শ্রাবণ মেঘের ভেলা ৮ম পর্ব

0
1491

#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#৮ম_পর্ব

ঐন্দ্রিলার হঠাৎ কেনো জানে মনে হচ্ছে এক জোড়া সূক্ষ্ণ চোখ তাকে নিপুন ভাবে দেখে যাচ্ছে। কিন্তু বিয়ে বাড়িতে এত মানুষ কে দেখছে সেটা বুঝার কোনো উপায় নেই। ঐন্দ্রিলা ঠিক পাত্তা না দিয়েই দিশার কাছে চলে যাবার জন্য রওনা দিলো। হঠাৎ একটি বাচ্চা ছেলে এসে একটি টিস্যু ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– এটা তোমার জন্য আপু
– কে দিয়েছে তোমাকে এটা?

অবাক চোখে বাচ্চাটিকে প্রশ্ন করতেই বাচ্চাটি দৌড়ে চলে গেলো। টিস্যু পেপারটা খুব সুন্দর করে ফোল্ড করা এবং তাতে কিছু লেখা যা না খুলেও ঐন্দ্রিলা বুঝতে পারছে। মনে হাজার প্রশ্নের ঝুড়ি নিয়ে টিস্যু পেপারটা খুলতেই নীল কালির কিছু লাইন তার চোখে ভেসে উঠে। লাইন গুলো এরকম,
“বেগুনি রঙটা আগে ভালো না লাগলেও
আজ রঙটাকে অন্যরকম ভালো লাগছে
বড্ড আপন লাগছে
এখন আমি খুব কনফিউসড এটা রঙের জাদু নাকি তোমার”

লাইনগুলো পরে খানিকক্ষণ থম মেরে ছিলো, প্রথমত আজ সে বেগুনী কাতান শাড়ি পড়েছে। তাই চিরকুটটা তাকে পাঠানো হয়েছে সেটা বুঝাই যাচ্ছে। কিন্তু কথাটা হলো, কে পাঠিয়েছে। নিচে আসার পর থেকেই মনে হচ্ছিলো কেউ তাকে দেখছে, তারপর এই চিরকুট। মাথাটা কয়েক মিনিটের জন্য হলেও হ্যাং হয়ে গেলো ঐন্দ্রিলার। নিজের মনকে শান্ত করার জন্য বেশ করে বুঝালো এটা কেউ তার সাথে মজা করছে। অহেতুক এসব নিয়ে পরতে গেলে হলুদের মতো বিয়ের আনন্দ মাটি হয়ে যাবে। একে অভ্র নামক লোকটার জন্য হলুদে আনন্দ মাটি হয়ে গিয়েছিলো। এখন বিয়েতে নিজেকে কোনোভাবেই উত্তেজিত করতে চাচ্ছে না সে। তাই টিস্যু পেপারটা ছিড়ে পাশে থাকা ডাস্টবিনে ফেলে দিলো সে।

রাত ৯টা,
বিয়ের সব কাজ সম্পন্ন হবার পর এবার কনেকে স্টেজে আনা হয়েছে। বর কনের দম্পতিকে বেশ মানিয়েছে। ফটোগ্রাফার বিভিন্ন আঙ্গিকে তাদের ছবি তুলতে ব্যস্ত। স্টেজের এক পাশে বসে গভীর নয়নে পিউ এই কান্ডগুলো দেখছে। কোথাও যেনো তার স্মৃতিগুলো বেশ তাজা হয়ে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্মৃতিরগুলোই এখন তার সারা জীবনের বাঁচার খোরাকি। আচ্ছা, এমন ও হতে পারে আহাশ একদিন ঠিক ফিরে এলো, হতে পারে না! তাদের যে অপূর্ণ সংসারটা রয়ছে সেটা তখন সুন্দর করে সাজাবে পিউ, বিশ্বাসে নাকি মিলায় বস্তু। এই বিশ্বাসটা কি কখনো সত্য হবে না। একদিকে পিউ যেমন এক নজরে দিশাদের দেখে যাচ্ছিলো অন্যদিকে নীলাদ্রির নজর শুধু পিউকে দেখে যাচ্ছিলো। পুতুলের মতো একটা মেয়ে তার সামনে বসে আছে, কালো সিল্ক শাড়ি পরে আছে মেয়েটা, চুলগুলো সুন্দর করে খোপা করে রেখেছে, কানে শুধু এক জোড়া ঝুমকো। মেয়েটাকে কোনো ভাস্কর্যের নিপুন হাতের শিল্পকর্মের চেয়ে কম লাগছে না। তবে পিউ এর নজরের আক্ষেপ, হারানোর যন্ত্রণা, সুখ খুজে বেড়ানোর প্রচেষ্টাগুলো নীলাদ্রির নজর এড়ালো না। মেয়েটার না পাওয়ার পাল্লাটা এতোটা ভারী হয়ে আছে যে তা পাওয়ার মাঝে দিব্বি নিজেকে আটিয়ে নিয়েছে। একজন বন্ধুর সাথে কথা বলেছিলো নীলাদ্রি পিউ এর ব্যাপারে। বন্ধুটি শুধু একটা সাজেশন দিয়েছে, যদি সম্ভব হয় তবে যাতে আহাশের জায়গা পূরণ করার কোনো ওয়ে খোঁজা হয়। কিন্তু সমস্যা একটাই সেটা হলো পিউ আহাশের প্রতি এতোটাই সমর্পিত যে সে কাউকে সেটা করার সুযোগটুকু ও দিতে নারাজ। বিয়েটা শেষ হলে এব্যাপারে খালুর সাথে বিস্তারিত আলাপ করতে হবে নীলাদ্রিকে।

মালাবদলের মালা খুজে বেড়াচ্ছে ঐন্দ্রিলা, কোথায় রেখেছে মনে নেই। মালার খোঁজে এদিক থেকে ওদিক ছুটে বেড়ানোর সময় কারোর সাথে খুব জোরে ধাক্কা লাগে ঐন্দ্রিলার। মাথা তুলে তাকাতেই মেজাজটা একেবারে খারাপ হয়ে যায় ঐন্দ্রিলার। কারণ সামনের দাঁড়ানো ব্যাক্তিটি আর কেউ নয় অভ্র চৌধুরী। বলে না “যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়” আজ সত্যি সত্যি সেটা খাটে গেছে। এটার ভয় পাচ্ছিলো ঐন্দ্রিলা। লোকটার কথা চিন্তা করলেই যেখানে মাথায় আগুণ জ্বলে যায়, সেখানে লোকটা নির্লজ্জের মতো সামনে দাঁড়ানো। আজকের দিনটা গতদিনের মতো নষ্ট করতে চাচ্ছে না ঐন্দ্রিলা অভ্রকে টোটালি পাত্তা না দিয়ে পাশ কাঁটিয়ে চলে যেতে নিলে অভ্র বলে উঠে,
– প্রথমে যতটা সাহসী ভেবেছিলাম, এখন দেখছি তোমার মুখেই শুধু ফাপড়। আসলে তুমি আস্ত ভীতুর ডিম
– সরি?
– শুনলাম, আমার এক থ্রেডে নাকি জ্বর বাধিয়ে একাকার করে ফেলেছো!

অভ্রের টিটকারির স্বরের কথাগুলো শুনে চোখ কুচকে তার দিকে তাকায়। ঐন্দ্রিলার চোখ জ্বলজ্বল করছে, পারলে এখনই চিবিয়ে খায় অভ্রকে। ঠোটের কোনায় হাসির রেখা টেনে শান্ত গলায় বলে,
– আপনার নিজেকে এতোটা ইমপোর্টেন্ট মনে হয়? যে আপনার মত মানুষের কথায় আমি ভয় পাবো? আমি এখনো আপনাকে জবাবটা দেই নি কারণ আমি চাই না আমার জন্য আমার বোনের সবথেকে সুখময় দিনগুলোয় কোনো ব্যাঘাত ঘটুক।
– তাই বুঝি?
– আপনার মাথায় কয়টা শয়তান আছে বলুন তো?
– কিহহহ??
– মানে এই মাথা ভর্তি শুধু মানুষকে কিভাবে হেনস্তা করা যায় এসব না ভেবে ভালো কাজেও তো ইউজ করতে পারেন তাই না?
– যেমন?
– যেমন আপাতত আমার পথটা ছাড়লে বড্ড বেশি উপকার হতো কিনা! আপনার ফালতু কথার জন্য আমার সময় নষ্ট হচ্ছে। বিয়েতে এসেছেন কোথায় খাবেন দাবেন তা না আমার পেছনে হাত ধুয়ে পড়ে আছেন। সমস্যাটা কি?
– যদি বলি ভালোলাগে, যদি বলি আমার তোমার পেছনে লাগতে ভালোলাগে

অভ্রের কথায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও মাথা ফাকা হয়ে যায় ঐন্দ্রিলার। কি বলা উচিত তার জানা নেই। অভ্র ধীরে ধীরে ঐন্দ্রিলার দিকে এগোতে থাকে। তখনই পিউ এর আগমণ ঘটে সেখানে। সে মূলত এসেছিলো ঐন্দ্রিলাকে ডাকতে, মালা পাওয়া গেছে তাই।
– ভাইয়া আপনি এখানে কি করছেন?

পিউ এর কন্ঠস্বরে অভ্র খানিকটা দূরে সরে যায়। পিউ হঠাৎ আগমনে ঐন্দ্রিলাও ঘোর থেকে বের হয়। পিউ এর চোখের হাজারো প্রশ্ন দেখে আমতা আমতা করে অভ্র বলে,
– তোমাকে খুজছিলাম, আসলে আমি আর বাবা চলে যেতে চাচ্ছি। তাই ইনাকে জিজ্ঞেস করছিলাম তোমার কথা।

অভ্রের দাহা মিথ্যা কথায় হতবাক হয়ে চেয়ে আছে ঐন্দ্রিলা। একটা লোক এতো সুন্দর করে মিথ্যা কথা কিভাবে বলতে পারে? তার থেকে অবাক হচ্ছেন এটা ভেবে যে এই লোকটা পিউ এর পরিচিত। অভ্রের কথা শুনে পিউ বলে,
– ওহ আচ্ছা, আপনাদের তো পরিচয় হয় নি। ঐন্দ্রিলা উনি আমার বাসুর, আহাশের বড় ভাই অভ্র ভাইয়া। আর অভ্র ভাইয়া তো ওকে চিনেন ই আমার খালাতো বোন, ঐন্দ্রিলা
– আহাশ ভাইয়ের বড় ভাই উনি?

পিউ এর কথায় বেশ অবাক হয়ে প্রশ্নটি করে ঐন্দ্রিলা। তখন পিউ ব্যাখ্যা করে বলে,
– হ্যা, আসলে আমাদের বিয়ের সময় উনি দেশের বাহিরে একটা কাজে ছিলেন, তাই আসতে পারেন নি। আচ্ছা যেকারণে আসা, চল নিচে মালা পাওয়া গেছে। আর ভাইয়া চলুন, আমি বাবার সাথে দেখা করে আসি।
– চল যাওয়া যাক।

অভ্র দেরি না করে পিউ এর সাথে বেড়িয়ে গেলো। ঐন্দ্রিলা কিছুক্ষণ বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে ছিলো। লোকটার সাথে আহাশের কোনো স্বভাবের মিল নেই অথচ তারা নাকি দু ভাই। চট করেই মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো তার। এখন শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা। মনে মনে বললো,
– অভ্র চৌধুরী তুমি ঘুঘু দেখেছো ফাঁদ দেখো নি

১০.
রাত ১টা,
ছাদে দাঁড়িয়ে আছে পিউ। দিশার বিয়ে কমপ্লিট, সে তার শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। বাড়িটা কেনো জানে ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মামা-মামীর মনটাও ভালো নয়। দিশা মেয়েটার সাথে ছোট থেকে বড় হয়েছে সে। অথচ এখন আর মামাবাড়িতে তাকে দেখবে না পিউ। কারণ এখন তার আবাসস্থল তার শ্বশুরবাড়ি। আচ্ছা মেয়েদেরই কেনো এভাবে নিজের ঘর ছেড়ে অন্যের ঘরে যেতে হয়! হয়তো এটাই নিয়তির লিখন। মনটা আরেকটা কারণেও খারাপ। আজ শারমিন বেগম এবং আহানা বিয়েতে আসে নি। শারমিন বেগমের নাকি শরীর ভালো নেই। তবে পিউ এর খুব ভালো করে জানা আছে তিনি কেনো আসেন নি। হলুদের দিন যখন নীলাদ্রির সাথে পিউ কথা বলছিলো সেটা শারমিন বেগমের ভালো লাগে নি। পিউ যখন তার খাওয়ার পর তাকে হাত ধুবার জায়গায় নিয়ে যাচ্ছিলো তখন উনি বলেই বসেন,
– ভালোই তো আছো দেখি, অহেতুক তোমার শ্বশুরমশাই তোমাকে নিয়ে চিন্তা করেন। কেউ দেখলে বলবে তুমি বিধবা?

আচ্ছা এই বিধবা হলে কি জীবনে হাসতে মানা! নাকি জীবন বাঁচতে মানা! চোখ বন্ধ করে যখন পিউ কথাগুলো ভাবছিলো তখন…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে