#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#১৫তম_পর্ব
ঐন্দ্রিলার চোখ ছলছল করছে, কি বলবে বাবা ভেবে পাচ্ছে না। ঠিক তখন শরীফুল সাহেব একটাই কথা বলেন,
– তুমি যদি চাও আমি বিয়েটা ভেঙ্গে দেবার ব্যাপারে ভাববো। তবে একটা কথা কি, তোমার বিয়ের জন্য উপযুক্ত বয়স হয়েছে, আর অভ্রের পরিবার কিংবা অভ্র উভয়ই তোমার উপযোগী। আমি তোমাকে এখানে বিয়ে দিয়ে খুব নিশ্চিন্ত হতে পারবো। তাই তোমার মতামত জানাটা খুব দরকার।
শরীফুল সাহেবের কথায় ঐন্দ্রিলার উঝতে বাকি নেই যে তিনি এই বিয়েতে খুব সন্তুষ্ট। মলিন হাসির রেখা ঠোঁটের কোনায় টেনে ঐন্দ্রিলা বলে,
– বাবা, তোমার যদি মনে হয় এই বিয়েটাতে আমি সুখী হবো, তবে আমার ও কোনো আপত্তি নেই।
ঐন্দ্রিলা শুনে শরীফুল সাহেব খুবই খুশি হন। মেয়েটাকে একটা সৎ পাত্রের হাতে দিতে পারছেন ভেবেই উনি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন। এতোদিন মেয়েটার সাথে ঠিকভাবে কথা হতে পারছিলো না তাই খুব খচখচ করছিলো তার মন। মা মরা মেয়ে তার যদি এই বিয়েতে তার মতামত না থাকে তবে তিনি জোর করতে চান নি। এখন তিনি খুব নিশ্চিন্ত। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে যান তিনি। শরীফুল সাহেরবে যাবার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঐন্দ্রিলা। বাবার চোখে খুশীর ঝলক দেখতে পেয়েছে সে তাই অহেতুক কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আর অভ্রের সাথে তার বিয়েটা তো হয়েই গেছে সুতরাং পিছ পা হয়ে এখন তার পরিবারের মানুষদের হেনস্তার শিকার করে লাভ নেই। বিছানায় গা এলিয়ে দিলো ঐন্দ্রিলা। কাল বিয়ের শপিং এর জন্য অভ্র তাকে নিতে আসবে। যেহেতু মা নেই তার আর শরীফুল সাহেব এসব ব্যাপারে জড়াতে চাচ্ছেন না। তাই পিউ এবং আসমা বেগম তাদের সাথে যাবে। অভ্রের সাথে এতগুলো কাটাতে হবে এটা ভেবেই কোথাও না কোথাও একটা বিরক্ত কাজ করছে। কিন্তু উপায় নেই, লোকটার সাথে তার সংসার করতে হবে আর কিছু দন পর। এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমের অতল সাগরে ডুব দিলো ঐন্দ্রিলা।
সকাল ৯টা,
বদরুল সাহেবের সোফায় নীলাদ্রি বসা, উদ্দেশ্য সবাইকে ওবাড়িতে নিয়ে যাওয়া। দিশাও দু এক দিনের মধ্যে চলে আসবে। যেহেতু মা নেই সুতরাং খালাই বিয়ের সব দায়িত্ব নিবেন। এই কয়দিন বদরুল সাহেবের পুরো পরিবার তাদের বাড়িতেই থাকবেন। একটা জিনিস নীলাদ্রির খুব ভালো লাগছে যে এখন আর তাকে পিউকে দেখতে আসতে ছুতো লাগবে না। বিয়ের কদিন যখন তখন তাকে দেখতে পারবে। মেয়েটার প্রতি সুপ্ত অনুভূতিগুলো আজকাল খুব হয়রান করছে। তবে কি সাত বছর আগের অনুভূতিগুলো তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে! হবে হয়তো! হঠাৎ খেয়াল করলো পিউ নিজের রুম থেকে ব্যাগ পত্র নিয়ে বের হচ্ছে। সাদা একটা কুর্তি পরা, সাথে নীল ওড়না এবং নীল চুড়িদার। চুলগুলো এক পাশে বেণী করে রেখেছে। কোনো বাড়তি সাজসজ্জা নেই শুধু ঠোটে লিপবাম দেওয়া। অথচ মেয়েটাকে এতো অপরূপ লাগছে। নীলাদ্রি খেয়াল করলো তার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। বুকের বা পাশটা একটা চিনচিন ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। পিউ এসে নীলাদ্রির সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,
– হা করে কি দেখছেন? একটু হেল্প করুন না, হালকা ভারী ব্যাগটা। আমি একা পারছি না
পিউ এর কথা কানে আসতে চোখ সরিয়ে নিলো নীলাদ্রি। আরেকটু হলেই ধরা পড়ে যেতো, তাড়াতাড়ি ব্যাগটা পিউ এর হাত থেকে নিতেই বলে উঠলো,
– এতো ভারী কেনো? ইট ডুকিয়েছো নাকি ব্যাগে।
– ওমা! বিয়ে বলে কথা? আমি তো দু পক্ষের তাই না? তাহলে আয়োজন তো বেশি হবেই।
– তুমি কি ও বাড়ি যাবে নাকি?
– ভাবছি যাবো, দায়িত্বের একটা ব্যাপার আছে। লোকটা না থাকলেও দায়িত্বগুলো তো আছে তাই না?
পিউ এর মুখে এরুপ কথা শুনে বেশ অবাক হয় নীলাদ্রি। তবে কি পিউ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে আহাশ না ফেরার দেশে চলে গেছে। নীলাদ্রি অবাক চোখজোড়া দেখে পিউ কৌতুহলী কন্ঠে বললো,
– আচ্ছা আপনার কি আজকে অবাক হবার রোগ হয়েছে? আমি যাই বলছি শুধু অবাক চোখেই তাকিয়ে আছেন?
– তুমি কি বিশ্বাস করেছো আহাশ ফিরবে না?
– জ্বী। করেছি, না করে উপায় যে নেই। প্রমাণ চোখের সামনে আমার। সেদিন যখন আপনারা আমাকে আয়শা আপুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেদিন আমার মনে হাজারো প্রশ্নেরা একসাথে হানা দেয়। এতোদিন সামনে থাকা সত্ত্বেও যেই সত্যিগুলো আমি দেখতে চাই নি সেগুলো আমার চোখের সামনে চলে আসে। আহাশ আর ফিরবে না এটা আমাকে মেনে নিতে হবে। ভালো থাকার নাম করে যে অভিনয়ে আমি মেতে উঠেছি সেটাতে আমি আজ ক্লান্ত। বাস্তবের মুখোমুখি তো হতেই হতো বলুন আমার বাস্তবটা বুঝতে অনেক দেরী হয়ে গেছে এটাই।
পিউ এর গলা ধরে এসেছে। কথা বলতে পারছে না সে।চোখ তার ছলছল, এই বুঝি অশ্রুগুলোকে চোখজোড়া মুক্তি দিবে। তাই নীলাদ্রি আর কথা বাড়ালো না। মেয়েটা এতোদিন আশায় বেঁচে ছিলো। আজ আশাটুকু ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে। তার হৃদয় শূন্যতায় ঘেরা। মাঝে মাঝে সত্যিগুলো এতোটা কষ্টদায়ক হয় তখন মনে হয় মিথ্যেগুলো বেশ ছিলো। নীলাদ্রির খুব ইচ্ছে করছিলো মেয়েটার হাতটা ধরে বলতে “তুমি একা নও পিউ আমি আছি”। কিন্তু সেটা বলার অধিকারটা তার নেই।
সেদিন আয়শার সাথে নীলাদ্রির বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়েছে। পিউকে আয়শা বিভিন্ন প্রশ্ন করেছিলো, তার রেকর্ডিং ও নীলাদ্রি শুনেছে। যখন আহাশের সাথে কথা পিউ এর আহাশের প্রতি একটা দূর্বলতা তৈরি হয়। পিউ এর জীবনের না পাওয়া অংশগুলো এতোই বেশি যে আহাশের মৃত্যুটা কিছুতেই মেনে নিতে পারে নি পিউ। আজ যখন পিউকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেছে আয়শা, পিউ নিজের প্রশ্নের জালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে। এতোদিনের মিথ্যের দুনিয়া যেভাবে গড়িয়ে ছিলো সেভাবেই খসে পড়ে গেছে। পিউ চোখের থেকে অঝর পানি পড়েছে। আহাশের মৃত্যুর পর এক ফোটা পানি তার পড়ে নি, কোথাও না কোথাও একটা ক্ষীণ আশা ছিলো। কিন্তু আজ সেটাও শেষ। সবাই তাকে বিধবা বললেও নিজের মনে আহাশের ফিরার আশা ছিলো। কিন্তু সেদিন সেটাও শেষ হয়ে গেছে। খুব কেদেছে সে, আশা ভাংগার অশ্রু ছিলো সেটা।
১৭.
দোকানে একের পর এক শাড়ি দেখে যাচ্ছে শারমিন বেগম। শারমিন বেগমের পাশে আহানা, ঐন্দ্রিলা, পিউ বসা। ঐন্দ্রিলার কোনো মতামত ই নেই এই ব্যাপারে। বসার দরকার বসে আছে সে। হঠাৎ……
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি