সিঁদুর রাঙা মেঘ পর্ব-২১+২২

0
1323

#সিঁদুর_রাঙা_মেঘ
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
পর্ব_২১,২২
—” আশিকের সাথে তোর কিসের সম্পর্ক? ”
মিশুর কথায় চমকে গেল কুহু বলল,,
—“সম্পর্ক? ও আমার বন্ধু শুধু!”
—“তাই যদি হয়? ভাইয়াকে কে বলল! তোর আর ওর সম্পর্ক আছে?”
কুহু অবাক হয়ে বলল,,
—“কি বলছো এসব?”
—“সত্যি বলছি। ভাইয়ার ফোনে পিক দেখেছি তোদের। এমন ভাবে যেনো তোরা কাপেল?”
—“,তেমন কিছু না আপি। ও আমার ছোট বেলার বন্ধু। পালিয়ে যাওয়ার পর মেন্টালি ভাবে ওই আমাকে সাপোর্ট করে। বেষ্ট ফ্রেন্ড আমার বলতে গেলে! আমাদের বন্ডিং দেখে অনেকে তাই ভাবতো। ভাইয়াকেও তারা আমাদের ভুল ভেবে ইনফরমেশন দিতো।”
কুহু হাসলো। মিশু দাম্ভিকতা ধরে রেখে বলল,,
—” আশিক নিজেই নাকি ভাইকে বলেছে? তুই আশিকে জি এফ?”
কুহু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,,
—“আমি বলতে বলেছিলাম।”
—“,কেন? আবাক হলো মিশু।
কুহু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,,
—“ভাইয়া আমার পিছনে লোক লাগিয়ে ছিল। আমার উপর নজর রাখার জন্য। আমি সত্যি বলেছিলাম নাকি তা যাচাই করার জন্য!”
মিশু কুহুর কাঁধে হাত রেখে বলল,,
—” তোর অনেক ধৈর্য কুহু। আমি কখনো পাড়তাম না।”
কুহু ছোট শ্বাস নিয়ে বলল,,
–” সময় সব শিখে দেয় বড়পু।”
মিশুও মাথা নাড়ালো।

ইউসুফ এখন সুস্থ। রাতের কথা কিছু মনে নেই তার। ইউসুফ মাথা চেপে বলল,,
–“রাতের কিছু মনে নেই কেন আমার?”
সাবেত হেসে বলল,,
—“নেশা করে ঘুমিয়েছিস শুধু।”
ইউসুফ সন্দিহান। বলল,,
—” সত্যিতো? আমার কেমন জানি ধোয়াশার মতো লাগচ্ছে!”
জাবেদ ইউসুফকে টেনেটুনে উঠিয়ে বলল,,
–“জ্বর এসেছিল রাতে এখন আর নেই।এবার উঠ নয়তো আর ঘোরাঘুরি হবে না।”

সবাই রেডি হয়ে বাহিরে চলে এলো। ইউসুফ কুহুকে দেখে না দেখার ভান করে গাড়িতে চড়ে বসলো। হুরও তার পিছন পিছন উঠে বসলো। সবাই একে একে উঠার পর গাড়ি ছাড়লো। একে একে আলুটিলা রিচাং ঝরনা, ঝুলন্ত ব্রিজ ঘুরে তারা গেল কংলাক পাহাড়ে। এটার উপর আধিবাসীর বসবাস। তখন বিকেল হয়ে গেছে প্রায়।এখান থেকেও সূর্য ডোবার দৃশ্য অনেক সুন্দর। তাই শেষে এখানে আসা। সবাই একে বারে উঠে দাঁড়ালো পাহাড়ের শেষ চূড়ায়। কেউ কেউ ক্যামেরা বের করেছে এই মুহূর্তটি তুলার জন্য। সূর্য ধীরে ধীরে অস্ত যাচ্ছে, তার লাল আলোয় চারিদিকে মাখিয়ে যাচ্ছে। তার আশেপাশের মেঘ গুলোকে সিঁদুর রাঙা মেঘ মনে হচ্ছে সেই আলোতে। কুহু মুগ্ধ নয়নে দেখছে তা। ঠিক সেই মুহূর্তে কেউ কুহুকে ধাক্কা দিলো। কুহু তার পাশের জন কে ছিল তা না দেখেই টেনে ধরলো। পাশের জন ব্যালেন্স না রাখতে পেরে তার সাথে হুড়মুড়িয়ে পাহাড় থেকে পড়তে লাগলো। আকস্মিক এমন হওয়াতে সকলের মাঝে নিরবতা কিছুক্ষণ থেকে মিহু এক চিৎকার দিল কুহু আপু বলে৷ সাথে চিৎকার চেঁচামেচি ঢল নেমে এলো। হুর তাজ্জব বনে গেল যেন। সে ভয়ে শুকনো ঢুক গিললো। কারণ কুহুকে সে ধাক্কা দিলেও তার সাথে ইউসুফ ও নিচে পড়ছে। হুর মুখে হাত দিয়ে আছে। নিজের পায় নিজে কুড়াল মেরেছে।সে কুহুকে মারতে চাইছিল তার জীবন থেকে সরাতে চাইছিল। কিন্তু হয়ে গেল এসব??

মিশু আর মিহু কান্না করতে লাগলো। জাবেদ আর সাবিত নিচে যাওয়ার চেষ্টা করতে চাইছে কিন্তু তারা একজায়গায় পড়েছে যেখানে নামা মুসকিল খুব। কিছু আদিবাসী বলে দিয়েছে,,
—“এরা আর বেঁচে নেই! এত উঁচা থেকে পড়লে কেউ বাঁচে না!”
এদের কথায় কান্নার রোল বেড়েই গেল। চারিদিকে তখন তোলপাড় চলছে নিচে যাওয়ার। কিছু সুরক্ষা বাহিনী এসেছেন তাদের সাথেই নিচে যাচ্ছে জায়েদ। সাবিত বাকিদের সামলাচ্ছে।

পর্ব_২২
কুহু জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে ইউসুফের বাহুডোরে পায়। ইউসুফের কঁপাল কেঁটে রক্ত পড়ছে। কুহু ভাবতে থাকে ওরা এভাবে কেন? তখনি মনে পরে কেউ তাদের ধাক্কা দিয়েছিল। কুহু অবাক হলো তারা বেঁচে আছে??কুহু উঠে বসে ইউসুফকে ডাকলো। ইউসুফ ফিটফিট করে চোখ খুলে আসেপাশে দেখে বলল,,
—” আমরা এখানে কেন?”
কুহু কিছু বলল না। পড়ার সময় তার ব্যাগপ্যাক কাধে ছিল। তা দূরে পড়ছে তা উঠাতে উঠাতে বলল,,
—“পাহাড় থেকে পড়ে গেছি আমরা। ”
ইউসুফ অবাক হয়ে বলল,,
–“বেঁচে আছি আমরা? নাকি মারা গেছি?”
কুহু হেসে ফেলল। সিরিয়াস মুহূর্তেও মজা করছে ইউসুফ। সে বলল,,
–“এবার উঠুন ফিরতে হবে সন্ধ্যা হয়ে আসচ্ছে। সবাই চিন্তা করছে।”
ইউসুফ উঠে বসেছিল এতক্ষণ কি ভেবে আর মাটিতেই শুয়ে পড়লো। বাচ্চাদের মতো বলল,,
—“যাবো না আমি। তুই গেলে যা।”
কুহু চোখ বড় বড় করে বলল,,
—” আমি একা কিভাবে যাবো। উঠুন প্লীজ কি নির্জন জায়গায় ভয় করছে আমার।”
—” তো আমি কি করবো?”
—” আপনার কি মাথায় বেশী চোট লেগেছে ইউসুফ ভাই।”
ইউসুফ কুহুর দিকে তাকালো এক পলক। এ চাহনিতে শীতল স্রোত বয়ে গেল যেন শরীরে তার। কিছুটা আমতা আমতা করেই বলল,,
—“আপনি থাকুন আমি যাই।”
হাঁটা ধরলো কুহু। পিছন থেকে ইউসুফ তাকে আটকে ফেলল। কুহুকে তার দিক ঘুড়িয়ে কুহু হাত দুটি পিছনে মুরে পিঠের সাথে ঠেকালো। ফিসফিস করে কুহুর কানের কাছে বলল,,
—“ভয় পাচ্ছিস কুহু? এই একা নির্জন জঙ্গলে তোর সাথে কিছু করে ফেলি? কেউ আসবে না এখানে কেউ না।”
কুহু ভয় পেল। কিন্তু বুঝতে দিলো না। শুধু দাঁত কেলিয়ে বলল,,
,—” আপনি এমন কিছুই করবেন না ইউসুফ ভাই।”
—“আর যদি করি? আমার এ মুহূর্তে গভীরভাবে তোকে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে।”
কুহু চমকে গিয়ে চকিতে বলল,,
—” আমার বিশ্বাস আছে আপনার উপর আপনি কিছুই করবেন না।”
ইউসুফ কুহুর কথায় বাঁকা হাসলো বলল,,
—” আমারও তোর উপর অনেক বিশ্বাস ছিল তুইতো ভেঙ্গেছিস তাই না? তাহলে আমি ভাঙ্গলে সমস্যা কই?”
কুহু এবার ভয়ে কাঁপতে লাগলো। ইউসুফের নেশা কাতর চোখ জোড়ায় নিচের মরন দেখতে পাচ্ছে। কুহু ইউসুফের থেকে সরতে চাইলো। ইউসুফ আরো কাছে এসে কুহুকে হিসহিস করে বলল,,
—“একদম নড়বি না। আমি কাছে আসলেই লাফালাফি শুরু হয় তোর?আশিকের সাথেতো ঠিকি হেসে হেসে কথা বলিস?”
কুহু মাথা নত করে ফেলল। ইউসুফ ছেড়ে দিলো।
ইউসুফ ব্যাগ নিয়ে হাটতে লাগলো। কুহু সেখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইউসুফ ঘাড় কাত করে বলে,,
—“কারো এখানে থাকার ইচ্ছে থাকলে থাকতে পারে।”
কুহু সঙ্গে সঙ্গে ইউসুফের পিছনে হাটতে লাগলো।
চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসচ্ছে। আসে পাশে ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে আসচ্ছে। দূর দূর পর্যন্ত কোনো মানুষ জন দেখতে পেলো না তারা।

এভাবে আরো কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটি জীপগাড়ির শব্দ শুন্তে পায় তারা। খুশিতে চকচক করে উঠে তাদের চোখ মুখ। কিন্তু খনিকের জন্য। জীপগাড়িটা তাদের খুব কাছেই থামলো। একজায়গায় ডাকাতে উপদ্রব আছে জানা ইউসুফের তাই গাছে আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো তাদের। তখনি কুহু বিরক্তি নিয়ে বলল,,
—“কি দেখছেন চলেন তারা চলে যাবে হেল্প পাবো। আপনি না গেলে আমি যাচ্ছি।”
কুহু এগিয়ে যেতে নিবে তার আগেই হেঁচকা টান দিয়ে কুহুকে গাছের সাথে মিশিয়ে ফেললো মুখের মাঝে হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল,,
–“চুপ একটা কঁথাও না।”
কুহু চুপ করে তাকিয়ে রইলো ইউসুফের দিক। ইউসুফ তার খুব কাছে তার মুখে মন্ডল৷ জুড়ে তার শ্বাসপ্রশ্বাস আছড়ে পড়ছে।

—” কিরে তোরাতো কইলি, মাইয়া পোলা এইহানেই পড়ছে?”
–“হো ওস্তাদ আমি নিজে দেখছি!”
—” তাইলে গেল কই? ”
—“আছে এইখানে কোনো জায়গায়। আর যাবে কই রাস্তা চিনবো না। জানেন না ওস্তাদ মাইটা হুর পরি!”
—” তোর হুর পরি তো উইড়া গেছে পরিস্থানে মনে হয়।”
রেগে বললো ওস্তাদ।
—“ওস্তাদ রাগিয়েন না আমরা খুঁজে দেখতাছি।”
ওস্তাদ রেগে গাড়িতে উঠে বসে বলল,,
—” খুইজা আস্তানায় আন আমি গেলাম।”
চামচা দুইটা মাথা নাড়ালো। কুহু ইউসুফ যেদিকে ছিল সেদিকে তারা চলে গেল। ইউসুফ তখন কুহুকে নিয়ে লুকিয়ে পরে। তারা যেতেই নিচু কন্ঠে বলে,,
—” এটা জঙ্গল এখানে যে কেউ ভাল হবে তা ভুল।”
কুহু কানে হাত চেপে বলল,,
—” সরি বুঝতে পারিনি। ”
ইউসুফ ছোট শ্বাস নিয়ে বলল,,
—” এটাই সমস্যা তুই বুঝতেই পাড়িস না?”
কুহু খোটা ধরতে পাড়লো। কিছু বলল না।
তারা আবার হাটা ধরলো। ততখনে রাত নেমে এসেছে। চাঁদের আলোয় তারা পা ফেলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। ইউসুফ তার ফোনটা বের করলো। নেট নেই। হতাশ হয়ে আবার রেখে দিলো। কুহু ভয়ে ভয়ে তার আশেপাশে দেখছে। তখনি একটি সাপ কুহু পায়ের উপর দিয়ে চলে গেল। কুহু এক চিৎকার দিলো।ইউসুফ অস্থির হয়ে বলল,,
—“কি হয়েছে?”
কুহু ভয়ে ভয়ে বলল,,
—“সাপ। আমার পায়ের উপর দিয়ে গেছে!”
ইউসুফ বলল,,
—“ভয় পাশ নে। চলেই গেছে। চল।
কুহু আর ইউসুফ চলতে লাগলো। কিছু দূর যেতেই তারা হলদে লাইটের আলোয় ছোট ছোট ঘর দেখতে পেল। কুহু খুশি হয়ে বলল,,
—” এটা গ্রাম মনে হচ্ছে।”
—” হে চল!”

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে