্ত লাগছিলো।ভাবে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিলে হয়তো ভালো লাগবে।তাই বন্ধুদের কাছে যায়।দুপুরেও কিছু খায়নি।অনবরত সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে একের পর এক।বন্ধুরাও খেয়াল করে তৌসিফ কোন কারনে বিরক্ত।কারন জানতে চাইলে আরো বিরক্ত হয়ে সন্ধ্যার পরপরই বাড়ি চলে আসে ।এই সময়ে আকবর আলি ছেলেকে বাসায় দেখে অবাক হয়ে যায়। তৌসিফ কে উদ্দেশ্য করে বলে,”আজ এই সময়ে তুই বাসায়? শরীর খারাপ করেছে নাকি তোর?এমন দেখাচ্ছে কেনো তোকে?”

তৌসিফ বাবার এতো প্রশ্নে একটু বিরক্ত হয়ে উত্তর দেয়,”উফ্ বাবা একসাথে কতো প্রশ্ন করো? কিছু হয়নি। এমনি ভালো লাগছে না তাই তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। দেরিতে এলেও রাগ করো।আর আজ তাড়াতাড়ি এসেছি এতেও এতো প্রশ্ন।”

আকবর আলি কিছুটা আন্দাজ করতে পারে। তবে আজ ছেলের বিরক্তি,রাগ দেখে মন খারাপ করেনি।বেশ ভালোই লাগছে।মন মনে বললো,”নিতু কে মায়ের কাছে পাঠিয়ে মনে হচ্ছে ভালোই করেছি।”

মৃদু হেসে তৌসিফ কে বলে,”যাক এসেছিস ভালো হয়েছে। আজ তো আর নিতু বাসায় নেই যে খেতে দেরি করবি আর গরম করে বসে থাকবে তোর জন্য। খাবার রাহেলা টেবিলে রেখে গেছে। সময়মতো খেয়ে নিস। আমি একটু দোকানে যাচ্ছি।”

তৌসিফ কোন উত্তর না দিয়ে ওর রুমে চলে যায়। নিতুকে ছাড়া পুরো বাসাটা কেমন যেনো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।ফ্রেশ হতে যাবে কিন্তু আজ ওর কাপড় , তোয়ালে কিছুই বের করা নেই। এই কদিন প্রতিদিন তৌসিফ বাসায় ফিরলে নিতু সব এগিয়ে দিয়েছে।তাই সব কিছুতে অনেকটাই নিতুর ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে। কোথায় কি আছে জানতে ফোন দেয়ার জন্য মোবাইল বের করতেই মেজাজটা যেনো আরো খারাপ হয়।সেই আসার পর থেকে একবার ও ফোন দিলো না মেয়েটা।তাই রেগে মোবাইল বিছানায় ছুড়ে মারে।ফোন দিতে গিয়েও আর ফোন দেয়না।নিজেই খুঁজতে গিয়ে সব এলোমেলো করে ফেলে। অবশেষে ড্রয়ার থেকে কাপড় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে। সারাদিন না খাওয়ায় প্রচন্ড ক্ষুধা পায় তৌসিফ এর ।তাই টেবিলে গিয়ে খেতে বসে।গতো কিছুদিন ধরে প্রতিদিন খাওয়ার সময় নিতু সামনে বসে সব এগিয়ে দিয়েছে।কোন কথা না বললেও চুপচাপ বসে থেকেছে।আজ একা একা খেতেও বিরক্ত লাগছে তৌসিফ এর। তাছাড়া আজ খাবার বিস্বাদ লাগছে।এই কদিনেই নিতুর হাতের রান্না খেয়ে আকবর আলি আর তৌসিফ দু’জনই অভ্যস্ত হয়ে গেছে।তাই ক্ষুধা থাকলেও অল্প খেয়েই উঠে পরে।গলা থেকে যেনো খাবার নামছিলো না আজ।

নিতু মায়ের রুমে গেলে সালেহা মেয়ের কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বর আছে কিনা।জিজ্ঞেস কর,”এখন কেমন লাগছে মা? কীভাবে জ্বর বাধালি?”

“জানিনা মা।জ্বর আসতে কি কোন কারন লাগে?আর এখন বেশ ভালো লাগছে।জ্বর নেই।”

“আমিতো দুপুরে তোর জ্বর দেখে চিন্তায় পরে গিয়েছিলাম।তোর শ্বশুর ফোন করেছিলো ।তোর সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো।তোর জ্বর শুনে খুব চিন্তায় পরে গেলো। কথা হয়েছে ওনার সাথে?”

“না ,মা।আসার পর থেকে কথা হয়নি। দেখি ফোন দেবো এখন।আসোলে বাবা আমাকে বেশ স্নেহ করেন।ঔষধ খেয়েছে কিনা সেটাও মনে করিয়ে দিতে হবে।”

সালেহা শ্বশুর বাড়ির প্রতি মেয়ের এমন টান দেখে বেশ খুশী হয়। তৌসিফ এর সাথে কথা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে নিতু প্রসঙ্গ এড়িয়ে রুমে চলে যায়। মোবাইল নিয়ে শ্বশুর কে ফোন দেয়।বেশ কিছু সময় কথা বলে রেখে দেয়। সবাই একসাথে খেয়ে শুয়ে পরে।আজ দুই ভাই বোন নিতুর সাথে ঘুমাবে বায়না ধরে। নিতু অনেক মজার গল্প বলে দুই ভাই বোন কে ঘুম পারিয়ে দেয়। কিন্তু আজ ওর চোখে কিছুতেই ঘুম ধরা দিচ্ছেনা।তাই বারান্দায় গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

হঠাৎ তৌসিফ এর চিন্তা মাথায় ভর করে।খেয়েছে কিনা,কাপড় খুঁজে পেয়েছে কিনা। তৌসিফ এর অনেক কিছুই ওর অপছন্দ। তারপরেও এতো দিনে একটা মায়া তো তৈরি হয়েছে।আর সকালে বাবার কাছে যখন শুনেছে যে রাতে ওর জ্বর দেখে কতোটা অস্থির হয়েছে তৌসিফ তখন থেকে একটু হলেও মনটা ভালো হয়েছে নিতুর। মোবাইল হাতে নেয় কিন্তু দেখে যে তৌসিফ এর কোন ফোন আসেনি।তাই আবার মন খারাপ করে মোবাইল রেখে আকাশ দেখতে থাকে। পাখিটাকেও খুব মিস করে। ওকে দেখলেই খুব সুন্দর করে নিতু নিতু ডাকে।

তৌসিফ বাবার সাথে নিতুকে কথা বলতে দেখে অথচ নিতু তৌসিফ কে এই পর্যন্ত ফোন দিয়ে একবার খবর নেয় না।এসব ভেবে অভিমান হয় ওর। বারান্দায় বসে সিগারেট খেতে থাকে। টিয়া পাখি আজ নিতু নিতু ডেকেই যাচ্ছে।পাখির ছটফট দেখে মনে হচ্ছে আজ ওর মতো পাখিটাও নিতু কে খুব মিস করছে। কয়েকবার ফোন করতে নিয়েও আবার থেমে যায়।একা আকাশের তারা দেখতে থাকে। চোখে শুধু নিতুর ভীতু চেহারা,ছোট ছোট বোকামি গুলো ভাসছে। খুব মনে পরছে খুব।এই একদিনেই এতো অস্থিরতা কি মনের টান নাকি প্রতিদিনের মতো নিতু কে কাছে একান্ত নিজের করে পাওয়ার বাসনা। সেটা তৌসিফ কিছুতেই বুঝতে পারছেনা। ক্লান্ত লাগছে খুব। কিন্তু বিছানায় যেতে ইচ্ছে করছে না কিছুতেই। নিতু কে জরিয়ে ধরে ঘুমানো যেনো অভ্যাস হয়ে গেছে। নিচে বসে একের পর এক সিগারেট খেতেই থাকে।এক পর্যায়ে রুমে এসে ঘুমিয়ে পরে।

সকালেও ঘুম থেকে উঠে নিতু শ্বশুর কে ফোন করে ঔষধ,নাস্তার ব্যাপারে খোঁজ খবর নেয়।ইচ্ছা থাকলেও তৌসিফ এর কথা কিছু জিজ্ঞেস করেনা। নাস্তা শেষ করে ওর পড়ার টেবিলের সামনে বসে বইগুলো দেখতে থাকে। পড়ার প্রতি কোন কালেই কোন আগ্ৰহ না থাকলেও বাবা মারা যাওয়ার পর ভেবেছিলো পড়াশোনা করে চাকরি করবে। মাকে সাহায্য করবে।ছোট ভাইবোনদের দায়িত্ব ও নিজেও কিছুটা নেবে। কিন্তু হুট করে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় এসবের কিছুই হলোনা। মেয়েদের জীবনটা কেমন জানি। ইচ্ছা থাকলেও সব মেয়েরা বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিতে পারে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।মা একা কতো কষ্ট করে সংসার চালাচ্ছে সেটা দেখে মন খারাপ করে।

মায়ের কাছে গিয়ে কাজে সাহায্য করতে নেয়।জ্বর না থাকায় আজ বেশ ভালো লাগছে। তবুও সালেহা কাজ করতে দেয়না।বলে,”শ্বশুর বাড়িতে তো করিস এখানে কিছু করতে হবে না। তাছাড়া এসেছিস রেস্ট নিতে রেস্ট নে।এসব টুকটাক কাজ আমি একাই শেষ করতে পারবো।”

একটু থেমে আবার বলে,”নিতু মা জামাই এর সাথে কথা হয়েছে? তোদের সম্পর্ক ঠিক হয়েছে তো?”

নিতু কি বলবে বুঝতে পারছিলো না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,”হুম সব ঠিক আছে মা।কোন সমস্যা নেই।”

নিতু ভাবে কবে এই সমস্যার সমাধান হবে সেটা একমাত্র আল্লাহ জানে।এতো এতো বদঅভ্যাস এই লোকের।এতো সহজে ভালো হবার নয়। কিন্তু মাকে বলে কোন লাভ হবেনা।উল্টো ওকেই মানিয়ে নিতে বলবে।তাই এসব ব্যাপারে কিছু বলেনা। না চাইতেও তৌসিফ নাস্তা করেছে কিনা,কি করছে এসব ভাবনা মাথায় বারবার উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু খবর নিতে ইচ্ছে হয়না।

তৌসিফ ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় তোয়ালে,কাপড় সামনে না পেয়ে জোরে জোরে নিতু কে ডাকে।গত কিছুদিন ধরে তৌসিফ এর বলার আগেই ওর প্রয়োজনীয় সব কিছু নিতু ওর সামনে রেডি করে রেখেছিলো।আজও ঘুম থেকে উঠে সবকিছু সামনে না পেয়ে তাই চিৎকার করে নিতু কে ডাকছিলো। নিতু যে বাসায় নেই সেটা ওর মনেই ছিলোনা।ওর চিৎকার শুনে তখনি রাহেলা দৌড়ে আসে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,কি হইছে ভাইজান?চিল্লান কেন?”

রাহেলাকে দেখে তৌসিফ বলে,”তুমি কেন এসেছো? নিতু কোথায়?”

“বৌ মনিরে তো কাইল আফনে মায়ের বাড়ি দিয়া আইলেন।এর মধ্যেই ভুইলা গেছেন?”

রাহেলার কথায় তৌসিফ এর খেয়ালে আসে আর আবারো মনটা বিষন্ন হয়ে যায়।আস্তে করে বলে,”হুম ,মনে পড়েছে।ঘুম থেকে উঠলাম তো তাই মাথায় ছিলোনা।যাক তুমি নাস্তা রেডি করো আমি বাইরে যাবো।”তৌসিফ ফ্রেশ হতে চলে যায়।

রাহেলার ওর কাজে চলে যায়। নাস্তা রেডি করে দেয়। তৌসিফ নাস্তা শেষ করে ওর মতো বাইরে চলে যায়। বন্ধুদের সাথে দেখা করে আর কিছুক্ষণ পরপর মোবাইল দেখে যে নিতুর ফোন এসেছে কিনা। কিন্তু না প্রত্যাশিত ফোন আসেনা। বন্ধুরা জানতে চায় কোন সমস্যা হয়েছে কিনা। তৌসিফ কিছু বলেনা এড়িয়ে যায়।যদিও ওদের পাঁচজনের গ্ৰুপের সবাই ভবঘুরে তবে বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে সবার সাথে সবার আত্মার সম্পর্ক। তৌসিফ এর আর ভালো লাগছিলো না তাই ঘন্টা দুয়েক থেকে বাসায় চলে আসে।

নিতু একবার রাহেলাকে ফোন করে বাসার কাজের তদারকি করে।না চাইতেও দায়িত্ববোধ মনের ভেতর বারবার তাগাদা দিচ্ছে এসব করার জন্য। তবে কেনো জানি তৌসিফ এর কাছে ফোন দিতে ইচ্ছে হয়না।আর তৌসিফ গতো কালকের পর থেকে আর ফোন দেয়না তাই নিতুরও ইচ্ছা হয়না।ভাবে,”অন্যায় যেহেতু তৌসিফ করেছে সেহেতু ফোন তৌসিফ আগে করবে আমি কেনো করবো?”

চলবে……..

#সুখের খোঁজে….(পর্ব -১৩)
#মৌমিতা হোসেন

তৌসিফ বাসায় এসেই দেখে সব এলোমেলো।এসব এলোমেলো অবশ্য ও নিজেই করে গেছে। ভেজা তোয়ালে বিছানায়, নোংরা কাপড় নিচে পরে আছে।এসব দেখে খুব বিরক্ত হয় ও।আগেও অবশ্য এমনি থাকতো। রাহেলা ওর সময়মতো কখনো গুছিয়ে দিতো আবার কখনো এলোমেলোই থাকতো।নিতু আসার পর থেকে সব গোছানো থাকতো তাই অল্প দিনেই এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।আজ তাই সব এমন অবস্থায় দেখে আবার মেজাজ বিগড়ে যায়। রাহেলাকে চিৎকার করে ডাকে।রাহেলার বিরক্ত হয়ে দৌড়ে আসে।বলে,”কি হইছে?আইজ সকাল থেইক্কা চিল্লাইতাছেন কেন?আমারে দৌড়ের ওপর রাখতাছেন।”

তৌসিফ এর মেজাজ আরো খারাপ হয়।বলে,”আমার ঘর এর এই অবস্থা কেনো?গুছিয়ে রাখতে পারো না?”

রাহেলা উত্তর দেয়,”ওমা আমার আর কাম নাই?আইজ বৌমনি বাসায় নাই।সব কাম একলা একলা করন লাগতেছে।বৌ মনি থাকলে হে নিজেই অর্ধেক কাম কইরা ফালায়।আর আপনের এইসব কাম কি আমি করি?এইগুলাতো বৌমনি করে।আমারে এগুলা ধরতে দেয়না।তাই এই রুমেও আসি নাই আর দেখিও নাই।তাই এগুলা গুছানো হয়নাই।”

“আপনে তাড়াতাড়ি বৌমনিরে নিয়া আইসেন।ওনারে ছাড়া কাম করতেও ভালো লাগতাছে না। খুব লক্ষি আমাগো বৌ মনি।”

তৌসিফ শুনে আর কিছু বলেনা। চুপ করে বাড়ান্দায় চলে যায়। ওকে দেখেই পাখিটা আবার ছটফট করতে থাকে আর জোরে জোরে নিতু কে ডাকতে থাকে। কর্নারে কয়েকটা ফুল গাছ এনে লাগিয়েছিলো নিতু। কবে কে এনে দিয়েছে এসবের কিছুই জানেনা তৌসিফ। তবে নিতুকে প্রতিদিন এগুলোতে পানি দিতে দেখতো।কাঠগোলাপ ,বেলি,জবায় বেশ কদিন ধরেই ফুল ফুটছিলো।ভালোই লাগতো।আজ খেয়াল করলো মাত্র দুই দিন পানি না দেয়ায় গাছগুলোকে কেমন জানি শুকনো মনে হচ্ছে। মাটি শুকিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কেনো জানি তৌসিফ এর গাছগুলোতে পানি দিতে ইচ্ছে হয়না।ভাবে ,”আরেকটু দেখি কি হয় গাছ এর অবস্থা।গাছ এর মতো আমার হৃদয়টাও তো শুকিয়ে যাচ্ছে। হৃদয়টা তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠছে কাউকে দেখার জন্য,কারো কন্ঠ শোনার জন্য, কারো নরম হাতের ছোঁয়া পাওয়ার জন্য। কিন্তু সেতো আমাকে এই দুই দিনে একবারের জন্যও মনে করলো না। আমি কি এতোটাই খারাপ? এতোটাই জঘন্য?”

আর ভালো লাগে না ভাবতে । রুমে এসে মোবাইলে একবার নিতুর নাম্বার বের করে। আবার পাশে রেখে দিয়ে বিছানায় ক্লান্ত,বিষন্ন শরীরটা এলিয়ে দেয়।চোখ বন্ধ করতেই নিতুর চেহারা ভাসতে থাকে। ভালো লাগে না কিছু। সারাদিন আর বাইরে বের হয়না তৌসিফ। দুপুরে খায়ওনা। বসে,শুয়ে, আকাশ দেখেই সারাটা দিন পার করে।শেষ বিকেলে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে।

দুপুরে আকবর আলি বাসায় খেতে আসলে যখন শোনে তৌসিফ বাসায় তখন প্রথমে একটু অবাক হয়।পরে বুঝতে পারে ছেলের সমস্যা কোথায়।আকবর আলিও কয়েকবার খেতে ডাকে ছেলেকে। কিন্তু তৌসিফ বলে ,”ক্ষুধা নেই আমি খাবো না এখন। তুমি খাও।”

আকবর আলি ইচ্ছা করেই কয়েকবার নিতু কে নিয়ে বিভিন্ন কথা বলে।ওর প্রশংসা করে।ছেলে চাইলেও যেনো বৌমাকে না ভুলতে পারে এটাই ছিলো ওনার উদ্দেশ্য। কিন্তু নিতু কে যে তৌসিফ ভুলতেই চায়না এটা এখনো ওর বাবা বুঝতে পারেনা।আকবর আলি ওনার কাজে চলে যায়।

নিতু সারাটা দিনে অনেক বার বাসার সবার কথা, পাখি, গাছের কথা মনে করেছে। সারাদিনে একবার ও তৌসিফ ওর খবর নেয়নি তাই না চাইতেও মন খারাপ হয়েছে। নাম্বার টা সেইভ করেনা।ভাবে ,” কখনো যদি তৌসিফ আমাকে মন থেকে ভালোবাসে তাহলে সেদিন নাহয় নাম্বার টা সেইভ করবো।”দ্বিতীয় রাতটাও ছটফট করেই কাটে নিতুর। মানুষটার এতো এতো খারাপ অভ্যাস যা নিতুর একেবারেই পছন্দ না। তবুও ওর জন্য নিতুর অস্থিরতা ওর মনে ঠিক কীসের সংকেত দিচ্ছে সেটা বুঝতে পারছে না নিতু।

তৌসিফ ও বিকেলে অল্প সময়ের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিলো।সন্ধ্যার পর হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই নিতুর কথা খুব মনে পড়তে থাকে।বাইরেও যেতে ইচ্ছে হয়না। জানালার পাশে বসে আকাশ দেখে।মা মারা যাওয়ার পর থেকে যখনি খুব একা লাগতো এই জানালার কাছে এসে অথবা বাড়ান্দায় বসে আকাশ দেখে মনটা ভালো করতো তৌসিফ।আজ ও একই কাজ করে আর এর সাথে সঙ্গি হয় সিগারেট। এটা অনেক আগে থেকেই তৌসিফ কে মানসিক শান্তি দিয়ে আসছে।মন খারাপের সাথি হলো এই সিগারেট এর ধোঁয়া।

নিতুর বলা কথাগুলো খুব করে হৃদয়ে আঘাত করতে থাকে ওর।নিজের কাজের জন্য নিজের ওপর খুব রাগ হয়। সত্যি তো মাস প্রায় শেষ হতে চলেছে ওদের বিয়ের।অথচ এতো দিনেও নিতুর ব্যাপারে ও তেমন কিছুই জানেনা। কখনো জানতেও চায়নি ওর পছন্দ অপছন্দ।সব দ্বিধা ফেলে ঠিক করে নিতু কে ফোন দেবে।ওর সাথে কথা না বললে যে মনটা শান্ত হবে না এটা বুঝতে পেরেছে তৌসিফ।তাই মোবাইল বের করে ফোন দেয়। নিতু তখনই পাশের বাড়ির আন্টির সাথে দেখা করতে যায় ওর মায়ের সাথে। মোবাইল বাসায় সাইলেন্ট করে রেখে যায়।যার কারনে ও আর টের পায়না।আর তাই তৌসিফ এর ফোনটাও রিসিভ করতে পারে না।

এদিকে কয়েকবার ফোন করার পরেও নিতু রিসিভ না করায় আবার খুব রেগে যায় তৌসিফ। মোবাইল ছুঁড়ে মারে।একাই বলে,”এতো কীসের দেমাগ?আমিতো আগে ফোন দিলাম তবুও রিসিভ করো না।শেষ পর্যন্ত এই দুই দিন আগে আসা মেয়েটার জন্য আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।অসহ্যকর।”
একা একা বিরবির করে কথাগুলো বলতে থাকে আর টেবিলের ওপর রাখা গ্লাসটাও ছুড়ে মারে।আর ভালো লাগে না তৌসিফ এর।

নিতু বাসায় এসে মোবাইল নেয় শ্বশুর আব্বাকে ফোন করবে বলে। মোবাইল নিয়েই দেখে তৌসিফ এর অনেক গুলো মিসকল উঠে আছে।দেখে একটু চিন্তায় পরে যায়।এই শক্ত মানুষ হঠাৎ ওর মোবাইলে এতো গুলো কল দিয়েছে নিশ্চই কোন ঝামেলা হয়েছে।তাই তাড়াতাড়ি ফোন দেয়।বেশ কয়েকবার রিং হয় কিন্তু রিসিভ হয়না দেখে চিন্তায় পরে যায় নিতু। কিছু একটা ভেবে শ্বশুর কে ফোন দেয়। তিনি রিসিভ করতেই সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে,”বাবা বাসার সব ঠিক আছে তো? আপনার শরীর ভালো?”

আকবর আলি একটু অবাক হয় নিতুর কথায়।বলে,”হ্যা মা সব ঠিক আছে। আমি কিছুক্ষণ আগেই বাসায় এসেছি। এখনো খাওয়া হয়নি। কিন্তু কেনো কি হয়েছে।তুই এতো চিন্তিত কেনো?”

কি বলবে ভেবে পায়না। নিতু দ্বিধা করতে করতে বলে,”না মানে উনি ফোন দিয়েছিলো আমাকে। মোবাইল বাসায় রেখে আমি একটু মায়ের সাথে পাশের বাসায় গিয়েছিলাম তাই ফোন রিসিভ করতে পারিনি। একটু আগে বাসায় এসে দেখি অনেকগুলো মিস কল উঠে আছে।দেখে আমিও ফোন দিলাম কিন্তু উনি ফোন রিসিভ করেননি। ভাবলাম আপনার শরীর খারাপ করেছে কিনা তাই আবার আপনার মোবাইলে ফোন দিলাম।”

আকবর আলি সব শুনে নিতু কে বলে,”আমি তো একটু আগেই বাসায় এসেছি। তৌসিফ এর সাথে এখনো দেখা হয়নি। তবে ও আজ সারাদিন বাসাতেই ছিলো।কোন কারনে হয়তো মন খারাপ।তুই ফোনটা রাখ আমি দেখি ছেলেটা কি করছে।”

“ঠিক আছে বাবা আপনি একটু দেখে আমাকে জানাবেন। আমি রাখছি এখন।”

আকবর আলি মোবাইল হাতে আস্তে হেঁটে ছেলের রুমে যায়। দরজা খোলাই ছিলো। রুমে ঢুকে লাইট অন করতেই দেখে গ্লাস এর ভাঙ্গা টুকরো ফ্লোরে পরে আছে। রুমের কোথাও তৌসিফ নেই। হেঁটে বাড়ান্দায় গিয়ে দেখে নিচে বসে আছে।কেমন বিদ্ধস্ত চেহারা। হাতে সিগারেট জ্বলছে।আকবর আলি ছেলেকে দেখে দ্রুত এসে ওর মাথায় হাত দেয়। তৌসিফ বাবাকে দেখেই সিগারেট ফেলে দেয়। উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”বাবা কিছু বলবে?কখন এসেছো তুমি?”

আকবর আলি দেখতে পায় ছেলের চোখ দুটো লাল হয়ে আছে।খারাপ লাগে ছেলের এমন বিষন্ন চেহারা দেখে।বলে,”কিরে বাবা কি হয়েছে তোর? এখানে এভাবে বসে আছিস কেনো?”

“কিছু হয়নি বাবা। ভালো লাগছেনা তাই এখানে বসে আছি।”

আকবর আলি বলে,”নিতু ফোন দিয়েছিলো। তোকে খুঁজছে।ওর মোবাইল সাইলেন্ট এ ছিলো তাই রিসিভ করতে পারেনি চিন্তা করছে মেয়েটা তোর জন্য। ওকে একটু ফোন দে। কথা বলে খেতে আয়।দুই বাপ ছেলে আজ একসাথে খাই।”

তৌসিফ এর মনটা বিষন্নতায় ভরা থাকলেও নিতু ফোন দিয়েছে, খবর নিচ্ছে শুনে ভালো লাগে ।তাই খুশি হয়ে বলে ,”ঠিক আছে বাবা তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি আসছি।”

তৌসিফ নিতুর ফোন রিসিভ না করতে পারার কারন জানতে পারায় স্বস্তি পায়।মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে মোবাইল অফ হয়ে আছে। মোবাইল অন করে। কিন্তু চার্জ নেই তাই ফোন করতে পারেনা। মোবাইল চার্জে দিয়ে খেতে যায়।

এদিকে আকবর আলি নিতু কে ফোন করে সবটা বলে।আর এও বলে যে, তৌসিফ নিজেই ফোন করবে ফ্রি হয়ে। নিতু যেনো একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সবটা শুনে নিতুর ভালো লাগে। মনে মনে ভাবে,সেদিনের পর থেকে তৌসিফ কে একটু অন্যরকম লাগছে।কে জানে কি হয়েছে।সাজিদ,সেতুর ডাকে ধ্যান ভাঙে নিতুর। মোবাইল রেখে ও নিজেও খেতে যায়। খাওয়া শেষ করে গল্প করছিলো এর মাঝেই ফোন আসে তৌসিফ এর।

নিতু দ্বিধা করতে করতে ফোন রিসিভ করে। প্রথমে নিতুই বলে,”হ্যালো”

তৌসিফ চুপ করে শোনে নিতুর কথা। মনে হচ্ছে বহুযুগ পরে শুনছে কারো কাঁপা কন্ঠ।

ওপাশ থেকে কোন উত্তর না আসায় নিতু আবার হ্যালো বলতেই তৌসিফ জিজ্ঞেস করে,”কেমন আছো?”

তৌসিফ এর এতো নরম কন্ঠ বিয়ের পর থেকে এই পর্যন্ত নিতু শুনতে পায়নি।তাই অবাক হয়। ভালো লাগে খুব। পরমুহূর্তেই ভাবে যে না নরম হওয়া যাবে না।তাই স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দেবার চেষ্টা করে।বলে,”ভালো আছি। আপনি?”

“হুম ভালো। তুমি কবে আসবে?”

নিতু উত্তর দেয় ,”জানিনা। ”

তৌসিফ একটু রেগে যায়।বলে,”জানিনা মানে কি? আমার সমস্যা হচ্ছে। বাবার সমস্যা হচ্ছে। তুমি চলে আসো।কাল আমি তোমাকে নিতে আসবো।রেডি থেকো।”

নিতু আবার তৌসিফ এর কথা শুনে বিরক্ত হয়। ইচ্ছে না করলেও না চাইতেও সাহস করে বলে ,”আসবো কিনা সেটা জানি না। আপনার জীবনে আমার আদৌ কোন ভূমিকা আছে ওসব ছাড়া?কেনো আসবো আমি বলুন?কোন কিছু করেন আপনি? সারাক্ষন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া হলো আপনার কাজ।এমন একজন কি আমার ভরন পোষণের দায়িত্ব নিতে পারবে?আর যদি বলেন সংসার এর কাজ সে তো একজন বুয়াও করতে পারবে। এজন্য আমি না আসলেও চলবে।”

এতো কঠিন ছেলেটা আজ এতো নরম নিতুর এসব কঠিন সত্যি কথা যেনো কোনভাবেই মানতে পারছিলো না । ভেতরটা কেমন যেনো চাপা কষ্ট হতে থাকে। নিতুর বলা প্রতিটা কথা সত্যি।তাই আর কোন কথা না বলে ফোনটা রেখে দেয়।ভাঙা মন নিয়ে বিছানায় ফোনটা ফেলে রেখে বাড়ান্দায় চলে যায়।আজ ঘোর অমাবস্যা।পুরো আকাশ অন্ধকার। যেমনটা আজ তৌসিফ এর মনটা অন্ধকার হয়ে আছে। রাতটা নির্ঘুম কাটে তৌসিফ এর।

নিতু কথা গুলো বলার পর ভাবে যে না বললেও হতো এতো কথা। আবার রেগে গিয়ে কি করতে কি করবে।সাহস করে কেনো যে বলতে গেলো।ওর নিজের ও ভালো লাগছেনা কিছুই।মাকে এখন পর্যন্ত কিছুই বলেনি।বলে হয়তোবা লাভও হবে না।আর ভেতরে ভেতরে ও নিজেও হয়তো এই অতি অপছন্দের মানুষটাকে পছন্দ করা শুরু করেছে। শুধু তৌসিফ কে নয় ঐ বাড়ির সবাইকে।সব মিলিয়ে ভালো লাগে না নিতুর।ভাবনায় আসে সামনে সুখের খোঁজ পাবে তো কখনো?

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে