সুখের খোঁজে পর্ব-০৪

0
770

#সুখের খোঁজে……(পর্ব -৪)
#মৌমিতা হোসেন

কাঁদতে কাঁদতে নিতু বলতে থাকে,’বিশ্বাস করো মা সাজিদ পানি খেতে চেয়েছিলো তাই আমি পানি নিতে আসি।আর তারপর ভাইয়া আমার সাথে অসভ্যতা শুরু করে। আমি কিছু করিনি। বিশ্বাস করো। ভাইয়া আমার নামে মিথ্যা বলছে।’

কথা শেষ করার আগেই ফুপি এসে নিতু কে এক চড় মেরে বলে,’এতো বড় সাহস তোর তুই আমার ছেলে সম্পর্কে এতো নোংরা কথা বলছিস। শুধু আমার মৃত ভাইয়ের মেয়ে বলে আজ তোকে মাফ করলাম। নাহলে এর উপযুক্ত শাস্তি আমি তোকে দিয়েই ছাড়তাম।বেশরম মেয়ে কোথাকার।কি আছে তোর মাঝে যে আমার এই সোনার টুকরো ছেলে তোর সাথে এমনটা করবে?যত্তোসব।’

রাগে চোখ রাঙিয়ে সালেহার দিকে তাকিয়ে ফুপি বলতে থাকে,’আরো কয়মাস আগেই বলেছিলাম ভাই বেঁচে নেই তাই এই বয়সি মেয়েকে ঘরে রেখো না বেশি দিন। বিয়ে দিয়ে দাও। আমার কথা শুনলেনা তো।এখনো সময় আছে মেয়েকে যতো জলদি পারো বিয়ে দিয়ে দাও।দেখো বেশি দেরি করতে গিয়ে আবার পস্তাতে না হয়। তোমার মেয়ের মতিগতি আমার সুবিধার ঠেকছে না বলে দিলাম। নাহলে এমন ঘটনা বাইরের কারো সাথে করলে সমাজে আর মুখ দেখাতে পারবে না। তাই সময় থাকতে মেয়ের একটা ব্যবস্থা করো।’

এতো সব কথা বলে ফুপি তার ছেলের হাত ধরে রুমে নিয়ে যায়। রুমে গিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে,”চিন্তা করিস না বাবা এখান থেকে আমরা কাল সকালেই চলে যাব। এখানে আসাটাই আমাদের উচিত হয়নি।তোর বাবা যেনো এসবের কোন কিছু না জানতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখিস।”আতিক এর বাবা বেশ রাগী মানুষ তাই ওরা সবাই ওনাকে বেশ ভয় পায়।

আতিক এতোক্ষণ টেনশনে থাকলেও এখন তার ওপর মায়ের বিশ্বাস দেখে একটু সাহস পায়।আর খুশিও হয়। সত্যি কথা বের হয়ে না আসে সেই ভয়ে ও মায়ের সাথে তাল মেলায়।আর বলে,”হ্যা মা আমরা কালকেই চলে যাবো।এমন জায়গায় থাকা উচিত না।কে জানে নিতুর মনে কি আছে। আবার কোন ঝামেলায় ফেলে দেবে আল্লাহ জানে।”এসব বলতে থাকে আর করুন চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।আর এর সাথে নিতুর নামে বানিয়ে আরো কিছু বাজে কথা বলে।

এসব শুনে নিতুর ফুপি ওর সম্পর্কে খুব খারাপ ধারনা পোষন করে আর প্রচন্ড রাগ হয়।

এদিকে সালেহা এতো কটু কথা শুনে কি বলবে বুঝতে পারছিলো না।আজ স্বামী বেঁচে থাকলে এমন জঘন্য কথা ওনার কলিজার টুকরাকে নিয়ে কারো বলার সাহস হতো না। শাড়ির আঁচল মুখে চেপে কাঁদতে থাকে।

আর নিতু হয়ে যায় নিশ্চুপ,নির্বাক। জীবনে এমন অপবাদ শুনতে হবে,এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে সেটা কখনো কল্পনাও করেনি নিতু। হঠাৎ দেখে সাজিদ, সেতু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।মা,আপার অবস্থা দেখে ওরাও কাঁদছে। নিতু লজ্জায়,অপমানে আস্তে আস্তে হেঁটে ওর ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।চুপ করে বসে কাঁদতে থাকে।

কাঁদতে কাঁদতে কখন যে সকাল হয়ে গেছে সেটা নিতু টেরই পায়নি। সকালে দরজা ধাক্কানোর শব্দে ঘুম ভাঙে নিতুর। নিচে বসেই দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছিলো। ঘুম ভাঙতেই টের পেলো প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে। ছোটবেলা থেকেই একটু কাদলেই নিতুর মাথা ব্যাথা করে।আজকেও তার ব্যাতিক্রম হলো না। তাড়াতাড়ি উঠে জামা ঠিক করে দরজা খুলতেই দেখে সামনে মা দাঁড়িয়ে আছে।

আসলে রাতে নিতু রুমে চলে সালেহা বেগম ইচ্ছা করেই মেয়েকে আর ডাকে না।মেয়ে একা একা কাঁদলে মন হালকা হবে ভেবে ছেড়ে দেয়। কিন্তু সকাল হলেও দরজা না খুললে চিন্তায় পরে যায় আর এজন্যই ডাকতে আসে। মেয়ের বিদ্ধস্ত চেহারা দেখে সালেহা বেগম এর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে।এক রাত কেঁদে কেঁদে চেহারার কি অবস্থা করেছে। অতিরিক্ত ফর্সা হওয়ার জন্য চোখ, মুখ পুরো গোলাপী হয়ে আছে। সালেহা বেগম নিতু কে স্বাভাবিক করার জন্য রাতের প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলে,’কীরে মা আর কতো ঘুমাবি? কলেজে যাবি না?’

‘না মা আজ শরীর ভালো লাগছে না।যেতে ইচ্ছে করছে না।আজ বাসায় থাকি?’

‘ঠিক আছে থাক।হাত -মুখ ধুয়ে আয় আমি নাস্তা দিচ্ছি।’

এর মধ্যে ফুপি আর আতিক আসে খাওয়ার রুমে।হাতে ব্যাগ দেখে সালেহা বলে ,’কী ব্যাপার আপা হাতে ব্যাগ কেনো?এতো সকালে কোথায় যাচ্ছেন?’

ফুপি রেগে উত্তর দেয়,’ভাবলে কি করে রাতের ঘটনার পরেও আমি আর আমার ছেলে তোমার বাসায় আরো থাকবো? আমাদের কি মান সম্মান বলতে কিছু নেই? আমরা এখনি চলে যাচ্ছি। ভাইয়ের বাসায় এটাই হয়তো আমার শেষ আসা। একটা কথা শোনো যা শুনলাম মেয়ের অবস্থা কিন্তু বেশি সুবিধাজনক নয়।তাই মেয়ের ভালো চাইলে পড়াশোনা শেখানোর ঢং না দেখিয়ে তাড়াতাড়ি বিয়ে দাও। অন্ততঃ আমার ভাইয়ের সম্মান টা রক্ষা হোক।’

নিতু খেতে বসলেও ফুপির কথা শুনে খাবার আর গলা থেকে নামলো না।আস্তে উঠে নিজের রুমে চলে যায়।সালেহা ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে।ঠিক করে এবার একটু কঠিন হতে হবে তাকে। অন্তত মেয়ের জন্য হলেও।

নিতু চলে গেলে আতিক আর আপাকে উদ্দেশ্য করে সালেহা বলে, আমি ভালো করেই জানি আমার মেয়ে কোন খারাপ কাজ করেনি।তাই দয়া করে আমার মেয়েকে নিয়ে আর কোন খারাপ কথা বলবেন না আপা।যেতে চাচ্ছেন চলে যান। আমাদের ভালো মন্দ আমরাই বুঝে নেবো।’

আতিক কে উদ্দেশ্য করে বলে,’আমি আর তোর মামা তোদের কখনো পর ভাবিনি‌। নিজের ছেলের মতোই তোদের ভালোবেসেছি।সেই তুই নিতুর সাথে এমন নোংরা কাজ কীভাবে করলি? নিতু কে নিয়ে এতো খারাপ কথা না বললেও পারতি আতিক।মামাতো হলেও তো তুই ওর ভাই। কীভাবে পারলি এতো নোংরা কথা ওকে নিয়ে বলতে? এতো নোংরা কাজ ওর সাথে করতে?এতো ছোট বয়সে ওর কোমল নরম মনে খুব বড় একটা দাগ দিয়ে দিলি।যাক মনে রাখিস যে অন্যায় করে সে জীবনের কোন একদিন ঐ অন্যায়ের জন্য অবশ্যই শাস্তি ভোগ করবে।’

নিতুর ফুপি সালেহার কথা শুনে রেগে আর কিছু না বলে আতিক কে নিয়ে তখনই চলে যায়।ওদের চলে যাওয়া দেখে সাজিদ, সেতু খুব খুশি হয়। সারাদিন ওরা নিতুর মন ভালো করার জন্য বিভিন্ন ধরনের গল্প বলে। কিন্তু নিতুর মন ভালো হয়না।সব কিছুর জন্য ওর খুব খারাপ লাগতে থাকে।

রাতে নিতু একা বসে চাঁদ দেখতে থাকে।আর বাবাকে মিস করতে থাকে।এর মধ্যে সালেহা নিতু কে খেতে ডাকতে আসলে নিতু বলে,’মা কেনো বাবা এতো তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে গেলো? আমি বাবাকে খুব মিস করছি। খুব ভালোবাসি বাবাকে।’

নিতু মা’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।সালেহা মেয়ের এই কথার কোন উত্তর দিতে পারেন না।নিরবে সেও চোখের পানি ফেলে। তিনটি সন্তানকে কীভাবে মানুষ করবে তার মাথায় এখন শুধু এই চিন্তা।কান্না লুকিয়ে মেয়েকে নিয়ে খেতে যায় সালেহা।

বেশ কিছুদিন কেটে যায়। নিতু, সাজিদ, সেতু সবাই পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।আর সালেহা তার সেলাই সহ সংসার এর বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে।এই ব্যস্ততায় ঐ রাতের ঘটনা সবাই প্রায় ভুলেই যায়। তবে সালেহা বুঝতে পারে বাস্তবতা বড়ই নির্মম আর কঠিন। নিতুর ফুপি বাসায় গিয়ে ছোট বোন আর ভাইকে সব বলে।তারাও ফোন করে সালেহাকে অনেক কটু কথা শোনায়।আর বারবার মেয়েকে বিয়ে দেয়ার কথা বলে। নিতুর চাচা এই সুযোগে টাকা দেয়া বন্ধ করে দেয়। চলতে কষ্ট হলেও সালেহা ঠিক করে এদের কাছ থেকে আর কোন রকম সাহায্য সে নেবে না।

এরই মাঝে নিতুর এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। নিতু যদিও ভালো ছাত্রী না তবুও বাবার ইচ্ছার পুরনের জন্য দিন রাত পড়াশোনা করে। মোটামুটি ভালো ভাবেই পরীক্ষা শেষ করে নিতু। পরীক্ষা শেষ হবার কিছু দিনের মাঝেই ডাক্তার চাচা নিতুর জন্য একটা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে।ছেলের নাম তৌসিফ।

বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে তৌসিফ।বয়স চব্বিশ।মা মরিয়ম আক্তার মারা গেছে সেই ছোট্ট বেলায়।বাবা আকবর আলির অতিরিক্ত আদরে বড় হয়েছে।এইচএসসি পরীক্ষার পর তৌসিফ আর পড়াশোনা করেনি। এলাকায় বন্ধুদের পাল্লায় পরে পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগী হয়ে পরে। কিছুটা বখাটে হয়ে যায়। অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে বসে আড্ডাবাজি করা,সিগারেট খাওয়া, সুন্দরী মেয়েদের পেছনে ঘুরে বেড়ানো আর বাবার টাকা বসে বসে খরচ করাই যেনো তার একমাত্র কাজ ছিলো। তবে তৌসিফ এর মনটা ভালো। একমাত্র ছেলে হওয়ায় আর মা না থাকার কারনে বাবা,চাচার অতিরিক্ত ভালোবাসায় যখন দেখলো ছেলে পুরোপুরি বিপথে যাচ্ছে তখন তৌসিফ এর বাবা জোর করে নিজেদের ব্যবসায়িক কাজে ছেলেকে বসিয়ে দেয়।আকবর আলির নিজের একটা দোকান আছে মালিবাগে মৌচাক মার্কেটে। কসমেটিকস এর দোকান। তবে দোকানে বসানোর পরেও কাজের প্রতি ওর অমনোযোগীতা দেখে আকবর আলি ভাবে বিয়ে দিয়ে দিলে হয়তো ছেলে সংসারী হবে,বখাটে গুলোর সঙ্গ ছাড়বে।আর তাই মেয়ে খোঁজা শুরু করে।

তৌসিফ দেখতে শ্যামলা,লম্বা,এক কথায় সুদর্শন যুবক। মগবাজারে নিজেদের তিনতলা বাড়ি। দুই চাচাসহ একসাথে থাকে এখানে। তৌসিফরা থাকে দোতলায় ‌।

আসিফ ডাক্তার এর পেশেন্ট হলো আকবর আলি।প্রায়ই আসতেন চেম্বারে।সেই সুবাদে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে দুজনের মাঝে।ছেলের বিয়ের কথা বললে আসিফ ডাক্তার এর নিতুর কথা মনে পড়ে।আর তাই সে নিতুর সাথে তৌসিফ এর বিয়ের কথা বলে।আকবর আলি খুব অমায়িক তাই তিনি ভাবেন ছেলেও নিশ্চই বাবার মতো হবে।আর এজন্যই খুব বেশি না ঘেটে বিয়ের কথা বলে ফেলে।

সালেহা বেগম প্রথমে এখনি নিতু কে বিয়ে দিতে না চাইলেও পরে সবকিছু ভেবে রাজি হয়ে যায়। তবে আগে নিতুর সাথে কথা বলে তারপর ডাক্তার কে সিদ্ধান্ত জানাবে বলে একটু সময় চায়।সালেহা নিতু কে ডেকে তৌসিফ এর ব্যাপারে সবকিছু বলে। নিতু বিয়েতে প্রথমে রাজি হয়না।কারন আতিক ভাই এর করা অসভ্যতামি নিতু এখনো পুরোপুরি ভুলতে পারেনি।আর ঐ রাতের ঘটনার পর থেকে পুরুষ দের প্রতি ওর একটা নেতিবাচক ধারনাও তৈরি হয়‌।তাই নিতু বলে,’মা আমাকে পর করে দেয়ার জন্য এতো তাড়াহুড়ো করছো কেনো? আরো কিছুদিন তোমার সাথে আমাকে থাকতে দাও। এতো তাড়াতাড়ি আমি তোমাদের ছেড়ে যেতে চাইনা।’

মা নিতু কে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত দিয়ে আদর করে বলে,’সব মেয়েকেই একদিন বাবার বাড়ি ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি যেতে হয়।তোর বাবা নেই। তোদের ডাক্তার চাচা যেহেতু প্রস্তাবটা এনেছে তাই আমার মন হয় ভালোই হবে।আশা করি তুই বুঝতে পারবি।’

নিতু কি বলবে ভেবে পায়না।কারন সে পড়ালেখা করে চায়। তবুও সব কিছু ভেবে মায়ের দিকে তাকিয়ে অবশেষে বিয়েতে রাজি হয় নিতু। সেতু, সাজিদ এতে বেশ খুশি হয়। পরদিন সকালেই সালেহা বেগম ডাক্তারকে ফোন দিয়ে ছেলের পরিবার কে নিয়ে বাসায় আসতে বলে।কারন বিয়ের আগের অনেক কথাবার্তা থাকে। যেহেতু নিতুর বাবা নেই তাই সব বিষয়েই নিতুর মা আগে কথা বলতে চায়। তাছাড়া ছেলে -মেয়েও কেউ কাউকে দেখেনি।তাই দেখার কাজটাও হবে।আর ছেলের নিতু কে পছন্দ হলে তবেই তো পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে বড়রা।

এদিকে তৌসিফ ও ওর এই বাউন্ডলিপনা ছেড়ে এখনি বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিলো না।ওর তো এলাকায় সব সুন্দরী মেয়েকেই পছন্দ হয়।কোন একজনে বাধা পড়তে তৌসিফ এর মন একেবারেই সায় দেয়না।কিন্তু বাবার জোড়াজুড়িতে বাধ্য হয়েই মেয়ে দেখতে আসতে রাজি হয়।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে