সুখেরও সন্ধানে পর্ব-৩৭

0
563

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩৭]

অপেক্ষা শব্দটি মানুষের সঙ্গে মানানসই হলেও সময়ের সাথে শব্দটি খুবই বেমানান। সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না, করতে পারে না।মানুষ আসে, মানুষ হারায় কিন্তু সময় তার নিজ গতিতে চলতে থাকে। ক্যালেন্ডারের সংখ্যা বদলায়। এই তো মাস দুয়েক আগে পুরোনো ফ্ল্যাট ছেড়ে ছেলেকে নিয়ে নতুন ফ্ল্যাটে এসে উঠেছে অর্থিকা। তার ফ্ল্যাট বদলানোর খবর পেয়ে অনুভাও ছুটে এসেছিল। সবকিছু গোছগাছ করতে বড়ো বোনকে সে সাহায্য করেছে।

বাহিরে আজ পূর্ণিমা রাত। আকাশে রূপোর থালার ন্যায় বিশাল আকৃতির চাঁদ। তার সাথে বারান্দা হতে ভেসে আসছে ফুলের মিষ্টি গন্ধ। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে অনুভা। মন তার ভীষণ খারাপ। শান্তা এবং হানিফ শেখ বাড়িতে নেই তিনদিন হলো। উনারা গেছেন সৌহার্দ্যের কাছে। ওখানে মাস খানেক থেকে তারপর হজ্জ করে বাড়ি ফিরবেন। এটাই যাওয়ার আগে বলে গিয়েছেন পুত্র এবং পুত্রবধূকে। কয়েক মাসেই সংসার জীবনে এসে শাশুড়ির মধ্যে মাতৃত্বের স্বাদ খুঁজে পেয়েছিল অনুভা। এখন হুট করে উনারা চলে যাওয়ায় মনটা তার ভীষণ খারাপ।

নিচ থেকে ঘরে এসে প্রবেশ করল শ্রাবণ। আড়চোখে স্ত্রীকে দেখে নিয়ে বসে পড়ল সোফায়। ঘাড় উঁচিয়ে তার পানেই তাকালো অনুভা। মিলিত হলো দুজনার দৃষ্টি। শ্রাবণ জিজ্ঞেস করল,“নোভা রাণীর মন খারাপ?”

অনুভা ছোট্ট করে উত্তর দিলো,“উহু।”

শব্দহীন হাসলো শ্রাবণ। উঠে এসে কাবাডের দরজা খুলে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করল,“শাড়ি নাকি থ্রী পিছ?

“মানে?”

“দুটোর মধ্যে কোনটা পরবে?”

“শাড়ি তো পরেই আছি তাহলে আবার কেন পরবো?”

“এভাবেই কী বাহিরে যাবে নাকি? উহু আমি তো এ হতে দিবো না। আমি ব্যতীত আমার বউকে খোলা চুলে অন্য কেউ কেন দেখবে?”

“এখন বাহিরে?”

“হুম, চলো ঘুরে আসি। যতোই হোক বউয়ের মন ভালো করার দায়িত্বটাও তো আমিই নিয়েছি তাই না?”

মুচকি হাসলো অনুভা। তাকে তাড়া দিয়ে নিজের পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো শ্রাবণ। তৈরি হয়ে বাড়ি থেকে বের হতে হতে তাদের আধ ঘণ্টা সময় লাগলো।

সময়টা এখন বর্ষাকাল। রাতের আকাশে নেই কোনো মেঘমালার দল। সকালেই ঝুম বৃষ্টি হয়েছে। ভিজিয়ে দিয়ে গেছে শহরতলী। কংক্রিটের রাস্তা অনেক আগেই শুষে নিয়েছে বৃষ্টির পানি। তবুও রাস্তার আনাচে কানাচে দৃশ্যমান মাটি হয়ে আছে কর্দমাক্ত। গ্যারেজ থেকে গাড়িটা বের করল শ্রাবণ। অনুভার গায়ে নীল গোলাপী রঙের মিশ্রণে সিল্কের শাড়ি। মাথায় নীল রঙের হিজাব। শাড়িটি অতি সাবধানে ধরে গাড়িতে উঠে বসলো সে। শ্রাবণও তৎক্ষণাৎ চালকের আসনে উঠে বসে গাড়িতে স্টার্ট দিলো।

ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে নয়টা ছুঁইছুঁই। একটি রেস্তোরাঁর কার্নিশের টেবিলে বসে আছে তানিম। চোখেমুখে ফোটে উঠেছে তার বিরক্তির ছাপ। একটু পরপর হাত ঘড়িতে সময় দেখছে আর বিড়বিড় করছে। আরো কিছু মিনিট পার হতেই চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো সে। তখনি দ্রুত একটি মেয়ে এসে তার সম্মুখ চেয়ারে বসলো। অপরাধীর ন্যায় কোমল স্বরে বললো,“স্যরি স্যরি। আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে। আসলে রাস্তায় এত জ্যাম ছিলো যে কী বলবো? জ্যামের কারণেই আরকি দেরিটা হলো। আপনি কী অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন?”

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো মেয়েটি। তানিম ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করল,“মিস. সাজিয়া?”

মেয়েটি উপরনিচ মাথা নাড়ায়। এবার রাগত স্বরেই তানিম বলে উঠলো,“ঠিক পয়ত্রিশ মিনিট লেইট হয়েছে আপনার। আমার কী সময়ের কোনো দাম নেই? শুধু মায়ের কথায় অফিস শেষে এখানে এসে এতক্ষণ অপেক্ষা করেছি, নইলে।”

“ভুল তো মানুষ মাত্রই হয়। চটছেন কেন? ধরুন আজ যদি আমার জায়গায় আপনি থাকতেন? আমি কী এভাবে রাগ করতে পারতাম? উহু মোটেও রাগ করতাম না হুহ।”

“আমি আপনার মতো কেয়ারলেস নই যে কাউকে এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করাবো।”

“শাশুড়িমা তাহলে ঠিকই বলেছিল, তার ছেলে তো সত্যি সত্যিই একটা বদমেজাজি।”

“কে শাশুড়িমা?”

“কে আবার? আপনার মা।”

“আমার মা আপনার শাশুড়ি হলো কীভাবে?”

“বদমেজাজির পাশাপাশি তো আপনি দেখছি ভারি বোকা পুরুষ! আপনার সাথে আমার বিয়ে হলে তো আপনার মা আমার শাশুড়িই হবে তাই নয় কি?”

মেয়েটার এমন দ্বারা কথাবার্তা কিছুতেই পছন্দ হলো না তানিমের। সাথে মেয়েটার এমন সময়জ্ঞানহীন স্বভাবও না। গম্ভীর মুখে বলে উঠলো,“উহু বিয়ে হচ্ছে না। আপনাকে আমার একদম পছন্দ হয়নি।”

সাজিয়ার ললাটে ভাঁজ পড়ল। ব্যাগ থেকে ছোটো বিউটি আয়নাটা বের করে নিজের মুখশ্রীতে ভালো করে চোখ বুলিয়ে বললো,“না খারাপ তো লাগছে না। তাহলে পছন্দ না হওয়ার কারণ কী?”

“আপনার কী মনে হয় আপনাকে অপছন্দ হওয়ার কারণ আপনার রূপ?”

“অবশ্যই। আমি সুন্দরী একটি মেয়ে। পছন্দ হবে না কেন?”

“সৌন্দর্য ধুয়ে কী আমি পানি খাবো নাকি? আপনার বাচনভঙ্গিতে প্রচুর ন্যাকামি রয়েছে আর আমার এইসব ন্যাকামি একদম পছন্দ নয়। তার উপর আপনার সময়জ্ঞান বলে কিচ্ছু নেই।”

“মেয়েরা ন্যাকামি করবে না তো কে ন্যাকামি করবে? আপনি? আনরোমান্টিক পুরুষ। যাই হোক এসব আঁতলামি স্বভাব বাদ দিন। আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে।”

“আমার হয়নি।”

“কেন যে হয়নি জানি না ভেবেছেন নাকি?”

“কী জানেন?”

“এই যে এক মেয়েকে পছন্দ করে তার জন্য বিয়ের প্রপোজাল পাঠিয়েছিলেন কিন্তু মেয়েটি আপনায় রিজেক্ট করে দিয়ে তার প্রেমিককে বিয়ে করে নিয়েছে তাই তো?”

হতভম্ব হয়ে গেলো তানিম। এই মেয়ে এসব কথা কোত্থেকে জানলো? কে বলেছে তাকে? মা? মা কেন তার মান সম্মান এর কাছে নষ্ট করবে? তাহলে? ভীষণ রাগ হলো তানিমের। আর কথা বাড়াতে চাইলো না। এখান থেকে চলে যাওয়াটাই শ্রেয় মনে করল। তাই চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সামনে তাকাতেই দৃষ্টিগোচর হলো পরিচিত মুখশ্রীর। তৎক্ষণাৎ পূর্বের স্থানেই বসে পড়ল তানিম। তার এহেন কাণ্ডে ভ্রু কুঁচকে নিলো সাজিয়া। প্রশ্ন ছুঁড়লো,“আপনার আবার কী হলো?”

উত্তর দিলো না তানিম। তার থেকে কয়েক টেবিল দূরত্বের একটি টেবিলে বসে আছে অনুভা। এই রেস্তোরাঁটা এখানকার বেশ নাম করা একটি রেস্তোরাঁ। বন্ধুদের সঙ্গে এর আগেও বেশ কয়েকবার এখানে এসেছিল শ্রাবণ। তাই আজ স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে হতেই প্লান করে নিয়েছিল যে আগে ডিনার করবে তারপর ঘোরাঘুরি করে বাড়ি ফিরবে।

মন খারাপটা মুহূর্তেই যেনো মিলিয়ে গেছে অনুভার। অধরে তার চমৎকার হাসি। শ্রাবণের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আশেপাশের সাজসজ্জা দেখতে ব্যস্ত সে। হঠাৎ সামনের দিকে দৃষ্টি যেতেই তানিমের সঙ্গে চোখাচোখি হলো। ভেতরে ভেতরে কিছুটা চমকালেও উপরে উপরে বেশ স্বাভাবিক রইলো অনুভা। একটি মেয়ের সঙ্গে বসে আছে তানিম। তবে মেয়েটির মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তার দিকে পিঠ ঘুরিয়ে বসে আছে।

চোখ ছোটো ছোটো করে স্ত্রীর পানে তাকালো শ্রাবণ। বাম গালটা আলতো করে টিপে দিয়ে মিহি স্বরে বললো,“সামনে আমি থাকতে অন্যদিকে কী মেয়ে? জানো আমি ক্লাসে থাকাকালীন সবাই হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।”

মুচকি হাসলো অনুভা। দৃষ্টি সরিয়ে শ্রাবণের পানে তা স্থির করল। বললো,“এই কথা শুনতে শুনতে আমার কানটাই মনে হয় নষ্ট হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ তারা হা করে তাকিয়ে তাকিয়ে তোমায় দেখে না বরং তোমার পড়া শুনে।”

“তাহলে আর কী? তুমি বরং আমায় শোনো।”

হাসিটা চওড়া হলো অনুভার। মুগ্ধ নয়নে তার পানেই তাকিয়ে রইলো শ্রাবণ। ততক্ষণে খাবার দিয়ে গেছে ওয়েটার। চামচ দিয়ে খাবার তুলে অনুভার মুখের সামনে ধরে শ্রাবণ জিজ্ঞেস করল,“মন ভালো হয়েছে?”

খাবারটা মুখে নিয়ে চিবোতে চিবোতে অনুভা উত্তর দিলো,“অর্ধেকটা।”

এবার শব্দ করেই হেসে উঠলো শ্রাবণ। পুনরায় প্রশ্ন করল,“পুরোটা কখন ভালো হবে?”

“এখান থেকে বের হয়ে আরেকটু ঘুরলে।”

প্রত্যুত্তর করল না শ্রাবণ। অধরে হাসি রেখেই খেতে লাগলো। একদৃষ্টিতে তাদের দেখে গেলো তানিম। দেখে নিলো আজ অন্য এক অনুভাকে। এক প্রাণবন্ত হাস্যজ্জ্বল মেয়েকে। মনে মনে আওড়ালো, মেয়েটির হাসি সুন্দর।সাজিয়া তার মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে কণ্ঠে বিরক্তি ফুটিয়ে বললো,“এতক্ষণ তো ভালোই জ্ঞান দিচ্ছিলেন আমায়।তাহলে এখন কোথায় গেলো আপনার সেই জ্ঞান? আমার কথার জবাব না দিয়ে নিজের মতো বসে আছেন?”

তানিমের দৃষ্টি সরলো। পূর্ণ দৃষ্টিতে এবার সামনে বসা অপরিচিত মেয়েটির পানে তাকালো সে। মেয়েটি দেখতে মন্দ নয়। মুখের গড়ন তার সুন্দর। পরনে বেগুনী রঙের শাড়ি। চুল‌ হাত খোঁপা করা। চোখে নিখুঁতভাবে কাজল দেওয়া। দু হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি।হুট করেই সিদ্ধান্ত বদলালো তানিম। শুকনো ঢোক গিলে নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো সে। অত্যন্ত গম্ভীর মুখে বলে উঠলো,“আপনার চুল সুন্দর। আমার বউয়ের সুন্দর চুল আমি ছাড়া আর কেউ দেখুক তা আমি চাই না। আপনার চোখটাও অসম্ভব সুন্দর। কাজলে যেনো মারাত্মক লাগে। আর বিয়ে হলে এই সপ্তাহেই হবে। শর্তে রাজি থাকলেই আমায় ফোন করবেন নয়তো ফোন করার প্রয়োজন নেই।”—কথাগুলো বলেই টেবিলের উপর একটা কার্ড রেখে বিল মিটিয়ে বড়ো বড়ো কদম ফেলে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গেলো তানিম। যাওয়ার সময় আড়চোখে দেখে গেলো সেই সুখী দম্পতিকে।

সাজিয়া অবাক হলো ছেলেটির কাণ্ড কারখানা দেখে। এভাবে হুট করে কিনা তাকে একা রেখে চলে গেলো? এখন না বললো পছন্দ হয়নি? তাহলে আবার বিয়ের দিনক্ষণও ঠিক করে ফেললো কেন? অদ্ভুত! কার্ডটি হাতে তুলে নিয়ে সেখান থেকে নাম্বারটা মোবাইলে সেভ করল সাজিয়া। অর্ডার দিলো এক মগ কফি। এসেছেই যখন তাহলে কফি খেয়েই না হয় বাড়িতে ফেরা যাবে।

খাওয়া শেষে বিল মিটিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বের হলো শ্রাবণ। পথেই অনুভা বায়না ধরলো রিক্সায় করে শহর ঘুরবে সে। স্ত্রীর আবদার পূরণ না করার মতো পুরুষ শ্রাবণ নয় তাই গাড়িটি সঠিক স্থানে পার্ক করে একটা রিক্সা ঠিক করে ওঠে পড়ল তাতে। হুড নামানো থাকায় পেছন দিয়ে হাতটা নিয়ে অতি যত্ন সহকারে স্ত্রীর বাহুতে ধরে রাখলো শ্রাবণ। যাতে আঁকাবাঁকা পথে গিয়ে ঝাঁকি খেয়েও মেয়েটি পড়ে না যায়। তার এত যত্নশীলতায় তৃপ্তির হাসি ফোটে ওঠে অনুভার অধরে। এত ভালো একজন জীবনসঙ্গী তার ভাগ্যে লিখে রাখায় মনে মনে শোকরিয়া আদায় করে রবের। পাশাপাশি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বড়ো বোনের প্রতি। সে তো বারবার বিভিন্ন শঙ্কায় এই পুরুষটিকে নিজের থেকে দূরে সরাতে চেয়েছে অথচ বড়ো বোন অমন উদ্যোগ নেওয়াতেই তো আজ সুখের সন্ধান পেয়েছে মেয়েটি। সব ক্ষততে লেপ্টে গেছে শ্রাবণ নামক শুদ্ধ পুরুষের ভালোবাসা।

আরো বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করে অবশেষে বাড়ি ফিরলো দুজনে। পূর্বের দিনের তুলনায় আজকের দিনটা ছিলো অনুভার নিকট এক বিশেষ দিন।
_________

শ্বশুর শাশুড়ির আগমনে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে প্রান্তি। সৌহার্দ্য অফিসে। হানিফ শেখ অ্যাপার্টমেন্টের খোলামেলা বারান্দায় কফি নিয়ে বসে ইংরেজি পত্রিকা পড়ছেন। রান্নাঘরে ব্যস্ত শাশুড়ি-বউমা। দেশে থাকাকালীন সময়টা খুবই স্বল্প হওয়ায় শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সঙ্গে বিশেষ কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি প্রান্তির। শাশুড়ি নামক মানুষটি তার কাছে শুধু শাশুড়ি হিসেবেই পরিচিত ছিলো।তবে এ কদিনে সম্পর্কের বিশেষ উন্নতি হয়েছে। রন্ধনে অদক্ষ মেয়েটি শাশুড়ির থেকে শিখে নিচ্ছে স্বামীর পছন্দনীয় বাঙালি সব রান্না।

সুপার শপ ঘুরে সকালের দিকেই খুঁজে খুঁজে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে শাশুড়ি আর বউমা মিলে। নাড়ু বানানোর জন্য নারকেল কোরাচ্ছেন শান্তা। উনার হাতের দিকে মনোযোগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রান্তি। আজকের রেসিপি হচ্ছে নাড়ু, পাটিসাপটা আর পিঠেপুলি। এখানে বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। ঠাণ্ডার মধ্যে পিঠে না হলে কী আর জমে? তার উপর পিঠা, নাড়ুসহ মিষ্টি জাতীয় সব ধরণের খাদ্যই সৌহার্দ্যের নিকট খুবই প্রিয়। প্রান্তি বললো,“এত কষ্ট করার কী প্রয়োজন মা? এর থেকে নারকেল ছোটো ছোটো করে কেটে ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করলেই তো হয়ে যায়‌।”

পুত্রবধূর কথায় শব্দহীন হাসেন শান্তা। বলেন,“ব্লেন্ড করলে তো ভর্তা হয়ে যাবে। তাতে কোরোনো নারকেলের মজা তো পাওয়া যাবে না মা।”

“কিন্তু এটা অনেক কঠিন আর সময়ের ব্যাপার।”

“তা অবশ্য ঠিক কিন্তু ভালো কিছু পাওয়ার জন্য তো কঠিন কাজ করতেই হয় তাই নয় কি?”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় প্রান্তি। শান্তা পুনরায় বলেন,
“প্রথম প্রথম একটু কঠিন লাগবেই। একবার শিখে গেলে দেখবে আর কঠিন লাগবে না। তাছাড়া সহুর আবার এসব খুব পছন্দের। এসব পেলে ওর আর কিছুই চাই না।”
__________

অন্যান্য দিনের থেকে শুক্রবারটা অনুভার প্রিয়। বিয়ের আগের শুক্রবার আর বিয়ের পরের শুক্রবারের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে অনেক। বিয়ের আগের শুক্রবার মানে তার কাছে ছিলো সংসারের দায়িত্ব অথচ বিয়ের পরের শুক্রবারটা একেবারে ভিন্ন। এখন নেই তার কোনো চিন্তা। জীবনের নেই কোনো জটিলতা। সকাল থেকে শ্রাবণকে বিভিন্ন ভাবে রাজি করিয়ে আজ সে বোনের কাছে এসেছে। গত দুই সপ্তাহ হয় তাঈম কিংবা অর্থিকার সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হয় না অনুভার।

অর্থিকাকে আজ আর রান্না করতে হলো না। শ্রাবণ বাহির থেকে খাবার আনিয়েছে। দুপুরে সবাই একসঙ্গে গল্প করতে করতে খেয়ে উঠলো। খাওয়ার পর তাঈমকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে চলে গেলো শ্রাবণ। আসার সময় ছেলেটার জন্য অনেক খেলনা কিনে নিয়ে এসেছে। সেগুলোই তো তাকে দেখাতে হবে।

এঁটো প্লেটগুলো ধুয়ে নিচ্ছে অর্থিকা। অনুভা চাইলো বোনকে সাহায্য করতে কিন্তু অর্থিকা তাকে হাত লাগাতে দিলো না। পাশে দাঁড়িয়েই হাঁসফাস করছে অনুভা। ইতস্ততবোধ করছে কিছু বলতে। বোনের এমন অবস্থা দেখে আড়চোখে তাকিয়ে অর্থিকা শুধালো, “কিছু বলবি? এমন ইতস্তত করছিস কেন?”

বড়ো বোনের অনুমতি পেয়ে অনুভার কণ্ঠস্বর দৃঢ় হলো,“ফায়াজ ভাই তোকে সত্যিই খুব ভালোবাসে আপু।”

“তা তো আমি জানিই কিন্তু তুই জানলি কীভাবে?”

“বাড়ি বদলানোর সময় উনার সঙ্গে কথা হয়েছিল। ওইটা ফায়াজ ভাইদেরই বাড়ি ছিলো।”

প্রত্যুত্তর করল না অর্থিকা। বড়ো বোনকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার গালে আলতো করে হাত রেখে অনুভা বললো,“তোকে সে বিয়ে করতে চায়। তাঈমকে নিয়ে তার কোনো আপত্তি নেই। তার চোখে তোর জন্য আমি ভালোবাসা দেখেছি আপু। নতুন করে শুরু কর না সবটা। এতে তাঈম বাবার ছায়াতল পাবে, বাবার ভালোবাসা পাবে। আর তোর এই একাকিত্বটাও ঘুচবে।”

হাসলো অর্থিকা। যেই হাসিতে নেই কোনো বিষাদের ছাপ আর না আছে আনন্দ। বললো,“ভালোবাসা এক অদ্ভুত অনুভূতি। যারা ভালোবাসে তারা এই অনুভূতির মধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায়। মানুষটি যদি সঠিক হয় তাহলে সেই মানুষটির স্মৃতি নিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। পৃথিবীতে বাবা ছাড়া ছেলে-মেয়েরা কী বড়ো হচ্ছে না? স্বামীর অবর্তমানে কী নারীদের জীবিকা চলছে না? আমি বিবাহিতা নারী, হয়তো বিধবা তবে আমার সন্তানের পিতৃ পরিচয় রয়েছে। আমার সন্তানের বাবা মৃ’ত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমাকে আর আমাদের সন্তানকে ভালোবেসে গেছে, নিজের দায়িত্ব পালন করে গেছে। তার জায়গায় অন্য কাউকে স্থান দেই কী করে বল তো অনু? এ তো অসম্ভব। তুই আমায় বাস্তবতা বুঝিয়েছিস আর আমি বুঝেছি। তুই আমায় মুভ অন করে ছেলেকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে শিখিয়েছিস, আমিও তা শিখে গেছি। এবার অন্তত বলিস না আবার নতুন করে বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সব নতুন করে শুরু করতে। জীবন মানেই শুধু বিয়ে নয়, সুখ মানেই বিয়ে নয়। আমি সম্মানের সাথেই এই পৃথিবীতে বাঁচবো। আমার সন্তান একদিন বড়ো হবে। আমিই ওর বাবা আর আমিই ওর মা। জীবন যেভাবে চলছে সেভাবেই না হয় চলুক। বিয়ের কথা আমি ভাবতে পারি না। এমন কথা শুনলে আমার কষ্ট বেড়ে যায়। আমি অসুখী হয়েও সুখী। আমার সুখ আমার স্বামীর স্মৃতি।”

নিরবে সব শুনলো অনুভা। কিন্তু বিপরীতে আর কিছুই বলতে পারলো না। অর্থিকার প্রতিটি কথাই যুক্তিযুক্ত। বিয়ে মানেই সব সমস্যার সমাধান নয়। ভবিষ্যতে কী হবে কী হতে চলেছে তা একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালাই তো জানেন।

চলবে _________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে