সতীনকাঁটা পর্ব ৩

0
1042

#সতীনকাঁটা পর্ব-৩
লেখায়ঃ(Nosrat Monisha)

-ফহিন্নির মত কাফর(কাপড়) পিইন্দা আছো যে ছোড বউমা। এক্ষণ পাড়াত্তে বেবাকতে(সবাই) আইয়া পড়বো। হেরা তুমারে এমুন কাফরে দেকলে বাড়ির মান-ইজ্জত থাকবো?।
এসব বলে তানজিনাকে ঝাড়ছিল রেহেনা খাতুন।

তানজিনার অপরাধ সে রান্না-বান্না শেষ করে এখনো ভালো কাপড় পরে তৈরি হতে পারে নি।

-পাড়ার মানুষ তো আর আমাকে দেখতে আসবে না। আপনি চিন্তা করবেন না মা,আমি ঘর থেকে বের হবো না ।

-তুমি চাইতাছোডা কি হাছা কইরা কও দেহি। বেবাকতের সামনে খান বাড়ির ইজ্জত ডুবাইতে? নাইলে ঘররেত্তন বাইর অইবা না কেরে?

-এখানে ইজ্জত ডুবানোর কথা কেন আসছে মা? পাড়ার মানুষ নতুন বৌ দেখতে আসবে, আমি ঘরের ভিতরে থাকলাম না বাইরে থাকলাম তাতে কি যায় আসে?

-শিক্ষিত অইয়্যা মুরুখ্যের লাহান কতা কইয়ো না।
তুমি ঘরে খিলি দিয়া বইয়্যা থাকলে বেবাকতে কইবো আগের বউরে বেজার(অখুশি) কইরা খান বাড়ির পোলায় নতুন বউ আনছে।

-এটাই তো সত্যি মা।আমি তো আপনার ছেলের এই বিয়েতে খুশি নই।

-তুমার খুশি-বেজারে আমার কিছু আইয়্যে যায় না। তয় পাড়ার লোহের(মানুষের) কতায় বহুত কিছু আইয়্যে যায়। গেরামে আমরা(আমাদের) বাড়ির একটা ইজ্জত আছে। তুমি ঘরে বইয়্যা থাকলে মাইনসে কইবো খান বাড়ির মানু(মানুষ) বালা না, বউরে দুক(দুঃখ) দেয়।

নতুন বৌকে সাজিয়ে নিজের ঘরে যাচ্ছিলো সানজিদা। তখনই তার চোখ শ্বাশুড়ি-বউয়ের তর্ক চোখে পড়ে।

তাই সানজিদা সেখানে গিয়ে ফোঁড়ন কাটে,
-কারে কি বুজাঈন আম্মা। তানজিনা আফা যুদি বাড়ির মান-ইজ্জতের কতা চিন্তা করতো তয় কি ভাইগ্যা বিয়া বইত? আগে বাফের(বাবার) বাড়ির ইজ্জত ডুবাইছে অহন হঊর বাড়িরটা ডুবানের লাইগ্যা চেস্টা-চরিত্তি করতাছে।

-তা যা কইছো বড় বউমা। তয় তুমিও কান খুইল্যা হুন ছোড বউমা এইডা তুমার বাফের বাড়ি না হঊর বাড়ি। হেই বাইত যা করছো তা এই বাইত করন যাইবো না।অহন যাও তুমার মামা হঊরে যেই লাল শাড়ি কাফরডা দিছিন হেইডা পিইন্দা আহ। লগে এড্ডু সন্নও(স্বর্ণ) পিইন্দ। এমুন বিধবার লাহান আইয়ো না।

তানজিনা আর সেখানে দাঁড়ালো না কারণ এ বাড়িতে যখনই সানজিদা আর রেহানা খাতুন একসাথে হয়েছে তাকে অপমান করেছে। কখনো পড়াশোনা, কখনো তার ঘরের কাজ না পারা নিয়ে, কখনোবা তার শ্যামলা রঙ নিয়ে।
এমন না তানজিনা প্রতিবাদ করে নি।

কিন্তু সব প্রতিবাদের মন্তব্য এসে দাঁড়াতো,
যে মেয়ে নিজের মা-বাবাকে আঘাত দিয়ে দুই দিনের পরিচয়ে, একটা ছেলের সাথে পালাতে পারে, সে কিছুতেই ভালো হতে পারে না।

তানজিনা ঘরে এসে শাড়ি বদলাচ্ছে। আর ভাবছে,
আমার কি দোষ? এই পালিয়ে বিয়ে করেছি।
এই একটা ভুলের জন্য সবসময় সবাই কথা শুনায়। শ্বশুর বাড়ির লোকেরা মা-বাবা তোলে গালি-গালাজ করে।
প্রতিবাদ করে কি পেয়েছি মাঝপথে পড়াশোনা থামিয়ে দিয়েছে তারা।
অথচ এই আজুয়াদের বাবাই আমার আব্বুর হাতে ধরে ওয়াদা করেছিল আমি যতদিন পড়তে চাই তারা পড়াবে।
আমার পড়া বন্ধ করে দেওয়ার পর যখন বাবা আর চাচা এসেছিল আমার শ্বশুরকে বোঝাতে তখন উনি বলেছিল,
বেয়াই বউ মানু ঢেঙ ঢেঙ কইরা রাস্তা দিয়া কলেজ যাইবো বালা দেহায় না। আর আমনের(আপনার) মাইয়্যারে তো কোনো কিছুর অবাবঅ(আভাবে) দেই না। অত পইরা কি অইব। এছাড়া হের মন তো ঘরের কামে কম কিতাবো বেশি থাহে।
আমার বাড়ির বউ ঘরে থাকবো কাম করবো, খাইবো, আইবোদ(বাচ্চা) পালবো। হেয় আর কলেজ যাইবো না, এইডা শেষ কতা।

না সেদিন আমার বাবা-চাচা প্রতিবাদ করতে পারে নি। মাথা নিচু করে এ বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো।
একবারও বলে নি চল তানজিনা, শুধু রান্না করা আর বাচ্চা মানুষ করার জন্য এ বাড়িতে তোর থাকতে হবে না।
তুই আমাদের বাড়ির মেয়ে কোন কাজের লোক বা বাচ্চা জন্ম দিয়ে লালন-পালনের যন্ত্র না।
আচ্ছা আমি যদি পালিয়ে বিয়ে না করতাম, যদি বাবার পছন্দে বিয়ে করতাম তাহলেও কি তারা আমাকে না নিয়ে এভাবে চলে যেতে পারতো?

এসব ভাবতে ভাবতে গয়না পড়তে লাগলো তানজিনা।
যখন হাতে চুড়ি পরবে তখন সেদিনের কথা মনে পড়লো যেদিন শ্বাশুড়ি এই চুড়ি নিয়েও তাকে কথা শুনিয়েছিলো।

একটু দেরি করে ঘুম ভাঙায় চুড়ি আর গলার চেইন না পরেই কাজ করছিল তানজিনা।
হঠাৎ আজুয়াদ এসে পানি খেতে চায়।সে স্বর্ণ পরে ঘুমাতে পারে না অস্বস্তি হয়।
তানজিনা পানি এগিয়ে দিলে তার শ্বাশুড়ি হাত থেকে গ্লাস ফেলে দেয়।
-বলি আমার পোলাডারে অসুকে(রোগে) ভুগাইতে চাও?
-মা আমি এমন কেন চাইবো? আর আপনি গ্লাসটা কেন ফেলে দিলেন?
-অ তুমি বুজ নাই ফিডার খাও। তোমার মায় কি শিহাইয়্যা (শিখিয়ে) হঊর বাইত পাডাইছে? এহেনিও(এতটুকু) জানো না খাইল্যা আত আর খাইল্যা গলায় সোয়ামীরে দানা-পানি দিতে নাই। হের অসুক অয়।

সামান্য একটা কারণে মা তুলে কথা তানজিনার ভাল লাগে নি।
তাই সে জবাব দেয়,
-মা এগুলো কুসংস্কার। কোন হাদিসে কিন্তু এসব লেখা নেই।
-অ-মায়া-মায়া-গো (বিশেষ বিলাপ) দুই দিনের মাইয়্যা আমারে কুরান-আদিস শিহায়। ও আজুরে, তুই কইত্তে আনছোস এইডারে?

সেদিন আজুয়াদ কিছু বলেনি তার মা’কে।

রাতে যখন তানজিনা তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করেছিল ;তখন আজুয়াদ জবাবে বলেছিলো,
-তুমি এসব ছোট-খাটো বিষয় নিয়ে ঝামেলা না করলেই পারো। মা’তো অনেক বড়ো কিছু করতে বলে নি, শুধু গহনা পরে থাকতে বলেছে। তাছাড়া গহনাতে তোমাকে বেশ সুন্দর লাগে।

অসাবধানতা বশত একটা কাঁচের চুড়ি ভেঙে তানজিনার হাত কেটে যায়। আর সে বর্তমানে ফিরে আসে।
তারপর রক্তটা মুছে একবার আয়নার দিকে তাকায়। তানজিনার মনে হয় নিজের প্রতিচ্ছবিটাও আজ তাকে দেখে হাসছে৷

বাজারে বাবুর্চি ঠিক করে বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরছে আমজাদ খান আর আজুয়াদ।

অনেকক্ষণ যাবত সাহস সঞ্চার করে আজুয়াদ কথাটা বলেই ফেলে,
-আব্বা আমি রাফিয়াকে তালাক দিবো৷

আমজাদ খান খুব বিজ্ঞ লোক। ছেলের মনোভাবটা সহজেই ধরে ফেললেন। তাই মাথা খাটিয়ে বলেন,
-তর বউ তুই তালাক দিবার পারস। তয় তালাক দিলে দুনো বউরে দেওন লাগবো।

-আব্বা এ কেমন কথা। তানজিনার কি দোষ? সে কেন সতীনের সংসার করবে?

-দুশ তো রাফিয়ারও নাই। যা দুশ সব তর। বউয়ের লাইগ্যা এত পীরিত আগে কই আছিন?

আজুয়াদ কোন জবাব দিতে পারলো না।

আমজাদ খান আবার বলে,
-খান বাড়ির পুরুষ মাইনসে দরহার অইলে চাইড্যা(চারটা) বিয়া করে, কিন্তুক তালাক দেয় না। আর তুই বউ খেদাবি (তাড়াবি) আমি বাইচ্যা থাকতে হেইডা অইবো না। দুই বউয়ের লগে বালা ব্যবার(ব্যবহার) কর দেকবি সব ঠিক অইব। সবতে(সবাই) সব মাইন্যা নিবো।

আজুয়াদ কোন কথা বলতে পারলো না,কোনদিনই পারেনি।
তাছাড়া বাবার সামনে কথা বলতে পারলে আজ তার অবস্থা এত করুণ হতো না।


এদিকে খান বাড়ির বসার ঘরে পাড়ার সব মহিলারা ভিড় জমিয়েছে।
নতুন বউ তার উপর ছেলের আগে একটা বউ আছে তাই ভিড়টা একটু বেশিই।সবাই আসলে নতুন বৌ দেখতে না পুরাতন বউয়ের কষ্ট দেখে মজা নিতে এসেছে।

-কিগো আবরারের মা আগের বউ পছন অয় নাই দেইখ্যা পোলারে আবার বিয়া করাইয়্যা দিলা?

-কি যে কন সালেহা ভাবী আমার পোলারে তো চিনেন। হেয় হের মজ্জি(মর্জি)মত বিয়া করছে। আগেরডাও অহেনরডাও।

-তা তুমার ছোডু বউ রাজি আছিন নি সোয়ামীর বিয়াত।

রেহানা খাতুন জানতো এই প্রশ্নটা উঠবে তাই তিনি এর উত্তর আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন।
-সোয়ামীর খুশিতেই ইস্তিরীর খুশি। আমার ছোড বউমা উচ্চ শিক্ষিত এইসব ভালা জানে বুজে। দেহেন না নতুন বউয়ের লগে কি সৌন্দর বইনের লাহান বইয়্যা রইছে। আইজকার বেবাক রান্নাও হেয়ই করছে।

সালেহা মুখ পানসে করে বলে,
-বালা অইলেই বালা।

এতক্ষণে রেহানা খাতুনের চাল বুঝতে পারলো তানজিনা। তাকে দিয়ে রান্না করানো, সাজিয়ে নতুন বউয়ের সাথে বসানো এসব করেছে তার শ্বাশুড়ি শুধু সবাইকে এটা বুঝাতে যে আজুয়াদ প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে বিয়ে করেছে।

তানজিনার ইচ্ছে করছিল চিৎকার দিয়ে দাঁড়িয়ে বলতে আমি এ বিয়ে মানি না। কিন্তু বলে কি হবে কয়েকজন মজা পাবে, কয়েকজন দুঃখ প্রকাশ করবে। একসময় সবাই এক হয়ে তাকে নিয়ে গল্প করবে।

সবশেষে প্রমাণ হবে, নিশ্চয়ই তানজিনার মধ্যে তার স্বামী খারাপ কিছু পেয়েছে তা না হলে তার স্বামী কেন দ্বিতীয়বার বিয়ে করবে।এটাই সমাজের বাস্তব চিত্র।
একসময় সবাই চলে গেলো।

তানজিনা ঘরে চলে গেলো।
সন্ধ্যার পর আফিয়া এসে বলে তাকে রেহানা খাতুন ডাকছে।

ঘরে যেতেই তার শ্বাশুড়ি বলে,
-আইছো, এদিকে আহো। আমার কাছে বহো।
শ্বাশুড়ির এমন ভাল ব্যবহারের কোন কারণ খুঁজে পেল না তানজিনা। তাও গিয়ে পাশে বসলো।

তানজিনার শ্বাশুড়ি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে,
-মায়াআ(মা) আমি বুজি তর খারাফ লাগতাছে। কি করবি ক। যা অওনের তা তো অইয়্যাই গেছে।
এড্ডু মানাইয়া ল। তোরে একখান কতা কই হুনবি?

মাথা নেড়ে সায় দেয় তানজিনা। বিয়ের পর আজ প্রথম তার শ্বাশুড়ি তার সাথে ভাল ব্যবহার করছে,স্নেহ করছে। কিছু সময়ের জন্য তো সে সব দুঃখই ভুলে গেলো।

-তুই আজুরে এড্ডু বুজা, ছোট্টু মাইয়্যাডারে ঘরেত্তন বাইর কইরা দিছে৷ নতুন বউয়ের লগে কেউ এমুন করে? তুই ওর ঘরে যা গিয়া কবি তোর এই বিয়ায় কুনো আপত্তি নাই।

আবার ধোঁকা পেল তানজিনা। বুঝলো এ স্নেহ তার জন্য না রাফিয়ার জন্য।
কিছু না বলে চোখের পানি নিয়ে শ্বাশুড়ির ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

তানজিনা দেখতে পেলো রাফিয়া সেজেগুজে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের পানিতে তার কাজল মুছে যাচ্ছে।

তানজিনা যেন নিজেকেই অন্যরূপে দেখতে পেলো। কারণ একইভাবে একদিন সেও দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। এ বাড়ির কেউ তাকে মেনে নিতে পারে নি বলে।

আজ রাফিয়ার সাথে বাড়ির সবাই তাও সে ঘরে যেতে পারছে না কিন্তু কেন? তাকে যদি এমন কষ্টই দিবে তাহলে বিয়ে কেন করেছে আজুয়াদ?

শ্বাশুড়ির কথায় গলে গিয়ে নয় এইসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আজুয়াদের দরজার কড়া নাড়লো তানজিনা।

ভেতর থেকে আজুয়াদের চিৎকার করা গলা শুনা গেলো,
-আবার যদি কেউ আমাকে ডাকে তাহলে আমি গলায়দড়ি দিবো।
তানজিনা একটু জোরেই বলে,
-আমি তানজিনা।

একটু পর খট করে আওয়াজ হলো এবং দরজা খুলে গেলো।

-চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে