সাত সমুদ্রের তিমির পর্ব-২৩

0
995

#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ২৩
#সুমাইয়া_আফরিন

রাফাতের বুকে ঢলে পড়েছে অনু। রাফাতের হাত অনুর কোমড়ে বিচরন করছে। রাফাত বুঝতে পারছে না অনুর হঠাত কি হলো? এমন কেন করছে অনু?

রাফাত অনুকে কোনোরকমে ঘরে নিয়ে আসলো।
এত গভীর রাতে কাউকে ডাকতেও পারছে না সে। অফিসের কাজের জন্য প্রচুর দেরি হয়ে গেছে তার।
কিন্তু অফিস থেকে ক্লান্ত শরীরে ফিরেই যে এমন দৃশ্য দেখতে হবে তাকে তা সপ্নেও ভাবতে পারেনি সে।

অনুকে বিছানায় বসাতে নিলেই অনু রাফাতের শার্টের কলার চেয়ে ধরে। রাফাতের উপর ভর করে ধুলুধুলু পায়ে উঠে দাড়ালো সে।
রাফাত নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে অনুর অচেতন মুখস্রির দিকে। অনু রাফাতের গলা ধরে ঝুলতে লাগল।
মুখে রহস্যময় হাসি বিরাজ করছে তার। রাফাত রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠল,

‘অনু,এই অনু,তোমার কি হয়েছে বলো তো? এমন কেন করছো তুমি?’

অনু অর্ধচোখে তাকিয়ে আছে রাফাতের দিকে। ঘাড়ের থেকে হাত সরিয়ে ব্লেজার আকড়ে ধরল সে।
রাফাতের বুকে আস্তে করে মাথা রেখে নেশাভরা স্বরে বলে উঠল,

‘এত রাগ করছেন কেন রাফাত? আমার মতো ছোট বাচ্চার উপর কেউ রাগ করে নাকি?’

রাফাতের মাথা ইতিমধ্যে ঘোরা শুরু করে দিয়েছে।
কয়েকদিন আগেই ছাব্বিশ বছর বয়সে পা দিয়েছে অনু।
আর এখন বলছে, সে নাকি ছোট বাচ্চা। তার কথা যদি কোনো ছোট বাচ্চা শোনে
তাহলে হয়তো নির্ঘাত এতক্ষনে কান্না শুরু করে দিতো।

রাফাত বিরক্তিভরা সুরে বলল,

‘তুমি ড্রিংক করেছো?’

অনু রাফাতের গালে ঠাসস করে একটা চড় মেরে দিল।
থাপ্পর মারায় রাফাতের রাগ যেন চরম পর্যায়ে পৌছে গেছে। হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনুর দিকে।
এক্ষুনি হয়তো গালে থাপ্পর পড়বে অনুর। রাগে রাফাতের চোখ রক্তবর্ণ ধারন করেছে।

অনু বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে রাফাতের দিকে।
কিছুক্ষন এভাবেই তাকিয়ে থেকে রাফাতের বুকে মাথা রেখে বলল,

‘আপনার কি মনে হয়, আমি নেশাখর।’

অনু রাফাতের বুকে মাথা রাখায় রাফাতের সব রাগ যেন পানি হয়ে গেছে।
এই মেয়েটা যেন প্রতিমুহূর্তে পরিবর্তন করে দিচ্ছে তাকে।
কাছে আসলেই সব ভুলে যেতে ইচ্ছা করে তার। পরম আবেশে আপন করে নিতে মন চায়। হৃদয় ভয়ঙ্করভাবে আকর্ষন করে অনুকে।

রাফাত বুঝতে পারছে অনুকে কেউ মদ খাইয়েছে।
কিন্তু অনুর মতো একজন শিক্ষিত মেয়ে অ্যালকহল বুঝতে পারবে না
তা কি করে হয়? রাফাত বুঝতে পারল কোনো খাবারের সাথে মেশানো হয়েছে যাতে বোঝা না যায়।

রাফাত অনুকে নিজের বুকের উপর থেকে সরিয়ে কাধ ধরে ঝাকিয়ে বলে উঠল,

‘অনু তুমি রাতে কি খেয়েছো?’

‘আমি তো রাতে খাইনি।’

এলোমেলোভাবে কথাগুলো বলল অনু।
রাফাত অনুর কথা বেশি একটা বিশ্বাস করতে পারল না।
কারন অনু এখন কি বলছে সেটা সে নিজেও জানে না।
এক প্রকার পাগল হয়ে আছে সে। না না পাগল না, পাগলি হয়ে আছে।

রাফাত কিছুক্ষন চুপ থেকে আবার অনুর দিকে দৃষ্টিপাত করল।
অনুকে জাপটে ধরে আছে সে। ছেড়ে দিলেই ধপ করে বিছানায় পড়ে যাবে অনু।
রাফাত অনুর কপালে লেপ্টে থাকা বেবি হেয়ার গুলো আঙুল দিয়ে সরিয়ে দিল।
অনু রাফাতের অনেকটা কাছে চলে আসলো। প্রায় গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে রাফাতের কাছে। অনুর এভাবে হঠাৎ এগিয়ে আসাতে
রাফাত একটু অবাক হলেও তা প্রকাশ করল না। রাফাত ব্যাকুল হয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই অনু আঙুল দিয়ে চেপে ধরল রাফাতের ঠোটযুগল।

অনু ধীরে ধীরে নিজের মুখটা কাছে নিয়ে গেল রাফাতের।
অনুর ব্যবহার অতিরিক্ত অবাক করে দিচ্ছে রাফাতকে। অনু রাফাতের মাথা
একটু কাছে রাফাতের ঠোটের সাথে তার ঠোট যুগল মিশিয়ে দিল।
রাফাত হতভম্ব হয়ে গেল অনুর এমন কাজে। মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল সে।
অনুর হাত রাফাতের বড় বড় চুলের ভেতর লুকিয়ে রয়েছে।
কিছুক্ষন পর অনু রাফাতকে ছেড়ে দিল। আবার বুকের উপর ঢলে পড়ল সে।
রাফাত যেন বরফের মতো জমে গেছে অনুর ব্যবহারে। কোনোরকমে অনুকে আকড়ে ধরে আছে সে।

নিজেকে ধাতস্থ করতে কিছুক্ষন সময় লেগে গেছে রাফাতের।
অনুকে বিছানায় আস্তে করে শুইয়ে দিল সে। কিছুক্ষন আগের কথা মাথায়
আসতেই সারা শরীরে অদ্ভুত শিহরন বয়ে যাচ্ছে তার। অনু যে এত কিছু পারে তা রাফাতের জানা ছিল না।

একটু আগে ঘটে যাওয়া অনুর করা প্রত্যেকটা কাজের কোনোকিছুই চোখের অগোচরে যায়নি সায়মা আর কাকলি সরকারের।
দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সবকিছুই নজরে রেখেছিল তারা।
খেলার পাশা যে এভাবে উল্টে যাবে তা ভাবতে পারেনি কাকলি সরকার।
রাগে মাথার রগগুলো ফুলে উঠেছে তার। সায়মা ইতিমধ্যে তার ন্যাকা কান্না জুড়ে দিয়েছে।
আরেকটু হলে সে রাফাত আর অনুর ঘরে ঢুকেই যেতো তাদের বাধা দেওয়ার জন্য।
কিন্তু কাকলি সরকার কোনোভাবে সামলিয়ে নেয় সায়মাকে।
কাকলি সরকার এক রাশ ঘৃনা আর রাগ নিয়ে চলে আসলেন সেখান থেকে।
অনেকখানি পথ অতিক্রম করার পর তিনি তার আশেপাশে তাকিয়ে দেখলেন সায়মা তার পাশে নেই।
পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখলেন সায়মা এখনো দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে চোখের জলে ভাসছে।
কাকলি সরকার রাগ মিশ্রিত দীর্ঘশাস ফেলে সায়মাকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন তার ঘরে।
সায়মা ও কাকলি সরকার ঘরে প্রবেশ করতেই সায়মা উচ্চ স্বরে বলে উঠল,

‘এটা কি হলো খালামনি? তুমি দেখলে ও-ই মেয়েটা রাফাতকে কি করল?’

কাকলি সরকার চোখ গরম করে সায়মার দিকে তাকালেন।
সায়মা একটু ভয় পেয়ে মাথা
নিচু করে ফেলল। কাকলি সরকার কঠিন গলায় সায়মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘তুই তোর কান্না থামা বুঝেছিস? আমি মরছি আমার জ্বালায় আর তখন থেকে তুই ভ্যা ভ্যা করে কান্না করছিস।’

‘তো কি করবো? আর কিই বা করার আছে আমার।’

কাকলি সরকার সায়মার কথার কোনো প্রতিউত্তর দিলেন না।
তার প্রত্যেকটা প্যান এভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছেন তিনি।
নিজের ছেলের সাথে এক সেকেন্ডের জন্যেও অনুকে সহ্য করতে
পারছেন না তিনি। রাগে শরীর থরথর করে কাপছে তার।

রাফাত ফ্রেশ হয়ে আস্তে করে শুয়ে পড়ল অনুর পাশে।
অনু এলোমেলোভাবে শুয়ে আছে।
বিভোরে ঘুমাচ্ছে সে।
ডিম লাইটের আলোতে অনুর মুখটা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে।
রাফাত নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনুর দিকে।
মায়াজড়িত এ-ই মুখটা একটু ছুতে ইচ্ছা করছে তার।
রাফাত অনুর গাল দুটোয় ছুতে গেলেই অনু নড়েচড়ে উঠল।
অনুর আচমকা নড়াচড়ায় সামান্য চমকে যায় রাফাত যার কারনে ভয়তে হাত নিচে নামিয়ে ফেলে সে।
অনু ঘুমের মাতালে হঠাৎ রাফাতের বুকের উপর গিয়ে শুয়ে পড়ে। ঘটনার আকাস্মিকতায় চমকে যায় রাফাত।
হতভম্বিত হয়ে তাকিয়ে থাকে অনুর দিকে। অনু রাফাতের শার্ট শক্ত করে আকড়ে আছে। রাফাতের মনে হতে লাগল এক্ষুনি হয়তো শার্ট ছিড়ে ফেলবে অনু।
রাফাতের শ্বাস ধীরে ধীরে ঘন হতে লাগল। হৃদয় অদ্ভুতভাবে কম্পিত
হতে লাগল তার।গলা বারেবারে শুকিয়ে আসছে তার। শুকনো ঢক গিলে চোখ বন্ধ করে ফেলল রাফাত।

সকালে নিজেকে রাফাতের বুকে নিজেকে আবিষ্কার করে চমকে গেল অনু।
লাফ দিয়ে রাফাতের থেকে দূরে সরে গেল সে। রাফাতের ঘুম অতি পাতলা
তাই অনুর এভাবে হঠাৎ করে জেগে ওঠাতে ঘুম ভেঙে গেল তার।
চোখ মুখ কুচকে তাকিয়ে রইল অনুর দিকে। অনু বিষ্ফরিত চোখে তাকিয়ে আছে রাফাতের দিকে।
রাতে সে রাফাতের বুকে কি করে গেল সেটাই মাথাতে ঢুকছে না তার।

অনুর মাথায় হঠাৎ হালকা ব্যাথা অনুভব করল। মনে হতে লাগল কেউ যেন তার মাথার উপরে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। অস্ফুট ব্যথা করছে তার মাথায়। সব ব্যাথা উপেক্ষা করে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেল অনু। মনে মনে ঠিক করে রাখল সে যে বাইরে বের হয়ে কিছু কঠিন কথা শোনাবে রাফাতকে। তাকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেবে যে রাফাত যদি সোফায় না শুতে পারে তাহলে সে কষ্ট করে শুয়ে পড়বে। তবুও তার সাথে রক বিছানায় কিছুতেই থাকবে না সে।

ফ্রেশ হওয়ার পড়ে মাথা ব্যাথাটা যেন একটু কমে গেছে। মাথাটাও হালকা হালকা লাগছে এখন। ওয়াশরুম থেকে বের হতেই রাফাতকে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে আবিষ্কার করল সে। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে রাফাত তাকিয়ে আছে অনুর দিকে। রাফাতের এমন দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পারল না অনু। অনু রাগান্বিত সুরে বলল,

‘কি হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’

রাফাত অনুর এমন মেজাজ দেখে রাগে ফুলে উঠল। রাগে গজগজ করতে করতে বলল,

‘এই যে ম্যাডাম, আমাকে প্রশ্ন করা বাদ দিয়ে আগে আপনি বলেন কালকে রাতে আপনার কি হয়েছিল?’

অনু ভ্রু কুচকে তাকালো রাফাতের দিকে। কালকে রাতে আবার কি হয়েছিল তার? অনু কালকের রাতের কথা মনে করতে গিয়ে থমকে গেল। সাংঘাতিক চমকে গেল সে কারন কালকে রাতের কিছুই মনে নেই তার। সে বিছানায় কখন আসলো সেই কথাও মনে পড়ছে তার। অনু নির্বিঘ্ন হয়ে মনে করার চেষ্টা করছে কালকে রাতের কথা।

রাফাত অনুর চোখ দেখে বুঝতে পারল অনু কালকে রাতের কথা মনে করার চেষ্টা করছে। রাফাত এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল,

‘বুঝতে পেরেছি, কালকে রাতের কিছুই মনে নেই তোমার। যদিও আমি কখনো ড্রিংক করিনি কিন্তু আমি এটা খুব ভালো করেই জানি ড্রিংক করলে কারো কিছু মনে থাকে না। কালকে রাতে তোমাকে কিছু একটার ভেতর মদ মিশিয়ে খাওয়ানো হয়েছিল আর তুমি মাতাল হয়েগেছিলে।’

রাফাতের কথায় অবাকের চুড়ান্ত সীমায় পৌছে গেল অনু। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই বাইরে শরগোলের আওয়াজ পেল তারা। আওয়াজের সন্ধান করতে গিয়ে সিড়ির রেলিং ধরে উপরে দাড়ালো রাফাত আর অনু। আচমকা একজনের দিকে চোখ পড়তেই ঘৃনায় মনটা ভরে উঠল তার। রাগে চোখ রক্তবর্ণ ধারন করেছে অনুর। লোকটি অনুর দিকে তাকাতেই ঘৃনায় চোখ সরিয়ে নিল সে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে