#সিঁদুর_রাঙা_মেঘ
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
পর্ব-২৩,২৪
গ্রামে প্রবেশ করতেই আবার পড়লো বিপদে ইউসুফ কুহু। তাদের দিক বাঁকা চোখে তাকিয়ে গ্রামের মুখয়া আর পঞ্চায়েতের লোকেরা বলল,,
—“তোমরা জামাই বউ আমরা কিভাবে বিশ্বাস করি? এখানে এমন অনেক কাহিনী হইছে ছেলে মেয়ে আহিয়া ফষ্টিনষ্টি করে চলে যায়। কোনো প্রুভ আছে তোমরা বিবাহিত? ”
ইউসুফ বলল,,
—” চাচা আমরা ঘুড়তে বের হইছিলাম ডাকাতের তারা খাইছি তাই এই খানে আসা। ঘুড়তে বের হইছি প্রুভ কই থেকে থাকবো।বেড়াতে গেল কেউ প্রুভ নিয়া বের হয় নাকি?”
মুরব্বিরা নিজেদের মাঝে কি কথা বলতে লাগলো। তারপর বলল,,
—” আইচ্ছা সমস্যা নেই। বিয়ে আবার হইবো।তারপর যতদিন ইচ্ছা থাকো আমাগো মেহমান হইয়া?”
কুহু এ কথা শোনার পর খামচে ধরলো ইউসুফকে কানে কানে বলল,,
—ইউসুফ ভাই এসব কি বলছে? আমি বিয়ে করবো না!”
ইউসুফ এক ধমক দিলো কুহুকে। কুহু চুপসে গেল। সে মুরব্বিদের জানালো। কোনো সমস্যা নাই বিয়ে করবে।
—“আপনি একা একা এ ডিসিশন কেমনে নিলেন? আপনার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে! তাও আমাকে বিয়ে কেন করলেন?”
কুহুর কথায় কোনো রিজেকশন দিলো না ইউসুফ খাটে বসে পা ঝোলাতে লাগলো। কিছুক্ষণ আগেই তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে৷ ইউসুফ মনে মনে বিদ্রুপের হাসি হাসলো। যাকে সে চাইতো মনে প্রানে আজ সে তার অর্ধাঙ্গনী। কত কাহিনীর পর। এখন বসে আছে বাসর ঘরে। ইউসুফের ভাবার মাঝে আবার বলল কুহু,,
—” আমরা সত্যিটা বললে পারতাম না?”
ইউসুফ এবার গম্ভীর সুরে বলল,,
–“হে পারতাম। পরে ডাকাতদের ডিনার হতাম।”
কুহু চুপসে গেল। খাটের কোনে বসে ভাবলো ইউসুফ তার বর। লাল হয়ে গেল মুখ খানা। অথচ এ দিনের জন্য কতই না জলপনা কল্পনা করেছিল কুহু। আজ তা সত্যি তো হলো এ ভিন্ন জায়গায় বিপদে পড়ে। আচ্ছা এ বিয়ের কোনো ভবিষ্যত আছে? কুহুর ভাবনায় ছেদ পড়লো। কেউ খটখট করে দরজার কড়া নাড়লো। ইউসুফ খুলতেই একটি মেয়ে এসে খাবার দিয়ে গেলো। কুহু খাবার দেখে বলল,,
—” অনেক খুদা পেয়েছিল!”
ইউসুফ হাসলো বলল,,
—“খেয়ে নে আসচ্ছি বাহির থেকে!”
ইউসুফ বাহিরে এসে ফোন বের করলো। নেটওয়ার্ক পেয়ে কল করলো জাবেদকে। তারা খুব চিন্তিত।মিশু আর মিহুতো রীতিমতো কেঁদে কেঁটে খুন। তাদের ঠিক আছে তারা জানিয়ে রুমে ফিরত আসতেই। খানিকটা ভ্রু কুচকায় ইউসুফ। কুহু কেমন দুলছে অস্বাভাবিক ভাবে। তার কাছে যেয়ে ইউসুফ বলল,,
—“এমন করে দুলছিস কেন তুই?”
কুহু মিটিমিটি হাসতে লাগলো। বলল,,
—“সরবত খেয়েছি। খুব মজা খাবে?”
ইউসুফ এগিয়ে এসে গ্লাসটা নাকের কাছে নিতেই বুঝতে পাড়লো কুহু নেশা জাতীয় কিছু খেয়েছে। ইউসুফ হতাশ হয়ে কুহুর দিক তাকাতেই কুহুকে পড়ে যেতে দেখলো। ধরে ফেলে সাথে সাথে।তখনি কুহু বলতে লাগে,,
—“জানো আমারো খুব ইচ্ছে হয় তোমাকে ভালবাসতে।”
–“আর?
—” তোমার বুকে মাথা রেখে তারা গুনতে!”
—“আর?
কুহু ইউসুফের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,,
—” তোমার সেই বিলাই চোখে হারিয়ে যেতে। ”
কুহু ইউসুফের কোমরে দু হাতে আবদ্ধ করে আরো কাছে টেনে নিলো। ধিমি আওয়াজে আবার বলল,,
—” আর?
কুহু তাকিয়ে রইলো ইউসুফের ওষ্ঠদ্বয়ে।ইউসুফ হাসচ্ছে তার ওষ্ঠদ্বয়ে বাঁকা হাসি। হাসির জন্য গালের টোলপড়াটা আর গারো হচ্ছে। কুহু সেখানে এক আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করলো। ফিসফিস করে বলল,,
—” তোমাকে খেয়ে ফেলতে!”
ইউসুফ ফিকে হাসলো। বলল,,
—” নেশার ঘোরে আছো। যখন হুঁশ ফিরবে। তখন আবার দূরে দূর থাকতে চাইবে।”
দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো ইউসুফ। কুহু হেলে পড়েছে ততখনে। পিটপিট করে তাকিয়ে থাকার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইউসুফ এবার কুহুকে কোলে তুুলে বিছানায় শুয়ে দিল। তার উল্টো পাশে নিজেও আধো আধশোয়া হয়ে বসলো । বিড়বিড় করে বলল,,
—” সময়টা যদি এখানেই থেমে যেতে! শুধু আমি আর আমার বাবুইপাখির একটি ছোট নীড় হতো। সবি স্বপ্ন শুধু সকাল হলেই রাতের মতো সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে যে তোর নেশার ঘোরে বলা সব কথা, আদর, ভালবাসা! মাঝে মাঝে মনে হয় লুকিয়ে ফেলি তোমাকে এ বুকের মাঝে। না পারবে কেউ আর আলাদা করতে আমাদের। যদি এমন হতো! কখনো কি হবে এমন? শুধু কল্পনায় নয় তোমায় ছুঁয়ে দেখতাম বাস্তবেও।”
পর্ব-২৪
সকাল হতেই ফিরে এলো তারা সাজেকে। গ্রামবাসী পৌঁছাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছে তাদের। ইউসুফ আসার পর থেকে এক ফুটাও কথা বলিনি। না তাকিয়েছে কুহুর দিক। মনের মাঝে এক গাধা অভিমান, অভিযোগে জমা। তার কারণ অবশ্যি কুহু। সকালে যখন তারা ফিরছিল ইউসুফ কুহুকে বলেছিল,,
—” আমি এ বিয়ের কথা সবাইকে জানতে চাই। ”
কুহু তখন নাকচ করে বলেছিল,,
–” আমি এ বিয়ে মানি না ইউসুফ ভাই। এখানে কি হয়েছিল আমরা দুজন ছাড়া কেউ জানি না। আর কাউকে জানানো প্রয়োজনও নেই। সামনে আপনার বিয়ে। আপনার বাগদত্তা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।।”
ইউসুফ তখন রেগে মেগে কুহুকে কাঠের দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বলে উঠে,,
—” প্রতিবার তোর কথাই কেন মানতে হবে আমার? আমি বলছি এ বিয়ের খবর জানবে সবাই তো জানবেই। ”
—” কিন্তু আমি চাইছি না জানাতে। আপনি ঢাকায় ফিরে ডিভোর্স দিয়ে দিবেন আমাকে শেষ কাহিনী।মুক্তি চাই আমি শুধু। ”
কুহুর নির্বিকার কথা গুলো সুয়ের মতো বিঁধল ইউসুফের বুকে। সে কুহুকে ছেড়ে দিল। যেতে যেতে এতটুকুই বলল,,
—” তোর কাছে আমার কোনো মূল্যই নেই, সে ভালবাসা হোক বা কোনো কথা। ভ্যালু লেস। তোকে মুক্ত করে দিবো দ্রুত।”
ইউসুফ শুকনো ঢুক গিললো। সবাইকে বলল,,
—” আজই বেক করবো আমরা।প্যাকিং শুরু করে দাও!”
বাসায় কেউই ইউসুফ-কুহুর পাহাড় থেকে পড়ে যাওয়ার কাহিনী জানায়নি। হুর জানায়নি তার অপরাধ বোধের জন্য। মিশু জানায়নি তার বাবা-মা টেনশন করবে বলে। বাসায় ফেরার পর থেকেই তোরজোরে শুরু হয় বিয়ের আয়োজন ইউসুফ আর হুরের। প্রতিটি অ্যারেঞ্জমেন্ট কুহু নিজ হাতে করছে। বিয়ের শপিং যাচ্ছে আজ। শপিং মলে মেয়ের জন্য বিয়ে ল্যাহেঙ্গা আর জুয়েলারি কিনে ফেললো। একে একে সবার কেনা কাটা শেষ করবার পর যখন বের হবে তখন ইউসুফ হুট করে কোথা থেকে এসে সকলের আড়ালে কুহুর হাতে একটি শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলল,,
—” বিয়ের পর বউকে কিছু দিতে হয়। এটা তোর জন্য!”
কুহুতো পুড়াই থ। আজ কতদিন পর ইউসুফ তার সাথে কথা বলল। ভেবেই চোখ মুখে খুশির ঝলক দেখা গেল। কিন্তু যখন ভাবলো তা ক্ষনিকের তখনি মুখটা মলিন হয়ে গেল তার।বাসায় ফিরে ব্যাগটা খুলতেই কুহু অবাকের শেষ চুড়ায় চলে যায়। ইউসুফ একটি পেঁয়াজ কালার সুন্দর শাড়ি আর ডায়মন্ড নেকলেস সাথে রূপার এক জোড়া পায়েল গিফট করেছে। কুহু বার বার ছুঁয়ে তা দেখছে। এ গুলো পড়ার মতো সাহস তার নেই।না সামর্থ আছে। তাই যত্ন করে আলমারিতে তুলে রাখলো কুহু।
আজ হলুদ ছেলে-মেয়ের এক সাথেই ফাংশন হবে বৃষ্টি বিলাশের সেই প্রকান্ড ছাদে।কুহু দূর থেকে ইউসুফ আর হুরের হলুদ ছোঁয়া দেখছে। বুক ফেটে কান্না আসচ্ছে তার। কুহু সরে ছাঁদের অন্য প্রান্তে চলে গেল। ছাঁদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। ছাঁদের এক প্রান্তে সাউন্ড বক্সে জোড়ে গান বাজানো হচ্ছে। ছেলের পক্ষ আর মেয়ে পক্ষ গানের তালে তালে নাচ প্রদর্শন করছে।কুহু বুক ফাঁটা কান্না কারোই কর্ণপাত হলো না।
কিছুক্ষণ পর কুহু তার পিছনে কারো উপস্থিতি টের পেল। চোখের জল অগোচরে মুছে ফেলে পিছনে ঘুরতেই হুরকে দেখতে পেল। হুর কুহু কাছে এসে ওর দুটি হাত ধরলো। অপরাধী সুরে বলল,,
—” আমায় ক্ষমা করে দাও কুহু। ”
কুহু অবাক হয়ে বলল,,
—“ক্ষমা কেন চাইছো?”
—“আমি ভুল করেছি। সে ভুল কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে আমায়। ”
ডুকরে উঠলো সে। কুহু বলল,,
—” আমি কিছু বুঝতে পাড়ছি না!”
চোখের জলটুকু মুছে হুর বলল,,
—” সেদিন পাহাড় থেকে ধাক্কা আমি দিয়েছিলাম তোমায়। বিশ্বাস করো তা করতে চাইনি। ইউসুফের সাথে তোমার রিলেশন ছিল তা জানার পর থেকে হিংসা হতে লাগে তোমার প্রতি।মনে চাইছিল মেরে ফেলি তোমাকে, তুমি বেঁচে থাকলে হয়তো ইউসুফ কখনও আমার হবে না এভেবেই। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম।জানো আজ পর্যন্ত ইউসুফ মন থেকে হাসি মুখে কাছে টানেনি আমাকে। যে কবার টেনেছে তোমার উপর রাগ ক্ষোভ আর জেলাসি করার জন্য। আমার বুঝা হয়ে গেছে। এ জীবনে ইউসুফ আমার হয়েও কখনো আমার হবে না। ”
কুহু মলিন হাসলো। বলল,,
—” মানুষটা এমনি খুব জটিল। দেখবে সে তোমাকে যখন ভালবাসবে তখন আর দূরে যেতে দিবে না।”
হুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,
—” এ জীবনে সে আমায় কখনো ভালবাসবে না। ”
কুহু বলল,,
—“ধৈর্য ধর। ধৈর্যের ফল বড়ই মিষ্টি।”
হাসলো হুর।
চলবে,