শ্রাবণ মেঘের ভেলা ৩য় পর্ব

0
1520

#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#৩য়_পর্ব

নিজের রুমের দরজা খুলতেই চক্ষুচরাগ গাছ পিউ এর। যা দেখলো তার জন্য একদম প্রস্তুত ছিলো না সে। তার রুমে তখন এক অচেনা পুরুষ টাওয়াল পরা অবস্থায় আয়নার সামনে চুল ঠিক করছে। বেশ লম্বা চওড়া, সুঠাম দেহী একজন পুরুষ, দেখে অনুমান করা যাচ্ছে ছয় ফুট তো হবে, ফর্সা পিঠে এখনো পানি লেপ্টে আছে। কিন্তু প্রশ্ন তার রুমে এই পুরুষটি কি করছে এবং কেনোই বা এভাবে দাঁড়িয়ে আছে!
– আপনি আমার রুমে কি করছেন?

অনেকটা উত্তেজিত ভঙ্গিমাতে পিউ অচেনা পুরুষটির কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। হঠাৎ নারী কন্ঠ শুনে পুরুষটি ঘুরে তাকায় তার দিকে। খুব সহজ ভঙ্গিমাতেই বলে,
– এক্সিউজ মি, এটা আমার রুম। আর আপনি নক না করে একটা ছেলের রুমে এভাবে কিভাবে ঢুকে পড়েছেন?
– মানেটা কি এটা আমার রুম। প্লিজ একটা কাপড় পড়ুন, আমার নিজেরই লজ্জা লাগছে।
– এক মিনিট আপনি সেই মহিলা না, যে গাড়ি চালাতে চালাতে নিজের স্বপ্নের রাজ্যে চলে যান আর ভুলে যান যে আপনি সিগন্যালে আছেন। আজ বিকেলেই আপনি গাড়ি চালাতে ভুলে গেছেন আর এখন নিজের রুম কোনটা সেটাই ভুলে গেছেন। সবসময় নিজের কাল্পনিক জগতেই থাকতে হয় তাই না?

পিউ খেয়াল করে দেখলো এই লোকটা সেই লোক যে সিগন্যালে তাকে কথা শুনিয়েছিলো। লোকটা এখনো একই অবস্থাতে দাঁড়িয়ে আছে। ভেজা বুকে লোমগুলো লেপ্টে আছে, পিউ এর খুব অস্বস্থি লাগছে। খানিকটা চেচিয়ে বললো,
– জাস্ট শাট আপ। এখনই এই ঘর থেকে বের হবেন নাকি লোক জড় করবো? আজ প্লিজ জামা পড়ে আসবেন?

মিনিট পাচেক পর ছেলেটি একটি নীল টিশার্ট এবং কালো থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট পড়ে আসে। বিছানায় আপনমনে বসতে বসতে বলে,
– হুম এখন বলুন।
– হুম বলুন কি! এখনই এই রুম থকে বের হবেন আপনি!
– মানে কি ফাজলামি! দিশা আমাকে এই রুমটা দেখিয়ে দিয়েছে। এখন বললেই হবে নাকি রুম ছাড়েন।
– বেশ আমি দিশাকেই ডাকছি! দিশা! দিশা!

পিউ এর চেঁচামেচি শুনে দিশা এক প্রকার দৌড়ে এসেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে আপি?
– এই উটকো ঝামেলাটা আমার রুমে কি করছে দিশা?
– কে উটকো ঝামেলা? ও নিলাদ্রী ভাই? আরে ও আমার খালাতো ভাই।
– কোন খালাতো ভাই যে আমি চিনি না?
– আরে, ঐন্দ্রিলা আপুর বড় ভাই।
– ঐন্দ্রির ভাই কি নতুন পয়দা হয়েছে?
– আরে যে সাত বছর আগে ইউ.কে তে চলে গিয়েছিলো। গত পরশু ফিরেছে।
– সে যেই হোক না কেনো? আমার ঘরে কি করছে?
– সরি আপি, তোমাকে বলতে ভুলে গেছি, আসলে মানুষ অনেক তো এই রুমটা আমার কাজিন ভাইদের দেয়া হয়েছে। তুমি আমার রুমে আমার সাথে থাকবে।
– সেটা আগে বলা যায় না। অহেতুক একটা ছাগলের সাথে তর্ক করা লেগেছে আমার।
– আরে ছাগল বলছো কেনো? উনি সায়কোলোজির ডাক্তার, ওই যে বাবা তোমাকে ইনার দেয়া ঔষধ খেতে বলেছিলো।
– ওহ এই সে সার্টিফাইড ছাগল যে কিনা আমাকে আবল তাবল ঔষধ খায়িয়ে পাগল বানাতে গেছিলো?

নিজের নামে এতো প্রশংসা শুনে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না নীলাদ্রি। ঝাঝালো কন্ঠে বলে উঠলো,
– এক্সিউজ মি! আমি আবল তাবল ঔষধ দেই? আপনি জানেন কার সাথে কথা বলছেন?
– জ্বী একটা পাগলের ডাক্তারের সাথে।

তেজের সাথেই উত্তর দেয় পিউ। দিশা সিচ্যুয়েশন বেগতিক দেখে সেটা সামলানোর জন্য বলে,
– নীলাদ্রি ভাই ও পিউ আপু, আমার ফুফাতো বোন। ঐন্দ্রি আপুর সমবয়সী ও।
– ও, তা তোমার পিউ আপুকে বলো আমাকে একটু সম্মান দিতে।
– পিউ না মোবাশশিরা। পিউ শুধু আমার প্রিয় মানুষদের জন্য, আপনার জন্য মোবাশশিরা ঠিক আছে। আর সম্মান মুখে বললে পাওয়া যায় না। অর্জন করতে হয়। আর এর পর থেকে যদি রুমে সাবারিয়া গানে পারফর্ম করার শখ থাকে তবে দরজায় লক করে নিবেন। চল দিশা।

বলেই গটগট করে রুম থেক বেরিয়ে যায় পিউ। নীলাদ্রি অবাক নয়নে তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো। নীলাদ্রির পুরো নাম নিলাদ্রি আহসান আহমেদ। সম্পর্কে দিশার খালাতো ভাই, বিগত সাত বছর ধরে ডিগ্রি নেবার আশায় দেশের বাহিরে ছিলো। এবার একেবারে বাইরের পাঠ চুকিয়ে দেশে ফিরেছে। পেশায় সায়কোলোজিস্ট। পরিবার বলতে শুধু বাবা আর বোন ই আছে তার। আসমা বেগমের খুব প্রিয় বলেই দেশে আসার পর থেকেই এ বাড়িতে এসে থাকার আদেশ পড়েছে তার উপর। বিকালে পিউকে খুব ইরিস্পন্সিবল একটা মানুষ মনে হলেও এখন খানিকটা ইন্টারেস্টিং লাগছে। মুখের উপর তাকে সার্টিফাইড ছাগল বলে কি তেজ দেখিয়ে চলে গেলো।

পিউ একটা খুব ভালো আবার খুব খারাপ স্বভাব রয়েছে, খুব সহজে তার রাগ উঠে না আবার উঠলে তা নামার নাম নেয় না। এই নীলাদ্রি নামক লোকটাকে দেখেই কেনো যেনো রাগ লাগছে। হয়তো তার উপর আগের সুপ্ত রাগ এবারের রাগের সাথে জমে বিরাট আকার নিয়েছে। রুমে ঢুকেই দেখলো ঐন্দ্রিলা বারান্দায় উদাসীন মনে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যবার হলে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে। ঐন্দ্রিলা আহমেদ, দিশার খালাতো বোন। মেয়েটার সাথে পিউ এর বেশ ভাব। মনেই হয় না তাদের মাঝে রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। ঐন্দ্রিলা মেয়েটিকে যদি দুর্ভাগার ক্যাটাগরিতে ফেলা হয় তবে টপ টেনে ওর নাম পড়বে। জন্মের সময় নাকি জমজ বাচ্চা জন্মে দেবার কথাছিলো মেয়েটির মা চাঁদনি বেগম, কিন্তু প্রেগ্নেন্সির কমপ্লিকেশনের জন্য অপর বাচ্চা এবং মা কাউকেই বাঁচানো যায় নি। শুধু ঐন্দ্রিলাকে কোনোমতে বাঁচানো গেছে। এজন্য শরীফুল আহমেদ অর্থাৎ তার বাবা মেয়েকে বেশির চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। ছেলে এবং মেয়ে সৎ মায়ের কবলে যাতে না পরে তাই দ্বিতীয় বিয়ে করার কথা চিন্তা ও করেন নি। ঐন্দ্রিলা এবং পিউ এর ভাবের এই কারণটাও আছে একজন ছোট বয়সে বাবাকে হারায় তো আরেকজন মাকে চোখেও দেখে নি। ঐন্দ্রিলাকে উদাসীন দেখে পিউ ফিসফিসিয়ে দিশাকে জিজ্ঞেস করে,
– ঐন্দ্রি কি প্রেমে ছ্যাকা খেয়েছে? পুরোনো দিনের নায়িকাদের মতো উদাসীন হয়ে আছে কেনো?
– না না, সেরকম কিছুই না। বিকেলে বাহিরে গিয়েছিলাম তখন কোন লোকের সাথে ঝগড়া হয়েছে নাকি।

পিউ ধীর পায়ে ঐন্দ্রিলার কাছে যেয়ে বলতে লাগলো,
– যদি সত্যি কারোর সাথে প্রেম করে থাকিস বলতে পারিস, মামাকে বলে তোর বিয়েটা দিশার সাথেই দিয়ে দিবো।

হঠাৎ কারোর কথা শুনে বেশ খানিকটা চমকে উঠে ঐন্দ্রিলা। পিউকে এতোদিন পর দেখে বেশ ভালো লাগছে ঐন্দ্রিলার। জড়িয়ে ধরে বলে,
– তুই কখন এসেছিস?
– যখন তুই তোর প্রেমিকের চিন্তায় বিভর ছিলি
– আরে ধুর! একটা ঘটনাতে মেজাজটা খানিকটা চটে ছিলো। তেমন কিছুই না
– অহ আমি ভাবলাম প্রেম ট্রেম করছিস কিনা, ছ্যাকা খেয়ে বেকে আছিস।

ভেতরে এসে গা এলিয়ে বললো পিউ। ঐন্দ্রিলা খানিকটা চেতে বললো,
– এসব প্রেম ট্রেম প্রচুর ছ্যাবলামি লাগে, প্রেম কিরে! বাবু, সোনা, আলগা পিরিত। আমি তো ভেবে রেখেছি, প্রেম ট্রেম না করে একেবারে বরকে ভালোবাসবো। একটা ক্লাসি ব্যাপার আছে
– যেমনটা পিউ আপু আহাশ ভাইকে করে? এতো বছর ধরে ভালোবাসা সত্ত্বেও কখনোই সেধে তার সামনেও যেতো না। শুধু বিয়ের আগে দুবার ঘুরতে গিয়েছিলো তাও বাবা বলাতে।

হঠাৎ দিশার মুখে আহাশের কথা শুনে পুরোনো স্মৃতিগুলো জীবন্ত হয়ে উঠলো পিউ এর সাথে। শান্ত ভাবে বললো,
– তোরা কথা বল, আমি একটু বাড়িটা ঘুরে দেখি। কতোদিন পর এসেছি বল।

পিউ আর কথা না বলে রুম ছেড়ে চলে গেলো। ঐন্দ্রিলা দিশার মাথায় গাট্টা মেরে বলতে লাগলো,
– মাতারি, তোর বয়স ই বেড়েছে, বুদ্ধি হলো না। কোথায় কি বলতে হবে এখনো জানিস না। কি দরকার ছিলো আহাশের কথা তোলা?
– সরি আপু।

দিশার এই বেঁফাস কথা বলার স্বভাব জীবনেও শুধরাবে না। ফটফাট করে কথা বলে দেয় মেয়েটা। ঐন্দ্রিলার বুঝতে বাকি নেই পিউ এখন কিছুক্ষণ অতীতের পাতা উল্টাবে আর আহাশের সাথে হাতেগোনা স্মৃতিগুলোকে আবার জীবন্ত করার চেষ্টা করবে।

০৫.
রাত ৯টা,
খাবার টেবিলে শারমিন বেগম প্লেট গুছাচ্ছেন। এর মধ্যে শওকত সাহেব, অভ্র এবং আহানা এসে হাজির। এ বাড়িতে ঠিক ৯.৩০ এর মধ্যে খারাবের পাঠ চুকে যায়। অভ্র চেয়ার টেনে বসতে বসতেই শারমিন বেগম বলে উঠলেন,
– ফরিদা আপা ফোন করেছিলেন, তোমার বিয়ের ব্যাপারে মেয়ে দেখছেন।
– ছোট মা, আপনি ভালোভাবেই জানেন আমি এসব বিয়ের ঝামেলাতে জড়াতে চাচ্ছি না। ফুপিকে মানা করে দিবেন প্লিজ।
– বয়স তো কম হয় নি অভ্র, এবার ত্রিশ শেষ হতে যাচ্ছে। বুড়ো বয়সে বিয়ের কোনো মানেই হয় না।

বেশ ঝাঁঝালো কন্ঠে কথাটা বলেন শারমিন বেগম। শারমিন বেগমের কথায় বেশ বিরক্ত হয় অভ্র। অভ্রের বিয়ে না করার কারণটা তিনি ভালোভাবেই জানেন তবুও এক কথাই বলে যাচ্ছেন। অভ্রের খানিকটা রাগ ও হচ্ছে। আজকে এমনিতেই কেনো জানে দিনটা খুব বাজে যাচ্ছে, উপরে তার ছোট মার এই বিয়ে নিয়ে ঘ্যানঘ্যানি। একটা সময় বলেই বসে,
– আচ্ছা একবার তো বলেছি আমি বিয়েশাদী করব না। কেনো বারবার একই কথা বলছেন? আমার জীবন নিয়ে আপনার না ভাবলেও চলবে।

অভ্রের কথাটা কোথাও না কোথাও বেশি কষ্ট দেয় শারমিন বেগমকে। তিনি তখন…………

মুশফিকা রহমান মৈথি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে