সুখেরও সন্ধানে পর্ব-৩৮ এবং শেষ পর্ব

0
655

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
#উপসংহার

সূর্য অস্ত গেছে অনেকক্ষণ আগে। মাগরিবের নামাজ আদায় করে রান্নাঘরে চা বানাতে এসেছে অনুভা। দুটো কাপে চা ঢেলে সাথে কয়েকটা বিস্কুট ট্রেতে তুলে নিয়ে সে হাঁটা ধরলো কক্ষের দিকে। বোনের নিকট হতে বিদায় নিয়ে বিকেলের দিকেই বাড়িতে এসে পৌঁছেছে দুজন। সবিতাকে গতকালই দুদিনের ছুটি দিয়েছিল শ্রাবণ। তাই বাড়িতে আজ দুজন ব্যতীত কেউ না থাকায় ঘরের মধ্যেই মাগরিবের নামাজটা সে আদায় করে নিয়েছে। নামাজের এই সুন্দর অভ্যাসটা শ্রাবণ আর সৌহার্দ্যের গড়ে উঠেছে মূলত বাবার নিকট থেকে। হানিফ শেখের ছেলেবেলা কেটেছে গ্ৰামের বাড়িতে। বাড়ির কাছাকাছি মসজিদ হওয়ায় মা আজান হতেই ছেলেদের পাঞ্জাবী পাজামা পরিয়ে পাঠিয়ে দিতেন মসজিদে। স্কুল ডিঙিয়ে কলেজে উঠতেই সেই চিরচেনা অরণ্যে ঘেরা গ্ৰাম ছেড়ে তিনি চলে আসেন শহরে। সেই থেকেই শহরে উনার বসবাস। একে একে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় তারপর চাকরিক্ষেত্র। একসময় এখানেই গড়ে তুলেন বসত ভিটা। এতকিছুর মধ্যেও তিনি নামাজটা ঠিকই জামায়াতে আদায় করতেন।

ছেলেরা যখন হাঁটতে শিখলো তখন নিজের দু হাত দিয়ে তাদের দুজনের হাতের আঙুল ধরে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন মসজিদে। আসা যাওয়ার পথে কতশত গল্প করতেন। যেই রবের কারণে অক্সিজেন নিয়ে এত সুন্দর পৃথিবীতে আমরা বেঁচে আছি, সুন্দরভাবে জীবনযাপন করছি,যেই রব আমাদের সৃষ্টি করেছেন সেই রবকে ব্যস্ততা দেখালে কী হয়? সব কাজের থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজই তো রবের ইবাদত। সেই থেকে যত কাজ থাকুক কিংবা থাকুক ব্যস্ততা। শ্রাবণ আর সৌহার্দ্যও সময়মতো ঠিকই নামাজ আদায় করে নেয়।

চায়ের ট্রে নিয়ে অনুভা ঘরে প্রবেশ করতেই বিছানায় গা এলিয়ে শ্রাবণকে শুয়ে থাকতে দেখতে পেলো।একপাশে ট্রে রেখে নিজের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে বললো,“নাও চা খাও।”

শোয়া থেকে উঠে বসলো শ্রাবণ। মুষ্টিবদ্ধ হাতের উপর থুতনি ভর দিয়ে মিহি হাসলো। মাতাল কণ্ঠে বললো, “মাথাটা বড্ড ধরেছে নোভা। চা খেলে তো হবে না। এই মুহূর্তে কড়া কিছু চাই।”

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তার পানে তাকালো অনুভা। ছেলেটির মুখশ্রীতে উন্মাদনা। আঁখি যুগলে প্রগাঢ় নেশা। তার মতলব যে খুব একটা ভালো নয় তা চট করে বুঝে ফেললো অনুভা। পাংশুটে মুখ করে বললো, “কড়া কিছু?”

“হু হু।”

“কী শুনি?”

“তোমাকে চাই, তোমার ওই নরম ঠোঁট চাই। যার কাছে এসব চা নগণ্য।”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো অনুভা। হুটহাট এসব নির্লজ্জ মার্কা কথায় এখন সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মুখ বাঁকিয়ে বললো,“চা খেলে খাও না খেলে নেই। পরে চা ঠাণ্ডা হয়ে গেলে কিন্তু আমায় কিছু বলতে আসবে না।”

মুখশ্রীতে অসহায় একটা ভাব ফোটে উঠলো শ্রাবণের। চায়ের কাপ হাতে তুলে নিয়ে অভিযোগের সুরে বললো,“তুমি খুবই পাষাণ হৃদয়ের এক নির্দয়া প্রেমিকা বউ নোভা। একটু আদর করতে না পারার যন্ত্রনা তুমি বুঝতে চাও না। বারবার এই অসহায় পুরুষটিকে দুঃখ দাও।”

“চুমু খেতে দেইনি বলে তুমি দুঃখ পেয়েছো?”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় শ্রাবণ। এবার আর মুখটাকে গম্ভীর করে রাখতে পারলো না অনুভা। হু হা করে হেসে উঠলো। কিছুক্ষণ হেসে অবশেষে হাসি থামাতে সক্ষম হলো। কাঁচুমাচু মুখ করে শ্রাবণ প্রশ্ন করল,“হাসার কী বললাম আমি? আমার অনুভূতি প্রকাশকে তোমার কাছে হাস্য রসাত্মক ব্যাপার মনে হলো?”

তার পানে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো অনুভা। নড়েচড়ে উঠে আচমকা ছেলেটির অধরে অধর ছোঁয়ালো। শব্দ করেই চুম্বন এঁকে কয়েক সেকেন্ডে সরে এলো। তৈরি করে নিলো পূর্বের ন্যায় দূরত্ব। চমকালো শ্রাবণ। এই প্রথম তার শখের নারী নিজ থেকে তার এত নিকটে এসেছে। নিজ থেকে অধরে অধর ছুঁয়েছে। মুহূর্তেই যেনো এক অন্য রাজ্যে হারিয়ে গেলো পুরুষটি। ভেতরে ভেতরে জেগে উঠলো স্বামী সত্তা। এই মুহূর্তে নিজেকে সামলানোর সকল পথ যেনো বন্ধ হয়েছে। দুটো কাপ ট্রেতে পূর্বের মতো রেখে তা মেঝের একপাশে সরিয়ে রাখলো। হুট করে অনুভার বাহু ধরে টেনে তাকে নিজের অতি নিকটে নিয়ে এলো। শাড়ির আঁচল ফেলে দিয়ে হাত রাখলো উদরে। বাঁধা দিলো না অনুভা। নিরবেই যেনো সায় জানালো সে। এই পুরুষটিকে সে অসম্ভব ভালোবাসে। তার কণ্ঠনালী হতে নিঃসৃত প্রতিটি শব্দ তার ভালো লাগে। তার স্পর্শ তাকে ভুলিয়ে দেয় সকল অসুখ।
_________

ছোট্ট দুধের বাচ্চাটি চিৎকার করে কাঁদছে। তমা বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে বাচ্চার ক্রন্দন থামাতে। আজ শনিবার। তানিমকে বলে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে নাহিয়ান। ছেলেকে রেখে অফিসে যেতে তার ভালো লাগে না। সময় সহজে কাটে না। তানিম অবশ্য তার এই ছটফট ভাবটা বোঝে। তাই শুক্রবারের সাথে শনিবারটাও কখনো সখনো তার জন্য ছুটি মঞ্জুর করে দেয়। অফিসে অনিয়ম করায় ছেলের প্রতি কুলসুমের রাগের অন্ত নেই।

ছেলের কান্নার আওয়াজ পেতেই ঘরে এলো নাহিয়ান। স্ত্রীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“আমার বাবা কাঁদছে কেন? কী হয়েছে?”

“বুঝতে পারছি না। ভেবেছিলাম খিদে পেয়েছে কিন্তু খাচ্ছেও না।”

“বিছানায় শুইয়ে দাও দেখি।”

স্বামীর কথামতো ছেলেকে বিছানায় শুইয়ে দিলো তমা। নাহিয়ান গিয়ে বসলো বিছানায়। তার দিকে ঝুঁকে একটা ঝুনঝুনি বাজাতে বাজাতে চোখেমুখের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করতে লাগলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাচ্চাটির কান্না বন্ধ হলো। ছেলের কপালে চুমু খেলো নাহিয়ান। হাস্যজ্জ্বল মুখে স্ত্রীর উদ্দেশ্য বললো,“দেখলে তো আমার বাবার কান্না থেমে গেছে?”

মুচকি হেসে মাথা নাড়ায় তমা।

সবাইকে তাদের সব কাজ বুঝিয়ে দিয়ে উদাস মনে নিজ চেয়ারে বসে আছে তানিম। অল্পতেই রেগে যাওয়া পুরুষটির কী আজ মন খারাপ? বোঝা যাচ্ছে না। মায়ের কথায় নিজেকে সামলে নিতে পারলেও সেদিনের সেই অত্যন্ত সুখী এবং সুন্দর হাসির মেয়েটি তার মস্তিষ্কে গেঁথে আছে। বারবার আঁখি পটে ভেসে উঠছে অধরে বিস্তৃত চওড়া হাসিখানা। খুব ঈর্ষা জাগছে ওই পুরুষটির উপর যে ওই নারীকে নিজের করে পেয়েছে। যে পেরেছে ওই হাসিমুখের কারণ হতে।

আচ্ছা শ্রাবণ নামক পুরুষটি কী এমনি এমনিই অনুভা নামক স্নিগ্ধ মেয়েটিকে নিজের করে পেয়েছিল? মোটেও নয়। প্রিয় মানুষকে অতি সহজে কখনোই পাওয়া যায় না। প্রিয় মানুষকে জীবনে পেতে হলে অসাধ্য সাধন করতে হয়। শ্রাবণ তাই করেছে। নারীটির মন জিতেছে, এতকিছুর পরেও তাকে ছেড়ে যায়নি। এই নোংরা সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে মেয়েটির সঙ্গে ঘর বেঁধেছে। আগলে রাখছে ভালোবাসা দিয়ে। যা তানিম পারেনি। সে একটু দেরিই করে ফেলেছিল মেয়েটির জীবনে আসতে।

চেয়ারে হেলান দিয়ে এসব ভাবনা ভাবার মধ্যেই তার কেবিনের দরজায় কেউ নক করল।মেয়েলী কণ্ঠস্বরে অনুমতি চাইলো,“আসবো?”

নিজেকে স্বাভাবিক করে মুখশ্রীতে গাম্ভীর্য এঁটে ঠিক হয়ে বসলো তানিম। বললো,“আসুন।”

তৎক্ষণাৎ দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল সাজিয়া। তাকে দেখতেই ভীষণ অবাক হলো তানিম। ততক্ষণে এসে তার সামনের চেয়ার দখল করে বসেছে সাজিয়া। টেবিলে রাখা পানি ভর্তি গ্লাসটি থেকে খেয়ে নিলো অর্ধেকটা পানি। পুরো ঘটনা মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করল তানিম। মেয়েটি তার পানে তাকাতেই সে একনাগাড়ে প্রশ্ন করল,“আপনি আমার অফিসে কী করছেন? কেন এসেছেন এখানে?”

সাজিয়ার সোজাসাপ্টা জবাব,“আপনার জন্যই তো এসেছি।”

“আমার জন্য?”

“হু, আপনার ওই শর্ত আমি মাথা পেতে গ্ৰহণ করে নিলাম স্যার। এমনিতেও জামাই ছাড়া আমার দিনকাল খুবই বিষণ্ণ কাটছে। ছেলে হিসেবে আপনি মন্দ নন। সমস্যা শুধু যখন তখন হুটহাট অযথা রেগে যান।”

অধর প্রশস্ত করে কিছু বলতে চাইলো তানিম কিন্তু তাকে বলার সুযোগ না দিয়ে সাজিয়াই বলতে লাগলো, “তাতেও আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি প্রচুর ড্রামা আর মুভি দেখি। সেখানেই দেখেছি জামাই রেগে গেলে কীভাবে রাগ ভাঙাতে হয়। অসব শিখে রেখেছি। অতো সুন্দর সুন্দর নায়করা যেই ফর্মুলাতে কুপোকাত হয়ে যায় সেই একই ফর্মুলাতে আপনার মতো চুনোপুঁটি পটবে না? উহু এমনটা তো হতেই পারে না। যাই হোক, চট করে তো বলে দিলেন বিয়ে এই সপ্তাহেই হবে অথচ বিয়ের কোনো তোড়জোড় নেই? এভাবে তো চলবে না, চলুন শপিং করতে যাবো।”

“শপিং? আমি?”

“আপনি নয়তো কে? একটা দেওরও তো নেই যে তাকে নিয়ে যাবো। যাই হোক, বিয়েতে আমি লাল টুকটুকে বেনারসি পরবো। বিয়ে হবে মসজিদে। অযথা খরচা করে লোক খাইয়ে লাভ আছে? বিপদের সময় এসব মানুষদের পাওয়া যায় না পাশে। তাই সেসব অর্থ না হয় গরীব মানুষদের দান করে দিবো। দারুন না বুদ্ধিটা?”

বুদ্ধিটা সত্যিই দারুন। মেয়েটির শেষের কথাগুলো মনে ধরেছে তানিমের। তাই উপরনিচ মাথা নাড়ায়। সাজিয়া উঠে দাঁড়ায়। তাড়া দিয়ে বলে,“নিন চলুন তবে। আর হ্যাঁ বাসরের জন্যও কিন্তু আলাদা ড্রেস কিনবো।”

“বাসরের জন্যও?”

“তো কী? আপনার জন্য স্পেশাল করে সাজতে হবে না? এমন সাজ সাজবো যে আপনি উল্টে পড়বেন।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়েটির কথাতেই ভুলবশত সায় জানিয়ে দেয় তানিম। ড্রয়ার থেকে ওয়ালেট বের করে বেশি করে ক্যাশ সাথে নিয়ে বের হয় কেবিন থেকে।
__________

সকালেই নির্ধারিত সময়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে শ্রাবণ। এখন প্রায় দুপুরের শেষার্ধ। বিছানায় ক্লান্ত দেহখানা নিয়ে মলিন মুখ করে শুয়ে আছে অনুভা। শরীরটা আজ আর তার ভালো নেই। দুপুরের খাবার খেয়ে ঘরে আসতেই বমি করে সব উগ্রে দিয়েছে। বমি করতে করতে একপর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে জ্ঞান হারায় মেয়েটি। টাইলসযুক্ত শক্ত মেঝেতে পড়ে মাথার কিছুটা অংশ ফুলে গেছে। রক্ত জমাট বেঁধেছে সেথায়।

সবিতা একসময় তাকে ডাকতে ডাকতে উপরে এসে এমন অবস্থা দেখে ভড়কে যায়। ভিতু হয় তার মন। চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে হাতেপায়ে তেল মালিশ করে একপর্যায়ে জ্ঞান ফেরাতে সক্ষম হয়। সবটা জিজ্ঞেস করতেই অনুভা তাকে জানায় সবকিছু। এরপর বেশ কয়েকবার শ্রাবণকে ফোন করার পরেও কলটা রিসিভ হয়নি। মোবাইল সুইচ অফ বলেছে বারংবার। তাই একপর্যায়ে সবিতাকে ফোন করতে বারণ করে দেয় অনুভা।

শরীরটা ভীষণ দুর্বল লাগছে তার। হুট করে এমনটা হওয়ায় থিতু হয়েছে মন। বমি বমি ভাবটা গতকাল থেকেই শুরু হয়েছে। সকালেও একবার হয়েছিল কিন্তু দুপুরের মতো অতটা নয়। তাহলে কী ফুড পয়জনিং হলো? আর কিছুই ভাবতে ইচ্ছে করল না তার। বন্ধ করে নিলো নিজ আঁখি। একসময় পাড়ি দিলো ঘুমের রাজ্যে।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল হলো শ্রাবণের। ভার্সিটিতে ইদানিং তার খুব চাপ। সেমিষ্টার পরীক্ষা চলছে। তার উপর তার সাবজেক্টের পরীক্ষা সমাপ্ত হয়েছে। খাতাও পেয়ে গেছে হাতে। এখন সেগুলো চেক করতে হবে। কত ঝামেলা! দারোয়ানকে দিয়ে খাতাগুলো ভেতরে নিয়ে এলো শ্রাবণ। সোফায় রাখলো। পরে সেগুলো ঘরে নিয়ে যাবে। গলার টাই আলগা করতে করতে সবিতাকে প্রশ্ন করল,“নোভা কোথায়?দুপুরে খেয়েছে?”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় সবিতা। তাকে সদর দরজা লাগানোর নির্দেশ দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোয় শ্রাবণ। তখনি পেছন থেকে সবিতা ডেকে ওঠে,“ভাইজান!”

পথিমধ্যে থেমে দাঁড়ায় শ্রাবণ। পেছন ফিরে শুধায়,
“কী?”

“ভাবী হঠাৎ কইরা অসুস্থ হইয়া পড়ছে। দুপুরে অনেকবার বমি করছে, অজ্ঞান হইয়া পইড়াও গেছিল। আপনেরে ফোন দিছিলাম কিন্তু তহন আপনের ফোন বন্ধ আছিল।”

চমকায় শ্রাবণ। দ্রুত পকেট হতে ফোনটা বের করে। পরীক্ষার হলে প্রবেশ করার আগে নিয়ম মাফিক মোবাইল বন্ধ করে রেখেছিল সে। তারপর বিভিন্ন কারণে তা খোলার কথা ভুলেই গিয়েছে। দ্রুত বন্ধ মোবাইল খোলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো সে। কললিস্টে গিয়ে দেখে নিলো সত্যিই বেশ কয়েকটা কল এসেছিল।

ঘরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলো ঘুমন্ত স্ত্রীকে। সকালেই তো দেখে গেলো সুস্থ মেয়েটিকে অথচ এর মধ্যেই মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে, মলিনতায় আচ্ছাদিত হয়েছে। বিছানায় গিয়ে বসলো শ্রাবণ। আঘাতপ্রাপ্ত ক্ষত স্থানটি দেখে বুকটা মুচড়ে উঠলো। চুলের ভাঁজে হাত রেখে ডাকলো,“নোভা!”

কয়েক মিনিটেই ঘুম ভাঙলো অনুভার। সম্মুখে স্বামীকে বসে থাকতে দেখেই মলিন মুখে হাসির রেখা ফোটে উঠলো। ধীরে ধীরে উঠে বসলো সে। মিনমিনে স্বরে শ্রাবণ বললো,“স্যরি নোভা। আসলে আমি…”

তাকে আর কিছু বলতে দিলো না অনুভা। থামিয়ে দিয়ে বললো,“স্যরি বলার প্রয়োজন নেই। কর্মক্ষেত্রে যখন গিয়েছো ব্যস্ততা থাকাটাই স্বাভাবিক। অসুস্থতা তো আর বলে কয়ে আসে না।”

“সকালেও তো ঠিক ছিলে। তাহলে?”

“জানি না, মনে হয় ফুড পয়জনিং বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হয়েছে। অধিক বমির কারণে মাথাটা ঘুরে গেছে এই যা।”

কথাটায় মোটেও শ্রাবণের চিন্তা কমলো না। সে উঠে দাঁড়ালো। তাড়া দিয়ে বললো,“পরনের পোশাক বদলানোর প্রয়োজন নেই। এর উপরেই বোরকা পরে নাও। হসপিটালে যাবো আমরা।”

“এই সামান্য কারণে হসপিটালে কেন যাবো? কোনো প্রয়োজন নেই। তাছাড়া আমার এখন ভালো লাগছে না।”

“চুপ থাকো। এরপর বড়ো কিছু ঘটে গেলে? দ্রুত তৈরি হয়ে নাও।”

“তুমিও তো মাত্রই….”—–বাকিটা আর বলতে পারলো না অনুভা। শ্রাবণের রাগান্বিত দৃষ্টি দেখতেই চুপসে গেলো। ছেলেটি সহজে রাগে না। বিশেষ করে তার উপর তো একদম নয় কিন্তু আজ যেনো রেগেই গেলো।

ছোটো ছোটো কদম ফেলে অধিক সময় নিয়ে বোরকা আর হিজাব পরিধান করে নিলো অনুভা। তার হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে সোজা গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলো শ্রাবণ। বাড়ির গাড়িতে সমস্যা হওয়ায় ড্রাইভার মেকানিক নিয়ে এসেছিল তা মেরামত করতে। শরীর কিছুটা ক্লান্ত থাকায় নিজে আর ড্রাইভ করল না শ্রাবণ। তবে বাহিরে সেই ক্লান্তি কিছুতেই সে প্রকাশ করল না।

হাসপাতালে পৌঁছে আগে স্ত্রীর ক্ষত স্থান ড্রেসিং করিয়ে তারপর ভালো একজন গাইনীর সঙ্গে কথা বললো শ্রাবণ। ভদ্রমহিলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করতেই ইতস্তত কণ্ঠে অনুভা বলেই দিলো,“গতকাল থেকেই অস্থির অস্থির লাগছিল। সকাল থেকে বমি বমি ভাবটা শুরু হয়েছে আর সাথে মাথাটাও চক্কর দিচ্ছিল কিন্তু বুঝতে পারিনি এমনটা হবে।”

কথাটা শুনতেই ভেতরে ভেতরে ক্ষোভে ফেটে পড়ল শ্রাবণ। মেয়েটি কিনা এসব জানালোই না তাকে? সচরাচর সে রাগে না। রাগলেও নিজের রাগ দমন খুব ভালো ভাবেই করতে পারে। বাহ্যিকভাবে রাগটাকে নিয়ন্ত্রনে রাখলো। সমস্যাগুলো শুনে একগাদা টেস্ট করাতে দিলেন ডাক্তার। টেস্ট করিয়ে তারপর আবার রিপোর্টগুলো নিয়ে উনাকে দেখাতে হবে।

অনুভার সঙ্গে একটা বাক্যও আর বিনিময় করল না শ্রাবণ। মেয়েটির উপর সে রেগে আছে। তার এই খামখেয়ালিপনাই রাগের মূল কারণ। তার উপর সারাদিনে এখনো একটুও নিজের বিশ্রাম নেওয়া হয়নি। দুপুরে খাওয়াটাও ঠিকমতো হয়নি। ওদিকে স্ত্রীর হঠাৎ কী হলো সে বিষয়ে চিন্তা। এত ঝোট ঝামেলা একটা মানুষের পক্ষে নেওয়া কী সম্ভব?

সকল পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর রিপোর্ট হাতে পেতে আরো ঘন্টাখানেক হাসপাতালে বসে থাকতে হলো। শরীর এখনো গোলাচ্ছে অনুভার। মাথায় চিনচিনে ব্যথা করছে। তবুও ঠাঁয় বসে আছে। মুখ ফোটে কিছুই বলছে না শ্রাবণকে। তার আরো আধ ঘণ্টা পর ভেতরে তাদের ডাক পড়ল। শ্রাবণ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললো,“তুমি এখানে বসো। আমি কথা বলে আসছি।”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় অনুভা। ত্রস্ত পায়ে হেঁটে কেবিনের ভেতরে প্রবেশ করে শ্রাবণ। রিপোর্টের ফাইলটা ভদ্রমহিলার দিকে এগিয়ে দিতেই তিনি মনোযোগ সহকারে দেখতে লাগলেন সেসব কাগজ।

অনুভা বসেই আছে চুপচাপ।বিরক্ত লাগছে সবকিছু। নিজের উপর রাগ হচ্ছে। সকালে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেয়ে নিলেই তো এই ঝামেলায় আর তাকে পড়তে হতো না। কিছুক্ষণ বাদে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো শ্রাবণ। হাবভঙ্গি অত্যন্ত স্বাভাবিক। বললো,“এখানকার কাজ শেষ। প্রেসক্রিপশন মাফিক কিছু ওষুধ কিনে একেবারে বাড়ি ফিরবো।”

উঠে দাঁড়ালো অনুভা। তার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললো,“কী ফুড পয়জনিং হয়েছে তাই না? আমি বলেছিলাম অযথা আসার প্রয়োজন নেই। সেই তো এলে? এতক্ষণ বাড়িতে একটু বিশ্রাম নিতে পারতে।”

অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে স্ত্রীর পানে তাকায় শ্রাবণ। তার এহেন দৃষ্টিতে হতচকিত হয়ে থেমে যায় অনুভা। জোরপূর্বক কৃত্রিম হেসে চুপচাপ চলতে থাকে।
_________

রাত সাড়ে দশটা। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেই গোসল সেরে একেবারে রাতের খাবার খেয়ে শুয়েছে শ্রাবণ। টানা দেড় ঘণ্টা ঘুমিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো সে। মোবাইলে এলার্ম বাজছে। এলার্ম দিয়েই ঘুমিয়েছিল সে। অনেক কাজ পড়ে আছে। পুরো ঘরে চোখ বুলিয়েও কোথাও অনুভাকে দেখতে পেলো না। এত রাতে কোথায় গেলো মেয়েটি?

বাথরুমে চলে এলো শ্রাবণ। চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে পুরোপুরি তন্দ্রা ভাবটা দূর করে বেরিয়ে এলো। তৎক্ষণাৎ দেখা পেয়ে গেলো অনুভার। সবেই সে ঘরে এসেছে। দরজা লাগিয়ে পেছন ফিরতেই স্বামীকে দেখে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল,“ঘুম ভেঙেছে?”

উত্তর দিলো না শ্রাবণ। বিপরীতে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“অসুস্থ শরীর নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছিলে কেন?”

“সবিতা আপা চলে গেছেন তাই দরজা আটকে সব লাইট নিভিয়ে এলাম।”

“শরীর কী এখনো খুব খারাপ লাগছে? মাথা ঘোরানো, বমি বমি ভাবটা কেটেছে?”

“তখনকার মতো অতটা খারাপ এখন আর লাগছে না। তাছাড়া খাবারের পরপরই তো ওষুধ খেলাম।”

বিপরীতে কিছু বললো না শ্রাবণ। নিরবে ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেলো বারান্দায়। তার এই গম্ভীর আচরণ কিছুতেই নিতে পারছে না অনুভা। পেছন পেছন সেও এসে দাঁড়ালো পাশে। কাঁচুমাচু মুখ করে নত স্বরে বললো,“তুমি কী আমার উপর খুব রেগে আছো শ্রাবণ? আমি অতকিছু ভেবে তোমার থেকে আড়াল করিনি ব্যাপারটা। এমনকি আমি তো বুঝতেও পারিনি….”

কথার মধ্যখানেই তার হাত ধরে হেঁচকা টানে নিজের সঙ্গে তাকে মিশিয়ে নিলো শ্রাবণ। পুরুষটির হৃদযন্ত্রের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে অনুভা। শরীর জুড়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো তার। কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে শ্রাবণ তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,“আমি আমার এই ছোট্ট জীবনে তিনবার সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত হয়েছি, এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভূতি আমার ভেতরে তোলপাড় করেছে। প্রথমবার হচ্ছে, যখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম অনুভা নামক একটি মেয়েকে আমি ভালোবাসি। দ্বিতীয়বার, যখন তিন কবুলের মাধ্যমে হালাল ভাবে আজীবনের জন্য তোমায় নিজের করে আমি পেয়ে গেলাম। আর তৃতীয়বার হচ্ছে আজ, আজ আমার ভেতরে অন্য এক নাম না জানা অনুভূতি কাজ করছে নোভা। সেই অনুভূতি অদ্ভুত যা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আর চাইলেও আমি তোমায় তা দেখাতে পারবো না।”

অনুভা ধৈর্য্য সহকারে মনোযোগ দিয়ে তা শুনছে। কথাগুলো বলতে বলতে শ্রাবণের চোখ ভিজে উঠলো। গলার স্বর ভারী হলো। শুকনো ঢোক গিলে কিছুটা সময় নিলো। অতঃপর ফিসফিসিয়ে বললো,“প্রিয় নোভা, ভালোবাসি তোমায়। ভালোবাসি তোমার ওই গর্ভে আসা আমার ছোট্ট পবিত্র ফুলকে।”

হতচকিত, হতভম্ব হলো অনুভা। বাঁধন হতে মুক্ত হয়ে মাথা তুলে তাকালো শ্রাবণের পানে। দৃষ্টি নিবদ্ধ করল ওই পুরুষালি আঁখি যুগলের মধ্যে। আপনা আপনি নিজ ডান হাতটি তার পেটে চলে গেলো। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে ফের তাকাতেই তৃপ্ত হাসলো শ্রাবণ। সুগভীর বাক্যে বললো,“কংগ্ৰাচুলেশন মিসেস নোভা, ইউ আর প্রেগন্যান্ট।”

কী প্রতিক্রিয়া করা উচিত বুঝতে পারলো না অনুভা। তার শ্বাস প্রশ্বাস ভারী হয়ে এলো। পূর্বের ন্যায় আশ্রয় নিলো প্রিয় পুরুষের বুকে। ভেজা স্বরে বললো,“সবাই পেয়েছে সুখের সন্ধান আর আমি পেয়েছি আস্ত একটা সুখ। তুমি আমার সুখ শ্রাবণ। অথচ এই সুখ আমার পাওয়ার কথা ছিলো না। তোমার মতো সুখ এবং শুদ্ধ পুরুষের ভালোবাসা পেয়ে নিজেকে আমার এই বিশ্বের সবচেয়ে সুখী নারী মনে হচ্ছে। কেন আমি এত সুখী বলো তো?”

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো অনুভা। তার চোখের পানিতে ভিজতে লাগলো শ্রাবণ নামক শুদ্ধ পুরুষটির পরনের শার্ট। কিন্তু সে এই মেয়েটিকে ছাড়লো না। বাঁধন আরো শক্ত হলো। এ কান্না যে সুখের কান্না। এ কান্না হারিয়েও প্রাপ্তির কান্না।

(~সমাপ্ত~)

[শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধৈর্য্য সহকারে গল্পটি পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাদের। গল্পে হয়তো অনেক ভুলভ্রান্তি হয়েছে তা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আসসালামু আলাইকুম।]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে