#সাপলুডুর_সমাপ্তিতে
তন্বী ইসলাম
০৯
কিছুটা সময় পর ভেতর থেকে ডাক আসে আমার। আমার বুকে কাপন শুরু হয়, বুক ধুরুধুরু করতে থাকে বার বার। আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাই সে রুমটার দিকে।
রুমের ভেতর গিয়ে দেখলাম তিনজন লোক বসে আছে পাশাপাশি। তাদের মধ্যে একজন বেশ স্বাস্থ্যসম্মত, লম্বায়ও অনেক। একজনের দেখলাম তার থেকে এক হাত সামনে তার ভুড়ি। অন্যজন যেনো কয়েক বছরের না খাওয়া হাড্ডি কঙ্কালসার দেহখানি নিয়ে বসে আছে।
উনাদের তিনজনের মধ্যে যিনি লম্বা আর স্বাস্থ্যসম্মত তিনিই হলেন জি এম স্যার। উনি আমাকে নানা ধরনের প্রশ্ন করলেন, আমি উত্তর দিলাম। শেষে আমাকে ইংলিশে কিছু লিখার জন্য দিলেন.. সেগুলোও আমি ঠিকঠাকভাবে লিখলাম। উনি খুশি হলেন। পাশের জনের দিকে তাকিয়ে আমার হাতের লেখা আর ব্যাসিক বুদ্ধির তারিফ করলেন খুব।
চাকরিটা পাকাপোক্ত। সকাল ৮ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত। বেতনও ভালোই, সেদিনের পর আর কিছুদিন শিহাবের বাসাতে ছিলাম আমি। এরপর অন্যত্র বাসা ভাড়া নিয়ে শিফট করি। শিহাবকে বার বার করে বলে দেই, যেনো আমার কথা বাড়িতে না জানায়৷ সে আমাকে আশ্বস্ত করে।
নতুন বাসাটা ভালোই, বাড়িটা দেখতে কিছুটা বাংলো বাড়ির মত, সামনে বিশাল বাগান। বাড়ির মালিক বাংলাদেশে থাকেন না, একজন কেয়ার টেকার বাড়িটার দেখাশোনা করেন। খুবই অল্প ভাড়ায় বাড়িটা আমি পেয়ে গেছি। তবে আমি একা নয়, এ বাড়িতে আরো একটা ফ্যামিলি আছে, তারা একতলায় থাকে৷ আমি নিজের মতো চলছি, চাকরি বাকরি করছি। বেশ ভালোই আছি।
নিচতলার মহিলাটা প্রায়ই আমাকে খোঁচা মেরে বলে
“কি গো মেয়ে, এতো বড় বাসায় একা একা থাকো কেন? বিয়েসাদী হয় নি নাকি তোমার? আছে কেউ?
আমি মুচকি হাসলাম। বললাম
“ছিলো, কিন্তু সাপে খেয়ে নিয়েছে।
তিনি অবাক হলেন। ভ্রু কুচকে বললেন
“মানে?
আমি উত্তর দিতে চাইছিলাম না, কিন্তু উনি বার বার প্রশ্ন করলেন। আমি বললাম
“আমার জীবনটা একটা সাপলুডুর ছক। এ ছকে বার বার আমি সিড়ির দেখা পেয়েছি, সিড়ি বেয়ে উপরে উঠেছি, কিন্তু টিকে থাকতে পারিনি। সাপে খেয়ে নিয়েছে।
বুঝলাম, তিনি আমার কথার মাথামুণ্ডু বুঝলেন না৷ শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।
আমি দিন পার করতে থাকলাম আমার মতো। প্রথম চাকরির বেতন পেয়ে একটা ফোন কিনেছি। চাইলেই নতুন সিম কিনতে পারতাম.. কিন্তু সেটা না করে আমার পুরোনো সিমকার্ডটা তুলে নিলাম। ফোনে ইমুও সেট করেছি। আগের অনেক নাম্বার চোখে আসলো। আমি অজান্তে হাসলাম, কিন্তু কি কারণে জানিনা।
ইদানিং বেশ পরিচিত একটা নাম্বার থেকে ইমু তে কল আসে, মেসেজ আসে। আমি শুধু তাকিয়ে থাকি, কল রিসিভ করিনা, মেসেজের উত্তরও দেই না।
সকাল সকাল অফিসে যাবার জন্য রেডি হচ্ছি। ঠিক এই সময় সেই নাম্বারটা থেকে আবারও কল এলো। কিন্তু এবার আর ইমু তে নয়, সরাসরি সিমে। আমি অবাক হলাম, দুশ্চিন্তায় পরলাম, রিসিভ করবো কি করব না ভাবতে থাকলাম
এক দুই ভাবতে ভাবতে কল কেটে গেলো, আমি ফোনটা রাখতে যাবো তখন আবারও বেজে উঠলো মোবাইল। এবার রিসিভ করলাম। ধীরে ধীরে ফোনটা কানে ঠেকালাম। শুনতে পেলাম সেই চিরচেনা কন্ঠস্বর থেকে নিসৃত শব্দ..
“তনু, আমি ফায়াজ। তুমি চিনতে পেরেছো আমায়?
আমি শক্ত গলায় বললাম
“চিনতে পারি নি। কে আপনি.?
সে আবারও বললো
“আমি ফায়াজ, তোমার ভালোবাসার ফায়াজ। তুমি ভুলে গেছো আমায়?
এবার আমি কড়া গলায় বললাম
“আমার ভালোবাসা মানে? মাথা গেছে আপনার? সেই কবেই আপনি আপনার খালাতো বোনকে বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন। তবে এখন আপনি কি করে এই কথাটা বলতে পারেন?
সে বিমর্ষ গলায় বললো
“তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে তনু। একটু সময় হবে কি?
“আমার মোটেও সময় নেই। আপনি ফোনটা রাখুন।
“প্লিজ তনু।
এবারে আমিই কেটে দিলাম। আমার সারা শরীর ঘামছে। এতো বছর পর সে কেন আমায় কল করলো? কেন বললো সে আমার ভালোবাসা? বার বার মাথায় প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খেতে লাগলো। তবে এখন এইসব নিয়ে ভাবার সময় নয়। অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার। আমি সমস্ত চিন্তাভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম। হাতের ঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে বেরিয়ে পরলাম অফিসের উদ্দেশ্যে।
(ফ্ল্যাশব্যাক)
যখন আমি প্রথম বার এন্ড্রয়েড ফোন নিয়েছিলাম তখন সবেমাত্র ইন্টার পাশ করেছিলাম। তখন আমার জীবনে না ছিলো ফায়াজ, আর না ছিলো মৃদুল। আর না ছিলো সজলের কোনো ছায়া। তবে ফায়াজ যেহেতু আমার প্রথম ভালোবাসা ছিলো, তাই এতো সহজে ভাকে ভুলতেও পারছিলাম না। দীর্ঘদিন তার বিরহে ভুগেছি আমি। প্রায়ই ইচ্ছে হত, একবার যদি তাকে দেখতে পেতাম। একবার যদি তার কন্ঠস্বরটা শুনতে পারতাম। সে তাড়না থেকেই আমি ইমু থেকে তার নাম্বারে কল করি। প্রথম বার কল হতেই সে রিসিভ করেছিলো, বলেছিলো
“কে?
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম
“আমি!
“আমি কে?
“তনু।।
সে কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে এক পর্যায়ে বললো
“হঠাৎ কল দিলে যে? আমি বারণ করেছিলাম তো।
আমি মুচকি হেসে বললাম
“মনটা যে বারণ মানে না।
“আবেগটাকে জলাঞ্জলি দাও তনু। আবেগ দিয়ে দিন চলে না, বাস্তবতাটাকে মেনে নাও। আমি তোমায় বার বার বলেছি আমি বিয়ে করেছি, তারপরও কেন আমায় এভাবে কল দাও? আমার বউ আছে, একবার যদি তার চোখে এটা পরে তাহলে আমার সংসারে ঝামেলা হতে পারে তনু।
আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুপ মেরে গেলাম। সে বললো
“কি হলো?
“আপনার জীবনে কোনো অশান্তি হোক আমি চাইনা। আপনার কাছে ভালোবাসার দাবীও আমি করি না। শুধু একটু সময় চাই, আপনাকে একটু দেখতে চাই।
সে গম্ভীর গলায় বললো
“ইমু খুলেছো! তা ফোন কিনলে কবে?
“এইতো কিছুদিন। ভিডিও তে কল দিবো?
“আমি ব্যস্ত আছি তনু। প্লিজ ডিস্টার্ব করো না আমায়।
সে কল কেটে দিলো। আমার চোখ বেয়ে অনবরত পানি পরছে। ফোনটার দিকে তাকালাম আবারও। সেদিনই এই নাম্বারটা খুলে ফেলে দিয়েছিলাম। নিয়েছিলাম নতুন সিমকার্ড।
বর্তমানে আমি বসে আছি বাসে৷ এই বাসে করেই আমি প্রতিদিন অফিসে যাতায়াত করি। আগে বাসে চড়তে পারতাম না, তবে এখন অনেক কিছুই পারি। বাসটা যখন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো তখনও আমার মনের মধ্যে শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিলো, “হঠাৎ সে কেন আমায় কল করলো? কি এমন কথা থাকতে পারে আমার সাথে যার জন্য একটু সময় চাইলো?
অফিসে গিয়ে যখন পৌছুলাম তখন অন্যদিনের চাইতে প্রায় দশ মিনিট লেইট হলো। অফিসে ঢুকামাত্রই জিএম স্যারের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হলো। তিনি লেট হবার কারণে কিছুটা বকাঝকা করলেন আমায়। আমি সেগুলো এক কানে ঢুকিয়ে অন্যকান দিয়ে বের করে স্যারকে স্যরি বলে নিজের ডেস্কে বসে পরলাম।। মাথাটা তখনও ভোঁ ভোঁ করছে, মাথা থেকে কিছুতেই তার কথাটা সরাতে পারিনি।
সাইড বেগ থেকে ফোনটা বের করলাম। চেক করলাম সে নাম্বার থেকে আবারও কোনো কল এলো কিনা। একটা দীর্ঘস্বাস ছাড়লাম। কোনো কল আসেনি। তবে তাতে আমার কোনো আক্ষেপ নেই, আমি এখন আর তাকে ভালোবাসি না। সমস্ত ভালোবাসা যে মৃদুলকে দিয়ে দিয়েছিলাম, তার জন্য অবশিষ্ট আর কিছুইই ছিলো না। অস্বীকার করবো না, তার জন্য অনেক দিন পর্যন্তই আমার মনে ভালোবাসা ছিলো, প্রথম প্রেম কিনা। তবে এখন আর সেসবের ছিটেফোঁটাও নেই।
আমি কাজে মন দিতে পারছিনা আজ। বার বার কিছু না কিছু ভুল করেই বসছি। আমার পাশেই ডেস্কেই আমার কলিগ জাহানারা বসা। তিনি বার বার আমায় খেয়াল করছিলেন। আমাকে উষ্কখুষ্ক দেখে প্রশ্ন করলেন
“তুমি কি অসুস্থ তনিমা?
আমি উনার কথায় তাকালাম। বিমর্ষ গলায় বললাম
“শারীরিক নয়, তবে মানসিক ভাবে আমি অসুস্থ।
তিনি আবারও প্রশ্ন করলেন
“তোমার মানসিক রোগের কারণ কি?
এবারে আমি হাসলাম। বললাম
“এ রোগের কারণ মুখে বলা যায় না, ঔষধেও সারে না।
আমি কাজ শুরু করলাম। দেখলাম, উনিও এবার নিজের কাজে মন দিয়েছে। সারাদিন কাজ শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে তখন সন্ধ্যে ছ’টা। রান্নাবান্না করা হয় নি সকালে। গতরাতের খাবার ছিলো, সেগুলো খেয়েই গিয়েছিলাম অফিসে। দুপুরে লাঞ্চ করেছি হোটেল থেকে আনিয়ে।। এবার রান্না না করলে আর হবেই না।।
চুলায় ভাত চাপিয়ে তরকারি কুটতে বসলাম আমি। কাটাকাটি প্রায় শেষের পথে, এমন সময় আবারও ফোন বেজে উঠলো। হাতটা ধুয়ে গেলাম ফোন নিতে। নাম্বার দেখে রিসিভ করার ইচ্ছেটাই মরে গেলো। ফোন রেখে দিলাম আবার আগের জায়গা তেই। ততক্ষণে ভাত হয়ে গেছে। ভাতের মাড় ঝড়িয়ে সেটা ছ্যাকা বসিয়ে তরকারি বসানোর রেডি করতে থাকলাম। ফোন এখনো অবিরাম ভাবে বেজেই যাচ্ছে। তরকারি বসিয়ে তারপর কিছুটা বিরক্ত হয়ে ফোন হাতে নিলাম। রিসিভ করে কানে ঠেকাতেও ওপাশ থেকে শক্ত গলায় ফায়াজ বলে উঠলো
“কখন থেকে কল করে যাচ্ছি, রিসিভ করছো না কেন?
উনার ঝাঝালো কথায় রাগ হলো আমার। তিক্ত গলায় আমি বললাম
“আমাকে এভাবে কথা বলার মতো অধিকার নিশ্চয়ই আপনার নেই।
উনি এবার নরম গলায় বললেন
“বার বার কল করার পরেও তুমি ধরছিলে না, তাই রাগ হচ্ছিলো আমার।।
“ঠিক কি কারণে আপনার রাগ হচ্ছিলো?
কথাটা বলার পর উনার উত্তরের অপেক্ষা না করে আমি আবারও বললাম
“আপনার বউ কোথায়? এখন সে দেখবে না? আমার সাথে কথা বললে এখন আপনার সংসারে অশান্তি হবেনা?
উনি কিছু বলছে না, নিরবে শুনে যাচ্ছে আমার কথা। আমার এবার খুব কান্না পেলো। ভালোবাসায় ব্যর্থ হয়েছি। দ্বিতীয়বার ভালোবেসে বিয়ে করেও স্বামীকে হারিয়েছি, কলিজার টুকরা মেয়েটাকে হারিয়েছি জীবনের মতো। সবগুলো কষ্ট একে একে মনে ক্ষতে থাকা ঘাঁয়ে আঘাত করছে। আমি কান্না বিজড়িত গলায় বললাম
“এতটা বছর পর কেন এভাবে আমাকে বিরক্ত করছেন, আমিতো আমার মতো করে ভালোই আছি। সুখে আছি, শান্তিতে আছি। তবে কেন আপনি আমার শান্তিতে আগুন ঢালছেন?
তিনি অবাক গলায় বললেন
“আমি তোমার শান্তিতে আগুন দিচ্ছি!!
“আপনার কথাটাই এখন আমার কাছে আগুনের মতো লাগছে।
তিনি এবার নরম গলায় বললেন
“জানি, আমাকে তোমার সহ্য হচ্ছেনা, আমার কথায় তুমি রাগ হচ্ছো। এটা দোষের নয়, আমার প্রতি তোমার রাগ থাকাটা স্বাভাবিক। তোমার সাথে আমি যে অন্যায়টা করেছি, তার কোনো ক্ষমা নেই। তবুও আমি তোমার কাছে মাফ চাইছি। তুমি কি আমায় মাফ করবে তনু?
আমি এবার ভেজা গলাতেও তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম। দায়সারাভাবে বললাম
“হাহ মাফ! আজ আমার জীবনটাই অন্যরকম হতো, যদি আপনি সেদিন আমার সাথে এমনটা না করতেন। বিশ্বাস করেছিলাম আপনাকে, তার ফল দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র আপনার কারণেই আজ আমার এই করুণ দশা। না আপনি আমাকে ছেড়ে যেতেন, না আমি অন্য কারো ভালোবাসায় জড়াতাম.. আর না আজ আমার এই হাল হতো। আজ আমি অসহায়, স্বামী হারিয়েছি, সংসার হারিয়েছি, এক মাত্র মেয়েকে হারিয়েছি… তার দায় কার? শুধুমাত্র আপনার।
কথাটা বলতে বলতে কেঁদে ফেললাম আমি। হেচকি দিয়ে কান্না করছি। চোখের বাধ আজ মানছে না, ভেঙ্গে গেছে পুরোটাই। কান্নার মাঝেই ওপাশ থেকে শুনতে পেলাম বিষণ্ণ গলার আওয়াজ..
“তুমি বিয়ে করে নিয়েছিলে তনু?
আমি ভেজা গলাতেই শক্ত করে বললাম
“কেন, আপনি বিয়ে করেন নি? আপনিও তো করেছেন..
“আমি বিয়ে করিনি তনু, সত্যিই করিনি।
চলবে….