#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#৪র্থ_পর্ব
– আচ্ছা একবার তো বলেছি আমি বিয়েশাদী করব না। কেনো বারবার একই কথা বলছেন? আমার জীবন নিয়ে আপনার না ভাবলেও চলবে।
অভ্রের কথাটা কোথাও না কোথাও বেশি কষ্ট দেয় শারমিন বেগমকে। তিনি তখন খুব শান্ত এবং ভারাক্রান্ত গলায় বলেন,
– জানি আমি তোমার আপন মা নই, তবে আমি কখনোই তোমাকে এবং আহাশকে আলাদা চোখে দেখি নি। অভ্র তোমার জীবনে আমার নাক গলানোর অধিকার নেই ঠিকই তবে নিজের নিজের ছেলের ভালো মন্দ দেখেও চুপ থাকাটা বোধ হয় কোনো মার ই উচিত নয়। আজ তোমার জায়গায় আহাশ থাকলেও এভাবেই তার ভালো মন্দের ব্যাপারে কথা বলতাম।
শারমিন বেগমের কথাগুলোতে সুপ্ত কষ্ট স্পষ্ট। অভ্রের কথায় তিনি কষ্ট পেয়েছেন এটা বুঝতে বাকি নেই অভ্রের। শারমিন বেগম এবং শওকত সাহেবের বিয়েটা খানিকটা নাটকীয়ভাবেই হয়। দুজন তাদের সন্তানের খাতিরে একে অপরকে বেছে নেন। অভ্র যখন দুই বছর বয়স তখন তার মা শুভ্রা বেগম তাকে ফেলে চলে যান। ছেলের এই বয়সে কিভাবে কি করবেন খুব দোটানাতে পরে যান শওকত সাহেব। তখন পরিবারের লোকেরা তার দ্বিতীয় বিয়ে শারমিন বেগমের সাথে ঠিক করেন। শারমিন বেগম এবাড়িতে বউ হয়ে আসেন তখন অভ্রের বয়স আড়াই বছর। অভ্রের যখন চার বছর তখন শুভ্রা বেগম তাকে নিজের কাছে নিয়ে যাবার জিদ ধরেন, কোর্টে অবধি টানা হ্যাচড়া হয় অভ্রকে নিয়ে। যার কারণে অভ্র জানতে পারে তার মা তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো এবং শারমিন বেগম তার আপন মা নয়। যদিও শারমিন বেগম কখোনোই অভ্র, আহাশ কিংবা আহানার মাঝে ভেদাভেদ করেন নি। তার যতটুকু তার সামর্থ্যে কুলিয়েছে ততটুকু ভালোবাসা সমান ভাবেই তিন বাচ্চার মাঝে সমানভাগে ভাগ করে দিয়েছেন। তবুও ছোট বয়েসের সেই আঘাত এখনো মেনে নিতে পারে নি অভ্র নিজের ভুল বুঝতে পেরে অসহায়ের মতো বলে অভ্র,
– ছোট মা আমি সেভাবে বলতে চাই নি, আমার জীবনে আপনার ততটুকু অধিকার আছে যা আমার আপন মা থাকলে তার থাকতো। আপনি খুব ভালো করে জানেন এই সম্পর্কের মারপ্যাচে আমি পড়তে চাই না। যেখানে আমার নিজের মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন সেখানে একটা অচেনা মেয়েকে কিভাবে বিশ্বাস করবো বলুন?
– তোমাকে কিছু কথা বলি বাবা, মনোযোগ দিয়ে শুনবে তারপরও যদি মনে হয় আমি ভুল তবে তোমার যা ভালো মনে হয় তাই করো। তোমার মা ভুল করেছিলেন, তিনি তার দু বছরের ছেলেকে ফেলে স্বার্থপরের মতো চলে গেছেন। কিন্তু সব মহিলা যে এরকম হবে তার কোনো মানে তো নেই। আর স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটার একটা লেয়ার নয়। ধাপে ধাপে এই সম্পর্কটা, আমাদের দেখো আমরা প্রথমে তোমার কারণে বিয়ে করেছিলাম। তারপর আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয় তারপর ভালোবাসার সম্পর্ক। এইজন্য বলছি তোমার ও একজন সঙ্গী প্রয়োজন জীবনে। ছাব্বিশ বছর অনেক কিন্তু তোমার মা যা করেছেন সেটার জন্য নিজের জীবনটাকে এভাবে নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। তুমি পিউ কেও দেখতে পারো, মেয়েটাকে আমার ভালো লাগে না ঠিকই কিন্তু মেয়েটা তার জীবনের আড়াই বছর আহাশের অপেক্ষায় পার করে যাচ্ছে। তাই বলছি সব মেয়ে একরকম হয় না।
শারমিন বেগমের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো অভ্র। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত ভাবে বললো,
– আমি ভেবে দেখবো ছোট মা, আপনি আপাতত ফুপিকে মানা করে দেন। আমার একটু সময় লাগবে।
– ঠিক আছে, তোমার সিদ্ধান্ত আমাকে পরে জানিয়ে দিয়ো।
– জ্বী। বাবা আমি উঠলাম, আমার খাওয়া শেষ।
বলে অভ্র নিজের রুমের দিকে চলে যায়। ভালোবাসা কিংবা স্নেহ ব্যাপারগুলো খু্বই ধোঁয়াশা লাগে অভ্রের কাছে। কোনো নারী তার দু বছরের বাচ্চাকে একা ফেলে যদি চলে যেতে পারে তার মত নারী আর যাই হোক মা শব্দের যোগ্য নয়। একারণে অভ্রের কাছে নারীর মুল্য শুধু চেকবইয়ের পাতাতেই সীমাবদ্ধ। অভ্রের কাছে মনে সব নারী কেবল টাকাকেই প্রাধান্য দেয়, যেমনটা তার মা দিয়েছিলো। তার বাবা যখন তার আপন মাকে টাকা দিয়েছিলো যাতে তার ছেলের আশেপাশে না আসে, তখন সে টাকা গ্রহণ করে এবং কেস উইথড্র করে। ব্যাপারটা তখন না বুঝলেও বয়স বাড়ার সাথে বুঝতে পারে। অতীত সত্যি কন্টকময়, আজ ছোট মা বিয়ের কথা না তুললে হয়তো এ কথাগুলো উঠতো না। বারান্দায় নিকোটিনের ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে এ কথাগুলোই ভাবছিলো অভ্র। আদৌও কি তার জীবনে এমন কেউ আসবে যে তাকে ভালোবাসবে, তার ভালো মন্দ মিলিয়ে তার সাথে জীবন কাটাবে। হয়তো আবার হয়তো না_____
০৬.
রাত দেড়টা,
ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে পিউ, নজর বাহিরের দিকে স্থির। মামু বাড়িটাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়েছেন। পুরো বাড়ি নীল আর সাদা মরিচ বাতির সারি দিয়ে চমৎকার রকমে সাজানো। ছাদ থেকে বাড়ির কেঁচি গেটের উপরে প্লাস্টিকের ফুলের ডেকোরেশনটা ও স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। বাড়ির জাকজমকে রাতের আকাশে তারাগুলো ঠিক ভালোমত দেখা যাচ্ছে না। এতো আলোর মধ্যেও পিউ এর দৃষ্টি শুধু রাস্তার মোড়ের ল্যাম্পপোস্টির দিকে। আড়াই বছর আগে, তার জীবনে এমন একটি দিন এসেছিলো। সে তখন দিশার মতো রাত জেগে তার হবু বরের ছবি দেখতো। তার মনে আছে, সেদিন মামু তাকে প্রথম আহাশের ছবি দেখিয়েছিলো। মামু এসে বলেছিলো,
– পিউ মা, আমি জানি এখন তোমার বিয়ের বয়স হয় নি তাই আমার এখনের কথাগুলো যৌক্তিযুক্ত নাও মনে হতে পারে তোমার কাছে। তোমার বাবা সবসময় শওকত ভাইয়ের ছোট ছেলেটির সাথে তোমাকে বিয়ে দেবার কথা বলতেন। উনি মারার যাবার পর তোমার মা একই আশাতেই ছিলেন। সেদিন শওকত ভাইয়ের সাথে বহুদিন পর দেখা হয়েছে। উনি উনার ছোট ছেলের বিয়ের জন্য পাত্রী দেখছেন। ছেলেটি কিছুদিন হয়েছে পুলিশের চাকরিতে জয়েন করেছে। এখানে ছবিটি রাখলাম। তুমি যা সিদ্ধান্ত নিবে সেটাই আমরা মেনে নিবো।
মামুর কথাগুলো শুনে বেশ লজ্জা লাগছিলো পিউ এর। বয়স তখন তার একুশ পেড়িয়ে বাইশ এ পড়বে, মনে এসব আবেগগুলো এক গুচ্ছ গোলাপের ন্যায় জীবন্ত। সেদিন কোনো উত্তর না দিলেও সপ্তাহ দুয়ক পর ঠিক ই তার সম্মতি জানিয়ে দেয়। অতীতের ঘটনাগুলো সিনেমার পর্দার মতো চোখে ভাসছে। যেনো সেলুলয়েডের রিল চালানো হয়েছে। সামনের ল্যাম্পপোস্টির দিকে তাকিয়ে আনমনেই বলতে লাগলো,
নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে
রয়েছ নয়নে নয়নে,
হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে
হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।
বাসনা বসে মন অবিরত,
ধায় দশ দিশে পাগলের মতো
স্থির আঁখি তুমি ক্ষরণে শতত
জাগিছ শয়নে স্বপনে ________(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
– রাত বিরাতে ব্যর্থ প্রেমের কবিতা আবৃত্তি করাটা বইয়ের পাতার নায়িকাদের মানায়, এখনকার সময়ে ব্যাপারটা খানিকটা ভূতুরে হয়ে যায় না!
হঠাৎ কারোর কন্ঠ শুনে চমকে উঠে পিউ। পেছন ফিরে তাকাতেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠে। পেছনে ফিরতেই দেখে পকেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বেশ আল্লু আর্জুন পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীলাদ্রি। লোকটাকে দেখে সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো পুনরায় মনে পড়ে গেলো পিউ এর। লোকটাকে দেখে বেশ বিরক্ত লাগছে তার। অস্বস্থিও লাগছে, নিজের একাকিত্ব সময়ে কারোর আগমণ পিউ এর একদম ই পছন্দ নয়। এটা শুধু তার এবং আহাশের স্মৃতির ব্যাক্তিগত মূহুর্ত। নিঃশব্দে নিজের রুমের দিকে রওনা দিতে নিলে…………
মুশফিকা রহমান মৈথি