#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#২৮তম_পর্ব
আর কিছু বলার আগেই আহানা নীলাদ্রিকে জড়িয়ে ধরে। নীলাদ্রি কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছিলো না। ঠিক তখনি রুমেএ দরজায় পিউ এর আগমন ঘটে। ইচ্ছে করে ঐন্দ্রিলা তাকে দিয়ে সুপ পাঠিয়েছে। কিন্তু রুমে এসে এমন কোনো দৃশ্য দেখবে সেটা তার জানা ছিলো না। তাড়াতাড়ি আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। পাগুলো যেনো জমে গিয়েছিলো পিউ এর। সে ভেবেছিলো আহানার অনুভূতিগুলো কেবলই বাচ্চামি। কিন্তু আহানার কথাগুলো যেনো বজ্রপাতের মতো লাগছিলো তার কাছে। আহানা তখনও নীলাদ্রিকে জড়িয়ে রয়েছে। আহানা ভাঙা গলায় বলতে লাগে,
– নীলাদ্রি ভাই, আমি কি করবো আপনি ই বলে দিন। আমার যে খুব কষ্ট হয়, তা চাইতেও আপনাকে অসম্ভব ভালোবেসে ফেলেছি যে। ভালোবাসা না পাবার কষ্টটা আপনি খুব ভালো করে জানেন। না চাইতেও বেহায়া হয়ে যায় মন। আমি জানি আমার এমন কাজে আপনি খুব বিরক্ত হচ্ছেন কিন্তু আমি কি করবো বলুন? আমি যে ভালোবাসি আপনাকে। আপনার আমাকে ভালোবাসা লাগবে না তবে আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না দয়া করে। আমার প্রথম ভালোবাসা আপনি।
– ভালোবাসা একপাক্ষিক হলে সেটা দু পক্ষকে কষ্ট বাদে কিছুই দেয় না আহানা। আর আমি যে তার কাছে ওয়াদা বদ্ধ। আমি তাকে ভালোবাসতাম, ভালোবাসি এবং ভালোবাসবো। তার জায়গাটুকু যে কাউকে দেবার মতো ক্ষমতা আমার নেই। আমাকে ক্ষমা করো আহানা। তোমার ভালোবাসা থেকে আবেগটুকু অনেক বেশি। আমি তোমার আবেগকে প্রশ্রয় দিতে পারবো না।
– কিন্তু সে তো আপনাকে ফিরিয়ে দিয়েছে
এবার আহানাকে নিজের কাজ থেকে ছাড়িয়ে সামনে বসায়। খুব শান্ত গলায় নীলাদ্রি বলে,
– আমি তাকে এগারো বছর ধরে ভালোবাসি আহানা। এগারো বছর কিন্তু এক দুই দিন না। চার হাজার পনেরো দিন। তুমি বুঝতে পারছো সে আমার কতোটুকু জুড়ে রয়েছে?
-……………
– তোমার আমার প্রতি অনুভূতি গুলো ভালোবাসা নয় নিতান্তই ইনফ্যাচুয়েশন বা আবেগ। হ্যা আমি জানি তোমার কষ্ট হবে। হয়তো মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছে হবে। কিন্তু একটা সময় দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু এখন যদি আমি তোমাকে মেনেও নেই, সেটা একটা কম্প্রোমাইজ হবে। আমাদের উভয়কে সেটা বয়ে চলতে হবে। আজ তোমার ভালো লাগবে একটা সময় বিরক্ত লাগবে। কারণ আমি তোমাকে কোনোদিন তোমার ভালোবাসার বিপরীতে ভালোবাসতে পারবো না। দায়সারা সম্পর্ক থাকবে। পারবে তো তখন সহ্য করতে? পারবে না। আর আমার ভালোবাসা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো সেটা যেমন ঠিক। সে আমাকে গ্রহণ ও করেছে। আমি যার জন্য এতো দিন অপেক্ষা করেছি, তুমি বলো এখন আমার কি করা উচিত! সে দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। তোমাকে আমায় জড়িয়ে ধরতে দেখে দ্রজাতেইদাঁড়িয়ে পড়েছে। সে ভাবছে সে কোনো ভুল করলো না তো আমাকে গ্রহণ করে, আমার ভালোবাসাকে গ্রহণ করে।
– সে কি এ বাড়িতে আছে?
– পিউ তুমি রুমে ঢুকতে পারো।
নীলাদ্রির মুখে একথাটা শুনে আহানা স্তব্ধ হয়ে যায়। অপরদিকে পিউ এর চোখ টলমল করছিলো। সে সত্যি এটাই ভাবছিলো, আহানার সুখের ভেতর কি সে হস্তক্ষেপ করে ফেলেছিলো। ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করলো পিউ। পিউ এর প্রবেশের সাথে সাথেই আহানা নীলাদ্রির দিকে তাকায়। নীলাদ্রি ঠোটের কোনায় হাসির রেখা টেনে বলে,
– হ্যা আহানা, আমি পিউকে ভালোবাসি। সে আমার ভালোবাসায় এতোদিন সাড়া না দিলেও এখন দিয়েছে। সুস্থ হলে তাকে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবো তোমার বাবার কাছে। এই মেয়েটাকে আমি এগারো বছর ধরে ভালোবাসি।
– ভাবী তো……
– জানি, কিন্তু আমরা সময়ের নির্মমতার স্বীকার। কিন্তু সুযোগ যখন পেয়েছি সেটাকে হাতছাড়া করার কি কোনো মানে আছে? সুখী হবার অধিকার ত সবার আছে।
– তোমার থেকে এটা এক্সপেক্ট করি নি ভাবী
বলেই আহানা সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। পিউ এর সাথে নিজের সব অনুভূতিগুলো শেয়ার করতো একটা সময়ে আহানা। নীলাদ্রিকে তার পছন্দ এটা দিশার বিয়ের দিনই পিউ কে জানিয়েছিলো সে। কিন্তু তখনও নীলাদ্রির প্রতি পিউ এর কোনো অনুভূতি থাকতে পারে বলে ভেবেই দেখে নি আহানা। কেনো জানে খুব দ্বিধা লাগছে। একদিকে সেও চায় পিউ নতুন করে সব শুরু করুক অপরদিকে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে সে তার নতুন জীবন সাজাবে ভেবে রাগ হচ্ছে আহানার। ঐন্দ্রিলাকে বলেই নিজের ব্যাগ নিয়ে নিজের বাসায় চলে যেতে লাগলো আহানা। নিজের আঘাতের জায়গাগুলো পচন ধরাতে চায় না সে। আহানার পিছু নিতে গেলে নীলাদ্রি পিউকে বারণ করে। না চেয়েও অপরাধবোধ হচ্ছে মনের মাঝে পিউ এর। পিউ এর হাতটা টেনে নিজের কাছে বসায় নীলাদ্রি। শান্ত গলায় বলে,
– কাঁদছো কেনো?
– আহানা অনেক ইমোশনাল, ও যে আপনাকে ভালোবাসে এটা আমার জানা ছিলো না
– থাকলে কি করতে?
– আমি………
– আমার থেকে দূরে চলে যেতে তাই তো?
– ……………
– আচ্ছা পিউ, নিজেকে কবে ভাববে?
– ……………
– একদম চুপ করে থাকবে না। আমার খুব বিরক্ত লাগে এটা
– কি বলবো?
– এই যে নিজেকে নিয়ে ভাবা করে শুরু করবে? পিউ তুমি সবার কথা ভাবো, প্রথমে সমাজ, তোমার শ্বশুরবাড়ি এখন আহানা। আচ্ছা তোমার সুখী হতে ইচ্ছে হয় না?
– কাউকে কষ্ট দিয়ে কি সুখী হওয়া যায়?
– না যায় না; কিন্তু তোমার কোনো দোষ নেই পিউ। আমার দোষ আর তুমি আমার জীবনে না আসলেও আমি আহানাকে কখনো প্রশ্রয় দিতাম না। আমি তোমাকে ভালোবাসি পিউ, এখন যদি তুমি আহানার জন্য আমার ভালোবাসা সেক্রিফাইস করো। আমার কিছুই বলার থাকবে না। আমি চুপচাপ মেনে নিবো। এখন তোমার উপর ডিসিশন।
নীলাদ্রির কথাগুলো খুব স্পষ্ট এবং ভারসম্পন্ন ছিলো। নীলাদ্রির কথায় এটা পিউ এর বুঝতে বাকি নেই যে সে যদি তাকে আজ কষ্ট দেয় তবে সে কিছুই বলবে না তবে আহানাকেও সে কখনোই মেনে দিবে না। মাথা তুলে নীলাদ্রির দিকে একনজর তাকায় পিউ। চোয়াল তার শক্ত হয়ে আছে, চাপা কষ্টগুলো মুখে স্পষ্ট। এই লোকটাকে কষ্ট দেবার কোনো মানেই হয় না পিউ এর। এখন ভাগ্যের উপর সব ছেড়ে দিবে সে। যা আছে কপালে। নীলাদ্রির হাতে আলতো পরশ দিয়ে শান্ত গলায় বললো,
– সুপটা গরম করে আনছি, খেয়ে নিবেন। তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে হবে, কাছে আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবেন তো নাকি?
নীলাদ্রির বুঝতে বাকি নেই পিউ এর কথার মানে। তার পিউ এবার তাকে একা করে দিবে না। এখন তো অনেকটা পথ চলা বাকি_____
২৮.
ড্রয়িং রুমের সোফাতে বসে রয়েছে বদরুল সাহেব এবং নীলাদ্রি। খালুকে সব খুলে বলেছে সে। বদরুল সাহেবের যেনো খুশির ঠিকানা নেই। এটাই তো চেয়েছিলো পিউ এর জন্য সে। একটা যোগ্য ছেলে যে কিনা পিউ কে তার ভেগের প্রাপ্য সুখটুকু দিবে। প্রতিবার পিউ এর জেদের কাছে তাকে হার মানতে হইয়েছে। কিন্তু এখন যেহেতু পিউ নিজেই এই সম্পর্কে মত দিয়েছে এবং জীবনটাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিতে চাইছে তাহলে কোনো কথাই থাকে না। কিন্তু এখন সমস্যাটি হলো পিউ এর শ্বশুর বাড়ি এবং শওকত সাহেব। আগের ব্যাপার হতে বদরুল সাহেব কুচপরোয়া না করেই বিয়েটাতে আগাতে পারতেন। কিন্তু এখন সে বাড়িতে ঐন্দ্রিলাও আছে। নীলাদ্রির ভয় টাও সেখানে ঐন্দ্রিলার সংসারটি হয়েছে এক মাস হয়েছে। এখন যদি তার কারণে ঐন্দ্রিলার জীবনে কোনো বাধা আসে ভাই হিসেবে সেটা কিছুতে মানবে না সে। বদরুল সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন,
– বুঝলে নীলাদ্রি, আমাদের সব কিছু বুঝে শুনে করতে হবে। ব্যাপারতা প্রেম ঘটিত এটা যদি দেখাতে চাই হিতে বিপরীত ও হতে পারে।
– তাহলে কি তবে আমরা পছনে সরে যাবো এই ব্যাপারটা থেকে? আমি পিউকে অনেক ভালোবাসি খালু
– না, না পিছনে সরবে কেনো? আমাদের কিছু বুদ্ধি বের করতে হবে বুঝলে
– কি বুদ্ধি?
– সেটা তো এখনো ভাবি নি, ভাবতে হবে। তবে তোমাকেও কথা দিতে হবে আমার পিউ মাকে কোনোদিন কষ্ট দিতে পারবে না
– এটা আপনাকে বলতে হবে না খালু এটা আমায় মাথায় আজীবন থাকবে।
নীলাদ্রির কথায় খুব শান্তি লাগছে বদরুল সাহেবের। এখন আর তার বোন দুলাভাই এর কাছে দায় থাকতে হবে না। পিউ এর জীবনটাও সুখের জোয়ারে ভাসবে। হঠাৎ মাথায় একটা চট করে বুদ্ধি চলে আসলো বদরুল সাহেবের। নীলাদ্রিকে বুদ্ধিটা বলতেই নীলাদ্রি ও সম্মতি জানালো তাকে। এখন শুধু অভ্রের সাহায্যের প্রয়োজন।
বিকেল ৪টা,
খুব ক্লান্ত লাগছে ঐন্দ্রিলার। সারাদিন অফিস করার পর এই সময়টা যেনো হাত পা ছেড়ে দেয় তার। অফিসের পর দিশানের কাছেও যেতে হবে। ছেলেটার সাথে বেশ ভাব হয়েছে বলতে হবে। খুব চুপচাপ ছেলেটি। বেশি লোকজন পছন্দ করে না। প্রথমে ঐন্দ্রিলার কষ্ট হলেও এখন বেশ তার সাথে মিশে গেছে সে। প্রতিদিন ৯-১০ টার দিকে বাড়িতেযায় বিধায় শ্বাশুড়ি মা আবার একটু ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলছিলেন। তাতে অবশ্য অভ্র বেশ সুন্দর করে সামলে নিয়েছে। এই লোকটাকে যত দেখে তত ভালোবাসতে মন চায় ঐন্দ্রিলার। এই এক মাসে আরো বেশী ভালোবেসে ফেলেছে সে তাকে। এবার দিশানকে বাড়ি নিয়ে যাবার পালা। হঠাৎ পিয়ন সামছু সাহেব এসে বলেন,
– ম্যাডাম একজন মেয়ে আপনার সাথে কথা বলতে চায়। পাঠাবো?
– হুম পাঠিয়ে দিন
এই সময় কোনো মেয়ে ঐন্দ্রিলার কাছে আসবে বলে জানা ছিলো না তার। কে এসেছে এটা ভাবতে ভাবতে সেই মেয়েটি কেবিনে প্রবেশ করে। মেয়েটি কেবিনে ঢুকলে…………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি