শ্রাবণ মেঘের ভেলা ২য় পর্ব

0
2412

#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#২য়_পর্ব

নিশির হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে নিলে পেছন থেকে একটা নারী কন্ঠ ভেসে আছে,
– আপনার টাকা আছে বিধায় আপনি কি নিজেকে কোথার রাজা মহারাজা ভাবেন নাকি? প্রথমে মন নিয়ে খেলবেন তারপর টাকা ধরিয়ে সেই মনটাকেই গুড়োগুড়ো করে চলে যাবেন? এতো সোজা?

একেই গা রাগে রি রি করছে উপর থেকে কথাটা শুনতেই মেজাজ আরো বিগড়ে গেলো অভ্রের। পেছনে ফিরতেই দেখে নীল কামিজ পরা একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটিকে দেখে এক মূহুর্তের জন্য অভ্রের চোখ আটকে গিয়েছিলো। শ্যাম বর্ণের গায়ের রঙ, এক পাশে বেনুনী করা, চোখে চশমা; কিন্তু মেয়েটির সাদামাটা চেহারাতে তেজটা দীপ্তিমান। এতো নজরকাড়া সুন্দরী মেয়েদের ডেট করার পর এতো সাদামাটা সিমসাম একটা মেয়ে তাকে আকর্ষণ করছে ব্যাপারটা প্রথমে হজম হচ্ছিলো না অভ্রের। মেয়েটি এসে তুড়ি বাঁজিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কি হলো উত্তর দিন? টাকা দিয়ে ভালোবাসা সম্পর্ক সব বুঝি কিনা যায়?

স্বাভাবিক ভঙ্গিমাতে অভ্র উত্তর দেয়,
– নারী কল্যান সমিতির লোক নাকি আপনি? অন্যের ব্যাপারে ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্যের সাথে সাথে নিজের সময়টুকু নষ্ট করছেন কেনো?
– না আমি নারী কল্যান সমিতির কেউ নই, তবে অন্যায় আমি ঐন্দ্রিলা সহ্য করতে পারি না। আপনাদের মতো মানুষদের যোগ্য উত্তর দিতে নিশ্চয় আমার নারী কল্যাণ সমিতির কেউ হতে হবে না! আর তোমাকেও বলছি, অপাত্রে ভালোবাসা দান করো না। আসলে কি বলোতো এই টাইপের লোকেরা টাকাকেই নিজের সব কিছু ভাবে, আর সামনে থাকা মানুষটাকে নিজের পায়ের ধুলা ভাবে। তাই বলছি এভাবে কান্নাকাটি না করে তার টাকা তাকে ফিরিয়ে দাও। আমি হলে তাই করতাম।

বলে মেয়েটি এক মূহুর্ত অপেক্ষা না করে হাটা দিলো। অভ্রের রাগে রি রি করছে, আজ অবধি কারোর সাহস হয় নি তার মুখের উপর কথা বলা, অথচ মেয়েটি কত সহজ ভঙ্গিমাতে তাকে অপমান করে হাটা দিলো। এই অপমানের শোধ তো তুলতেই হবে তাকে। তবে যেই জিনিসটা তাকে বেশি ভাবাচ্ছে তা হলো মেয়েটিকে যে সে অপমান করতে পারতো না না কিন্তু নয়, কিন্তু কেনো জানে কোনো উত্তর দিতে পারলো না অভ্র।

০৩.
“মেঘের ভেলা” তে পৌছাতে পৌছাতে আজ দেরী হয়ে গেছে পিউ এর। বাড়িতে ফিরেই দেখলো সোফায় পিউ এর মামা বদরুল ইসলাম বসা। পিউ এর বাবা আশফাক সাহেব মারা গেছেন বারো বছর হবে, তার পর থেকে বদরুল সাহেবের কাছেই পিউ এবং তার মা রত্না বেগম থাকতো। চার বছর আগে রত্না বেগম মারা যায়। সেকারণে মামা বদরুল সাহেব ও মামী আসমা বেগম ই তার লিগাল গার্ডিয়ান। শওকত সাহেব, আশফাক সাহেবের অনেক বছরের বন্ধু। সেই সুবাধেই এই বিয়েটা ঠিক হয়। আহাশের মৃত্যুর বদরুল সাহেব বারবার পিউ কে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। তার কথা, পিউ এর পুরোজীবন পরে রয়েছে। কিন্তু প্রতিটাবার শওকত সাহেব ভেটু দেন। তার কথা মেয়ের একবার বিয়ে হয়ে গেলে সেটাই তার এক মাত্র ঘর। তাই শারমিন বেগমের পিউকে পছন্দ না হওয়া সত্ত্বেও তাকে সহ্য করে যাচ্ছেন। পিউকে দেখেই বদরুল সাহেব তাকে ডেকে তার পাশে বসতে বলে,
– পিউ মা, আয় তো আমার পাশে একটু বয়।
– জ্বী মামু আসছি।

পিউ পাশে বসতেই বদরুল সাহেব শওকত সাহেবকে বলেন,
– দেখুন শওকত ভাই আমি চাচ্ছি পিউ কিছুদিন আমার এখানে থাকুক। আমার মনে হয় না আপনি আপত্তি করবেন? দিশার সামনে বিয়েও পিউ থাকলে ওর ও ভালো লাগবে
– পিউ মা যা বলবে তাই হবে। আমার কোনো আপত্তি নেই।
– তাহলে ব্যাগ গুছিয়ে নাও পিউ।
– মামু, বলছি কি
– যাও মা ব্যাগ গুছিয়ে আসো। আমি এখনি তোমাকে নিয়ে যেতে চাইছি।
– আচ্ছা মামু।

পিউ রুমের দিকে যাবার পর শওকত সাহেবকে তিনি বলেন,
– এবার আমি পিউ এর চিকিৎসা করিয়ে তারপর সে যদি চায় তখন এ বাড়িমুখো করবো। আড়াই বছর ধরে মেয়েটা পাগলের মতো একজনের অপেক্ষা করে যাচ্ছে যার ফেরার কোনো আশা রাখা মানেই বোকামী।
– দেখো বদরুল আমি মানছি পিউ এর চিকিৎসা প্রয়োজন তবে সে আমার বাড়ির বউ। আহাশের স্ত্রী, তুমি চাইলেই তাকে নিজের কাছে রাখতে পারো না। পিউ এ বাড়ির মেয়ে হয়ে আছে এবং সারাজীবন থাকবে।
– ক্ষমা করবেন শওকত ভাই, তবে একটা মেয়ের সারা জীবন পড়ে রয়েছে। কেবল চব্বিশে পা দিয়েছে সে, তাকে এভাবে নিজের কাছে জোর করে রেখে দেয়াটা বোধ হয় যৌক্তিক না। আর সব চেয়ে বড় কথা এতো যে নিজের মেয়ে নিজের মেয়ে করছেন আদৌ কি নিজের মেয়ের বেলাতে এভাবে হাতে হাত রেখে বসে থাকতে পারতেন? পারতেন না। বরং এক বছর পর আবার তার জীবন সাজানোর জন্য উঠে পরে লাগতেন। যাক গে কথায় কথা বাড়ে আমি পিউ কে নিয়ে যেতে চাই ব্যাস।

শওকত সাহেব চুপ করে বসে আছেন, বদরুল সাহেবের একটা কথাও ফেলে দেবার মতো না খুব ভালো করে জানা আছে তার। এরই মাঝে অভ্র বাড়িতে ডুকে। বদরুল সাহেব কে দেখেই তার বুঝা হয়ে যায় পিউ কে নিতে এসেছেন তিনি।
– আসসালামু আলাইকুম আংকেল, কেমন আছেন?
– এই তো বাবা ভালো, তুমি?
– ভালো আংকেল। আপনি কি মোবাশশিরা কে নিতে এসেছেন?
– জ্বী বাবা, দিশার বিয়ে ঠিক হয়েছে সামনের সপ্তাহে। তোমার দাওয়াত রইলো।
– জ্বী চেষ্টা করবো।
– বয়স তো হচ্ছে বাবা বিয়েশাদীর কথা কি চিন্তা করলে?
– আংকেল এই বিয়ে জিনিসটাতে আমার এলার্জি আছে। এমনেই ভালো আছি খামোখা উটকো ঝামেলা। আপনি বাবার সাথে কথা বলুন আমি রুমে যাচ্ছি।
– আচ্ছা। যাও

অভ্র বদরুল সাহেবের সাথে আর কথা না বলে রুমের দিকে রওনা দিলো। তখন পিউ সাথে দেখা হলো তার। পিউ তখন ব্যাগ দিয়ে বের হচ্ছে। পিউকে দেখেই শান্ত গলায় বললো,
– অতীতের থেকে বের হবার চেষ্টা করো মোবাশশিরা, খুব সুন্দর ভবিষ্যৎ তোমার অপেক্ষায় আছে।
– উনি ফিরবেন কথা দিয়েছেন।
– লাশের ডি.এন.এ টেষ্টের পর ও যদি তুমি সত্যিকে মেনে নিতে না চাও তাহলে আমি বলবো তোমার সত্যি ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন। অতীতকে আগলে আর কতোদিন থাকবে?
– আপনি ও কি অতীতকে আগলে রাখেন নি? ছাব্বিশ বছর আগে যা হয়েছে সেটাকে কেন্দ্র করে এখনো নিজের বর্তমানটাকে নষ্ট করছেন না? আজ অবধি বিয়েটুকু করেন নি। প্রতিমাসে আপনার নতুন গার্লফ্রেন্ড হয়। এসবের পরে আমাকে জ্ঞান দেয়াটা বোধ হয় মানায় না অভ্র ভাই।
– বাহ আজকের দিনটাই বুঝি মানুষের কথা শুনে আমাকে কাটাতে হবে। যাক গে, বিয়েতে যাচ্ছো আনন্দ করো।
– অবশ্যই।

অভ্র আর কথা বাড়ালো না, অতীতের কালো অধ্যায় সবার জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। কেউ সেটাকে আকড়ে ধরে বেঁচে থাকে, কেউ এডিয়ে। অভ্র রুমে গিয়ে গা এলিয়ে দিলো বিছানাতে। আজ বিকালের ঘটনাটা খুব ভাবাচ্ছে। ঐন্দ্রিলা নামক মেয়টি বারংবার চোখের সামনে ভাসছে। এমনটা হবার কারন বুঝতে পারছে না।

০৪.
মামা বাড়ি লাস্ট অনেকদিন আগে এসেছিলো পিউ। এখানে আসতে চায় না কারণ একটাই সেটা হলো বদরুল সাহেব শুধু ডাক্তার দেখাতে চান। একবার এক ডাক্তার তাকে হিপটোসিজমের মাধ্যমে আহাশের স্মৃতি ভুলাতে চাচ্ছিলো। শওকত সাহেব বাধা না দিলে হয়তো সেটা হয়েও যেতো। আরেক ডাক্তার গোটাখানিক রিভার্ট, মাইলাম নামক ঔষধ দিয়েছিলো, সেটা খেয়ে টানা ২৩ ঘন্টা ঘুমাবার রেকর্ড ও করে পিউ। মামু মানেই শুধু একেকটা ঝামেলার উদ্ভব ঘটাবেন। গতবার কোন এক ছেলেকে নিয়ে এসেছিলো, সারাদিন ঐ ছেলের সাথে না চাইতেও পিউকে ঘুরতে হয়েছে। এবার কি প্লান করে রেখেছে আল্লাহ জানে। বাড়িতে আসার সাথে সাথে দিশা তাকে জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটা বড় হয়ে গেছে, কে বলবে সামনের সপ্তাহে তার বিয়ে! ঘর গমগম করছে, আসমা বেগমের সব আত্নীয়স্বজন এসেছেন সাথে পিউ এর নানাবাড়ির মানুষে বাড়ি ঠাসা। সবার সাথে একঘন্টা যাবৎ কুশলাদি বিনিময়ের পর নিজের রুমের দিকে রওনা দিলো পিউ। নিজের রুমের দরজা খুলতেই চক্ষুচরাগ গাছ পিউ এর। যা দেখলো তার জন্য একদম প্রস্তুত ছিলো না সে। তার রুমে তখন……………

মুশফিকা রহমান মৈথি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে