সংসার পর্ব-০৩

0
979

#সংসার(০৩)
#তাহরীমা

“সবার ভাত খাওয়া শেষে তনুর জন্য অবশিষ্ট যা ছিল তাই খেয়ে চুপ করে থাকলো।সবাই যে যার মতো ঘুমিয়ে গেলে তনু সব গুছিয়ে তারপর নামাজ পড়তে গেলো।নামাজ শেষ করতে করতে আবার কিছুক্ষণ পর বিকেলের চায়ের সময় হয়ে গেলো।

—–

“কিছুদিন পর তনুর বর বিদেশে চলে গেলো।তনু একেবারে একা হয়ে গেলো।সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকে।আর শাশুড়ির বকা তো আছেই।

তনুর দুই দেবর একটা কাজ ও করেনা।এতদিন তনুর বর ই বাজার যা যা করা লাগে করতো।কিন্তু দেবরদের বাজারে পাঠালে আগে পকেট ভর্তি টাকা লাগতো তারপর বাজার কোনোমতে নিয়ে আসতো।

ধান চাষের দিনে তাদের পাঠানো যেত না যদিও লোক রাখতো চাষের জন্য তারপর ও যদি যায় তবে তনুর থেকে শরবত এনে ওদের কে পাকা দিয়ে বিছিয়ে খাওয়াতে হতো। তারপর অন্য কাজে যেতে পারতো।

তনুর শশুড় যতেষ্ট ইয়ং ছিলেন,তাও একটা লুঙ্গি ও তিনি ধুতেন না সব তনুর জন্য রেখে দিতেন।সংসারের সব কাজ করে আবার সবার কাপড় চোপড় ধুতে হতো।অতিরিক্ত গরমে তনু একটু ফ্যান চালিয়ে ঘুমাতে চাইতো।তনুর দেবর অথবা শাশুড়ি এসে ফ্যান টা বন্ধ করে দিতো।এতে জিজ্ঞেস করলে বলত-

–ফ্যান এর হাওয়া লাগলে মোটা হয়ে যাবে,তাই।নয়ত অনেক বিল আসবে তো।

“তনুর জবাব দেয়ার সাহস ছিল না যে,আমার বরের টাকাই তো সব হচ্ছে।অথচ ওরা সারাদিন ফ্যান চালিয়ে বসে থাকতো।

“কোনো ভিক্ষুক আসলে তনুর শাশুড়ি কাউকে কিছু দিতে চাইতো না।মোটকথা কারো খাবার খাওয়া তিনি পছন্দ করেন না।তবে তার বড়মেয়ের বেলায় উলটা সব।তনুর ননাস বাড়ি আসলে যত্নের কমতি রাখেন না।বড় বড় মাছ কিনে এনে খাওয়াতো।তার উপর ঘরের ভাল ভাল সব জিনিস তাকে দিয়ে দিত।তনুর কপালে কিছুই জুটতো না।

তখনকার সময়ে মোবাইল ফোন ছিল না।চিঠির মাধ্যমে ই যোগাযোগ হতো,যদি কখনো তনুর বর চিঠি পাঠাতো শাশুড়ি আগে পড়তো হ্যা শাশুড়ি বাংলা পড়তে পারেন।পড়ে তারপর চিঠি টা তনুকে দিতো।বোকা তনু এসব জানতো ই না।

“তনুর বর বিদেশ থেকে ব্যাগভর্তি জিনিস পাঠাতো কিন্তু তনুকে কিছুই দিতো না বরং প্রায় সব ননাস তার শশুড় বাড়িতে নিয়ে যেত।কারণ ননাসের জামাই বেকার ছিল তনুর বরের টাকায় তাদের সংসার চলতো,প্রায় সময় তারা বাড়িতেই থাকতো।একটু অসুখ হলে তনুকে ই সেবা করতে হতো এত কাজ করেও তাদের চোখে পরতো না।বরং কোনো মানুষ আসলে শাশুড়ি শুনিয়ে শুনিয়ে বলতো-
“এ আর কি কাজ সামান্য রান্নাবান্না ই তো করে বউ,কই আমার কি মাথা আছড়ায় দেয় নাকি?

“এসব কথায় তনুর চোখ দিয়ে অনবরত বৃষ্টি ঝরে পরতো।এরই কয়েকদিন পর তনুর আরো ছোট দুইবোনের বিয়ে হয়ে যায়।বিয়েতে তনুর শাশুড়ি তেমন কোনো গিফট না দিলেও সবাই গিয়ে ইচ্ছেমত খেয়ে আসলো সাথে বদনাম তো রয়েছেই।তনুর ননাসের জামাই খালি শাশুড়ি আর তনুর বর কে নিন্দা করতো তনুর নামে,এতে সবার একটা ভুল ধারণা থেকে যায় যে- তনু খারাপ।

“দুই দেবর অত্যন্ত রাগিমেজাজের ছিল।তারা যা চাই তাই করতো, একজনে আয় করে সবার তখন দেমাগ বেড়ে গেছিলো।অথচ তনুকে তো দেখেশুনে ই বউ করে এনেছে তার তো অপরাধ থাকার কথা না?

“একটা সাবান অনেকদিন ব্যবহার করতে হতো সাবানের ও জবাবদিহি দিতে হতো অথচ প্রতিবন্ধী ননদ টা দুইতিন বার করে গোসলে ব্যবহার করতো কিন্তু তাদের যে স্বাধীনতা ছিল তনুর তা ছিল না।কারণ সে মেয়ে নয় বরং বউ।কিন্তু সে কারোরর তো মেয়ে এমনকি শাশুড়ি নিজেও মেয়ে সেটা মস্তিষ্কে আসতো না।তনুর বর তনুকে কিছু টাকা দিতে চাইলে শাশুড়ি আপত্তি করতো-বউয়ের কেন টাকা প্রয়োজন হবে?আমরা কি খাওয়াচ্ছি পরাচ্ছি না?

“তনু বাপের বাড়ি গেলে মায়ের থেকে কিছু টাকা খুঁজে আনতো।সেগুলো জমা করে রেখে দিতো যদি কখনো প্রয়োজনে লাগে ব্যবহার করার জন্য,বোনদের নতুন বিয়ে হয়েছে তাদের তো দাওয়াত দিতে হবে,কিন্তু শাশুড়ি দিবে ই না তাই সে মায়ের টাকা গুলা দিয়ে নিজে দাওয়াত দিলো আর নাম করলো শাশুড়ির।কিন্তু এতেও তনুর ই দোষ এত দাওয়াত দেয়ার কি আছে?

“তনুর বর এত এত টাকা পাঠানো সত্ত্বেও ধারের অন্ত ছিল না শাশুড়ির।প্রায় দোকানে ধার করে রেখে আসতো আর তনুর বর দেশে আসলে সব শোধ করতো। মাস শেষ হওয়ার আগে ঘরের চাল শেষ হয়ে যেত আর তনুকে বলতো তার বাবার থেকে যেন টাকা নিয়ে আসে পরে শোধ করে দিবে।শাশুড়ির মান বাঁচাতে তনু মায়ের কাছে যেত টাকা আনতে বাবাকে শুনাতো না।কারণ বাবা যদি শোনে খুব রাগ করবে বরের উপর, বিদেশি জামাইকে মেয়ে দিয়েছে বাবার টাকা নিয়ে যাওয়ার জন্য তো নয়।তবে এসব কিছু তনুর বর জানতো না সব করতো শাশুড়ি নিজেই।কাজ করার জন্য তনুর সংসার হলেও কর্তৃত্ব করতো শাশুড়ি।

“কোনো এক বৃষ্টির দিনে তনুর হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো।তাকিয়ে দেখলো ঘরের টিন ফুটা হয়ে গেছে আর সেদিক দিয়ে সারা বিছানায় বৃষ্টি পরে ভিজে যাচ্ছে শাশুড়ি কে ডাকতে গেলে তারা সবাই রাতে আরামে ঘুমাচ্ছিল,তনু কোনোমতে হাড়ি,বাসন দিয়ে রাখলো বিছানায়।আর ঘুম হলো না।সকালে শাশুড়ি কে এটা বললে তিনি পাত্তা ই দিলেন না।এভাবে যতদিন বৃষ্টি পরতো তনু ঘুমাতো না তার চোখ দিয়ে ও অঝোরে বৃষ্টি গড়িয়ে পরতো।

“কিছুদিন পর তনু দেবরের সাহায্য নিয়ে উপরের টিন গুলা ঠিক করলো,নিজে নিজে ইট কিনে এনে একটা দেয়াল তৈরি করলো।শাশুড়ি খুব খুশি বউকে এরকম কাজ করতে দেখে।

দুইটা গরু ছিল,তনুর শাশুড়ি ই এদের দেখাশুনা করতো।পাশের ঘরের চাচি শাশুড়ি রা এসে বলতো-

–তোমার বয়স হয়েছে বউকে এত বসে বসে খাওয়াচ্ছ কেন?চাইলেই তো গরুর সব বউয়ে দেখাশোনা করতে পারে।

“তনু এবার চরম রেগে মহিলাকে বলল-

–ভাল কিছু বলতে না পারলে এসব খারাপ উপদেশ দিতে আসিয়েন না।বসে বসে খায় কিনা আল্লাহ জানেন।

“বউ কিভাবে এভাবে মুখের উপর কথা বলে?এ নিয়ে কথার শেষ নেই।যেন মনে হয় বউদের কথা বলার জন্য মুখ ই থাকতে নেই।সেদিন অনেক ঝগড়া হলো।তনু নিরবে চোখের পানি ফেলে কাজ করতে লাগলো।

ধুলাবালি ধোয়া কম সহ্য করতে পারতো বলে তনু সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চলতো।এ নিয়ে শশুড় বলতো-

–যতসব অসুখ শুধু তোমার কই আমাদের তো এমন হয় না।

“তনু একদম কিছুই বলতো না।বললে ই আবার ঝগড়া।ঝগড়া থেকে এড়িয়ে চলার জন্য কত প্রচেষ্টা তার।ননদ আর আর দেবর কে পড়াতে বসালে ওরা বলতো –

–আমাদের নিয়ে ভাবতে হবেনা,সব জানি আমরা।

“কোরআন শরিফের আদবকায়দা সম্পর্ক এ শিক্ষা দিতে গেলে শশুড় ডাক দিয়ে বলতো-

–কোরআন শরীফ উল্টালে ও সওয়াব।

“এরপর থেকে তনু এদের কারোর বিষয়ে কোনো কথা বলতো না।তাও একটা না একটা বিষয়ে শাশুড়ি বকা দিত প্রতিটাদিন।

“শীতের দিন আসলে তনুকে একটা শীতের জামা ও কিনে দিতো না।কারণ তাদের ধারণা বউদের শীত লাগতে নেই।একবার এক পুরনো শাল তনু পরেছিল বলে বাড়ির এক শাশুড়ি তনু কে বলল-ইসশ বউ হয়ে শাল পরে?জোয়ান বয়সে এত শীত কিসের?

তনু তখন বলে-

–আপনি কি জোয়ান বয়সে কাপড় না পরে থাকতেন নাকি?

“এটা শুনে মহিলাটি আবার শাশুড়ি কে এসব বলিয়ে বকা শুনায়।তনুকে পুরা বাড়ির মানুষ অপছন্দ করতে শুরু করে।

“ইদের সময় আসলে ঘরে কেউ আসতো না বসতো না।তনুর শাশুড়ি অপরিষ্কার ভাবে চলে যে সবাই জানে,এদিকে তনুকে ও পছন্দ না করায় বাড়ির কেউ আসতো না,আসলেও খাবার খেত না।সারাবছরে দুইটা শাড়ি পরতে পরতে একদম ছিঁড়ে গেছে তাও একটা শাড়ি কিনে দিত না ইদের জন্য।অথচ তনুর বাবা গরিব হলেও ইদে সব ভাইবোন কে নতুন জামা কিনে দিতো,সবাই ইদের দিন সেসব পরে আনন্দ করতো।আজ তার কপালে একটা ভাল শাড়ি ও জুটে না।তনুকে ইদের দিন শাড়ি কিনে না দেয়ার কারণ যাতে বাড়ির মানুষ পচাতে পারেন।বাড়ির অন্য বউরা তনুকে দেখিয়ে দেখিয়ে শাড়ি আর গহনার বাহার দেখাতো,তনু ছলছল চোখে এসব চেয়ে থাকতো।ইদের দু তিনদিন পর তাও সস্তা শাড়ি তনুর কপালে জুটতো।নতুন বছরে তনুর মা বাবা যে কাপড় পাঠিয়েছিল তনুর পছন্দ হলেও তনুর শাশুড়ি কত ব্যঙ্গ করেছিল কিন্তু নিজে তার চেয়ে খারাপ শাড়ি পরতে দিলো।

তনুর শাশুড়ির কতৃত্ব বেশি হওয়ার এক্টায় কারণ তিনি অনেক সম্পত্তির মালিক।তার বাবা তার নামে সম্পত্তি লিখে দিয়ে গেছেন,তাই তিনি তনু গরিব হওয়ায় মানুষ মনে করতেন না।আরো বলতেন-

–আমাকে অবহেলা করলে আমার অনেক সম্পত্তি এগুলা বিক্রি করেও সারাজীবন পা তুলে খেয়ে যেতে পারবো।

“সারাক্ষণ সম্পত্তি গুলো নিয়ে অহংকার করতো।আর বাড়ির মানুষ তাল মেলাতো।

“তনুর শাশুড়ি আবার পিঠা বানাতো ভালই।কিন্তু বানানোর সাথে সাথে খেয়ে ফেলতো,রাতদিন পিঠা ই খেত।তনু অবাক হয়ে চেয়ে থাকতো।মাঝেমাঝে তনুর থেকে ও পিঠা বানাতে হতো।তনু এই পিঠা বানাতো এই তারা খেয়ে শেষ করে ফেলত একটা ও তনুর জন্য রাখতো না।তনু এসব ব্যবহারে খুব কষ্ট পেতো।তাই একদিন বুদ্ধি করে তনু পিঠা বানাতে বানাতে কয়েকটা খেয়ে ফেলে,তনু জানে যে তার কপালে পিঠা জুটবে না।

“নতুন চালের ভাত রাঁধতে গিয়ে তনু পুড়িয়ে ফেলতো শাশুড়ির বকার ভয়ে ভাল সব তাদের খাইয়ে পুড়া সব তনু ই খেত।
——————

“এভাবে সংসার চলে তনুর।কিছুদিন পর তনুর বর আবার দেশে আসে।ততদিনে তনুর ছোটবোন দের বাচ্চা হয়ে গেছে।কিন্তু তনুর এখনো বাচ্চা হচ্ছে না।তনুর বাবা অনেক চিকিৎসা করালো,না কিন্তু তাও বাচ্চা হচ্ছে না।কিন্তু বাচ্চা না হওয়াতে শাশুড়ি খুশিই।তিনি একা রাজত্ব করতে পারছেন।তার মেয়ে জামাই নাত্নিরা সব নিতে পারছে,বাচ্চা হলে আরেকটা ভাগ বেড়ে যাবে এ ধারণা তার।কিন্তু বাচ্চা না হওয়াতে ও কথার শেষ নেই।তনু কে শুনিয়ে ই বলে-

–নিশ্চয় সে পাপী তাই তার বাচ্চা হচ্ছে না।

“তনু এসব শুনে জায়নামাজ এ কান্নায় ভেঙ্গে পরে।কোরআন শরীফ পড়তে বসলে ই আঘাতের কথা গুলা মনে পরে দম ফেটে কান্না আসে…….

চলবে…….

(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন,আর ভাল না লাগলে ইগনোর করুন,ধন্যবাদ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে