সুখেরও সন্ধানে পর্ব-৬+৭

0
602

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৬]

প্রভাতের কিরণ ধরণীতে আস্ফালিত হতেই সজাগ হয়ে উঠলো জনজীবন। পল্লবী ভবনের সদস্যরা এসে উপস্থিত হয়েছে ডাইনিংয়ে। মুহূর্তেই সকল নিস্তব্ধতা ঘুচে শুরু হয়ে গেলো গুনগুন আওয়াজ। বাচ্চারা খাবার সম্মুখে রেখে মেতে উঠেছে একে অপরকে খোঁচাখুঁচি নামক দুষ্টুমিতে। রমণীরা খানিক বাদে বাদে হেসে উঠছে নিজেদের মধ্যকার কথার তালে তালে। টেবিলের কর্ণারের একটি চেয়ারে বসে পাউরুটিতে জেল মাখাতে ব্যস্ত তানিম। আশেপাশে বোম ব্লাস্ট হলেও যেনো তাতে কিছু যায় আসে না তার। আজ এক সপ্তাহ ধরে নিজের তিন সন্তানকে নিয়ে বাপের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে বড়ো বোন তিথি। তিথি এলেই বাড়ির পরিবেশটা একেবারে বদলে যায়। গুমোট ভাব কেটে শুরু হয় হইচই। তখনি সেখানে উপস্থিত হলেন গম্ভীর ধাঁচের লোক আজিজুল হক। উনাকে দেখতেই থেমে গেলো সব হট্টগোল। তৎক্ষণাৎ যে যার মতো হুঁশিয়ার হয়ে উঠলো।

স্ত্রী আফসানা সিদ্ধ ডিম ভর্তি একটি প্লেট এনে স্বামীর সম্মুখে রাখলেন। খাওয়ায় মনোনিবেশ করলেন আজিজুল হক। আড়চোখে তাকালেন পুত্রের পানে। দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য খুক খুক করে দুবার কাশলেন। তারপরেই প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“ব্যবসা বাণিজ্য কেমন চলছে তোমার?”

মুখের রুটি শেষ করে পিতার মুখের পানে তাকায় তানিম। স্পষ্ট বাক্যে উত্তর দেয়,“চলছে ভালোই।”

নিশ্চিন্ত হন আজিজুল হক। খাওয়ায় মনোনিবেশ করেন। নিজের খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ে তানিম। বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় অফিসের উদ্দেশ্যে। গাড়ি নিয়ে আগেই বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিলো নাহিয়ান। তানিমই তাকে আসতে বলে দিয়েছিল। কী একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ নাকি আছে তার জন্যে। মাঝপথে যেতেই থেমে গেলো গাড়ি। ল্যাপটপ আর একটা ফাইল হাতে নেমে গেলো নাহিয়ান। তারপর আবারো চলতে শুরু করল গাড়িটা। মিনিট পনের বাদে এসে থামলো অফিসের সামনে।

কম্পিউটারের সামনে বসে দ্রুত হাতে টাইপিং করছে অনুভা। তখনি ভেতরে প্রবেশ করল তানিম। কেউ তাকে সালাম জানালো আবার কেউ বললো,“গুড মর্নিং স্যার।”

সকলের জবাব নিয়েই করিডোর দিয়ে হেঁটে নিজ কেবিনে চলে গেলো সে। যাওয়ার আগে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গেলো অনুভার পানে। নতুন নতুন যখন মেয়েটা জয়েন করেছিল অফিসে তখন তাকে বিশেষ একটা খেয়াল করেনি তানিম। দুয়েকবার নজরে পড়লেও ঠিক অন্যান্য কর্মচারীর দৃষ্টিতেই দেখে এসেছিল তাকে। কিন্তু হুট করেই ঘটে গেলো এক অঘটন।

তখন সবে অফিসের ভেতরে পা রেখেছে তানিম। করিডোর দিয়ে হেঁটে নিজের কেবিনের দিকে পা বাড়াতেই বিদঘুটে শব্দ শুনে থেমে যায় পথিমধ্যে। পিছু ফিরতেই দেখতে পায় ফাঁকা চেয়ার টেনে একটা মেয়ে বসেছে সবে। মূলত চেয়ারটা টানার ফলেই ঘর্ষণের শব্দ হয়েছে। ফাঁকা চেয়ারটা শুরুতেই তার নজরে আটকে ছিলো। ভেবেছিল, হয়তো টেবিলের কর্মচারী ছুটিতে আছে তাই এত মাথা ঘামায়নি তানিম। কিন্তু তৎক্ষণাৎ পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো তার সম্মুখে। তড়াক করে মেজাজ খারাপ হলো তানিমের। এসব অনিয়ম ছেলেটার মোটেও পছন্দ নয়। অফিসের ম্যানেজার থেকে শুরু করে দারোয়ানসহ প্রত্যেক কর্মচারী এ বিষয়ে অবগত। তাই কেউই কখনো ভুলক্রমেও দেরি করে আসে না। অফিসের সময়টা সর্বদা সতর্কিত থাকে সকলে।

এগিয়ে আসে তানিম।একহাত পকেটে গুঁজে আরেক হাত টেবিলের উপর রেখে শুধায়,“কয়টা বাজে?”

চেয়ার ছেড়ে দ্রুত পদে উঠে দাঁড়ায় অনুভা। প্রশ্নের আসল অর্থটা সহজেই বোধগম্য হয় তার। মিনমিনে স্বরে বলে,“আজ একটু দেরি হয়ে গেছে স্যার।”

“অফিস টাইম শুরু হয় সাড়ে আটটায়। আপনি এসেছেন নয়টা চল্লিশে। অর্থাৎ এক ঘণ্টা দশ মিনিট লেট হয়েছে আপনার। অথচ আপনি একটু বলছেন?”—-শেষের কথাটা একটু ধমকের সুরেই বলে উঠলো।

ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো অনুভার। স্বভাবসুলভ ভাবে সে ভিতু মেয়ে না হলেও চাকরিতে প্রবেশ করতেই যেনো সারাক্ষণ তাকে ভয়ে তটস্থ থাকতে হয়। যদি কোনো ভুলের কারণে চাকরিটা চলে যায়? কী হবে তখন? পরিবারকে যে রাস্তায় নামতে হবে! সারাক্ষণ মাথায় ঘুরঘুর করে এসব দুশ্চিন্তা।

বাকি কর্মচারীরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত। এমন ভাব যেনো আশেপাশে কিছুই হচ্ছে না। কিংবা হলেও তা তারা টের পাচ্ছে না। হয়তো ভয়ে। অনুভা খেয়াল করে দেখেছে এই লোকটার ভয়ে সকলে তটস্থ। এর কারণটাও অবশ্য একসময় টের পেয়ে গিয়েছিল অনুভা।

কোনো উত্তর না পেয়ে রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো তানিমের। প্রশ্ন করল,“বেতনের সময় এক টাকাও তো কম নিবেন না তাহলে কাজের বেলায় এতশত খামখেয়ালিপনা কেন?”

এবারও নিরব অনুভা।প্রত্যুত্তর করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। অজান্তেই ভুল একটা হয়ে গেছে, তার উপর যদি ভুল কিছু বলে ফেলে?তখন কী চাকরিটা আদৌ থাকবে? তার এই নিরুত্তরপনা দেখে ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে তানিমের। যদিও ছেলেটার ধৈর্য্য এমনিতেই খুব কম। কথায় কথায় রাগ ঝেরে ফেলা তার অভ্যাস। বিপরীত মানুষটার পরিস্থিতি কিছুতেই বুঝতেই চায় না বা চেষ্টাও করে না।এবারও তাই হলো। রাগমিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
“লেট কেন হলো তার এক্সপ্লেইন দিন। ফাস্ট।”

সাহস সঞ্চয় করে কয়েক সেকেন্ড মৌন রইলো অনুভা। কণ্ঠে নমনীয়তা এনে উত্তর দিলো,“বাবু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হুট করে বমি হচ্ছিল, ওষুধ খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে আসতে আসতে দেরি হয়ে গেছে।”

ভ্রু যুগল পরিপূর্ণ কুঁচকে গেলো তানিমের। সাথে বেশ কয়েকটা সরু ভাঁজ পড়ল ললাটে। কণ্ঠে বিষ্ময় নিয়ে শুধালো,“আপনি বিবাহিত?”

দুদিকে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বোঝালো অনুভা। পুরো চোখেমুখে বিষ্ময় ছাপিয়ে গেলো তানিমের। শুধালো,
“তাহলে বাবু এলো কোত্থেকে? বিয়ের আগেই কী?”

এতটুকু বলে থেমে গেলো তানিম। তার শেষ না হওয়া খারাপ ইঙ্গিতপূর্ণ কথাটি বুঝতেও বেশি সময় লাগলো না অনুভার।নত মস্তক উঠিয়ে কঠোর দৃষ্টিতে তাকালো তানিমের পানে। এমন নারী দৃষ্টিতে মুহূর্তেই ভড়কে গেলো তানিম। মেয়েটার দৃষ্টিতে দেখতে পেলো সীমাহীন রাগ। অনুভা কঠিন স্বরে উত্তর দিলো,“আমার বোনের বাচ্চা। বাবা-মা,বোন সবাই অসুস্থ তাই আমার উপরেই ওর সব দায়িত্ব। দেরি হওয়ার জন্য দুঃখিত স্যার। পরবর্তীতে আর কখনো এমনটা হবে না।”

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো অনুভা। এতগুলো কথা বলার উদ্দেশ্য ছিলো একটাই। যাতে দ্বিতীয়বার তাকে আর কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে না হয়।সেদিন আর কিছুই বলতে পারলো না তানিম। ওই তেজস্রী চাহনি তার কণ্ঠনালী থেকে বাক্যগুলো কেড়ে নিয়ে তাকে করে দিলো নির্বাক। হাতের ইশারায় বসতে বলে সেই ব্যাপারটাকে সেখানেই সমাপ্ত করে নিজের কেবিনে গিয়ে বসে পড়ে তানিম।

তারপর থেকে না চাইতেও মেয়েটা বারবার তার নজরে পড়ে। তানিম খেয়াল করে মেয়েটির কাজের ধরণ খুব ভালো। কোনো প্রজেক্ট দিলে খুব গুছিয়ে তা শেষ করে। মাঝে মাঝে ভুলও অবশ্য করতো। এই যেমন নতুন কোনো ফাইল দিলে দেখা যেতো অফিসেই ফেলে রেখে চলে গেছে। নয়তো কখনো সখনো বাড়িতে ফেলে রেখে চলে এসেছে অফিসে। এসব কারণে মেয়েটার প্রতি অনেক ক্ষোভও ছিলো তার। কাজের প্রতি অভিজ্ঞ বলে শুধু বের করে দিতে পারছিল না অফিস থেকে।তার পাশাপাশি প্রতিবারই ওর পক্ষে নাহিয়ানের অজস্র সাফাই গাওয়া।

নাহিয়ান ছেলেটা খুব ভালো। একেবারে তানিমের মনের মতো। প্রথম প্রথম অফিসের পি.এ হিসেবে তাকে সীমাবদ্ধ রাখলেও একসময় বানিয়ে নেয় এসিস্ট্যান্ট। ব্যক্তি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কাজসহ বিভিন্ন পরামর্শও তার কাছ থেকেই নেয় তানিম। তার সঙ্গে থাকতে থাকতে নাহিয়ানও যেনো স্যারের বলার আগেই অনেক কিছু বুঝে যায়।

অনুভার সেদিনের অপরাধটা ছিলো মারাত্মক। সেই মিটিংয়ের জন্য অনেকটা অপেক্ষা করতে হয়েছিল তানিমকে। প্রজেক্টের কাজ যদিও আগেই শেষ হয়েছিল তবুও সে অনুভাকে ফাইলটা চেক করার জন্যই মূলত দিয়েছিল। যাতে কোনো ভুল না থাকে। মেয়েটা ভুল ধরতে খুব এক্সপার্ট। কিন্তু সেদিনই সে আসলো না। ক্লাইন্টরা তিনটে পর্যন্ত অপেক্ষা করে তাদের প্রতি ক্ষোভ নিয়েই চলে যায় অফিস থেকে। সেই রাগটা যেনো কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারছিল না তানিম। ইচ্ছে করছিল মেয়েটাকে সামনে পেলেই যা তা শুনিয়ে দিতে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের চেয়ার টেনে বসলো তানিম। পুরোনো কথাগুলো ভাবলেই তার হাসি পায়। কেন জানি এখন আর অনুভা নামক মেয়েটির উপর কোনো রাগই করতে পারে না সে। মেয়েটার জন্য ভেতরে অনুভূত হয় মায়া। সেদিন হয়তো রাগের মাথায় কাজ থেকে তাড়িয়েও দিতো অনুভাকে। কিন্তু নাহিয়ান এসে আটকায় তাকে।যতটুকু সম্ভব অনুভার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানায়। তখনি মেয়েটির জন্য করুনা হয় তানিমের। সেদিন পুরোটা সময় ভেবে দেখে মেয়েটার অবস্থা।

প্রায়সই সিসি টিভিতে মনোযোগ সহকারে দেখে মেয়েটাকে। তবে ইচ্ছেকৃত নয় বরং অনিচ্ছাকৃত। নিজের এমন কাজে কখনো সখনো অবাকও হয়। আজও ব্যতীক্রম ঘটলো না। এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে স্ক্রীনে। শুধু দেখে যাচ্ছে অনুভাকে। তবে অনিচ্ছাকৃত নয়, আজ ইচ্ছাকৃতভাবেই সে দেখছে। বাহ্যিক ভাবে কেউ দেখে বলতেই পারবে না এই মেয়েটির জীবনে এতশত ট্রাজেডিতে ভরা।

আচমকা ঠোঁটের কার্নিশে এক চিলতে হাসি ফোটে উঠলো তানিমের। হুট করেই তার মনে হলো মেয়েটি সুন্দর। বাস্তবিক অর্থে এই সুন্দর মেয়েটিকে তার ভালো লাগছে। যে সে ভালো নয় বরং অন্যরকম ভালো। আবার এও বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে নাহিয়ানের সঙ্গে অনুভা নামক মেয়েটির চলাফেরা, কথা বলা তার সহ্য হয় না। রাগ হয়। চরম রাগ।
______

আজ তৃতীয় এবং চতুর্থ বর্ষ মিলিয়ে মোট দুটো ক্লাস ছিলো শ্রাবণের। ক্লাস শেষে নিজের টিচার্স রুমেই এতক্ষণ বসে ছিলো সে। দরজার কাছে আসতেই দেখতে পেলো একটা মেয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে কথা বলছে পিয়ন। মেয়েটার মুখখানা দেখতেই পরিচিত ঠেকলো তার নিকট কিন্তু নামটা আপাতত মনে পড়ছে না। এখানে হচ্ছেটা কী তা বোঝার জন্য সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। মেয়েটি অনুরোধের সুরে বলছে,“স্যারের সঙ্গে আমার কথা আছে। বলছি তো কথা বলেই চলে যাবো।”

পিয়ন লোকটাও নাছোড়বান্দা। কিছুতেই মেয়েটিকে ভেতরে ঢুকতে দিবেন না।কর্কশ কণ্ঠে বললেন,“স্যার এহন বাহির হইবেন তাই কথা কওয়া যাইবো না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে নালিশ করমু গিয়া।”

“আপনি স্যারকে একবার বলে তো দেখুন।”

“কী বলমু? দেখা করার লাইগ্গা অনুমতিপত্র আছে? কই দেখান আগে।”

সামিরা অবাক হলো। স্যারের সঙ্গে দেখা করতে আবার অনুমতিপত্রও লাগে? প্রথমদিন যে কথা বললো তখন তো লাগেনি।আজ কেন লাগবে? শুধালো,“অনুমতিপত্র লাগবে কেন? সেদিনও তো কথা বললাম তখন তো লাগেনি।”

পিয়ন লোকটার ললাটে ভাঁজ পড়ল। দৃষ্টিতে যোগ হলো সন্দেহ। পাল্টা প্রশ্ন করলেন,“অফিসরুমে গিয়া কথা কইছেন?”

“না, ক্লাস শেষে বলেছিলাম।”

“তাইলে আর কী? ক্লাসে কিংবা ক্লাস শেষে কথা কওয়া আর অফিস রুমে ঢুইক্কা কথা কওয়া কী এক নাকি? অফিস রুমে ঢুকতে হইলে আলাদা দরখাস্ত লাগে, অনুমতিপত্র লাগে এইডাই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম। এহন যান এন থাইক্কা।”

সামিরার মুখখানায় মলিনতা ভর করল। ফিরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই শ্রাবণ বেরিয়ে এলো বাহিরে। সবটা শোনার পরেও না শোনার ভান ধরে শুধালো,“কী হয়েছে এখানে? এতো হট্টগোল কীসের?”

পিয়ন চমকে উঠলো। আমতা আমতা করে বললো,
“তেমন কিছু না স্যার। ক্যাম্পাসে নতুন পোলাপাইন আইছে তাই নিয়ম কানুন না জাইনাই দেখা করতে আইছে। আমি বুঝাইয়া তাড়াইয়া দিছি।”

পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতেই পথিমধ্যে থেমে গেলো সামিরা। পেছন ফিরে শ্রাবণকে বের হতে দেখেই চিকচিক করে উঠলো অক্ষি যুগল। বিলম্ব না করে দ্রুত হেঁটে এগিয়ে এসে বললো,“স্যার!”

ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালো শ্রাবণ।পিয়ন আঁতকে উঠলো। বেয়াদব মেয়েটা আবার এসেছে? কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই শ্রাবণ উনাকে থামিয়ে দিয়ে সামিরার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল,“কিছু বলবেন?”

উপর নিচ মাথা নাড়ালো সামিরা। পাল্টা প্রশ্ন করল,
“দুদিন ধরে আপনি ক্লাসে আসছেন না কেন স্যার?”

“ক্লাস ছিলো না তাই।”

উত্তরটি জানতেই থতমত খেয়ে গেলো সামিরা। নত স্বরে বললো,“ওহ, তাহলে আপনার নেক্সট ক্লাস আবার কবে স্যার?”

“ক্লাস রুটিন দেখেননি?”

“না স্যার।”

“এই প্রশ্ন করার জন্য এখানে এসেছেন?”

ইতস্ততবোধ করল সামিরা। ইচ্ছে করল নিজের গালে নিজ হাতে দুটো চড় মেরে দিতে। একটা বলতে এসে বলে ফেলেছে আরেকটা। মনে করার চেষ্টা করল, কী যেনো বলতে এসেছিল সে? না কিছুতেই মনে পড়ছে না। এই পিয়ন ব্যাটার জন্যই আসল কথাটা ভুলে বসে আছে। তার নিরুত্তর ভাব দেখে বিরক্ত হলো শ্রাবণ। তাড়া দেখিয়ে বললো,“আমার ক্লাস আবার কালকে। ক্লাস রুটিন সম্পর্কে সিনিয়রদের থেকে ভালো করে জেনে নিবেন। আর হুটহাট টিচার্স রুমে দেখা করতে আসবেন না। এটা ইউনিভার্সিটি, এখানে অনেক আলাদা আলাদা নিয়ম-কানুন আছে। যা সমস্যা হবে তা নোট করে রাখবেন। ক্লাসে গেলে তখন আমায় বলবেন উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো।”

আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গটগট হেঁটে প্রস্থান করল শ্রাবণ। হাস্যজ্জ্বল মুখখানা চুপসে গেলো সামিরার। এই মুহূর্তে খুব অপমানিত বোধ হচ্ছে তার। মিলি বারবার নিষেধ করেছিল এখানে আসতে কিন্তু তাদের কথা না শুনে আসাটা যে অনুচিত হয়েছে তা ধের বুঝতে পারছে মেয়েটা।
_______

সন্ধ্যার খানিক পর অফিসে প্রবেশ করল নাহিয়ান। সোজা ঢুকলো তানিমের কেবিনে। তানিম চেয়ারে বসে মোবাইলে কারো সঙ্গে কথা বলছে। চোখেমুখে কাঠিন্যতা। নাহিয়ানকে দেখতেই হাতের ইশারায় তাকে বসতে বললো। আরো কিছুক্ষণ কথা বলে তারপর মোবাইলটা রাখলো টেবিলের উপর।

নাহিয়ান এগিয়ে দিলো একটা ফাইল। ফাইলটা নিজ হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখতে লাগলো তানিম। শুধালো,“একটা সাইন করাতে এতো দেরি হলো কেন?”

“কী করবো স্যার বলুন তো? গিয়ে দেখি উনি অফিসেই নেই। উনার পি.এ বললো, এসে পড়বে। এই এসে পড়বে বলতে বলতেই দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করালো। তারপর জানালো, উনার স্যার নাকি বিকেলের আগে আসবেন না। কী একটা কাজে আটকে গেছেন।”

“আমি তো উনার সঙ্গে আগেই কথা বলে রেখেছিলাম তারপরেও এমন করল? আর তুমিই বা চলে এলে না কেন?”

“এতদূর পর্যন্ত গেলাম, এতক্ষণ অপেক্ষা করলাম তাই ভাবলাম একেবারে সাইনটা করিয়েই নিয়ে যাই।”

ঠোঁটের কার্নিশে হাসি ফোটে উঠলো তানিমের। প্রশংসার সুরে বললো,“এই জন্যই তুমি আমার এতো প্রিয় নাহিয়ান। অনেক খেটেছো এবার বাড়ি যেতে পারো। আজ তোমার ছুটি।”

“ধন্যবাদ স্যার।”

স্লান হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠে তানিমের কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো নাহিয়ান। একটা প্রজেক্টের কাজ অনেকদিন ধরেই আটকে ছিলো উপর মহলের একটা সাইনের জন্য।যার দরুন অনেক কাগজপত্রও উপস্থাপন করেছিল তানিম। সেখান থেকেই আজ তাকে ডাকা হয়েছিল। যেহেতু কথাবার্তা আগেই সারা ছিলো তাই বাকি কাজটার দায়িত্ব দিয়ে নাহিয়ানকেই পাঠিয়ে দিয়েছিল তানিম।

অফিস শেষে নিজের টেবিলের সব গোছগাছ করে বের হলো অনুভা। অফিস থেকে কিছুটা পথ সামনে যেতেই দেখতে পেলো নাহিয়ানকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কলা খাচ্ছে সে। অনুভাকে দেখতেই এগিয়ে এলো। আরেকটা কলা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,“নাও কলা খাও।”

বাড়িয়ে দেওয়া কলাটা গ্ৰহণ করল না অনুভা। বিষ্মিত স্বরে প্রশ্ন করল,“আপনি তো অনেকক্ষণ আগেই অফিস থেকে বের হয়ে গিয়েছেন ভাইয়া। তাহলে এখনো বাড়ি ফিরেননি যে?”

আসল কথাটা চেপে গেলো নাহিয়ান। তার জন্যই যে এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিল বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। সংক্ষিপ্তভাবে বললো,“এমনি। এখন তো বাসায় ফিরবে তাই না? চলো পৌঁছে দিয়ে আসি।”

প্রস্তাবটা নাকোচ করে দেওয়ার জন্য ঠোঁট দুটো প্রসারিত করতেই থেমে গেলো অনুভা। রাস্তার উল্টো দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলো নাহিয়ান। আর অনুভা ছিলো তার বিপরীতে যার দরুন পুরো রাস্তাটা সহজেই তার দৃষ্টিগোচর হলো। পরিচিত একটা মুখ দেখতেই অদ্ভুত শিহরণে ছেয়ে গেলো হৃদয়খানা। তাকে থেমে যেতে দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকে নিলো নাহিয়ান। অনুভার দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছন ফিরে তাকালো। পরিচিত তেমন কিছুই তার চোখে পড়ল না তাই শুধালো,“কী দেখছো অনু?”

ধ্যান ভঙ্গ হলো অনুভার। ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে কাঙ্ক্ষিত মানুষটি। আজ এক সপ্তাহ পর আবার এই মানুষটির সঙ্গে দেখা হলো অনুভার। সেই যে সেদিন শুক্রবারে দেখা হলো তারপর আর ছেলেটি একবারের জন্যেও সামনে এলো না তার। তারপর কেটে গেলো এক সপ্তাহ। সামনে এসে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে প্রশ্ন করল শ্রাবণ,“এখানে দাঁড়িয়ে কী করছো নোভা?”

নড়েচড়ে উঠলো অনুভা। নাহিয়ান ভ্রু বাঁকিয়ে প্রশ্ন করল,“আপনারা পরিচিত?”

“তার থেকেও বেশি।”—-কেমন এক রহস্যময়ী ভঙিতে কথাটা বলে উঠলো শ্রাবণ।

নাহিয়ানের চোখেমুখে ছেয়ে গেলো হাজারো প্রশ্ন। অনুভার দিকে দৃষ্টি ফেলে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু সেই সুযোগ আর তাকে দেওয়া হলো না। চট করে শীতল কণ্ঠে শ্রাবণ বলে উঠলো,“গাড়িতে গিয়ে বসো নোভা।”

এই কণ্ঠস্বরের বিপরীতে কড়া কিছু বলতে চেয়েও কেন যেনো কখনোই কিছু বলতে পারে না অনুভা। কোথাও একটা বাঁধা অনুভব করে। এই মুহূর্তে কী করা উচিত সে বুঝতে পারলো না।নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে কীভাবে না বলবে ভাবতে লাগলো। ভাবনার মধ্যেই ফের শোনা গেলো সেই কণ্ঠস্বর। কণ্ঠে মায়া ঢেলে বললো,“এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? তুমি কী আমাকে সারারাত এখানে দাঁড় করিয়ে রাখতে চাইছো নোভা? তাতে অবশ্য আমার কোনো আপত্তি নেই। তুমি পাশে থাকলে সারারাত কেন? সারাদিনও আমি নির্দ্বিধায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো এখানে।”

হুট করে এমনভাবে কেন কথা বলছে ছেলেটা? মনে হাজারো প্রশ্ন রেখেই নাহিয়ানের থেকে বিদায় নিয়ে সামনে হাঁটা ধরলো অনুভা। তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে অপরিচিত ছেলেটির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো নাহিয়ান,“কে হন আপনি ওর? কী সম্পর্ক আপনাদের মধ্যে?”

মুচকি হাসলো শ্রাবণ। একটু এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললো,“আপনি এতদিন ধরে যা হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন আমি ওর তা-ই হই।”

বিষ্ময়ে ছেয়ে গেলো নাহিয়ানের মুখশ্রী। কৌতূহলী কণ্ঠে বলে উঠলো,“মানে?”

চলবে _______

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৭]

শ্রাবণের হাস্যজ্জ্বল মুখখানা মুহূর্তেই হয়ে উঠলো গম্ভীর। একদৃষ্টিতে নাহিয়ানের পানে তাকিয়ে আছে সে। নাহিয়ানের দৃষ্টিও একইভাবে তার মুখশ্রীতে স্থির। উতলা হয়ে উঠেছে মন। পূর্বের কথাটার অর্থ বোঝার জন্য উদগ্ৰীব হয়ে আছে। নিরবতার অবসান ঘটিয়ে শ্রাবণ বলে উঠলো,“কেউ কী এমনি এমনি কাউকে সাহায্য করে মি.নাহিয়ান?”

হঠাৎ এই প্রশ্ন? মানেটা বুঝতে পারলো না নাহিয়ান। যা তার চোখেমুখে সুস্পষ্ট। শ্রাবণ তার মুখভঙ্গি দেখে তা সহজেই টের পেলো। পুনরায় বললো,“অনুভা আপনার উপর বরাবরই কৃতজ্ঞ। কারণ তার কঠিন দুর্দশার সময় এই চাকরির সন্ধানটা আপনিই তাকে দিয়েছিলেন। ও শুরু থেকেই আপনাকে বড়ো ভাইয়ের দৃষ্টিতে দেখে আসছে। সে অনুযায়ী আপনাকে সম্মানও করে। কিন্তু আপনি কী তাকে আদতে বোন হিসেবে ট্রিট করেন?”

ভড়কে গেলো নাহিয়ান। আমতা আমতা করে ফের বললো,“মানে?

“এত মানে মানে করছেন কেন? সত্যটা তো আপনিও জানেন আমিও জানি তাহলে এত নাটকীয়তার কী প্রয়োজন আছে মি.নাহিয়ান?”

সন্তর্পণে নিঃশ্বাস ফেলে স্থির হয়ে দাঁড়ালো নাহিয়ান। ললাটে জমে থাকা ঘাম বাম হাত দিয়ে মুছে নিয়ে বললো,“সবটা জানেনই যখন তাহলে জিজ্ঞেস করছেন কেন? নাকি আমার মুখ থেকে শুনতে চাইছেন? আপনি কে তা আমি জানি না। কীভাবে এসব জানলেন তাও জানি না তবে এটাই সত্যি যে আমি শুরু থেকেই অনুকে ভালোবাসি। অনু বুঝুক বা না বুঝুক তবুও আমি ওকে ভালোবাসি।”

মুখশ্রী কঠিন হয়ে উঠলো শ্রাবণের। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বললো,“আর বাসবেন না।”

চমকে গেলো নাহিয়ান। প্রশ্ন করল,“ভালোবাসবো না? এ আবার কেমন কথা?”

“কেমন কথা তা তো জানি না। তবে আজকের পর থেকে অনুভা নামক মেয়েটিকে আপনি আর ভালোবাসবেন না। পৃথিবীতে সবাইকে ভালোবাসার অধিকার থাকলেও অনুভাকে ভালোবাসার অধিকার আপনার নেই। অপাত্রে ভালোবাসা ঢালাটা যে সময় নষ্টের কাতারে পরে মি.নাহিয়ান। অনুভা নামক পথ আপনার জন্য নিষিদ্ধ, কাঁটার ন্যায় বিষাক্ত বিষ।”

“আমি না হয় কাঁটায় পা দিয়ে এই বিষটাই পান করতে চাই।”

কঠিন, গম্ভীর মুখখানায় হুট করেই সূর্যের ন্যায় ঝলকে উঠলো একফালি হাসি। যেই হাসিতে মিশে রয়েছে ভয়ানক কিছু। শ্রাবণ শীতল কণ্ঠে বললো,“তাহলে আপনার মৃ’ত্যু যে নিশ্চিত মি.নাহিয়ান। অনুভা পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই আপনার মৃ’ত্যু সুনিশ্চিত।”–কথাটুকু বলেই নাহিয়ানকে রেখে গাড়ির কাছে চলে গেলো শ্রাবণ।

শ্রাবণের অপেক্ষায় এতক্ষণ ধরে গাড়ির কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো অনুভা। শ্রাবণ গিয়ে গাড়ির দ্বার খুলে দিতেই ভেতরে গিয়ে বসলো সে। এরপর শ্রাবণ নিজেও ভেতরে ঢুকে সিট বেল্ট বেঁধে নিলো।

নাহিয়ান পথেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। মস্তিষ্ক জুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে ছেলেটার বলা কথাগুলো। তার চোখের সামনেই রাস্তার ধুলো উড়িয়ে চলে গেলো গাড়িটি। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিলিয়ে গেলো অদৃষ্টে। নাহিয়ান হুট করেই অনুভব করল তার অনুভূতিতে মরীচিকা ধরে যাচ্ছে। এতদিনের ভালোবাসাটা হয়ে যাচ্ছে ফিকে। তাহলে সত্যিই কী সে অপাত্রে ভালোবাসা দান করল? লুকিয়ে লুকিয়ে একতরফা ভালোবেসে কী সত্যিই ভুল করল?

“মামা কই যাইবেন?”

হঠাৎ এমন ডাকে নড়েচড়ে উঠলো নাহিয়ান। দেখতে পেলো রাস্তার কিনারা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটি রিক্সা। রিক্সাচালক উপর্যুক্ত প্রশ্নটি করে তার পানে চেয়ে আছে উত্তরের আশায়। নাহিয়ান উঠে বসলো তাতে। আনমনে বললো,“যেদিকে দুচোখ যায়।”

“এই রাইতের বেলা আমার লগে কী মজা করেন মামা?”

“মজা! এই মুহূর্তে আমার জীবনে এসব মজা টজা বলে কিছুই নেই। যতো চাইবে ভাড়া না হয় ততোই দিবো, এবার চলো।”

“যাইবেন কই? ঠিকানাডা তো কন।”

“বললাম না দুচোখ যেদিকে যায়।”

রিক্সা চালক আর কোনো প্রশ্ন করলেন না। নিরবে চালাতে লাগলেন রিক্সা।

মনোযোগ সহকারে ড্রাইভ করছে শ্রাবণ। তার পাশে বসে হাঁসফাঁস করছে অনুভা। বলতে চাইছে কিছু কিন্তু কীভাবে বলবে বুঝতে পারছে না। সামনের আয়না দিয়ে পুরোটাই খেয়াল করল শ্রাবণ।শুধালো,
“বলবে কিছু?”

“নাহিয়ান ভাইয়ার সামনে অমন করে কথা বলা তোমার উচিত হয়নি।”

“কেমন করে বলেছি? বকেছি তোমায়?”

“বকবে কেন? আসলে ওই যে অমন করে কথা বললে না? কে জানে উনি কী ভাবলেন আমাদের সম্পর্কে।”

“অন্যের ভাবনা দিয়েও তো দেখছি তোমার অনেক কিছু যায় আসে নোভা। শুধু আমার ভাবনা দিয়েই তোমার কিছু যায় আসে না।”—-কথায় তার তাচ্ছিল্য ভাব।

চট করেই বিষয়টা ধরে ফেললো অনুভা। মাঝে মাঝে এমন ত্যাড়া ধরণের কথা শুনলে খুব রাগ হয় তার। এবারও হলো। প্রশ্ন ছুঁড়লো,“এতদিন পর আমাদের আবার দেখা হচ্ছে কেন বলো তো? এটা কী সত্যিই কাকতালীয় ঘটনা? প্রথম সাক্ষাৎ এর মতোই কী কাকতালীয়?”

“যদি বলি ইচ্ছাকৃত?”—-শ্রাবণের সোজাসাপ্টা জবাব।

ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হয় অনুভার। কণ্ঠে বিষ্ময় এনে শুধায়,“ইচ্ছাকৃত?”

চলন্ত গাড়িতে হঠাৎ করেই ব্রেক কষে শ্রাবণ। সিট বেল্ট খুলে অনুভার দিকে ঘুরে বসে। পাল্টা প্রশ্ন করে,
“আমাদের যে আবার দেখা হচ্ছে এতে কী তুমি খুশি নও?”

ভড়কে যায় অনুভা। হঠাৎ করে যে তাকে এমন একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তা কষ্মিনকালেও ভাবতে পারেনি সে। কী উত্তর দিবে এখন? প্রশ্নের উত্তরটা যে নিজের কাছেই তার অজানা। সত্যিই কী শ্রাবণ নামক অদ্ভুত পুরুষটির সঙ্গে পুনরায় দেখা হওয়ায় অখুশি সে? তার থেকে আশানুরূপ কোনো উত্তর না পেয়ে চোয়াল শক্ত হলো শ্রাবণের। তিরিক্ষ মেজাজে বললো,
“খুশি নও তাই না? কেন খুশি নও? জীবনে কী বসন্ত এসেছে? কী হলো উত্তর দিচ্ছো না কেন? এসেছে কী বসন্ত?”

একনাগাড়ে প্রশ্নগুলো করে থামলো শ্রাবণ। ঘাবড়ালো অনুভা। বুঝতে পারলো ছেলেটা রেগে গেছে। শুকনো ঢোক গিলে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে অস্পষ্ট আওয়াজে উত্তর দিলো,“নাহ।”

মুখের আদল বদলালো শ্রাবণের। ছোট্ট একটা শব্দে পুরো দেহ শীতলতায় ছেয়ে গেলো। কণ্ঠ হলো মোলায়েম। গাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,“না আসাই ভালো। তোমার জীবনে বসন্ত আসা নিষিদ্ধ নোভা। তোমার জীবনে শুধু একটা ঋতুই আসবে আর তা হচ্ছে বর্ষাকাল। শ্রাবণের বর্ষাকাল। বর্ষার মেঘমালাকে তুমি দুচোখ ভরে দেখবে, ভালোবাসবে। বৃষ্টির জলে গা ভেজাবে। আর সেই বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় শ্রাবণ মিশে তোমাকে ছুঁয়ে দিবে। অনুভার জীবন হবে শুধুই শ্রাবণময়।”

নিষ্পল দৃষ্টিতে সামনে বসে থাকা সুদর্শন পুরুষটির পানে তাকিয়ে আছে অনুভা। অশান্ত মণি দ্বারা খুঁজে ফিরছে অপর চোখ থেকে কিছু। মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে তাণ্ডব চালাচ্ছে বাক্যগুলো। শেষ বাক্যটি কণ্ঠনালীতে গিয়ে খুঁটি গেড়েছে,‘অনুভার জীবন হবে শুধুই শ্রাবণময়!’

ততক্ষণে পূর্বের ন্যায় আবারো গাড়ি চালানোতে মনোনিবেশ করেছে শ্রাবণ। অনুভা যে অন্যমনস্ক হয়ে গেছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারলো সে কিন্তু কিছুই বললো না। নিরবে দ্রুত গতিতে পাড়ি দিতে লাগলো পথ।

পূর্বের মতো সেই একই রাস্তায় গাড়ি থামালো শ্রাবণ। অনুভা গাড়ি থেকে নেমে পড়ল।বিদায় নেওয়ার কথা মনে রইলো না আজ। রোবটের ন্যায় হাঁটা ধরলো সামনের পথ ধরে।একসময় মিলিয়ে গেলো অন্ধকার গলির ভেতরে। তার চলে যাওয়া দেখেই মুচকি হাসলো শ্রাবণ। এবার নিজের বাড়ি ফেরার পালা।
_______

আজ বাড়ি ফিরেই সোজা নিজের ঘরে প্রবেশ করল অনুভা। পোশাক বদলে হাত-মুখ ধুয়ে ঘর থেকে বের হলো। উঁকি দিলো বোনের ঘরে। তাঈম ঘুমিয়ে আছে বিছানায়। তার একপাশে একটা কোলবালিশ আর একটা পাশ বালিশ দিয়ে বাঁধ দেওয়া যাতে সে নিচে পড়ে না যায়। আরেক পাশে শোয়া অর্থিকা। ঘুমিয়ে আছে সে। শ্রাবণের কথায় তিনদিন আগেই তাকে ভালো একজন সাইক্রিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছিল অনুভা। ঘণ্টা বেঁধে দুজন কী এমন কথা যে বলেছিল কে জানে? তারপর থেকেই হুট করে বদলে গেলো মেয়েটা। ছেলের প্রতি আগের থেকেও অনেক যত্নশীল হয়ে উঠলো। দুদিন ধরে তার কাছেই তো ঘুমায় তাঈম।

রাতের খাবার খেয়ে ড্রয়িং রুমের আলো নিভিয়ে ঘরে এসে দরজা লাগালো অনুভা। ঘরটায় ছোট্ট একটা ব্যালকনি আছে। আকারে সরু। ছোটো একটা টুল রেখে নির্দ্বিধায় বসা যায় সেখানে। ফ্ল্যাটের ঘরগুলোও অতো বড়ো নয়। ছোটোই বলা চলে। এত সস্তায় ভালো কিছু আশা করাটাও বোকামি। অনুভার খেয়াল হলো এই ঘরে আজ পাঁচ মাস ধরে থাকছে সে অথচ এই বারান্দাটায় দুদণ্ড এসে বসেছে বলে মনে হয় না তার। একটা টুল পেতে আজ এখানে বসলো অনুভা। বাহিরে জ্যোৎস্না রাত কিন্তু চাঁদটা ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। সম্মুখেই বিশাল একটা বিল্ডিং। এই বিল্ডিং এর কারণে আকাশটাই পরিপূর্ণ দেখা যাচ্ছে না সেখানে চাঁদ তো দূরহ ব্যাপার।

তবুও বসে রইলো অনুভা।যতটুকু দেখা যায় ততটুকুই আপনমনে দেখতে লাগলো। মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে রইলো তারকামণ্ডলীর পানে। অতীত ঘেঁটে করতে লাগলো স্মৃতিচারণ।

অনুভার ছোটোবেলাটা কেটেছে মূলত ভ্রমণের মতো। বাবা পুলিশ অফিসার থাকার দরুন প্রতি বছরই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বদলি হতে হতো উনাকে। অর্থিকা আর অনুভাকেও বদলাতে হতো স্কুল। প্রথম প্রথম বন্ধুদের ছেড়ে আসতে কষ্ট হলেও একসময় এতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে অনুভা। দুই বোনের বয়সের পার্থক্য কেবল পাঁচ বছরের। বড়ো বোনই তখন হয়ে ওঠে অনুভার প্রিয় বান্ধবী। স্কুল থেকে ফিরে সারাদিনের জমে থাকা গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসতো অর্থিকার কাছে। অর্থিকাও মনোযোগ সহকারে শুনতো ছোটো বোনের কথা। সব গুরুত্বপূর্ণ কথাই দুই বোনের মধ্যে থাকতো সিক্রেটের মতো। ঝগড়া হলেও কখনো এ নিয়ে কেউ কারো নামে অভিযোগ জানাতো না মায়ের কাছে।

অর্থিকা তখন দ্বাদশে পড়ে আর অনুভা সবে সেভেনের বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছে। কামরুল হাসান সিলেটের একটা থানায় বছর দুয়েক পোস্টিং ছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে উনার আবার বদলি হয়ে যায় টাঙ্গাইলে। এদিকে অর্থিকার সামনে এইচএসসি পরীক্ষা।ওকে সঙ্গে করে নতুন জায়গায় পাড়ি দেওয়া যেমন সম্ভব নয় তেমনি একা রেখে যাওয়াটাও সম্ভব নয়। কী করবেন না করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না কামরুল হাসান। সবাইকে যে এখানে রেখে যাবেন তাতেও তো সমস্যা। সামনের বছর আবার অনুভার জেএসসি। এখানকার স্কুলেই আবারো ভর্তি করালে পরের বছরটাও পুরো পরিবারকে এখানেই থেকে যেতে হবে। অনেক ভেবেচিন্তে শেষে সিদ্ধান্ত হলো অর্থিকার পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত সুফিয়াই মেয়েকে নিয়ে থাকবেন এখানে। অনুভাকে নিয়ে কামরুল হাসান চলে যাবেন টাঙ্গাইল। ওখানকার একটা স্কুলেই ভর্তি করানো হবে তাকে।

তারপর আট আটটা মাস একে অপরকে ছেড়ে আলাদা থাকতে হয়েছে দুই বোনকে। রোজ ফোনে কথা হলেও অনুভার সে কি কান্না! বোনকে ছাড়া তার যেনো চলছেই না। অভিমানে নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে দেয়, সেবার বাঁধিয়ে ফেলে অসুখও। গা পুড়িয়ে তার জ্বর আসে। কামরুল হাসানের প্রাণ হচ্ছেন দুই মেয়ে। সবার ঊর্ধ্বে উনার কাছে উনার মেয়েরা তারপর বাকি সবকিছু। থানা বাদ দিয়ে মেয়ের শিয়রে বসে সারারাত মাথায় পানি ঢালেন। সকাল হতেই ছুটেন হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে। টানা এক সপ্তাহ জ্বরে ভোগে সেবারের মতো সুস্থ হয়ে ওঠে মেয়েটা। প্রাণ ফিরে পান কামরুল হাসান। ওই আটটা মাস অনুভার কাছে মনে হয়েছিল যেনো আট যুগ। অর্থিকার পরীক্ষা শেষ হতেই কামরুল হাসান আবারো যান সিলেটে। সবকিছু গোছগাছ করে বউ মেয়েকে নিয়ে চলে আসেন নতুন বসত বাড়িতে।

দুই বোন আবার একত্র হয়। তারপরের দিনগুলো মোটামুটি ভালোই চলছিল তাদের। মাস পাঁচেক পর ঢাকার একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যায় অর্থিকা। ভার্সিটি টু টাঙ্গাইল যাতায়াত অসম্ভব হয়ে ওঠে তার জন্য। তারপর ওখানকারই একটা ‘হলে’ গিয়ে ওঠে সে। তখন অবশ্য কান্নাকাটি করে নিজের বেহাল দশা বানায়নি অনুভা। তার বোঝ হয়েছে, লেখাপড়া করে বড়ো কিছু হওয়ার জন্য যে বোনের যাওয়াটা প্রয়োজন তা বাবা খুব ভালো করেই বুঝিয়েছে তাকে। সাড়ে তিন বছর টাঙ্গাইল কাটিয়ে আবারো পোস্টিং হয় কামরুল হাসানের। তবে সেবার পোস্টিং তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই নিয়েছিলেন। পোস্টিং হয়ে চলে আসেন মিরপুরের একটি থানায়। থানার কাছাকাছিই কিনে নেন বিলাসবহুল একটি ফ্ল্যাট। ওখানকারই একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় অনুভাকে।অর্থিকাও তখন ‘হল’ ছেড়ে চলে আসে বাড়িতে। নিজের পরিবারের কাছে। তারপর বাড়ি থেকেই শুরু করে ভার্সিটিতে যাতায়াত।

আগের থেকে দুই বোনের সম্পর্কটার উন্নতি হয় অনেক। দেখতে দেখতে একটা একটা করে বছর কাটে। অনুভার এইচএসসি শেষ হয়।

অনার্স শেষ করে অর্থিকা ভর্তি হয় মাস্টার্সে। অনুভা এইচএসসি দিয়ে এডমিশনের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য ভর্তি হয় ফার্মগেটের ভালো একটা কোচিং সেন্টারের মেইন শাখায়।

অনুভার ক্লাস ছিলো একদিন পরপর। সবসময় বাস ধরেই মিরপুর টু ফার্মগেট যাওয়া আসা করতে হতো তাকে। প্রথম প্রথম অর্থিকা ছোটো বোনকে দিয়ে আসা নিয়ে আসা করলেও তারপরে রাস্তা চেনা হতেই অনুভা একা একাই যাতায়াত শুরু করে। কিন্তু হুট করেই একদিন মাঝ রাস্তায় বাসের মধ্যে ঘটে চরম বিপত্তি। যাকে বিপত্তি বললেও ভুল হবে। এককথায় হয়রানি।

ফার্মগেটের কাছাকাছি আসতেই হেল্পার ভাড়া উঠাতে শুরু করে যাত্রীদের নিকট হতে। অনুভা ব্যাগ থেকে টাকা বের করে বাড়িয়ে দিতেই বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে নেয় হেল্পার লোকটা। কণ্ঠে বিরক্তি মিশিয়ে বলে,“এই রাস্তায় কী নতুন নাকি আপা?”

এহেন প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় অনুভা। শুধায়,
“নাহ। কেন বলুন তো?”

“আপনে মিরপুর তে বাসে উঠছেন না? তাইলে হাফ ভাড়া দিলেন ক্যান?”

“স্টুডেন্টদের জন্য তো হাফ ভাড়াই নির্ধারিত। আমি তো একদিন পরপরই যাতায়াত করি তখন তো হাফ ভাড়াই দেই।”

“আপনে স্টুডেন্ট?”

“হুম। এই যে কলেজ ব্যাগ।”—কোলের উপর থাকা ব্যাগটা দেখিয়ে বললো অনুভা।

হেল্পার ছেলেটা দেখেও না দেখার ভান ধরে বললেন,
“এইসব ব্যাগ ট্যাগ দিয়া হইবো না। প্রমাণ দেন।”

ব্যাগ থেকে আইডি কার্ডটা বের করে ছেলেটার সামনে তুলে ধরলো অনুভা। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা সুর বদলে টাকাটা অনুভার কোলের উপর ফেলে দিলো। অন্য যাত্রী থেকে ভাড়া উঠাতে উঠাতে বললো,“ওই সব হাফ ভাড়া টাড়া এহন আর নাই আপা। পুরা ভাড়াই দিতে হইবো।”

“পরশুও তো বাস দিয়েই গেলাম। কই তখন তো শুনলাম না হাফ ভাড়া বন্ধ হয়ে গেছে?”

লোকটি এবার কর্কশ কণ্ঠে বললো,“দেখেন আপা হুদাই তর্ক করবেন না। টাকা পয়সা না থাকলে গাড়িতে উঠেন ক্যান?”

লোকটার কথায় বেশ অপমানিতবোধ করল অনুভা। বাস ভর্তি মানুষের সামনে এমন একটি কথা যেনো কিছুতেই নিতে পারলো না।চুপচাপ ব্যাগ থেকে বাকি টাকাটা বের করে পূর্বের টাকার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে দিলো ভাড়া। কিছুক্ষণ পরেই দেখতে পেলো অন্য আরেকজন ছেলের থেকে হাফ ভাড়াই গ্ৰহণ করল হেল্পার লোকটি। দৃশ্যটি দেখার সঙ্গে সঙ্গেই চট করে মেজাজ গরম হয়ে গেলো অনুভার।

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে