#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩১]
চারদিনের মধ্যেই বৌ ভাতের সকল আয়োজন সম্পন্ন হলো। গ্ৰাম, শহরসহ বিভিন্ন জায়গা হতে আত্মীয় স্বজনেরা এসে উপস্থিত হলো শেখ বাড়িতে। বিশাল এক কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করে সেখানেই অনুষ্ঠানের সূচনা করলেন হানিফ শেখ। দুই পুত্রবধূকে মনমতো সাজালেন শান্তা। লকারে তুলে রাখা সব গহনা দিয়ে গা ভর্তি করে দিলেন।
স্ত্রীকে এমন ভারি সাজে দেখে দৃষ্টিতে মুগ্ধতা ছড়িয়ে গেলো শ্রাবণের। হুট করেই মনে হলো তার এই ব্যক্তিগত নারীটি অসম্ভব সুন্দর।সব সজ্জায়-ই তাকে দারুন লাগে।
নিজের এবং মেয়ের পুরো শ্বশুরবাড়ির লোক সমেত অনুষ্ঠানে এসে উপস্থিত হলেন রুবিও। ভদ্রমহিলা এসেই প্রান্তির সঙ্গে যেনো ভাব জমাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অনুভাকে দেখেও না দেখার ভান করে রইলেন পুরোটা সময়। অনুভা প্রাপ্ত বয়স্ক বোঝদার একজন নারী। মানুষের আচার-ব্যবহার, দৃষ্টি সবকিছুর অর্থদ্বার তার নিকট পরিষ্কার। তাই শ্রাবণের এই খালার মনোভাব দেখে সহজেই সে বুঝে গেলো উনার যে কোনো কারণে তাকে অপছন্দ। অপছন্দ হতেই পারে এটাই স্বাভাবিক। একজন মানুষ কখনোই সকলের মনের মতো হতে পারে না। তাই ব্যাপারটার প্রতি তেমন একটা গুরুত্ব দিলো না অনুভা।
অনুষ্ঠানে অর্থিকা এলো তাঈমকে নিয়ে। অথচ হানিফ শেখ এবং শ্রাবণ গিয়ে সকলকে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছে। সাথে বলে দিয়েছে মাজেদাকেও যাতে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু তা আর হলো না। সুফিয়ার চলাচল করতে অসুবিধে হয়। দিনে দিনে ভদ্রমহিলা একেবারে নিরব হয়ে গেছেন। নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখতেই পছন্দ করেন। তাই উনি বড়ো কন্যার সঙ্গে এখানে আর আসতে চাইলেন না। কড়াকড়িভাবে তাকে বলেও দিলেন,“অনুকে সত্যটা বলার প্রয়োজন নেই অর্থি। ওকে যা হোক কিছু একটা বলে বুঝিয়ে দিস। মেয়েটা অবুঝ। মায়ের জন্য চিন্তা করবে, কেঁদেকেটে ভাসাবে।”
তাই মাজেদাও আর এলো না। এ কদিনে সুফিয়ার প্রতি তার একটা টান জন্মে গেছে। এর আগেও অনেক বাড়িতেই সে কাজ করেছে কিন্তু এমন মাতৃ আচরণ কারো নিকট হতেই প্রাপ্ত হয়নি তাই হয়তো উনার প্রতি তার এত মায়া আর টান।
কাজিন শ্রেণীরা কমিউনিটি সেন্টার হতে খেয়ে দেয়ে বাড়িতে এসেছে অনেক আগেই। ফুল দিয়ে সজ্জিত করেছে বাসর ঘর দুটো। দুই ভাইয়ের একই দিনে বাসর ভাবা যায়!ব্যাপারটা নিয়ে সবাই খুবই উৎসুক। বাসর সাজানো শেষ হতেই সকলে মিলে একত্রে ফন্দি আঁটে কীভাবে তাদের থেকে আদায় করবে অর্থ। ফুফাতো, মামাতো, চাচাতো ভাই-বোন মিলে মোট ন খানা মাথা গোল হয়ে বসে আছে। টানা মিনিট দশেক ফন্দি এঁটে তারপর চেঁচিয়ে উঠলো সকলে।
পুত্রবধূদেরকে নিজেদের সঙ্গে করেই বাড়ি ফিরেছেন হানিফ শেখ এবং শান্তা। বাড়ি ফিরতেই তাদেরকে ঘিরে ধরলো সকলে। শ্রাবণ এবং সৌহার্দ্য এখনো ফেরেনি। দুজনে এক সঙ্গেই ফিরবে।
অনুভাকে আবারো নতুন করে সাজিয়ে এনে বসানো হলো তাদের শোবার ঘরে। ঘর দেখে আশ্চর্য হলো অনুভা। বিছানার মাঝখানে গোলাপের বদলে চন্দ্রমল্লিকা দিয়ে লাভ সেফ। তার মধ্যিখানে দুই জাতের শুভ্র বেলী ফুল। খাটের উঁচু পাটাতনে নাম না জানা কয়েক পদের ফুলের মেলা। ঘরটি আজ বড্ড অচেনা ঠেকছে তার নিকট। আসবাবপত্র সব পূর্বের থাকলেও ঘরটি সাজানোর কারণেই মূলত এই অচেনা রূপ।
কাজিন শ্রেণীর মধ্যে রূপা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে অনুভার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,“বুঝলে ভাবী তোমার বাসর ঘর সাজানোর পুরো প্লান কিন্তু শ্রাবণ ভাইয়ের। এই যে দেখছো ফুলগুলো? এইসব ফুল কিন্তু ভাইয়া এনে দিয়েছে আর আমাদের সব দিক নির্দেশনাও ভাইয়াই দিয়েছে।”
চমকায় অনুভা। এতকিছুর মধ্যে এ দিকটাও কিনা ছেলেটির খেয়ালে ছিলো? অবন্তী বিরক্তির সহিত বলে,“সৌহার্দ্য ভাই শুধু প্রেমটাই যা করতে পারলো আসলে ব্যাটা একটা আনরোমান্টিক। ওর বাসর ঘরটা কিন্তু আমরা আমাদের আইডিয়াতেই সাজিয়েছি। সে তো তার বউ নিয়েই চরম ব্যস্ত ছিলো। এদিক ভাবার সময় কোথায়?”
অবন্তীর কথায় হো হো করে হেসে উঠলো বাকিরা। রূপা বিছানার মাঝখানটায় অনুভাকে সুন্দর করে বসিয়ে দিয়ে বললো,“বসে বসে এবার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করো ভাবী। আমাদের পাওনা টাকা না দিলে কিন্তু তোমার সোয়ামি এ ঘরের চৌকাঠেও পা রাখতে পারবে না বলে দিয়ে গেলাম। তাই আল্লাহকে ডাকো যাতে তার মনে দয়া মায়ায় ভরিয়ে দেয়।”
ননদের কথায় লাজুক হাসে অনুভা। অবন্তী তাড়া দিয়ে বলে,“এবার ছোটো ভাবীর কাছে চল। তাকে আর সৌহার্দ্য ভাইকে নিয়ে একটু মজা কুড়িয়ে আসি।”
সকলেই সায় জানালো তার কথায়। অনুভার নিকট হতে বিদায় নিয়ে চলে গেলো কক্ষ হতে। প্রান্তি বসে আছে সৌহার্দ্যের কক্ষের বিশাল খাটটির মাঝখানে। দু দলে বিভক্ত হওয়া কাজিনদের মধ্যে একদল তাকে বসিয়ে দিয়েছে এখানে। আরেকদলও অনুভার কাছ থেকে এখানে এসে হাজির হলো। খয়েরি রঙের ল্যাহেঙ্গায় বেশ সুন্দর লাগছে মেয়েটিকে। দেহে বাবা-মা এবং শ্বশুর শাশুড়ির দেওয়া অজস্র গহনা। লাজুক মুখ করে বসে আছে সে। অবন্তী আর রূপা এসে বসলো তার পাশে। উদ্দেশ্য একটাই সৌহার্দ্যকে জড়িয়ে তার সঙ্গে মজা নেওয়া।
_______
ঘড়ির কাঁটায় এগারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট। দুই ভাই অবশেষে বাড়িতে ফিরলো। সিঁড়ির কাছে আসতেই তাদের পথ রোধ করে দাঁড়ালো কাজিন শ্রেণী। দুই ভাই একে অপরের মুখপানে চাওয়াচাওয়ি করল। তাদের মধ্য হতে বয়সে বড়ো এবং বিবাহিত কাজিন রুয়েল ঠাট্টাশ্লেষ বলে উঠলো,“তোদের দু ভাইয়ের বয়সের পার্থক্য কত রে?”
ভ্রু কুঁচকে নিলো শ্রাবণ। উত্তর জানা প্রশ্ন এ আবার কেন করছে? ভেবেই ললাটে সরু ভাঁজ পড়ল। সৌহার্দ্য চটপট উত্তর দিলো,“ভাইয়া আমার থেকে তিন বছর পাঁচ মাস চৌদ্দ দিনের বড়ো। কেন বলো তো?”
নিরব বললো,“তাহলে শ্রাবণের আরো তিন বছর আগে বিয়ে করে বাসর করার কথা ছিলো অথচ শেষমেশ কিনা দুই ভাইয়ের একদিনেই বাসর! তোরা তো গিনেস বুকে নাম উঠাতে পারবি রে।”
তৎক্ষণাৎ সমস্বরে হেসে উঠলো সকলে। সৌহার্দ্য আফসোস করে বললো,“না রে নিরব ভাই। এমন ঘটনা আগেও অনেক ঘটেছে তবে তোরা আগে ভাগে বিয়ে না করে আমাদের জন্য অপেক্ষা করলে হয়তো আজ আমাদের চার জনের বাসরই একদিনেই হতো। তাহলে গিনেস বুকে নাম উঠে গেলেও উঠতে পারতো।”
সৌহার্দ্যের কথায় দমে গেলো রুয়েল এবং নিরব। শ্রাবণ বিরক্তির সহিত বললো,“নাম তো তোর নিরব তাহলে নিরব না থেকে এত পটর পটর করিস কেন? আসল মতলবটা বলে ফেল। দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না।”
অবন্তী খোঁচা দিয়ে বললো,“দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না নাকি বউকে ছাড়া ভালো লাগছে না?”
গম্ভীর মুখখানায় মুচকি হাসি ফোটে উঠলো শ্রাবণের। বললো,“দুটোই।”
অকপটে স্বীকারোক্তিতে আবারো হৈ হুল্লোড় সৃষ্টি হলো সকলের মধ্যে। কাজিন শ্রেণীর মধ্যে ছোটো থেকেই শ্রাবণ ছিলো ঘাড়ত্যাড়া এবং চাপা স্বভাবের একটি ছেলে। তার ভেতরের খবর বাহিরে আনা ছিলো যেনো দুঃসাধ্য একটি কাজ। তাদের মধ্যকার অনেক মেয়ে কাজিনই ছোটো থেকে লাইন মারতে চেয়েছিল শ্রাবণকে কিন্তু বরাবরই তাদের সুন্দর করে এড়িয়ে গিয়েছে শ্রাবণ। অথচ সেই ছেলেই কিনা একটা মেয়ের সাথে এত বছরের প্রণয়ের সম্পর্ক করে বিয়ে করে নিলো! আবার কী সুন্দর করে সকলের সামনে নিজের অভিব্যক্তি স্বীকারও করে নিচ্ছে! এতেই যেনো সকলে চরম অবাক।
অবন্তী বলে উঠলো,“সবাই শান্ত হ। কাজের কথায় আসি। শোন ভাইরা আমাদের। তোদের বাসরঘর আমরা অনেক কষ্টে সাজিয়েছি তাই আমাদের সাজানো ঘরে গিয়ে এমনি এমনি রোমান্স করা তো চলবে না।”
সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে বললো,“কষ্ট করে প্রেম করে বিয়ে করলাম আমরা, বাসর সাজালি আমাদের টাকায় আবার বউকে সারাজীবন সহ্য করবো আমরা অথচ টাকা দিবো তোদের? কাভি নেহি। ভাইয়া এদের জোরে একটা ধমক দাও তো। আমি আছি তোমার পেছনে।”
মুহূর্তেই ক্ষেপে উঠলো সকলে।শুরু হলো বাগবিতণ্ডা। অতি কথা বিরক্ত লাগছে শ্রাবণের। তাই ওদের থামিয়ে দিয়ে শুধালো,“এমাউন্টটা বলে শান্তি পা এবং শান্তি দে।”
হাসি ফোটে উঠলো সকলের মুখে। রূপা সৌহার্দ্যকে ভেংচি কেটে শ্রাবণের উদ্দেশ্যে বললো,“দেখো ভাইয়ারা বেশি কোনো দাবি আমাদের নেই। শ্রাবণ ভাইয়ার বাসরঘর আলাদা এবং স্প্যাশালভাবে সাজানো প্লাস পুরোনো সাজ উঠিয়ে বড়ো ভাবীকে আবার নতুন করে সাজানোর জন্য শ্রাবণ ভাই দিবে পঁচিশ হাজার টাকা, আর সৌহার্দ্য ভাইয়ের জন্য অত খাটতে হয়নি বলে ও দিবে বিশ হাজার টাকা।”
অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো সৌহার্দ্যের। বুকের বা পাশে হাত রেখে বললো,“তোরা কী ডাকাত নাকিরে? একসাথে আমাদের দুই ভাইয়ের কাছ থেকে পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা ঝেঁপে দিবি? এই এই টাকা কী গাছে ধরে নাকি? দুই হাজার দিচ্ছি ভাগ বাটোয়ারা করে নিস।”
তেতে উঠলো রুয়েল। বললো,“এসব বলতে তোর লজ্জা করে না? বিদেশে হাই ফাই চাকরি করিস, মাস শেষে ডলার কামাস আর এখানে এসে এমন ছ্যাচড়ামি করছিস? মাত্র বিশ হাজারই তো চেয়েছে ছোটো বোনেরা। টাকার তো তোদের অভাব নেই।”
“নিজেরা ছ্যাচড়ামি করে আমাকে ছ্যাচড়া বানাচ্ছো? শ্যাম অন।”
শ্রাবণ কিছু একটা ভেবে নিয়ে বললো,“আমার বাসরঘর প্লাস বউকে সাজানোর পুরো আইডিয়া আমার। পুরো শপিং মল ফুলের দোকান খুঁজে খুঁজে সবকিছু আমি এনে দিয়েছি তোদের। বাহির থেকে লোক আনিয়ে এসব করালে হাইস্ট দশ হাজার খরচ হতো। এর বেশি কিন্তু নয়। তবুও তোরা আমার ভাই- বোন তাই পনেরো হাজার দিতে রাজি আছি। এর থেকে একটা টাকাও বেশি দিবো না। এবার বাকিটা তোদের মর্জি। ভেবে দেখ।”
তাদের সামনে থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো সকলে। আলোচনা চললো কী করবে। নিবিড় ফিসফিস করে বললো,“শ্রাবণ যা ঘাড়ত্যাড়া আমি তো ভেবেছিলাম একটা টাকাও ওর থেকে আদায় করতে পারবো না। তারপরেও পনেরোতে রাজি হয়েছে এটাই হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। তাই চুপচাপ মেনে নে।”
নিবিড়ের কথায় সম্মতি জানালো সকলে। পুনরায় এসে দাঁড়ালো তাদের সম্মুখে। রূপা বললো,“ওকে তোমার কথায় রাজি আমরা। নগদ পনেরো হাজারই দাও তবে।”—–বলেই হাত বাড়ালো।
মুচকি হেসে পাঞ্জাবীর পকেট হতে চকচকে একটা হাজার টাকার বান্ডেল বের করে দিলো শ্রাবণ। সকলেই আবারো আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠলো। সৌহার্দ্য কাঁচুমাচু মুখ করে বললো,“আমার থেকেও পাঁচ হাজার কম রাখলে হয় না?”
অবন্তী বললো,“শ্রাবণ ভাইয়ার মতো যুক্তি দেখা তারপর ভেবে দেখবো।”
কী যুক্তি দেখাবে ভাবতে লাগলো সৌহার্দ্য কিন্তু খুঁজে পেলো না কিছুই। বাধ্য হয়েই পকেট হতে সেও বের করল একটা বান্ডেল। রুয়েল গুনলো টাকাটা কিন্তু এখানে বিশ হাজারের বদলে আছে চৌদ্দ হাজার। রেগে গেলো তারা। প্রতিবাদ করে বললো,“এটা কিন্তু ঠিক নয় সৌহার্দ্য। বাকি ছয় হাজার দে বলছি।”
“আমার কাছে এটাই ছিলো। এর বেশি কিছু নেই। বাকিটা না হয় কাল দিবো?”
নিবিড় ঘোর প্রতিবাদ করে বললো,“উহু বাকির নাম ফাঁকি। টাকা ছাড়া বাসরঘরের চৌকাঠ মারানো নিষেধ।”
সকলের মুখ গুরু গম্ভীর। সৌহার্দ্য অসহায় মুখ করে বড়ো ভাইয়ের পানে তাকালো। বাচ্চাদের মতো পাঞ্জাবীর হাতা টেনে বললো,“ভাইয়া দিয়ে দাও না।”
বিরক্তির সহিত তার পানে তাকায় শ্রাবণ। সৌহার্দ্য ফের বলে,“প্রমিস শোধ করে দিবো।”
ভাইয়ের অসহায় মুখ দেখে না করতে পারে না শ্রাবণ। এমন ঝামেলায় পড়তে হবে ভেবে আগেই সে নিজের কাছে ভালো পরিমাণের ক্যাশ রেখে দিয়েছিল। তাই চুপচাপ দিয়ে দেয় তাদের টাকাটা। টাকা কে দিলো তা নিয়ে হলো না কারো মধ্যে কোনো মাথাব্যথা। টাকা নিয়ে দু ভাইকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রস্থান করল সকলে।
বাহিরের সমস্ত হইচই কর্ণগোচর হলো অনুভার। লজ্জায় পুরো দেহ তার কাঁপছে। ক্ষণে ক্ষণে শুকনো ঢোক গিলে চলেছে। এসি চলার পরেও হাত-পা ঘেমে নেয়ে একাকার। তাদের হৈ হুল্লোড় বন্ধ তার মানে শ্রাবণ আসছে!
ঘরে প্রবেশ করল সৌহার্দ্য। দরজা আটকে দিয়ে পাঞ্জাবীর হাতা গোটাতে গোটাতে এগিয়ে গিয়ে ঢপাস করে বসে পড়ল বিছানায় নববধূর সম্মুখে। দুই হাত দিয়ে ঘোমটা সরিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো,“মাশাআল্লাহ! অপূর্ব!”
লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো প্রান্তি। তার থুতনি ধরে মুখ উঁচু করল সৌহার্দ্য। ললাটে গভীর চুম্বন আঁকলো। চোখ বন্ধ করে নিলো মেয়েটি। খামচে ধরলো স্বামীর পাঞ্জাবী। সৌহার্দ্য হাসলো। ফিসফিস করে বললো,“প্রান্তি লজ্জা পেতেও জানে? কই জানতাম না তো।”
লজ্জার পরিমাণ বৃদ্ধি পেলো প্রান্তির। দুষ্টু হাসলো সৌহার্দ্য। বললো,“লজ্জাবতীকে নির্লজ্জবতী করার ক্লাস শুরু করবো?”
কথার অর্থদ্বার বুঝতেই এবারো চুপ রইলো প্রান্তি।নিরবতাই যেনো সম্মতির লক্ষণ। সৌহার্দ্য হাসলো। সঙ্গে আনা উপহারটা স্ত্রীর হাতে দিয়েই আবারো চুম্বন আঁকলো অধরে।
এদিকে ঘড়ির কাঁটা এক ঘর হতে আরেক ঘরে স্থির হলো। সাড়ে বারোটা প্রায় বেজে গেছে অথচ এখনো ঘরে প্রবেশ করেনি শ্রাবণ। চিন্তিত হলো অনুভা। এতক্ষণে তো তার এসে পড়ার কথা তাহলে? কোথায় গেলো শ্রাবণ?
ধীরে ধীরে সময় অতিবাহিত হলো বেশ কিছুটা। মোবাইল হাতে নিলো অনুভা।অন করতেই দৃষ্টিগোচর হলো ‘শ্রাবণ’ দিয়ে সেভ করা নাম্বারটি থেকে গুণে গুণে এগারোটি মিসড কল। শঙ্কিত হয়ে উঠলো তার মন। মোবাইল সাইলেন্ট থাকায় টের পায়নি কিছুই। কম্পিত হাতে দ্রুত কল লাগালো নাম্বারটিতে।রিসিভও হলো সঙ্গে সঙ্গে। যেনো চাতক পাখির ন্যায় তার অপেক্ষাতেই ছিলো এতক্ষণ। তাকে কিছু বলতে না দিয়ে সুগভীর কণ্ঠে শ্রাবণ বলে উঠলো,“ঘর থেকে বের হয়ে হাতের ডানে হাঁটলেই সিঁড়ি পেয়ে যাবে। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে চলে এসো।”
এর বেশি একটা বাক্যও খরচা করল না শ্রাবণ।কেটে দিলো কল। বড়োই আশ্চর্য হলো অনুভা। এত রাতে ঘরে না এসে তাকে ছাদে কেন ডাকলো ছেলেটি? মাথা হতে দু পাট্টা খুলে বিছানায় রেখে দিলো অনুভা। পরনের অমায়িক কাজ করা শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে বের হলো ঘর থেকে।
নূপুরের রিনিঝিনিতে মুখোরিত হয়ে উঠলো চারিপাশ। ভয়ে, লজ্জায় কেঁপে উঠলো অনুভার মন। হঠাৎ কেউ দেখে ফেললে কী মনে করবে? হাঁটার গতি কমিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে পা ফেলতে লাগলো সম্মুখ পথে। তবুও নূপুরের শব্দ হচ্ছে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো অনুভা। চারিপাশে চোখ বুলিয়ে অবশেষে দেখা মিললো শখের পুরুষের। রেলিংয়ে হেলান দিয়ে আকাশপানে মনোযোগী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। স্ত্রীর উপস্থিতি টের পেতেই সম্মোহনী স্বরে বললো,“দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এসো।”
তাই করল অনুভা। আটকে দিলো ছাদের দরজা। ছোটো ছোটো কদমে এগিয়ে এসে সেও রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো পাশে। মিহি স্বরে শুধালো,“এত রাতে ছাদে ডাকলে কেন?”
আকাশ হতে দৃষ্টি সরিয়ে সেই দৃষ্টি স্ত্রীর পানে স্থির করল শ্রাবণ। সোনালী রঙের সুতোয় বোনা চোখ ধাঁধানো সুন্দর শাড়িটি যেনো সঠিক অঙ্গতেই স্থান পেয়েছে। শাড়িটি তাঁতি পাড়া থেকে মনমতো ডিজাইনে বানিয়ে এনেছিল শ্রাবণ। ইচ্ছে ছিলো যেদিন অনুভা নামক মেয়েটিকে সে জীবনে পেয়ে যাবে সেদিন তাকে মনের মতো সাজাবে। সাজাবে ফুলে ফুলে ফুলপরী। তাই হয়েছে, নিখুঁত ভাবে শাড়িটা পরানো হয়েছে তাকে। শরীরে বিভিন্ন জাতের ফুলের গহনা। মোটা করে কাজলটানা চোখ। ঠোঁটে লিপবাম। এর বেশি আর সাজ নেই। চুলগুলো খোঁপা করা কিন্তু তার উপর দিয়েই ছোটো ছোটো চুলগুলো বাতাসের তালে তালে এলোমেলো হয়ে উড়ছে।
এক অদৃশ্য ঘোরে আবদ্ধ হয়ে উঠলো শ্রাবণ। দৃষ্টিতে জমা হলো তীব্র প্রেমের নেশা। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো অনুভার কোমর। কোনো ধরণের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই নিজ ঠোঁটের ভাঁজে আবদ্ধ করে নিলো রমণীর তুলতুলে নরম ঠোঁট। এহেন কাণ্ডে বিষ্মিত হলো অনুভা। কিছুই যেনো পূর্বে আঁচ করতে পারেনি সে। নিস্তেজ হয়ে এলো তার শরীর। বাঁধা দেওয়ার মতো সমস্ত শক্তি লোপ পেলো।
পূর্ণিমার চাঁদ। হলদে আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে ধরণী। ছাদের টবে লাগানো কামিনী ফুলের সুবাস ছড়িয়েছে চারিদিকে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বইছে মৃদু বাতাস। দূর পথ হতে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ ভাসছে। ভাসছে ঝিঁ ঝিঁ পোকার গান। প্রেমময় একটি মুহূর্ত।
কিছু সময় অতিবাহিত হতেই শ্রাবণ তার ওষ্ঠদ্বয় ছেড়ে দিলো। নিতে লাগলো ভারি শ্বাস। অনুভার অবস্থাও এক। লজ্জায় বন্ধ চোখ মেলতে পারছে না কিছুতেই। এমন একটি কাণ্ড ঘটার পর কী করে সম্মুখ পুরুষটির চোখে চোখ রাখবে সে?
ধীরে ধীরে বাঁধন শক্ত হলো শ্রাবণের। শাড়ি ভেদ করে অনেক আগেই উন্মুক্ত উদরে হাত এসে প্রবেশ করেছে। মেয়েটির অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন, উত্তপ্ত শ্বাস- প্রশ্বাস খুব ভালো করেই টের পাচ্ছে। কিছু সময় কেটে গেলো। একরাশ লজ্জা নিয়েই পিটপিট করে তাকালো অনুভা। ফের দৃষ্টিগোচর হলো সেই মাদকতা মেশানো এক জোড়া দৃষ্টির। দৃষ্টিটি প্রকান্ড গাঢ় তার উপর। শরীরের ভারসাম্য যেনো ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে অনুভার। জড়িয়ে ধরলো পুরুষটিকে। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রুজল। বাঁধন শক্ত হয়ে এলো। ফুঁপিয়ে কান্না করার শব্দ ভেসে এলো শ্রাবণের কর্ণে। অথচ সে কিছুই বললো। বাঁধা দিলো না। এ কান্না যে দুঃখের নয়। এ কান্না হচ্ছে সুখের।
শ্রাবণ বলেছিল,‘আমি তোমায় সুখের অসুখে ডুবিয়ে রাখবো নোভা।’ সেই বাক্যটিই এই মুহূর্তে বারংবার প্রতিধ্বনি হতে লাগলো অনুভার কানে। এই কী তবে সেই সুখ? ভালোবাসার প্রাপ্তি বুঝি এত সুখকর? গলা জড়িয়ে গেলো অনুভার। চোখের পানি নাকের পানি একত্রে হয়ে তা লেগে গেলো শ্রাবণের পাঞ্জাবীতে। আজ সকল জড়তা একপাশে সরিয়ে দিয়ে জড়ানো কণ্ঠেই অনুভা স্বীকার করে বসলো নিজের মনের গহীনে লুকায়িত সেই চির চিরায়ত সত্য কথাটা,“ভালোবাসি শ্রাবণ। অনেক ভালোবাসি তোমায়।”
শ্রাবণ হাসলো। যেই হাসির কোনো শব্দ নেই। এই হাসি প্রাপ্তির হাসি। তার মনটা নড়ে উঠলো। পুরুষালী কঠোর চোখ দিয়েও হলো দু ফোঁটা বর্ষন। যা দৃষ্টির অলক্ষ্যে থেকে গেলো সুখী রমণীর। মাথায় আলতো চুমু খেয়ে তাকে সপাৎ করে পাঁজাকোলে তুলে নিলো শ্রাবণ। ফিসফিসানো গাঢ় স্বরে প্রয়োগ করল সুগভীর বাক্য, “আঁধারিয়া রজনীর আঁধার সরিয়ে আলোকিত করা ওই চন্দ্রের চেয়েও সুন্দর আমার নোভা। কামিনী ফুলের গন্ধের চেয়েও মোহনীয় আমার নোভার দুটো ঠোঁট। শ্রাবণ নামক পুরুষটির উপরই শুধু নিহীত হোক নোভার সকল সুখ।”
লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো অনুভা। প্রিয়তমের পাঞ্জাবী খামচে ধরে প্রশস্ত বক্ষে গুঁজলো মুখ। কিন্তু ঘোর কাটলো না শ্রাবণের। তাকে কোলে নিয়েই নিচের দিকে যেতে যেতে ফিসফিসিয়েই আবদার করল,“আজ পুরোপুরিভাবে আমার হবে মেঘফুল? শত জড়তা, লজ্জার দেয়াল ভেঙেচুরে দিয়ে আমার হবে? তোমার পবিত্র দেহে আমার ভালোবাসার স্পর্শ আঁকতে দিবে?”
এত সুমধুর আবদার নাকোচ করতে পারলো না অনুভা। সেও চায় পুরোপুরিভাবে শ্রাবণের হতে। লাজুক স্বরে ছোট্ট করে উত্তর দিলো,“হু।”
চলবে_________
#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩২]
আজকের দিনটি শুরু হলো হাজারটা অনিয়ম দিয়ে। শ্রাবণ, সৌহার্দ্য কেউই আজ সকাল সকাল হাঁটতে বের হলো না, খোলা আকাশের নিচে বসে তাদের চা খাওয়া হলো না, এখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তারা।গোসল সেরে এসে বাসি ফুলগুলো পরিষ্কার করার কাজে লেগে পড়ল অনুভা। ভেজা চুল দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। যার দরুন কোমরের কাছের শাড়ির অংশটি ভিজে লেপ্টে গেছে শরীরের সঙ্গে। ঘরদোর পরিষ্কার করে ময়লাগুলো একপাশে রেখে দিয়ে আয়নার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো সে। নিজের পানে নিজে তাকাতেই যেনো লজ্জাবোধ হচ্ছে মেয়েটার।
গতকাল রাতের কথা মনে পড়তেই বারবার কেঁপে উঠছে সর্বাঙ্গ। নিচে যেতে ভীষণ লজ্জা লাগছে। ভেজা চুল দেখে কী মনে করবে সকলে? সকাল হয়ে গেছে অনেক আগে এতক্ষণ ধরে ঘরে বসে থাকাটাই বা কেমন দেখায়? লজ্জা ঠেলে আশেপাশে তাকালো অনুভা। ড্রেসিং টেবিলের উপর পেয়েও গেলো হেয়ার ড্রায়ার। তাই আর বিলম্ব না করে সুইচ অন করে চুল শুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তখনি শব্দ হলো ওয়াশরুমের দরজার। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখতে পেলো বিছানা ফাঁকা। তার মানে শ্রাবণ উঠে গেছে!
সময় নিয়ে চুল শুকিয়ে বিছানা গোছাতে চলে এলো অনুভা। কাবাড খুলে নতুন বিছানার চাদর বের করে তা বিছাতে লাগলো। ওয়াশরুমের দরজা খুলে তখনি বেরিয়ে এলো শ্রাবণ। তোয়ালে দিয়ে ভেজা মাথা মুছতে মুছতে তাকালো স্ত্রীর পানে। বারান্দায় আধ ভেজা তোয়ালে মেলে দিয়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো স্ত্রীকে। অনুভা চমকালো। তার কাঁধে থুতনি ঘষে আহ্লাদী সুরে শ্রাবণ বললো,“স্বামীর ছোঁয়া পেতে না পেতেই দেখছি তোমার সৌন্দর্য বেড়ে গেছে নোভা! আমারটা কেন বাড়লো না? আমিও তো এই প্রথম বউকে আদর করলাম।”
হতভম্ব হয়ে গেলো অনুভা। কনুই দিয়ে গুঁতো মারলো তার পেটে। খানিকটা ব্যথা পেলো শ্রাবণ।তাকে ছেড়ে পেটে হাত দিয়ে বসে পড়ল। রাগত স্বরে অনুভা বলে উঠলো,“তুমি সত্যিই একটা অসভ্য। মুখে যা আসে তাই বলে দিবে?”
“আজব! আমি একটা লয়্যাল ছেলে, মনে যা আসবে তাই তো বউয়ের সামনে প্রকাশ করবো তাই না?”
“সরো এখান থেকে। বিছানা গোছাতে দাও।”
“না সরলে কী করবে?”
রাগ তরতর করে বৃদ্ধি পেলো অনুভার। বালিশটা শ্রাবণের দিকে ছুঁড়ে মেরে মাথায় ঘোমটা টেনে হাঁটা ধরলো দরজার দিকে। বললো,“নিজে গুছিয়ে নাও। সবটা সুন্দর করে গোছাবে বলে দিলাম।”
আলগোছে হাসলো শ্রাবণ। ততক্ষণে দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে অনুভা।সোফায় বসে চা খাচ্ছেন আর জা ননদদের সঙ্গে গল্প করছেন শান্তা। বড়ো পুত্রবধূকে দেখতেই প্রসন্ন হেসে শুধালেন,“ঘুম ভেঙেছে?”
এহেন প্রশ্নে সকলের সামনেই খানিকটা লজ্জা পেলো অনুভা। উপরনিচ মাথা নাড়ালো। শান্তা পুনরায় বললেন,“শ্রাবণ উঠেছে? উঠলে টেবিলে নাস্তা বেড়ে রাখা আছে, ওগুলো নিয়ে ঘরে চলে যাও। দুজনে একসঙ্গে গিয়ে খেয়ে নাও।”
আহত দৃষ্টিতে শাশুড়ির পানে তাকালো অনুভা। এই তো ছেলেটার লাগামহীন কথায় বিরক্ত হয়ে সে নিচে চলে এসেছিল।এখন কিনা আবার তার কাছেই যেতে হবে? দূর, দূর। তার করুন চাহনি আর দৃষ্টিগোচর হলো না শান্তার। তিনি তো গল্প করাতেই মনোযোগী হয়ে উঠলেন। তাই বাধ্য হয়েই খাবার নিয়ে পুনরায় ঘরে চলে গেলো অনুভা।
কিছুক্ষণ বাদে নিচে নেমে এলো প্রান্তি এবং সৌহার্দ্য। তারাও একসঙ্গেই নাস্তা করে নিলো।
_________
অর্থিকা এবং ফায়াজ একই ইউনিভার্সিটি এবং একই ব্যাচের স্টুডেন্ট। যদিও তাদের ডিপার্টমেন্ট ছিলো সম্পূর্ণ আলাদা তবুও প্রথমে এই মেয়েটি ফায়াজের নজরে পড়েছিল নবীন বরণের দিন। তখন তারা দ্বিতীয় বর্ষের স্টুডেন্ট। ক্যাম্পাসে আগমন ঘটেছে নতুন শিক্ষার্থীদের। নতুনদের ফুল দিয়ে ক্যাম্পাসে স্বাগত জানানোর দায়িত্ব এসে পড়েছিল তাদের উপর। বন্ধুদের বিভিন্ন কথাবার্তার উদ্বেগ পূর্ণ শক্তি সেদিন বের করে এনেছিল অর্থিকার প্রাণোচ্ছ্বল হাসিখুশি রূপটা। এই রূপেই তখন মুগ্ধ হয়েছিল সদ্য যৌবন অতিবাহিত করতে থাকা যুবকটি। সেদিন পুরোটা সময়ই সে মেয়েটির পানে নিষ্পল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো।
তার এই প্রেমে পড়ার কাহিনীটা একসময় বন্ধুদের নজর এড়ায়না। তখন সবাই তাকে চেপে ধরে। সবার জোরাজুরিতে নিজের মনের গহীনে হুট করে আগমন ঘটা এক রমণীর প্রতি প্রেমের কথা তাদের জানিয়ে দেয় ফায়াজ। তারপর বন্ধু মহলে যেনো এটাই হয়ে ওঠে অতিব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু। সবার কথায় এবং ভরসায় ধীরে ধীরে সে ভাব জমায় অর্থিকার সাথে। শুরু হয় দুজনার বন্ধুত্ব। কিন্তু ফায়াজ আর বলতে পারে না নিজের মনের কথা। বলতে পারে না এই বন্ধুত্বের পিঠে লুকিয়ে থাকা অনুভূতি গুলোর কথা।
এভাবেই শেষ হয় ভার্সিটি লাইফ। কয়েক মাস বাদে হুট করেই একজন বন্ধুর থেকে ফায়াজ জানতে পারে যে অর্থিকার নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তখন কী কষ্টটাই না পেয়েছিল ছেলেটা। মধ্য রাতে দ্রুত গতিতে বাইক চালিয়ে হাজির হলো প্রিয়তমার বাড়ির সম্মুখে। একের পর এক কল দিয়ে ভঙ্গ করল অর্থিকার আরামদায়ক ঘুম। মোবাইল সাইলেন্ট করা না থাকায় ঘুম থেকে জেগে উঠলো অর্থিকা। কল রিসিভ করে কানে ধরতেই শুনতে পেলো করুন কণ্ঠস্বর,“অর্থিকা!”
ঘুমের রেশ বিলীন হয় অর্থিকার। আশ্চর্য হয়ে শুধায়, “ফায়াজ?”
“নিচে আসবে অর্থিকা?”
“নিচে আসবো মানে?”
“হু, এসো না। আমি দাঁড়িয়ে আছি নিচে। প্লিজ একটিবার এসো।”
দৌড়ে বারান্দায় চলে আসে অর্থিকা। তার বারান্দা থেকে রাস্তাটা খুব ভালো করেই দেখা যায় তাই ফায়াজকে দৃষ্টিগোচর হতে আর বেশি সময় লাগে না অর্থিকার। শুধায়,“এত রাতে তুমি এখানে? হঠাৎ? পাগল টাগল হয়ে গেলে নাকি?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ পাগলই হয়েছি। তুমি এসো।”
“বললেই তো আর এত রাতে নিচে আসা যায় না ফায়াজ। দরজা ভেতর থেকে লক করা। চাবি বাবা-মায়ের কাছে। তাদের দরজাও তো লক করা। কী বলবে ফোনে বললেই তো হতো অযথা মাঝরাতে আসার কী প্রয়োজন তাই তো বুঝলাম না।”
“অযথা নয় অর্থিকা, আমার অনেক কিছু বলার আছে তোমায়, যা ফোনে বলা সম্ভব নয়।”
“বাড়িতে যাও, বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলে কাল না হয় দেখা করো।”
“তোমার তো বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, তাই কাল বলা যাবে না। যা বলার আজই বলতে হবে।”
“বিয়ের এখনো মাসখানেক দেরি আছে ফায়াজ।পাগলামো বাদ দিয়ে বাড়ি যাও।”
সেদিনের মতো শান্ত হয়ে ঠিকই বাড়ি ফিরে গিয়েছিল ফায়াজ। কিন্তু কেউই আর রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারলো না। তার পরেরদিন বিকেলে দুজনে দেখা করল একটি ক্যাফেটেরিয়ায়। সম্মুখে বসেই অর্থিকা প্রশ্ন ছুঁড়েছিল,“কী এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা যে অত রাতে বাড়ির সামনে আসতে হলো তোমায়? নাও এখন বলা শুরু করো।”
কোনো ধরণের হেঁয়ালি ছাড়াই টেবিলের উপর রাখা অর্থিকার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো ফায়াজ। উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলো,“আমি তোমায় ভালোবাসি অর্থিকা। খুব খুব ভালোবাসি। তোমাকে অন্যের হয়ে যাওয়াটা নিজ চোখে দেখতে পারবো না আমি। আমার যে খুব কষ্ট হবে অর্থিকা। আমি কষ্ট সহ্য করতে পারি না। দেখা গেলো এত বড়ো কষ্টে আমি মরেই গেলাম। তখন কী হবে? প্লিজ অর্থিকা বিয়েটা ভেঙে দাও। তুমি বিয়েটা ভেঙে দিলেই আমি আমার বাবা-মাকে নিয়ে তোমার জন্য বিয়ের প্রপোজাল পাঠাবো।”
কথাগুলো শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো অর্থিকা। এমন কিছু শোনার জন্য যেনো সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। মেয়েদের নাকি এক অদৃশ্য ক্ষমতা আছে। কেউ তাদের লুকিয়ে লুকিয়ে পছন্দ করলেও তারা তা বুঝে ফেলে কিন্তু ফায়াজ নামক পুরুষটির সঙ্গে এত বছরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকার পরেও কিছুই বুঝতে পারলো না অর্থিকা। কারণ বোঝার মতো এমন কোনো কাজই তো ফায়াজ করেনি। সে ভেবেছিল লেখাপড়া শেষে একটা চাকরি জুটিয়েই সবটা জানিয়ে দিবে অর্থিকাকে। অর্থিকা তার ডাকে সাড়া না দিলে বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে। তখন তো আর মেয়েটা না করতে পারবে না। কিন্তু সব যেনো এক নিমিষেই এলোমেলো হয়ে গেলো।
নিজেকে যথাসাধ্য সামলে নিয়ে তার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো অর্থিকা। প্রশ্ন করল,“কবে থেকে তোমার মনে এসব চলছে?”
“মনে এসব চলছে মানে?”
“না মানে কবে থেকে ভালোবাসো?”
“আমাদের বন্ধুত্ব শুরু হওয়ার আগে থেকে।”
“তাহলে এতদিন বলোনি কেন?”
দৃষ্টি নত করে নেয় ফায়াজ। বলে,“বেশ কয়েকবার বলতে চেয়েও বলতে পারিনি।”
“কেন?”
“ভয়ে, যদি আমায় এক্সেপ্ট না করো তাই।”
তাচ্ছিল্য হাসলো অর্থিকা। ফের প্রশ্ন করল,“তাহলে এখন কেন বলছো?”
“আমি তোমাকে হারাতে চাই না অর্থিকা।”
“এখন যে এক্সেপ্ট করবো শিওর হচ্ছো কী করে?”
“এক্সেপ্ট না করার তো কোনো কারণ দেখছি না। আমি ভালো চাকরি করি, আমার পরিবারও ভালো। তুমি শুধু এই বিয়েটা ভেঙে দাও। বাকি সব কিছু আমি ম্যানেজ করে নিবো। প্লিজ আমার হয়ে যাও অর্থিকা।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্থিকা। বলে,“এ সম্ভব নয় ফায়াজ। তুমি অনেক দেরি করে ফেলেছো। আমার বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন সপ্তাহ দুয়েক আগে। ছেলের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে তাকে আমার মনে ধরেছে আর আমিও বিয়েতে পুরোপুরিভাবে মত জানিয়ে দিয়েছি। ছাপাখানায় বিয়ের কার্ড ছাপাতে চলে গেছে। বিয়ের শপিংও অর্ধেকটা শেষ। মাঝপথে এসে এসব আর সম্ভব নয়। শুরু থেকেই স্রেফ তুমি আমার একজন ভালো বন্ধু ছিলে ব্যস এতটুকুই। তবে তোমার উচিত ছিলো নিজের মনের কথাটা আমায় জানিয়ে দেওয়া। তাহলে তো অন্তত নিজের দিক থেকে তুমি দায়সারা থাকতে পারতে। তোমার দিক থেকে তুমি সব চেষ্টা করেছো এ কথাটাও বলতে পারতে কিন্তু তুমি তা করোনি। এখন মাঝপথে এসে, ভালোবাসি তোমায় বিয়ে ভেঙে দাও বললেই তো হয় না ফায়াজ।”
“আমি মানছি আমি ভুল করেছি কিন্তু এখন তো বললাম। এখনো তো তোমার বিয়ে হয়নি তাই না?”
“বিয়ে হয়নি তবে হবে। এমন একটা জায়গা থেকে ফিরে আসা সম্ভব নয় ফায়াজ। তাছাড়া সকল ভুলের সমাধান হয় না। তোমার ভালোবাসায় সাড়া দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ভেবেছিলাম বিয়ের প্রথম কার্ডটা আমি তোমায় দিবো কিন্তু দেওয়া আর হলো না। এতে তোমার কষ্ট আরো বাড়বে। একতরফা ভালোবাসা ভুলে গিয়ে নিজের জীবন গুছিয়ে নিও। আশা করি ভালো একজন মানুষ তোমার জীবনে আসবে। আল্লাহ হাফেজ।”
এতটুকু বলেই বিদায় নিয়েছিল অর্থিকা। এরপর আর কারো সঙ্গে কারো দেখা হলো না। বাড়িতে শুরু হলো ফায়াজের পাগলামি। অর্থিকার বিয়ে হতেও আর মাসখানেক সময় লাগলো না। দিন পনেরো বাদেই হয়ে গেলো বিয়ে। সেদিন নিজেকে ঘরবন্দি করে ছিলো ছেলেটা। বেশ কয়েকবার শেষ করে দিতে চেয়েছিল নিজেকে। পুরুষ মানুষ শক্ত হৃদয়ের হয় কিন্তু তার হৃদয়টা যেনো ছিলো দুর্বল। পরিবারের একমাত্র সন্তান হওয়ায় বাবা-মা চিন্তিত হয় তাকে নিয়ে। বিভিন্ন ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয় না। এভাবেই বছর গড়ায়। মায়ের হাহাকার এবং চোখের পানিতে একসময় সকল দুঃখ কষ্টের অবসান ঘটে ছেলেটার। যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে চাকরি বাকরিতে মনোনিবেশ করে। যদিও তার বাবার ছিলো অঢেল সম্পত্তি। ঢাকা শহরের মতো একটি জায়গায় নিজস্ব দালান। তার কয়েকদিন পরেই মায়ের কথায় মায়ের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে নেয় ফায়াজ কিন্তু বৈবাহিক জীবনে দেখা মিলে না শান্তির।
ফায়াজ নিজেকে যথেষ্ট বদল করে স্ত্রীর প্রাপ্যটা তাকে দিতে চেয়েছিল, চেষ্টা করেছিল স্ত্রীকে ভালোবাসার কিন্তু মেয়েটি যেনো দাম্ভিক স্বভাবের ছিলো। সংসারে প্রবেশের মাস দুয়েকের মধ্যেই পুরো সংসারটা নিজের আয়ত্তে আনতে চাইলো যার দরুন শুরু হলো মা স্ত্রীর বিভেদ। এতে একসময় অতিষ্ট হয়ে উঠলো ফায়াজ। ঘা সারানোর জন্য একজনকে জীবনে এনে ঘা যেনো দিনদিন আরো বৃদ্ধি পাচ্ছিল। একসময় মেয়েটি তো বলেই বসে,“তোমার কাছে দুটো অপশন আছে ফায়াজ, হয় তোমার বাবা-মাকে বেছে নিবে নয়তো আমাকে। তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে এক ছাদের তলায় আমি আর থাকতে রাজি নই। আমার আলাদা সংসার চাই।”
ফায়াজ স্ত্রীকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করল কিন্তু মেয়েটি বুঝলো না। ভয় দেখালো ডিভোর্সের, সাথে শ্বশুর-শাশুড়ির হুমকি ধামকি তো আছেই। এসব কিছু আর নিতে পারলো না সে আর না পারলো তার বাবা-মাকে ছাড়তে। তার ওই কঠিন বিপদের সময় তো এই বাবা-মা ই পাশে ছিলো। এই মেয়েকেও মূলত সে বিয়ে করেছিল মায়ের জেদের কারণে। বিভিন্ন বোঝ দিয়েও যখন কাজ হলো না তখন ডিভোর্সই বেছে নিলো ফায়াজ। যেই সম্পর্কে মানসিক শান্তি নেই সেই সম্পর্ক না থাকাটাই শ্রেয়।
সময়টা গোধূলির বিকেল। ছাদে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে ফায়াজ এবং অর্থিকা। অফিসে একটা মিটিং ছিলো কিন্তু মিটিং ক্যান্সেল হওয়ায় দুপুরের দিকেই ছুটি পেয়ে যায় অর্থিকা। তাই আসরের নামাজ আদায় করে আজ সে ছাদে এসেছিল কাপড় নিতে আর তখনি দেখা হয়ে গেলো ফায়াজের সাথে। চেয়েও যেনো ছেলেটিকে উপেক্ষা করে চলে যেতে পারলো না অর্থিকা।
কিছুক্ষণ নিরবতার পর ফায়াজ নিজেই বলে উঠলো,“সবকিছু কী নতুন করে আবার শুরু করা যেতো না অর্থিকা?”
অর্থিকা হেসে উত্তর দিলো,“নতুন করেই তো শুরু করেছি।”
“এই শুরু করার কথা বলছি না।”
“তাহলে?”
“আমি তোমায় এখনো সেই আগের মতোই ভালোবাসি। তখন তোমায় পাইনি কিন্তু এখন তো আর কোনো বাঁধা নেই আমাদের মধ্যে। বিয়ে করবে আমায়? তোমার ছেলে নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। ও তো তোমারই অংশ। বাবার সকল দায়িত্ব ভালোবাসা সব দিয়ে ওকে বড়ো করবো।”
“এ হয় না ফায়াজ।”
“কেন হয় না? কতই তো হচ্ছে।”
“আমার পক্ষে নতুন করে সংসার বাঁধা সম্ভব নয়। আমার পুরো জগৎ জুড়ে শুধুই তন্ময়। ও ব্যতীত অন্য পুরুষের ঘ্রান আমি চাই না। চাই না কারো ভালোবাসা। ইহকালে যেমন আমি তন্ময়ের ছিলাম তেমন পরকালেও ওর হয়েই থাকতে চাই। দুনিয়াতে নতুন করে কারো সঙ্গে ঘর বাঁধলে কী এটা সম্ভব?”
“অর্থিকা!”—-ছেলেটির কণ্ঠস্বর করুন শোনালো।
সন্তর্পণে নিঃশ্বাস ফেলে অর্থিকা বললো,“কিছু করার নেই ফায়াজ। এতটুকু স্বার্থপর তো হতেই হয় বলো। তন্ময় স্বামী হিসেবে চমৎকার একজন পুরুষ। সবাই প্রেমিক হতে পারলেও সবাই কিন্তু স্বামী হতে পারে না ফায়াজ। আমি তার মায়া, সম্মান, আগলে রাখা, ভালোবাসা এবং ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্যের উপর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছি। এ বাঁধন থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র রাস্তা মৃ’ত্যু। আমার মৃ’ত্যু কবে হবে তা একমাত্র রবই জানেন। তাই এ ব্যাপারে আর কখনো কিছু বলো না। তোমার পুরোটা জীবন পড়ে আছে। নতুন করে কাউকে জীবনে জড়িয়ে সুখের সংসার করো।”
বলেই ছাদ থেকে নিচে নেমে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো অর্থিকা। ফায়াজ পিছু থেকে বলে ওঠে,“তুমি আমার অনুভূতি নিয়ে একবারও ভাবলে না অর্থিকা। আমার অপরাধটা কোথায় ছিলো? কেন আমি বঞ্চিত হলাম তোমার ভালোবাসা থেকে?”
অর্থিকা পথিমধ্যে থেমে গেলো। পিছু ঘুরে চমৎকার হেসে বললো,“সময় কারো জন্য থেমে থাকে না। তোমার ভুল ছিলো তুমি সময়ের কাজ সময়ে করতে পারোনি। তোমার ভুল ছিলো তুমি সঠিক সময়ে নিজের অনুভূতির কথা জানাতে পারোনি। সব ভুল তোমার এসব খামখেয়ালিপনার। যা চাইলেই তুমি আর শোধরাতে পারবে না।”
আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না অর্থিকা। চলে গেলো নিচে। আর সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো একজন হেরে যাওয়া পুরুষ। প্রেয়সীকে না পাওয়া ব্যর্থ প্রেমিক।
চলবে __________
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)