#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#২৬তম_পর্ব
ফোনটা ধরতেই আসমা বেগম বলতে থাকেন,
– পিউ, একটা অঘটন ঘটে গেছে রে।
আসমা বেগমের এরুপ কথায় কলিজায় কামড় পড়ে পিউ এর। ঘড়ির দিয়ে সময়টা দেখে খানিকটা নিজেও ঘাবড়ে যায় সে। ঘড়ির কাটা ১১ পার হয়ে গেছে। এই রাতে কি অঘটন ঘটেছে! নিজেকে শান্ত করে ধীর গলায় বলে সে,
– মামি মা, আগে ঠান্ডা হও। শান্ত হয়ে বলো কি হয়েছে?
– ঐন্দ্রিলাকে ফোন করেছি ১২-১৫ বার হবে। ও ফোন ধরছে না, তাই তোকে এই রাতে ফোন করলাম।
– ও হয়তো ঘুমিয়ে আছে। আজ ভোরে কক্সবাজার থেকে এসেছে। তারপর সারাদিন ব্যস্ত ছিলো, তাই হয়তো এখন ঘুমোচ্ছে। ফোন হয়তো সাইলেন্ট। হয়েছেটা কি?
– নীলাদ্রির এক্সিডেন্ট হয়েছে রে। এখন হাসপাতালে ভর্তি, তোর মামু আর আমি এখানে রয়েছি। কিচ্ছু মাথায় আসছে না। দুলাভাই তো খুব ভেঙ্গে পড়েছে। ঐন্দ্রিকে খবরটা দে তাড়াতাড়ি।
নীলাদ্রির এক্সিডেন্টের খবরটা শুনে পিউ যেনো স্তব্ধ হয়ে যায়। আড়াই বছর আগের স্মৃতিগুলো যেনো চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে যায় চোখের সামনে। কালো মেঘগুলো চোখে জমা হতে লাগে, এখনি বুঝি অঝরে নোনাজল রুপে চোখ জোড়া হতে মুক্তি পাবে। বুকের বা পাশের চিনচিন ব্যথাটা তীব্র হতে লাগলো। এমন তার সাথেই কেনো হয়? এবার তো নীলাদ্রিকে নিজের জীবনেও প্রবেশ করতে দেয় নি সে তবে! গলায় কথাগুলো দলাপাকিয়ে যাচ্ছে যেনো। খুব কষ্ট করে বললো,
– এখন কি…কি অবস্থা?
– অপারেশন চলছে, ইমারজেন্সি থেকে ও.টি তে শিফট করেছে ওকে। ডাক্তার না বের হলে কিছু বুঝা যাচ্ছে নারে। ব্লাড লাগবে, তাই বলছি ঐন্দ্রিকে নিয়ে চলে আয় মা। আমার খুব ভয় লাগছে।
– হুম
বলেই ফোনটা রেখে দিলো পিউ। পা যেনো চলতেই চাচ্ছে না, মাথাটা ঝিমঝিম করছে। এতো কষ্ট হচ্ছে কেনো লোকটার জন্য! এটা বারংবার প্রশ্ন করছে পিউ। একটা সময় লোকটাকে দেখলে গা পিত্তি জ্বলে যেতো পিউ এর, অথচ লোকটার এক্সিডেন্টের কথা শুনে কিছুতেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না পিউ। না সময় নষ্ট করলে চলবে না। এখনি ঐন্দ্রিকে জানাতে হবে সবকিছু। কোনো রকমে ওড়নাটা গায়ে টেনেই ছুট লাগালো পিউ। পিউ এর রুমের দু ঘর পরেই অভ্রের রুম। গলা থেকে স্বর বেরোতেই চাচক্সহে না যেনো পিউ এর। কোনোমতে “ঐন্দ্রি” “ঐন্দ্রি” বলে ডাকতে লাগলো পিউ। ঐন্দ্রিলা তখন গভীর ঘুমে, মোবাইলটাও সাইলেন্ট করা। ঢাকাতে এসেছে পাঁচদিন হয়েছে। কিন্তু এই পাঁচদিন সম্পূর্ণ দিশানের কাটিয়ে এই দম্পতি। বাড়ির কাউকে আপাতত দিশানের ব্যাপারে কিছুই জানায় নি তারা। আজ সকালে বাসায় আসে তারা। তারপর আবার অফিস, দিশানের সাথে সময় কাটানো সব মিলে খুব ক্লান্ত ঐন্দ্রিলা। অভ্রের বুকে মুখ ঘুজে গভীর ঘুমের রাজ্যে আপাতত না বিরাজ। পিউ এর ডাকে অভ্রের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঐন্দ্রিলাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুলে সে। আড়মোড়া ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে ঐন্দ্রি বলে উঠে,
– এতো তাড়াতাড়ি সকাল হয়েগেছে অভ্র?
– আরে না মোবাশশিরা ডাকছে, এতো রাতে কি হয়েছে কে জানে। উঠো।
– আচ্ছা।
বলেই নিজেকে ঠিক করে দরজা খুলে ঐন্দ্রিলা। পিউ এর চোখ মুখ সুবিধার লাগছে না তার কাছে। চোখমুখে ভয়ের ছাপ, চোখের পানি এখনো শুকায় নি; কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। পিউকে দেখে বেশ আৎকে উঠে ঐন্দ্রিলা। মনের মাঝে অজানা ভয়গুলো জড় হতে লাগে ঐন্দ্রিলার। খানিকটা উত্তেজিত হয়েই ঐন্দ্রিলা বলে,
– পিউ, কি হয়েছে? তোকে এমন লাগছে কেনো?
– নীলাদ্রি………… নীলাদ্রি
বলেই গলা আটকে যাচ্ছে পিউ এর। কেউ যেনো গলা টিপে ধরে রেখেছে এমন লাগছে পিউ এর। কোনো কথা বলতে পারছে না সে। এটাকেই বুঝি ভালোবাসা বলে, এতোদিন স্বীকার না করলেও আজ তা হারে হারে টের পাচ্ছে সে। হ্যা, নীলাদ্রিকে ভালোবাসে সে। তার জীবনেও বসন্ত এসেছে। তবে এই বসন্তকে আপন করে নেবার মতো সাহসটুকু তার ছিলো না। এখন যখন তাকে হারানোর ভয় মনে ঝেকে বসেছে তখন মনে হচ্ছে ইশ কি হতো মনের কথাটুকু শুনলে? কি হতো নিজেকে এবং তাকে একটা সুযোগ দিলে! কি হতো জীবনকে একটা সুযোগ দিলে!
রাত ২.৩০টা,
হাসপাতালের করিডোরে বসে রয়েছে অভ্র, ঐন্দ্রিলা এবং পিউ। ঐন্দ্রিলার কান্না যেনো থামতে চাচ্ছে না, অভ্র শান্তনা দিচ্ছে তাকে। ভাই বলে কথা, এতো মারাত্নকভাবে এক্সিডেন্টটা হয়েছে যে বাঁচানো যাবে কিনা এটা নিয়ে প্রশ্ন ছিলো। হাইওয়ে তে এক্সিডেন্ট গুলো খুব মারাত্নক হয়, এটা নীলাদ্রির ভাগ্য ভালো যে দ্রুত তাকে এখানে আনা হয়েছে এবং ডাক্তাররা কো-ওপারেট করেছে। নয়তো সাধারনত এই সময়টাতে দাক্তার পাওয়া যেনো ঈদের চাঁদ হাতে পাবার মতো কোনো ঘটনা। আর কিছুক্ষণ পর নীলাদ্রিকে আই.সি.উ তে শিফট করবে। পিউ এর মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও তো লোকটাকে ভালোই দেখেছিলো, সবাই নিজ নিজ মতো নিজের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে পারছে কিন্তু সে চাইলেও কাঁদতে পারছে না, কাউকে বলতে পারছে না তার প্রাণটা যেনো কেউ আটকে রেখেছে। যতক্ষণ না নীলাদ্রিকে চোখের সামনে দেখছে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না নিজেকে। হঠাৎ একজন নার্স বের হলেই তার কাছে ছুটে যায় পিউ। নার্সটিকে কোনোমতে বলে,
– কি অবস্থা প্যাশেন্টের?
– এই তো আই.সি.উ তে শিফট করবো। আলহামদুলিল্লাহ অপারেশন সাক্সেস্ফুল হয়েছে। এখন ৭২ ঘন্টা অবজারবেশনের পর ই কিছু বলা যাবে। দোয়া করেন যাতে সব ঠিক যায়, বিপদের সময়টা যাতে কেটে যায়।
নার্সের কথায় যেনো প্রাণে পানি আসে পিউ। আলহামদুলিল্লাহ বলে শুকরিয়া আদায় করে সে। মানুষটাকে হারাতে চায় না পিউ। তাকে যে এখনো বলা হয় নি, তাকে ভালোবাসে পিউ। এই কথাগুলো শুনা যে তার এখনো বাকি। পিউ এর বাকি জীবনটা যে তার সাথে চলতে চায়। এখনো তার জানা বাকি যে নিজেকে নতুন লড়াই এর জন্য প্রস্তুত করেছে পিউ। এখনো কত লড়াই বাকি, এতো তাড়াতাড়ি হার মানলে আবার জীবনযুদ্ধে যে হেরে যাবে পিউ। এখনো যে তাদের পথচলা বাকি______
২৭.
নীলাদ্রিকে ওয়ার্ডে শিফট করা হয়েছে। এই পনেরোটা দিন নীলদ্রি নিজের জীবনের লড়াই লড়েছে আর পিউ নিজের মনের সাথে হাজারো লড়াই লড়েছে। এমন দিন যায় নি যে নীলাদ্রিকে দেখতে আসে নি। কিন্তু কোনোভাবেই নীলাদ্রির সাথে তার কথাটুকু হবার ও সুযোগ হয় নি। আজ নীলাদ্রিকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হবে তাই আসমা বেগম এবং ঐন্দ্রিলা বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পিউ কে নীলাদ্রির কাছে রেখে তারা বাড়িতে সব ঠিক করতে চলে গেলেই। নীলাদ্রিকে বদরুল সাহেবের বাসায় রাখা হবে। নীলাদ্রিদের বাসায় তাকে দেখভালের কেউ ই নেই। নীলাদ্রি ধরে ধরে বসতে পারে। মাথায়, ডান হাতে, দু পায়ে এখনো ব্যান্ডেজ। এক সপ্তাহ পর সেগুলো খুলবে। আপাতত হুইল চেয়ারে তাকে চলতে হবে। এখন নীলাদ্রির খাবার সময়। রুমে পিউ বাদে কেউ না থাকায় নিজে নিজেই খাবার খাওয়ার চেষ্টা করলো নীলাদ্রি। পিউকে কোনোভাবেই বিরক্ত করতে চাচ্ছে না সে। একটা সময় যখন বা হাতে কিছুতেই ব্যালেন্স করতে পারছিলো না তখন পিউ খাবারের প্লেটটা নিজ হাতে নিয়ে নেয়। খানিকটা করা কন্ঠেই শাসিয়ে বলে,
– নিজেকে কি সুপারম্যান ভাবেন? আমি তো মরে যাই নি। নাকি আপনার ধারণা আমি অদৃশ্য। আপনার যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেকারণেই তো এখানে বসে আছে নাকি? এতো মাতব্বিরির কি আছে তো বুঝলাম না। আমি তো আছি আমাকে বললেই তো আমি খাওয়িয়ে দিচ্ছি। সমস্যা কি আপনার? অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকতে ভালো লাগে নাকি?
– তুমি কি সারাজীবন থাকবে পিউ?
– জ্বী?
– বললাম, সারাজীবন কি তুমি থাকবে? আমি আমারটা ঠিক করে নিতে পারবো। তোমাকে শুধু শুধু বিরক্ত করতে চাচ্ছি না। আজ তুমি আমাকে দরদ দেখিয়ে সেবা করবে, আমি আবারো তোমার প্রতি উইক হয়ে যাবো। তারপর আমাকেই সেটা বয়ে বেড়াতে হবে। আমি সত্যি আর পারছি না খুব কষ্ট হয়।
– যদি বলি…………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি