সুখেরও সন্ধানে পর্ব-২+৩

0
647

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০২]

মৃত স্বামীর লাশের খাটিয়ার সম্মুখে বসে আছে অর্থিকা। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। আগরবাতির গন্ধে মো মো করছে চারিদিক। বিশাল হল রুমের মাঝখানে সাদা কাফন গায়ে জড়িয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে শুয়ে আছে তন্ময়। ঘর থেকে ভেসে আসছে তাদের দুই মাস বয়সী ছেলের গগন বিধারক কান্নার শব্দ। সবার মতো ছোট্ট বাচ্চাটাও হয়তো টের পেয়ে গেছে যে এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে চিরকালের জন্য বিদায় নিয়েছে তার বাবা নামক মানুষটি। তাদেরকে অথৈ সাগরে ফেলে ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তে। দুধের শিশুটির গায়ে অনাথ তকমা লাগিয়ে সকল দায়িত্ব থেকে নিয়েছে অব্যাহতি।

কয়েকজন বয়স্ক মহিলা এগিয়ে এসে অর্থিকাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আফসোসের সুর তুলে বলতে লাগলেন,“আহারে! দুধের পোলাপাইন রাইখা এই অল্প বয়সে পোলাডায় মইরা গেলো! এহন একলা একটা মাইয়া মানুষ এই পোলাপাইন লইয়া কই যাইবো? কী হইবো ওগো?”

কোনো কথাই যেনো শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছালো না অর্থিকার। এক ধ্যানে নিষ্পল দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে মৃত স্বামীর প্রাণহীন মুখশ্রীতে। জানাজার সময় হয়ে এসেছে। তন্ময়ের দুলাভাই এবং চাচাতো ভাইয়েরা এগিয়ে এলো। একজন মিহি স্বরে বলে উঠলো,“ভাইকে এবার নিয়ে যেতে হবে। জানাজার সময় হয়েছে। জানাজা শেষে একেবারে দাফন।”

বাক্যগুলো চট করে মস্তিষ্কের নিউরনে আঘাত হানলো। নড়েচড়ে উঠলো অর্থিকা। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল স্বামীর নিষ্প্রাণ দেহের উপর। শুকিয়ে যাওয়া চোখ থেকে শুরুর মতো বইতে লাগলো তীব্র বর্ষন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে চিৎকার করে বলতে লাগলো,“আমার তন্ময়কে আমি কোথাও যেতে দিবো না। ও তো আমায় কথা দিয়েছিল ফিরে আসবে। বাবুকে কোলে নিবে। তাহলে কেন রাখলো না সেকথা? ও তন্ময় ওঠো না। ওই যে দেখো না আমাদের বাবু কান্না করছে। তোমাকে ছাড়া আমরা থাকবো কী করে? দয়া করে একবার চোখ মেলে তাকাও। এসব দুষ্টুমি কিন্তু আমার ভালো লাগছে না।তন্ময়….”

দৌড়ে এসে তাকে জাপটে ধরলো অনুভা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অশান্ত কণ্ঠে শুধালো,“আপু! এই আপু! কাঁদছিস কেন?”

“ওরা তন্ময়কে নিয়ে যাচ্ছে রে অনু। ওদের থামতে বল। আমি ওকে ছাড়া থাকবো কী করে?”

চিন্তিত হলো অনুভা। জগ থেকে পানি নিয়ে ছিটিয়ে দিলো বোনের চোখেমুখে।তৎক্ষণাৎ ঘুম ভেঙে গেলো অর্থিকার। আশেপাশে তাকিয়ে সবকিছু ভালো করে পর্যবেক্ষণ করল। দু হাতের আজলে বোনের মুখটা তুলে নিলো অনুভা। নম্র কণ্ঠে শুধালো,“আবারো দুলাভাইকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিস তাই না?”

পূর্বের ন্যায় সশব্দে কেঁদে উঠলো অর্থিকা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো,“কেন আমার সঙ্গেই এমনটা হলো বল না? তন্ময় বেঁচে থাকলে কী খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো? মরলোই যখন আমাকে কেন রেখে গেলো? ও কী জানতো না যে ওকে ছাড়া থাকাটা আমার পক্ষে অসম্ভব?”

বোনের এই আহাজারি কষ্ট মোটেও সহ্য হয় না অনুভার।প্রতিবারের মতো এবারও তাকে বোঝানোর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,“মৃ’ত্যু হচ্ছে একমাত্র সত্য। সকল প্রাণীকেই মৃ’ত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়।আল্লাহ এটাই তোর ভাগ্যে লিখে রেখেছিলেন। দুলাভাইয়ের মৃ’ত্যুটা মেনে নে আপু। রোজ রাতে এমন পাগলামী করলে, যে চলে গিয়েছে সে কী আর ফিরে আসবে? আমরা আছি তো তোর পাশে। এখনো অনেকটা পথ বাকি। তোকে সুস্থ ভাবে বাঁচতে হবে। নিজের জন্য না হলেও তোদের সন্তানের জন্য বাঁচতে হবে।”

“তাঈম কোথায়? ওকে এনে দে না একটু।”

“ও তো ঘুমাচ্ছে। আচ্ছা তুই বোস আমি নিয়ে আসছি।”

বড়ো বড়ো কদম ফেলে নিজের কক্ষে এলো অনুভা। দোলনায় থাকা ঘুমন্ত তাঈমের দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর খুব সাবধানে তাকে কোলে তুলে নিলো যাতে ঘুমটা ভেঙে না যায়।তন্ময় মারা গিয়েছে ছয় মাস হতে চললো অথচ তার স্মৃতি এবং মৃ’ত্যুর ঘোর থেকে কিছুতেই যেনো বেরিয়ে আসতে পারছে না অর্থিকা। তাদের বিয়েটা পারিবারিকভাবে হলেও এই পুরুষটাকে অসম্ভব ভালোবাসতো সে। বিয়ের বছর তিনেক পরেই তাদের কোল আলো করে আসে তাঈম। অথচ হুট করেই একটা ঝড় এসে লণ্ডভণ্ড করে দিলো সবকিছু। ভালোবাসার মানুষকে চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে দেখে দিক বেদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গেলো অর্থিকা নামক মেয়েটি। বাচ্চাটিকে কবে যে ঠিক করে কোলে নিয়েছে, কান্না থামিয়ে আদর করেছে, খাইয়ে দিয়েছে তা যেনো মনে করাই দুষ্কর।

বাবা বিছানা থেকে উঠে বসতে পারেন না। মায়ের কোমরে বাতের ব্যথা, পায়ের হাড়টাও ভেঙে গেছে। যতটুকু চলাফেরা করতে পারেন তাও অনেক কষ্ট করে। বাড়িতে ছুটা বুয়া রাখা। অফিস থেকে ফেরার আগ পর্যন্ত বাচ্চাকে দেখাশোনার সব দায়িত্ব সেই বুয়ার। অফিস থেকে ফিরে তাঈমকে সময় নিয়ে খাইয়ে, ঘুম পাড়াতে পাড়াতে যে কখন রাত পেরিয়ে যায় সেই খেয়ালই থাকে না অনুভার। মাঝেমধ্যে নিজেকে নিয়ে ভাবতে বসলেই খুব হাসি পায় তার। একটা সময় কী ছিলো আর আজ কী হলো। অল্প বয়সেই তার মাথায় হাজার হাজার দায়িত্ব। জন্ম না দিয়েই কখন যে ভেতরে ভেতরে তার মধ্যে তৈরি হয়ে গেলো মা নামক মাতৃত্বের সত্তা তা-ই অজানা।

তাঈমকে এনে অর্থিকার কোলে তুলে দিয়ে পাশে বসলো অনুভা। ছেলেকে পেয়েই বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলো অর্থিকা। কয়েক মিনিট অতিক্রম হতেই সারা মুখে ভরিয়ে দিলো আদরমাখা চুম্বনে। ভরাট কণ্ঠে বলে উঠলো,”ও জন্মানোর পর থেকে প্রায় রাতেই বিভিন্ন কারণে আমার ঘুম ভেঙে যেতো।ঘুম ভাঙলেই ওই মাঝরাতে তন্ময়কে জাগ্ৰত অবস্থায় ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখতাম। একদিন খুব আগ্ৰহ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এতো কী দেখো বলো তো? ও উত্তরে বললো,জানো অর্থি আমার না অনেক শখ ছিলো আমাদের একটা মেয়ে হবে। যাকে আমি মা বলে ডাকবো। আমার তো মা নেই।মা কেমন হয় তাও তো জানি না। সেই ছোটো বেলায় মা মারা গিয়েছিল তাই চেহারাটাও তেমন একটা মনে নেই।”

দম ছাড়লো অর্থিকা। পুনরায় বললো,“তুমি কী তবে খুশি নও ওকে নিয়ে? প্রশ্নটা করার সময় আমার কণ্ঠনালী খুব কাঁপছিল। আমার ভয় হচ্ছিল ছেলেটাকে নিয়ে। ও কী তবে ওর বাবার অখুশির কারণ?কিন্তু আমার সকল ভয় আর সংশয় দূর করে দিয়ে তন্ময় হেসে উঠলো। উত্তর দিলো, অখুশি হবো কেন? ও তো আমাদের সন্তান। আমার আরেকটা বাবা। বড়ো আপা বলেছে ও নাকি দেখতে একেবারে আমার মতো হয়েছে। সত্যিই কী অর্থি ও আমার মতো হয়েছে? ওর প্রশ্নে সেদিনই আমি খেয়াল করে দেখলাম সত্যিই আমার ছেলেটা একেবারে তার বাবার মতো দেখতে হয়েছে।”

বলেই হো হো করে কেঁদে উঠলো অর্থিকা। এতক্ষণে ঘুম থেকে জেগে উঠেছে তাঈম। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মায়ের পানে। অনুভা নিরব দর্শক হয়ে বোনের কষ্টকে চোখের পানির মাধ্যমে নির্বাসন দিতে দেখছে। ভালোবাসার মানুষকে হারানোর বেদনা যে খুবই নিকৃষ্ট তার স্বাক্ষী হচ্ছে বারংবার।

অর্থিকার মনে পড়ে, অফিসের কাজে চট্টগ্রাম গিয়েছিল তন্ময়। ফেরার আগের দিন রাতেও ভিডিও কলে কথা বলেছিল তার সঙ্গে। মন ভরে দেখেছিল নিজের ছেলেটাকে। বলেছিল,“তুমি আমায় খুব মিস করছো তাই না অর্থি? আমিও তোমায় খুব মিস করছি। বাবু না থাকলে তোমাকেও আমার সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম এখানে।দেশের ভেতরেই ছোটোখাটো একটা হানিমুন হয়ে যেতো।” এতটুকু কথায় কি লজ্জাটাই না পেয়েছিল মেয়েটা। যা অতদূর বসেও খুব ভালো করেই টের পেয়েছিল তন্ময়। মুচকি হেসে আশ্বস্ত করে ফের বলেছিল,“আমার জন্য চিন্তা করো না বউ। কথা দিচ্ছি, আগামী রাতটা আমাকে ছেড়ে তোমাদের আর থাকতে হবেনা। তখন তোমাদের পাশে রোজকার মতো আমি থাকবো। রাতে এসে একসঙ্গে ডিনার করবো।”

কিন্তু তন্ময় নিজের কথা রাখেনি। রাখতে পারেনি। সেদিনই যে তার মৃ’ত্যু অনিবার্য ছিলো। পরেরদিন ঠিকই সে ফিরলো তবে লাশ হয়ে। কাজ শেষে ভোর রাতেই বাসে করে রওনা দিয়েছিল তন্ময়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার বাসটা পথিমধ্যে এক্সিডেন্ট করে। বেশ কয়েকজন যাত্রী নিহত হয় যার মধ্যে তন্ময়ও ছিলো একজন। জানালার পাশে বসায় জানালার কাঁচ মাথায় ঢুকে নিকৃষ্ট মৃ’ত্যু হয় তার।

এসব মনে পড়লেই নিজেকে কিছুতেই ধরে রাখতে পারে না অর্থিকা। বাবার উপর সে বরাবরই কৃতজ্ঞ। বাবার কারণেই সে এমন ভালো মন মানসিকতার একজন জীবনসঙ্গী পেয়েছিল। বাবা নিজে পছন্দ করে যাচাই বাছাই করে তাকে তুলে দিয়েছিল তন্ময়ের হাতে। বিয়ের তিনটে বছর ছিলো তার কাছে স্বর্গীয়। মাঝে মাঝে ছোটো বোনের নিকট ফোন করে বলতো,“একটা মানুষের কপালে এতটাও সুখ থাকে রে অনু? এতো সুখ কেন রে আমার কপালে? এই মানুষটা আমায় এতো ভালোবাসে কেন অনু?”

কখনো সখনো কথা বলতে বলতে কেঁদে উঠতো। সুখের কান্না। আজ সেই সুখ আর নেই। সুখের অতল সাগরে তাকে ডুবিয়ে রাখা মানুষটাই যে আর নেই। শত ডাকলেও সে আর ফিরবে না। আজও অর্থিকা কাঁদে তবে দুঃখে। রোজ নিয়ম করে কাঁদে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় দুঃস্বপ্নে। রাতে খেতে পারে না।বারবার মনে পড়ে তন্ময়ের বলা সেই কথাটা,“রাতে ফিরে একসঙ্গে আমরা ডিনার করবো।”

“কেন সেই রাত এলো না? কেন?”

বলেই চিৎকার করে কেঁদে উঠলো অর্থিকা। তার এই চিৎকারে ভয় পেয়ে গেলো কোলে থাকা তাঈম। সেও কেঁদে দিলো মায়ের সঙ্গে। এবার অনুভারও ভয় হলো। দ্রুত তাঈমকে নিয়ে নিলো নিজ কোলে। পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে হাঁটতে লাগলো ঘর জুড়ে। ব্যস্ত হয়ে পড়ল কান্না থামাতে। তন্ময় বেঁচে থাকাকালীন স্ত্রীর প্রতি তার ভালোবাসা স্বচোক্ষে দেখেছে অনুভা। প্রায়সই বড়ো বোনকে খোঁচা দিয়ে বলে উঠতো,“দুলাভাই তো একেবারে বউ পাগলারে আপু!”

এ কথাতে কী রাগটাই না করতো অর্থিকা। আগুনের লাভার ন্যায় জ্বলে উঠতো। বলতো,“তুই কী বুঝবি এসবের? তুই তো একটা রোবট। যেদিন তোর এই রোবটময় জীবনে এমন একজন আসবে সেদিন ঠিক অনুভব করতে পারবি। ভালোবাসা কী, ভালোবাসা কাকে বলে।”

কথাটা মনে হতেই অনুভার মনে প্রশ্ন জাগে,“কেউ কী এসেছিল এই জীবনে? হয়তো এসেছিল। বেসেছিল কী ভালো? হয়তো বেসেছিল। আচ্ছা এখনো কী বাসে ভালো? নাকি সময়ের সাথে সাথে ভুলে গেছে আমায়?”

হৃদয় প্রাঙ্গন কম্পিত হলো। চোখ জোড়া বন্ধ করে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বিড়বিড় করে বললো,“ভালোবাসা আগুনের লাভা। যাতে পা দিলে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে হয়। ভালোবাসা হচ্ছে বিষ। যা গলাধঃকরণ করলে মৃ’ত্যু সুনিশ্চিত। যারা ভালোবেসেছে তারাই হয় পুড়েছে নয়তো মরেছে।”

বোনের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে তাঈমকে নিয়ে ঘর থেকে বের হতে লাগলো অনুভা। যেতে যেতে বলতে লাগলো,“নিজের বাচ্চার জন্য হলেও আপু মরতে পারবে না। আবার শান্তিতেও থাকতে পারবে না। তাকে পুড়তে হবে, পুড়ার যন্ত্রনা সহ্য করে নিষ্ঠুর পৃথিবীতে বাঁচতে হবে। ভালোবাসা খুবই জঘন্য। ভালোবাসা গড়তে নয় বরং জানে শুধুই ধ্বংস করতে। মনোধ্বংসের মূলভিত্তিই যে ভালোবাসা।”
________

রোজকার ন্যায় আজও অনুভার ঘুম ভাঙলো বাচ্চার ক্রন্দনরত শব্দে। দেরিতে ঘুমানোয় মাথাটা ভার হয়ে আছে। কোনোমতে চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে কোলে তুলে নিলো তাঈমকে। তাকে নিয়েই এগিয়ে গেলো রান্নাঘরের দিকে। শুনতে পেলো মায়ের ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর।কারো সঙ্গে যে তিনি রাগ নিয়ে কথা বলছেন তা সুস্পষ্ট। অনুভা মাথায় ওড়না টেনে সদর দরজার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখতে পেলো একজন বয়স্ক লোককে। মায়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“এই সাত সকালে চেঁচামেচি করছো কেন?”

রাগ মিশ্রিত দৃষ্টিতে মেয়ের পানে তাকান সুফিয়া। কণ্ঠে তেজ এঁটে বলেন,“কেউ কী সাধে চেঁচায়? বাপের মতো সারাক্ষণ আমার চেঁচানোটাই দেখিস। এদিকে সংসারের পেছনে যে খেটে মরছি তা দেখতে পাস না?”

“সহজ প্রশ্নের উত্তর সহজভাবে দাও। কী করেছে ইনি?”

“রোজ রোজ দুধে পানি মেশায়। দেখ তুই, আজকের দুধটাও একেবারে পাতলা। তাহলে দুধ খেয়ে লাভ কী বল? ডাক্তার তোর বাবাকে প্রতিদিন গরম দুধ খেতে বলেছে শরীরের পুষ্টির জন্য।এসব ভেজাল খেলে কী শরীরে আদৌ কোনো পুষ্টি হবে? এদিকে টাকা নেওয়ার বেলা পুরো টাকাটাই গুণে গুণে নেয় কিন্তু জিনিসের বেলা দেয় ভেজাল।”

“এনার কাছ থেকে দুধ নিও না তাহলেই তো হয়।”

“তাহলে কার কাছ থেকে নিবো? আমি তেমন কাউকে চিনি? তোকে কতবার করে বলেছি বাজার থেকে নিজে গিয়ে দেখে শুনে কিনে নিয়ে আয়। তা তো পারিস না।”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো অনুভা। মায়ের থেকে দুধের পাতিল নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে জাল দিতে লাগলো। জাল দেওয়া হতেই কিছুটা ফিডারে ভরে ঠাণ্ডা পানিতে চুবিয়ে রাখলো। সারাদিন অফিস তারপর বাজার থেকে শুরু করে বাবা-মায়ের ওষুধ, ঘর ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল আবার মাসে নিয়ম করে তাদের ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়া সঙ্গে রোজকার রুটিনে একটা বাচ্চা সামলানোর দায়িত্ব। একা একটা অবিবাহিত মেয়ের পক্ষে কতটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়? মা যেনো কিছুতেই বোঝেন না তার পরিস্থিতি।বুঝতে চান না। অথচ তারও যে একটা জীবন আছে, তারও যে ক্লান্তি আছে, মন খারাপ আছে তা নিয়ে ভাবার কেউ নেই। সবার কথা ভাবতে গিয়ে নিজের কথাটাই যে ভাবা হয় না।

রোজকার মতো গোসল সেরে তাঈমকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বের হলো অনুভা। দুদিন ছুটি কাটিয়ে আজ কাজের মেয়ে পারভিনা চলে এসেছে। তার কোলে তাঈমকে দিয়ে নাস্তার টেবিলে বসে পড়ল অনুভা।সকালের নাস্তাটাও পারভিনাই তৈরি করেছে। নাস্তা করে অফিসের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হলো অনুভা।

তাদের বাড়িটা গলির একদম ভেতরের দিকে। রঙ ওঠা মলিন চার তলা বিল্ডিং। একেকটা ফ্লোরে দুটো করে ফ্ল্যাট। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এতগুলো মানুষের সংসার চালাতে গিয়ে যখন হিমশিম খেয়ে ওঠে অনুভা তখনি মায়ের বুদ্ধিতে বাধ্য হয়েই পূর্বের বাড়িটা তাকে বদলাতে হয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একজন পরিচিতর নিকট থেকে এই বাড়িটির সন্ধান পায় সে। সুযোগ সুবিধা কম থাকলেও আগের তুলনায় এখানকার ভাড়াটা যথেষ্ট সাধ্যের ভেতরে।

কিছুটা পথ হেঁটে মেইন রাস্তায় উঠতেই দেখতে পেলো পরিচিত একটি মুখ। তাকে দেখতে পেয়ে দাঁত কপাটি বের করে হাসলো লোকটি। অনুভার ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হলো। শুধালো,“নাহিয়ান ভাই! আপনি?”

এগিয়ে এলো নাহিয়ান। বিনীত সুরে বললো,“তোমার জন্যই এসেছি। জানো কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছে?”

“আমার জন্য! কেন?”

“কেন আবার? এই যে পথে ঘাটে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে হাতের অবস্থা নাজেহাল করে ফেলেছো। দুদিন পর যে ভেঙে ফেলবে না তার কী কোনো গ্যারান্টি আছে? তাই একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে তোমাকে অফিস পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া আমার দায়িত্ব।”

সৌজন্য হাসলো অনুভা। বললো,“তার কোনো প্রয়োজন ছিলো না ভাইয়া। তবে আজ যেহেতু এসেই পড়েছেন, চলুন তবে। লেইট হয়ে গেলে দেখা যাবে আবার বেতন কেটে নিবে।”

নাহিয়ান হাসলো। একটা সিএনজি দাঁড় করিয়ে অনুভাকে আগে ওঠার সুযোগ করে দিয়ে পরবর্তীতে নিজেও উঠে পড়ল তাতে। অফিসে সঠিক সময়ে পৌঁছেও গেলো দুজন। তারপর যে যার মতো বিদায় নিয়ে চলে গেলো নিজেদের কাজে।

নির্ঝঞ্ঝাটে অফিস টাইমটা পার হলো অনুভার। আজ একবারের জন্যও তাকে তানিমের মুখোমুখি হতে হয়নি। এমনকি লোকটা কোনো কাজের জন্যও তাকে ডাকেনি পর্যন্ত। এতে হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে। লোকটার মুখোমুখি হওয়া মানে নিজের মান সম্মান নিজ হাতে বিসর্জন দেওয়া। অফিস ছুটি হতে হতে সাড়ে আটটা বেজে গেলো। নাহিয়ান যদিও তাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসতে চেয়েছিল কিন্তু তার প্রস্তাব নাকোচ করে দিয়ে রোজকার মতো একা একাই বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলো অনুভা।

চলবে _______

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৩]

“রাতেরবেলা শুনশান রাস্তায় একা একটা মেয়ে মানুষ! যদি কোনো বিপদ আপদ ঘটে? কী হবে তখন? বিশেষ করে যদি অ্যাটাক ফ্যাটাক হয়?”

বাক্যগুলো শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই নড়েচড়ে উঠলো অনুভা। পিছু ফিরতেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো একটি কালো রঙের গাড়ি। ড্রাইভারের আসন থেকে কাঁচ নামানো জানালা দিয়ে মাথার অর্ধেকটা বের করে রেখেছে একজন পুরুষ। অন্ধকারে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে না তার মুখটা।

রাস্তাটা মোটেও তেমন শুনশান নয়। ক্ষণে ক্ষণে দুয়েকটা গাড়ি চলছে। অনুভার কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে শব্দ করে খুলে গেলো গাড়ির দ্বার। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো লম্বা চওড়া একজন পুরুষ। বড়ো বড়ো কদম ফেলে সামনে এগিয়ে আসতেই গাড়ির সম্মুখের জ্বলন্ত হেডলাইটের আলোয় স্পষ্ট হলো পুরুষটির মুখশ্রী।

পুরুষটিকে দেখতেই বিষ্মিত হলো অনুভা। স্তম্ভিত নয়নে তাকিয়ে থাকলো তার মুখপানে। কী এক রুদ্ধদ্বার অবস্থা। এই মুহূর্তে কি অভিব্যক্তি প্রকাশ করা উচিত চট করে বুঝে উঠতে পারলো না। সেকেন্ডের জন্য থমকে গেছে হৃদয়। মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছে এই সুপুরুষকে সে চিনে। খুব ভালো করেই চিনে। এও খেয়াল করল তার ভেতরে কৈশোরের সেই নিদারুণ ঝড় বইছে। সাথে তুমুল ভাবে চালাচ্ছে তাণ্ডব। একে অপরের চোখে চোখ রেখে পরিস্থিতি বুঝতে ব্যস্ত দুজনা। ব্যস্ত চোখের ভাষা বুঝতে। তখনি গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলো সম্মুখে দাঁড়ানো পুরুষ। কণ্ঠনালী কম্পিত হলো অনুভার। শত কষ্টে চিত্ত চিরে বেরিয়ে এলো কৌতূহলী শব্দ,“শ্রাবণ!”

শান্ত মুখশ্রীতে এবার ফোটে উঠলো বিস্তৃত হাসি। বিপরীত ব্যক্তিটি বিদ্রুপ করে বলে উঠলো,“চিনতে পেরেছো তবে? তোমার হাবভাব দেখে তো আমি ভাবলাম আমায় হয়তো ভুলেই গেছো। এখন আর চিনতেই পারছো না।”

নিজেকে ধাতস্থ করতে কয়েক মিনিট সময় লাগলো অনুভার। খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে শ্রাবণ প্রশ্ন করল,“তা কী করছিলে এখানে?”

প্রশ্নটা স্বাভাবিক হলেও অনুভার নিকট এটাই যেনো অস্বাভাবিক ঠেকলো। মিনমিনে স্বরে উত্তর দিলো, “ওদিকে একটা কাজ ছিলো। সেখান থেকেই বাড়ি ফিরছিলাম কিন্তু মাঝরাস্তায় এসে গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই নেমে যেতে হয়েছে।”

“এই রাতের বেলা কাজ! বাড়িতে কিছু বলবে না?”

অনুভা খেয়াল করল শ্রাবণের চোখেমুখে সন্দেহের ছাপ। তার সকল সন্দেহ দূর করার জন্য চঞ্চলা কণ্ঠে বললো,“কে কী বলবে? অফিস শেষে উল্টো পথে গিয়েছিলাম একটা প্রয়োজনে। তাছাড়া গাড়ি খারাপ না হলে তো এতক্ষণে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছেও যেতাম।”

“আমি তো এমনি জিজ্ঞেস করলাম আর তুমি কিনা কৈফিয়ত দিয়ে দিলে? আগের মতোই আছো তবে।”

ভড়কে গেলো অনুভা। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে গাড়ির সামনের দ্বার খুলে দিলো শ্রাবণ।বললো,“উঠে এসো। পৌঁছে দেই।”

ইতস্ততবোধ করল অনুভা।গাড়িতে উঠতে সায় দিচ্ছে না মন। শ্রাবণ হয়তো টের পেলো তার অনুভূতি। স্লান হেসে জিজ্ঞেস করল,“ভয় পাচ্ছো? আমাকে? কই আগে তো কখনো পেতে না। তাহলে?”

উত্তর দিলো না অনুভা। গম্ভীর হয়ে এলো শ্রাবণের মুখশ্রী। শীতল কণ্ঠে বললো,“পৃথিবীতে আর কারো দ্বারা তোমার কোনো ক্ষতি হলেও শ্রাবণের দ্বারা যে তোমার কোনো ক্ষতি হবে না তা আমার থেকেও তুমি খুব ভালো করেই জানো। নিজের মানুষের ক্ষতি কী কেউ করে নোভা?”

নোভা! সেই সম্বোধনীয় নাম। সেই দরদ মাখা কণ্ঠস্বর! মুহূর্তেই মন নরম হয়ে এলো অনুভার। মাথা নাড়িয়ে নিরবে গাড়িতে উঠে বসলো। তাচ্ছিল্য হাসলো শ্রাবণ। উঠে বসলো চালকের আসনে।চলতে লাগলো গাড়ি। অর্ধ নামানো কাঁচ ভেদ করে বাহিরের পরিবেশ দেখতে লাগলো অনুভা। ভেতরে সংকীর্ণতা, আতঙ্ক, জড়তা। কীসের এই আতঙ্ক? প্রশ্নের উত্তর নেই তার নিকট।ছেলেটির পাশে বসে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে। প্রচন্ড তেষ্টা পেয়েছে। উপরের আয়নায় ক্ষণে ক্ষণে পাশের যুবতী রমণীকে পরখ করে দেখছে শ্রাবণ। ঠোঁটের কার্ণিশে তার হাসির ফোয়ারা। সকল নিরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করল,“তা মাস্টার্স কমপ্লিট করেছো?”

প্রশ্নটায় কিঞ্চিৎ লজ্জিত হলো অনুভা। দৃষ্টি বাহিরে রেখেই দুদিকে মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো “না।”

“কেন? আমার জানামতে লেখাপড়ায় তো ভালোই ছিলে। পরিবার থেকেও ভালো সাপোর্ট ছিলো, তাহলে?”

“পরিস্থিতি অনেক কিছুই বদলে দেয়।অনার্স কমপ্লিট করে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েও আর পড়া হয়নি।”

“বিয়েও তো করোনি তাহলে?”

চমকিত, বিষ্মিত দৃষ্টিতে শ্রাবণের পানে তাকায় অনুভা। সে জানলো কী করে যে অনুভা অবিবাহিত? তার প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি আড়চোখে দেখে নিলো শ্রাবণ। সোজাসাপ্টা জবাব দিলো,“বিয়ে হলে নিশ্চয়ই এত রাত অবধি একা একা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না।”

চুপ রইলো অনুভা। শ্রাবণ ফের শুধালো,“তা কী করছো এখন? চাকরি?”

“হুম।”

“খুব ভালো।”

শ্রাবণের কণ্ঠের তাচ্ছিল্য ভাবটা খুব ভালো করেই টের পেলো অনুভা। প্রশ্ন করল,“এতদিন বাদে হঠাৎ করে আমাদের দেখা হলো? ব্যাপারটা কী কাকতালীয়?”

“তোমার কী মনে হয় ইচ্ছেকৃত? ইচ্ছেকৃত দেখা হওয়ার কোনো কাজ অথবা সুযোগ করে রেখেছিলে তুমি?”

ভড়কে গেলো অনুভা। প্রসঙ্গ বদলে জিজ্ঞেস করল,
“তা তুমি কী করছো? কোন প্রফেশন?”

“আপাতত একটা ভার্সিটির লেকচারার হিসেবে আছি।”

“আপাতত? পরবর্তীতে কী না থাকার পরিকল্পনা আছে নাকি?”

“দেখা যাক।”

“বিয়ে থা করেছো?”

“করা হয়নি।”

“কেন?”

প্রশ্নের বিপরীতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অনুভার পানে চাইলো শ্রাবণ। তার সেই চাহনিতে ঘাবড়ে গেলো অনুভা। বুঝতে পারলো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে ফেলেছে। মিহি স্বরে “স্যরি” বলে ফের দৃষ্টি ভিড়ালো জানলার বাহিরে। বিপরীত থেকে উত্তর এলো,“বউয়ের উপর যে অনেক দায়িত্ব। দায়িত্বের বেড়াজালে সে এতটাই আবদ্ধ যে আমাকে বিয়ে করার সময়টাই তার নেই।”

বিষ্ময়ের প্রকোভ পূর্বের থেকেও এবার বৃদ্ধি পেলো অনুভার দৃষ্টিতে। বউ! শ্রাবণের বউ! সে যে বললো বিয়ে করেনি তাহলে?পছন্দের কেউ আছে? পছন্দের নাকি একান্তই নিজের ভালোবাসার? গাড়ি থেমে গেলো। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে পুনরায় তাকালো শ্রাবণের পানে। শ্রাবণ মুচকি হাসলো। বললো,“তোমার বাড়ির রাস্তায় এসে গেছি। গলিটা সরু তাই গাড়ি ভেতরে ঢুকবে না সম্ভবত।”

অনুভার মনে হলো আজ শুধুই তার চমকানোর পালা। শ্রাবণ নামক পুরুষটির মুখোমুখি সে যেদিন থেকে হয়েছে সেদিন থেকেই যেনো শুধু চমকাতে শিখেছে। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো অনুভা। ঘাড় নামিয়ে প্রশ্ন করল,“কথার তালে বাড়ির ঠিকানা জানাতেই তো ভুলে গেছিলাম। তাহলে তুমি জানলে কীভাবে আমার ঠিকানা?”

শ্রাবণের চোখেমুখে রহস্যের ছাপ। গাড়িতে স্টার্ট দিলো। বললো,“সবকিছু যে তুমি জানানোর পরেই আমি জানতে পারবো এমন ধরাবাঁধা নিয়ম কী ছিলো কখনো? রাত হয়েছে বাড়িতে যাও।”

কথা শেষ হতেই শাঁ শাঁ করে রাস্তা পরিত্যাগ করল গাড়িটি।মনে অজস্র প্রশ্ন নিয়েই গলি পার হয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল অনুভা। কলিং বেল বাজাতেই আজও দরজা খুলে দিলেন সুফিয়া। পুলিশের ন্যায় জেরা করলেন,“আজ ফিরতে এতো দেরি হলো যে?”

মায়ের দিকে দুটো শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“এগুলো আনতে গিয়েছিলাম।”

মেয়ের হাত থেকে ব্যাগ দুটো নিজের হাতে নিতেই উনাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল অনুভা। সুফিয়ার চোখেমুখে বিষ্ময়।ব্যাগ দুটো হাতড়ে ভেতরে পেলেন দুটো তাঁতের শাড়ি। মেয়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“শাড়ি কার জন্য?”

“তোমার জন্য।”

“আমি কী তোর কাছে শাড়ি চেয়েছিলাম? দিনদিন সংসারের খরচ বাড়ছে এখন আবার অযথা খরচ করতে হবে কেন?”

“তুমি আবার নিজের জন্য কবে কী চেয়েছো? চাইতেই তো পারো না। তোমার যে বাড়িতে পরার মতো শাড়ি নেই, সেগুলো যে ছিঁড়ে গেছে তা আমায় না জানালেও আমার চোখ কিন্তু এড়ায়নি। ছেঁড়া শাড়ি ফেলে দিয়ে আপাতত এই দুটো পরতে থাকো। বেতন হাতে পেলে আরো দুটো না হয় কিনে দিবো।”

মেয়ের কথাগুলো শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই মনটা নরম হয়ে এলো সুফিয়ার। ভিজে উঠলো অক্ষি যুগল।টানাপোড়েনের সংসারে একজনের রোজগারে এতগুলো মানুষ চলা যে কি দুঃসাধ্য কাজ তা সুফিয়া খুব ভালো করেই বোঝেন। এও বোঝেন যে উনার মেয়েটা ভালো নেই। এইটুকু বয়সে বাবা-মা, বিধবা বোন আর তার সন্তানের মাথার উপর ঢাল হয়ে ভরসা হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে নিজেই ডুবে গেছে চিন্তা আর দায়িত্বের অতল গহ্বরে। সব জেনে বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকতে হয় সুফিয়াকে। কারণ উনার হাত-পা বাঁধা। মেয়েটাই যে শেষ সম্বল। এই মেয়েটা না থাকলে কিংবা মেয়েটা এতদিন নিজের সুখের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লে যে উনাদের মুখ থুবড়ে পড়তে হতো। পরিবারটা ভেসে যেতো বানের জলে।

সারাদিন সকলের সঙ্গে খিটখিটে মেজাজ দেখালেও দিনশেষে আড়ালে চোখের পানি ফেলেন সুফিয়া। জায়নামাজে বসে রবের নিকট মেয়ের সুখের জন্য আকুল হয়ে দোয়া করেন।

ঘরে গিয়ে তাঈমকে দেখতে না পেয়েই ললাটে চিন্তার রেখা ফোটে উঠলো অনুভার। ঘর থেকে বের হতেই পাশের ঘর থেকে বোনের আহ্লাদী কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো। ঘরের সামনে গিয়ে উঁকি দিতেই চমকালো। তাঈমের সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করছে অর্থিকা। মায়ের কথা না বুঝেও খিলখিল করে তাল মিলিয়ে হেসে যাচ্ছে বাচ্চাটা। অথচ তন্ময় মারা যাওয়ার পর থেকে দুধের ছেলেটাকে দু’চোখে দেখতে পারতো না অর্থিকা। বুকের দুধ খাওয়ানোও একসময় বন্ধ করে দেয়। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলেই মেয়েটা কেঁদে দিতো। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে যেতো তার। বলতো, “ওকে দেখলেই আমার না তন্ময়ের কথা মনে পড়ে যায়। সাদা কাফনে জড়ানো তন্ময়ের লাশটা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ওকে দেখলে আমার কষ্ট বাড়ে। বেঁচে থাকার পরেও মৃ’ত্যু যন্ত্রনা আমায় তিলে তিলে ঘিরে ধরে।ওকে নিয়ে যা আমার সামনে থেকে। আমি ওকে সহ্য করতে পারছি না।”

খালা নাকি মায়ের মতো হয়। মায়ের পরে একমাত্র বড়ো বোন আর খালাই নাকি মায়ের মতো ভালোবাসতে পারে। কথাটা কতটুকু সত্য তা ধারণা না করা গেলেও অনুভা যেনো তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মা যখন সন্তানকে দূরে ঠেলে দিলো তখন তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল অনুভা। মায়ের মতো যত্ন করে লালন পালন করছে। আট মাস বয়সী তাঈম এখনো কথা শিখতে না পারলেও তার ওই অ্যা অ্যা, মা মা শব্দ দিয়েই যেনো বারবার সে বুঝিয়ে দেয় অনুভা তার আরেক মা।

সন্তর্পণে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে নিজ কক্ষে গেলো অনুভা। সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে এই রাতের বেলায় গোসল সারলো। তারপর চলে এলো বাবার ঘরে। হাতে ব্যথা পাওয়ার পর বাবার সামনে আর আসা হয়নি। আজ হাতের ব্যান্ডেজ খুলে এসেছে। ব্যান্ডেজকৃত স্থানে লেপ্টে দিয়েছে মলম। বাবার এই এক সমস্যা, মেয়েকে নিয়ে বড্ড চিন্তা করেন। মেয়ে অসুস্থ হলেই নিজের উপর চাপিয়ে দেন সকল দোষ। মাঝেমধ্যে তো চোখের পানি ফেলে নিজের মৃ’ত্যু কামনা করতেও দ্বিতীয়বার ভাবেন না।

বিছানার ফাঁকা স্থানে এসে বসলো অনুভা। কামরুল হাসান চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন।মেয়ের উপস্থিতি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিতেই চোখ মেলে তাকালেন তিনি। হাস্যজ্জ্বল মুখে শুধালেন,“কখন ফিরলি?”

“আধ ঘণ্টা হবে।”

“ওহ।”

“শরীর কেমন আছে বাবা?”

“আলহামদুলিল্লাহ।”

“সারাক্ষণ এভাবে শুয়ে থাকতে তোমার অনেক কষ্ট হয় তাই না বাবা?”

“কষ্ট তো হয় তবে শুয়ে থাকার জন্য নয় বরং তোর উপরে বোঝা হয়ে থাকার জন্য। আমি বাবা নামের কলঙ্ক তাই না রে মা? যে সময় কিনা নিজের মেয়েকে সৎ পাত্রের হাতে তুলে দিয়ে তার জীবনে সুখ দিয়ে ভরিয়ে দেওয়ার কথা সেই সময়টাতেই মেয়ের উপর এতগুলো মানুষের ভরণ পোষণের দায়িত্ব চাপিয়ে দিলাম। আমি অনেক ভুল করেছি মা। আমার লোভ করা যে উচিত হয়নি। নিজের নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়া উচিত হয়নি।উচিত হয়নি তোর চাচা ফুফুদের উপর বিশ্বাস করা। তোর মায়ের কথা শুনলে হয়তো আজ এদিন দেখতে হতো না আমাকে। নিজ হাতে তোর জীবনটা নষ্ট করে দিচ্ছি।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো অনুভা। বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বললো,
“আহা বাবা! সবসময় এসব বলে কী মজা পাও বলো তো? আজ যদি আমার জায়গায় তোমার কোনো ছেলে থাকতো তাহলে কী এড়িয়ে যেতে পারতো সকল দায়িত্ব?”

“তুই যতটা করছিস তোর জায়গায় ছেলে হলে কখনোই আমাদের জন্য এতটা করতো না। জীবনে কত দেখলাম।”

“এসব বলে আর কী লাভ? আফসোস করলে কী আর সেই সুদিন ফিরে আসবে? এসব ভেবে ভেবেই দিনদিন শরীরের অবস্থা উন্নতির বদলে আরো খারাপ হচ্ছে তোমার। ঘুমাও এবার।”

কথাটা বলেই দ্রুত বাবার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো অনুভা। বেশিক্ষণ সামনে থাকলে হয়তো নিজেও দুর্বল হয়ে পড়তো।
________

গাড়ি পার্কিং করে বাড়িতে প্রবেশ করেছে শ্রাবণ। ভেসিংয়ে হাতটা ধুয়েই বসে পড়ল ডাইনিংয়ের চেয়ারে। ছেলের এসব ছোটো খাটো অনিয়ম দেখলেই মেজাজ খারাপ হয় পিতা হানিফ শেখের। শক্ত গলায় বললেন,
“বাহির থেকে এসেছো। ফ্রেশ হয়ে, পোশাক বদলে তারপর খেতে বোস।”

বাবার কথা শেষ হতে না হতেই ভাত মাখিয়ে এক লোকমা মুখে পুরে নিয়েছে শ্রাবণ। মুখের খাবার টুকু শেষ করে ব্যস্ত কণ্ঠে প্রত্যুত্তরে বললো,“উপরে যাবো তারপর আবার নিচে এসে খাবো? এতশত ঝামেলার দরকার কী? তাছাড়া আমার প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে। একেবারে খেয়েদেয়ে তারপর ঘরে যাবো।”

ক্রুদ্ধ হলেন হানিফ শেখ। বিদ্রুপ করে বললেন,“তুই না শিক্ষক? একজন শিক্ষক হয়ে যদি নিজের মধ্যেই সঠিক শিক্ষা ধরে রাখতে না পারিস তাহলে ছেলে- মেয়েদের কী শেখাবি?”

“ছেলে-মেয়েরা যা শিক্ষা পাওয়ার পরিবার এবং স্কুল শিক্ষকদের কাছ থেকেই পেয়ে আসে। আমরা হচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমাদের কাজ ক্লাসে ঢুকে একেক দিন একেকটা টপিকসে লেকচার দেওয়া যা আমি খুব ভালো করেই দিতে পারি।”

“বেয়াদব।”—-বিড়বিড় করতে করতে নিজের খাওয়ায় মনোনিবেশ করলেন হানিফ শেখ।

পিতার কথাটা শুনেও না শোনার ভান করে নিজের মতো খেতে লাগলো শ্রাবণ। খাওয়া শেষ করে এঁটো প্লেটে হাত ধুতেই নিরবতা ভেঙে মা শান্তা বলে উঠলেন,
“এই না বললি খুব খিদে পেয়েছে? তাহলে এত তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ হলো কী করে? তেমন করে তো কিছুই খেলি না।”

“পেটে যতটুকু আঁটবে ততটুকুই তো খাবো মা।”

বসা থেকে ওঠার জন্য উদ্যত হতেই হানিফ শেখ পুনরায় ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,“তা বিয়ে সাদি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিস নাকি?”

ভ্রু দ্বয় কুঁচকে নিলো শ্রাবণ। শুধালো,“এমনটা মনে হওয়ার কারণ?”

“তোর মতিগতি দেখে তো তাই মনে হলো। খাওয়ার সময় আর মর্নিং ওয়াকের সময় ছাড়া তো তোর টিকিটিও পাওয়া যায় না। বিয়ের বয়স হয়েছে সেই কবে। ভালো চাকরিও করছিস। ওদিকে সৌহার্দ্যের লেখাপড়াও শেষ। ওরও তো বিয়ের বয়স হয়েছে। ছুটি শেষ হলেই কয়েকদিন পর আবারো চলে যাবে দেশের বাহিরে। তোর জন্য তো আর ওর বিয়েটা আটকে রাখতে পারি না। তাছাড়া মানুষের হায়াৎ মউত সব আল্লাহর হাতে। কবে মরে যাই তা তো সঠিক জানি না তাই তোদের দুই ভাইকে বিয়ে দিয়ে আমি আর তোর মা মিলে সামনের বছরই হজ্জে যেতে চাইছি।”

আড়চোখে ছোটো ভাইয়ের পানে তাকালো শ্রাবণ। সৌহার্দ্যকে দেখে যেনো মনে হচ্ছে ভাঁজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না। একেবারে বাবা-মায়ের বাধ্য সন্তান। কিন্তু এ ছেলেটারই যে পেটে পেটে শয়তানী তা শ্রাবণ ছাড়া কেউই জানে না। চুপচাপ ভদ্র ছেলের মতো মনোযোগ সহকারে খাবার খাচ্ছে সৌহার্দ্য। এমন ভাব আশেপাশের কোনো কথাই কর্ণগোচর হয়নি তার। বাবা যা সিদ্ধান্ত নিবে তাতেই সে রাজি।

গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলো শ্রাবণ। পিতার উদ্দেশ্যে বললো,“আমার বিয়ে নিয়ে ভাবতে তো আগেই নিষেধ করে দিয়েছি তোমাদেরকে। হজ্জে যাবে ভালো কথা। ছেলের বিয়ে দিবে তাও ভালো কথা। আমার জন্য সৌহার্দ্য কেন আটকে থাকবে?ওর জন্য তোমরা বরং মেয়ে খোঁজা শুরু করে দাও। হজ্জে যাওয়ার আগে বিয়েটা ওর দিয়ে দাও।”

শান্তা ঘোর প্রতিবাদ করে বললেন,“সে কী কথা? বড়ো ভাই রেখে ছোটো ভাইয়ের বিয়ে? লোকে কী বলবে?”

“লোকে কিছুই বলবে না।”

“এমন করছিস কেন মেহু? বিয়ে তো মানুষকে করতেই হয় তাই না।”

“আমিও তো তাই বলি।”

চট করে আনন্দিত হয়ে গেলেন শান্তা। আহ্লাদী কণ্ঠে বললেন,“তাহলে রুবির সঙ্গে কথা বলি? রুবির ননদের মেয়েটা এবার ভার্সিটিতে পড়ছে। কয়েক মাস আগে বেড়াতে গেলাম না?তখন সেও এসেছিল। প্রথম দেখাতেই মেয়েটাকে আমার মনে ধরেছে।”

“তোমার মনে ধরলেই তো হবে না। সংসার যেহেতু আমায় করতে হবে সেহেতু মনেও আমারই ধরতে হবে।”

“মেয়ে অনেক সুন্দর। তোরও পছন্দ হবে।”

“হবে না, মন অনেক আগেই অন্য কাউকে দেওয়া হয়ে গেছে। ওই মেয়েকে তোমার অতিরিক্ত পছন্দ হলে ছোটো ছেলের বউ করে ঘরে নিয়ে এসো।”

বড়ো ভাইয়ের কথাটা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই আঁতকে উঠলো সৌহার্দ্য। টেবিল ছেড়ে উঠে গেলো শ্রাবণ। সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে কিছু একটা মনে পড়তেই পিছু ফিরে ছোটো ভাইয়ের পানে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,“আমি না হয় বেয়াদব কিন্তু তোমাদের ছোটো ছেলে তো খুবই ভদ্র, বাবা-মায়ের বাধ্য সন্তান। বাধ্য সন্তানরা কখনো প্রেম করে না তাই আশা করি তুমি যাকে পছন্দ করবে ও তাকেই বিয়ে করবে মা।”

কথাটা বলা শেষ করে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে নিজের পথে পা বাড়ালো শ্রাবণ। তৎক্ষণাৎ গলায় খাবার আঁটকে গেলো সৌহার্দ্যের। উন্মাদের মতো কাশতে লাগলো। শান্তা ছেলের পিঠে চাপড় মারতে মারতে বিচলিত কণ্ঠে শুধালেন,“কী রে তোর আবার কী হলো?”

হানিফ শেখ ধমকের সুরে স্ত্রীর উদ্দেশ্য বললেন,
“প্রশ্ন পরে করো আগে পানি দাও ওকে।”

পুত্রের দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন শান্তা। গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে গ্লাসের পুরো পানি শেষ করল সৌহার্দ্য। কাশির পরিমাণটা পূর্বের তুলনায় কমে এসেছে। এঁটো হাত ধুয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। কক্ষের দিকে অগ্রসর হতে হতে বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,“আমার ঘুম পেয়েছে আমি ঘুমাতে গেলাম।”

ছেলের যাওয়ার পানে দুজনেই হা করে তাকিয়ে রইলেন। তাদের চাহনির মধ্যে একটাই প্রশ্ন,“হঠাৎ করে এর আবার কী হলো?”

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে