সাত সমুদ্রের তিমির পর্ব-২৪

0
844

#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ২৪
#সুমাইয়া_আফরিন

রাফাত ধীর পায়ে নিচে নেমে গেল। আলি উদ্দিন চৌধুরি রাফাতকে দেখেই অস্ফুট আনন্দে জড়িয়ে ধরল তাকে। আলি উদ্দিন চৌধুরির জড়িয়ে ধরাতে যে রাফাত একদমই খুশি হয়নি তা রাফাতের মুখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। রাফাত দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আলি উদ্দিন চৌধুরি বুঝতে পারলেন তার ছেলে এখনো ক্ষমা করতে পারেনি তাকে। তিনি রাফাতকে ছেড়ে দিয়ে আনন্দভরা কন্ঠস্বরে বললেন,

‘কতোদিন পর তোকে দেখলাম রাফাত!বিশ্বাস কর অনেক খুশি হয়েছি তোকে দেখে।’

রাফাত বিরক্তি নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি এনে বলল,

‘কিন্তু আপনাকে দেখে নিজেকে খুশি করতে পারলাম না। অ্যানি ওয়ে, আপনাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চাই। আফটার অল ইউ আর মাই ফাদার মিস্টার আলি উদ্দিন চৌধুরি। সো আপনাকে তো ছেলে হিসেবে একটা সারপ্রাইজ দিতেই পারি রাইট?’

‘ইয়াহ, বাট সারপ্রাইজটা কি?’

রাফাতের মুখে ক্রুর হাসি। উপরে তাকিয়ে আঙুল দিয়ে একজন মেয়েকে দেখালো সে। আলি উদ্দিন চৌধুরি রাফাতের ইশারা মোতাবেক উপরে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলেন। এ কাকে দেখছেন তিনি?চোখের কোনো ভুল নয়তো?

আলি উদ্দিন চৌধুরি হা হয়ে তাকিয়ে আছে অনুর দিকে। অনু ঘৃনায় চোখ সরিয়ে নিল তার থেকে। গা ঘিনঘিন করছে অনুর। ~সকালে উঠেই যে এ-ই লোকটার মুখ দেখতে হবে তাকে তা কল্পনাতেই ভাবেনি সে।

রাফাত আলি উদ্দিন চৌধুরির মুখ দেখে বুঝতে পারল সে অনুকে এখানে আশা করেনি। হয়তো এখন অনেক সিনক্রিয়েট করবে আলি উদ্দিন চৌধুরি কিন্তু রাফাতকে হতাশ করে দিয়ে আলি উদ্দিন চৌধুরি বলে উঠলেন,

‘অনু মা, তুমি এসেছো? আমি তো আসার আগে আরো ভাবছিলাম এবার তোমাকে এই বাড়িতে এনেই ছাড়বো। যাই হোক, তোমাকে দেখে খুব খুশি হলাম।’

অনু ও রাফাত দুজনেই ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে আলি উদ্দিন চৌধুরির দিকে। এসব কি বলছেন তিনি? তিনি অনুকে এ-ই বাড়িতে আনতে চেয়েছিলেন?এটাও কি সম্ভব?

বাড়ির সবাই আলি উদ্দীন চৌধুরির কথায় আনন্দে লাফিয়ে উঠল। শুধু খুশি হতে পারল না সায়মা আর কাকলি সরকার। বরং আলি উদ্দিন চৌধুরির কথায় প্রচন্ড অবাক হয়েছে তারা। আলি উদ্দীন চৌধুরির থেকে এমন কথা আশা করেনি তারা।

অনু আলি উদ্দিন চৌধুরির কথা আস্তে করে কর্নগোচর করে রাফাতের রুমে হনহন করে চলে গেল। অনুর এভাবে চলে যাওয়াতে আলি উদ্দিন চৌধুরি বুঝতে পারলেন অনুর মনে মারাত্মক রাগ লুকিয়ে আছে। এ-ই রাগের পরিসীমা কত তা কেউ হয়তো পরিমাপ লরতে পারবে না যার কারনে আলি উদ্দিনের ভয় ক্রমশ বৃদ্ধি

অনু ঘরে ঢুকতেই নিজের ফপ্নের রিংটোন শুনতে পেল। তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই এক হাপানো সিস্টারের কন্ঠস্বর ভেসে আসলো তার কর্ণকুহরে। সিস্টারটি অসম্ভব ব্যাস্ততার সঙ্গে অনুকে বলল,

‘অনু ম্যাম তাড়াতাড়ি মেফিকেলে আসুন প্লিজ।’

অনু সিস্টারের এমন কথার অর্থ বুঝতে পারল না। এমন কি হয়েছে যে তার ডিউটির দুই ঘন্টা আগে তাকে ডাকা হচ্ছে?অনু উতলা হয়ে জিজ্ঞাসা করল,

‘কেন? কি হয়েছে?’

‘ম্যাম এখন কথা বলার সময় নেই। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন।’

সিস্টার সংক্ষেপে কথাটি বলে ফোন কেটে দিল। অনুর মাথায় হাজারো চিন্তা এসে তাড়া করতে লাগল। এক অজানা ভয় গ্রাস করতে লাগল তাকে। অনু শুকনো ঢক গিলে ব্যাগ থেকে একটি থ্রি পিছ বের করে ওয়াশরুমে চলে গেল।

ড্রেসিং টেবিকের সামনে দাঁড়িয়ে হন্তদন্ত হয়ে রেডি হচ্ছে অনু। রাফাত অনুর এত তাড়াতাড়ি রেডি হওয়াতে অনেকটা অবাক হয়ে গেল। কৌতুহলি কন্ঠস্বরে বলে উঠল,

‘অনু তুমি এত তাড়াতাড়ি আজকে মেডিকেলে যাচ্ছো কেন বলো তো? কিছু হয়েছে নাকি?’

‘কি হয়েছে সেটাই তো জানতে এত তাড়াতাড়ি যাচ্ছি মেডিকেলে।’

ব্যস্ততা নিয়ে কথাগুলো বলে উঠল অনু। রাফাত এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় বসে পড়ল। নিষ্পলক দৃষ্টিতে দেখতে লাগল অনুর ব্যস্ততাভরা তৈরি হওয়া। একজন ডাক্তার কতো পরিমান ব্যস্ত থাকে তার জীবনে! ব্যক্তিগত জীবনে কতোটুকুই বা সময় পায় পরিবারের জন্য!

অনু রেডি হয়ে বাড়ি থেকে বের হপ্যে গেল। রাফাত ড্রাইভারকে আগে থেকে বলে রেখেছিল যার কারনে অনু গাড়িতে করে হসপিটালে চলে গেল। হাসপাতালে যেতে অনু থমকে গেল। এত বড় মেডিকেলে কখনো এত মানুষের আনাগোনা দেখতে পায়নি যতটা আজকে দেখছে অনু। চারিদিকে মানুষের ছোটাছুটি আর কান্নার হাহাকার। কিছু মানুষ তাদের আপনজনদের মৃত শরীরের বুক জড়িয়ে কান্না করছে। কারো চেহারায় অস্বাভাবিক চিন্তা বিরাজ করছে। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তারা তাকিয়ে আছে আই.সি.ইউ এর দরজার দিকে। কখন ডাক্টর বেরিয়ে আসবে আর তখনই তার জানতে পারবে তাদের আপনজনের অবস্থার কথা।

সবকিছু দেখে নিজেকে পাগল মনে হতে লাগল অনুর। কিছুদুর তাকিয়ে দেখল ইরা, লারা আর মিমিও যোগ দিয়েছে সেই সব ডক্টরদের সাথে যারা নির্বিকার হয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করছে এত মানুষদের। হঠাৎ নিজের নাম কারো মুখে উচ্চারিত হতেই পাশে তাকিয়ে দেখল পারুলতা ডাকছে তাকে। অনু বড়বড় পা ফেলে ঢুকে গেল সেই ভয়াবহ রুমটায়। অনু বড় রুমটায় চোখ বুলিয়ে দেখল ৪০ জনেরও বেশি মানুষ মৃত্যুর সায়হে পাঞ্জা লড়ছে। এ-ই রকম অনেক রুমেই ৪০-৫০ জনের মতো মানুষ কাত হয়ে পড়ে আছে। অনু সময় নষ্ট না করে লেগে পড়ল মানুঢদের বাঁচাতে।

অনু খেয়াল করল সবারই অতিরিক্ত কাশি হচ্ছে। অনেকে আবার বমিও করে ফেলছে। বমির সাথে রক্ত বের হচ্ছে তাদের।ঢাকা মেডিকেলের প্রত্যেকটা ডক্টর আপ্রান চেষ্টা করছে সব মানুষদের বাঁচানোর কিন্তু অধিকাংশ মানুষই প্রান হারাচ্ছে তাদের।

সারাদিন অনেক ধকল গেছে অনুর উপর দিয়ে। রোগীদের জন্য দৌড়াতে দৌড়াতের ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। প্রায় রাত দুইটা বাজে এখন। হসপিটালের কেবিনে বসে একটু শ্বাস নিচ্ছে সে। হাসপাতালে এখনো মানুষদের শোরগোল হচ্ছে। অনুর ঠিক পাশেই একজন মহিলা চোখের পানি তার অসুস্থ স্বামীর জন্য ব্যয় করছেন।

অনুর আর এইসব ভালো লাগছে না। হঠাৎ এভাবে প্রায় দুই হাজার মানুষের অসুস্থ হয়ে পড়া অস্বাভাবিক লাগছে তার কাছে। দুপুরের দিকে পুলিশ এসেছিল মেডিকেলে। তারা জানতে পেরেছে অসুস্থ সব মানুষেরাই ইসলাম কম্পানির কর্মচারী ছিল। ইসলাম কম্পানির মালিককে এখনো ধরা যায়নি। সব থেকে অবাক করা বিষয় হলো ইসলাম কম্পানির মালিককে কেউ চেনে না।

সব কর্মচারী এতদিন যাকে মালিক ভেবে এসেছিল সে আসল মালিক নয়, আসল মালিক অন্য কেউ যার পরিচয় কেউ এখনো জানতে পারেনি। যে লোকটা মালিক ছিল সে বিষ খেয়ে নিজের প্রান ত্যাগ করেছে।

হঠাৎ অনুকে ডক্টর মুগ্ধ ডাক দিয়ে বলল,

‘অনু চলো, সব ডক্টরদের নিয়ে মিটিং বসেছে।তোমাকে ডাকছে তনয় স্যার।’

অনু হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল মিটিং এ। একটা চেয়ারে বসে আছে একজন সিনিয়র ডক্টর। তিনিই সবাইকে ডাক দিয়েছেন। সবাই উপস্থিত হওয়ার পরে তিনি বলতে শুরু করলেন,

‘ইসলাম কম্পানির যে দুই হাজার শ্রমিক আমাদের মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিল তাদের মধ্যে প্রায় অনেককেই আমরা বাঁচাতে পেরেছি আবার অনেককেই পারিনি। সবার মধ্যেই বিষাক্ত ধরনের বিষ পাওয়া গেছে যা সাধারনত ডিটার্জেন্টে ইউজ করা হয়। এত বিষাক্ত একটা বিষ সবার শরীর থেকেই আমাদের বের করতে হবে। সব মানুষদের বাঁচাতে হবে আমাদের কারন সবাই আমাদের উপরই ভরসা করে আছে। তাই আশা করবো আপনারা সবাই আপ্রান চেষ্টা করবেন।’

আরো অনেক গুরত্ত্বপূর্ণ কথা বলে মিটিং শেষ করলেন তিনি। বাইরের হসপিটাল থেকে আরো অনেক ডাক্টার এসেছে যার কারনে অনুকে সাময়িকভাবে দায়িত্ব থেকে অব্যাহত দেওয়া হয়েছে। মাত্র চার ঘন্টার সাময়িক বিরতিতে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল অনু। গোসল করে খাওয়া দাওয়া করে আবার চলে আস্তে হবে তাকে।

প্রায় রাত তিনটা বাজে। অনু বাড়ির ডুবলিকেট চাবি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। বিদঘুটে অন্ধকার বিরাজ করছে বাড়িতে। সবাই বিভোর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। অনু নিশব্দে উপরে চলে গেল। উপরে যেতেই একটা বিষয় তাকে অবাক করে দিল। বাড়ির সব লাইট অফ কিন্তু একটা ঘরে এখনো লাইট জ্বলছে। অনু ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ঘরটার দিকে। ঘরের সামনে গিয়ে দরজা হালকা করে সরিয়ে দিতেই রাফাত আর আলি উদ্দিন চৌধুরিকে দেখতে পেল অনু। যেই রাফাত তার বাবাকে গত সাত বছর ধরে বাবা বলে ডাকেনি আজ সে তার বাবার সাথে কি এমন কথা বলছে তাও আবার এত রাতে। বিষয়টিকে হালকাভাবে নিতে পারলো অনু যার কারনে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল সে।

বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ রাফাতের কন্ঠস্বর পেল অনু। নিজের সমস্ত মনোযোগ লাগিয়ে দিল সেই কথায়। রাফাত উচ্চস্বরে বলছে,

‘তুমি একদম চিন্তা করো না বাবা। অনু কিচ্ছু করতে পারবে না তোমার। আর তুমিই যে ইসলাম কম্পানির মালিক তাও কেউ জানতে পারবে না। সমস্ত ব্যাবস্থা করে রেখেছি আমি।’

‘কিন্তু রাফাত অনু কি এত সহজে ছেড়ে দেবে নাকি?’

‘বাবা এত কেন চিন্তা করছো তুমি? অনু এখন আমাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। আমি ওর বিশ্বাস সম্পূর্ণ অর্জন করে ওর থেকে রেকর্ডিংটা নিয়ে নেবো। তারপর ছুড়ে ফেলে দেবো ওকে। এমন হাল করবো যে, দ্বিতীয়বার আর এ-ই বোধশক্তিটাও থাকবে না যে ওর সাথে কি হচ্ছে। তিলে তিলে মারবো ওকে। ওর সাহস কতো বড়! ও রাফাতের বাবাকে জেলে পাঠাতে চায়।’

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে