শ্রাবণ মেঘের ভেলা ১২তম পর্ব

0
1370

#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#১২তম_পর্ব

– আজ কি এখানেই বসে থাকার প্লান তোমার?

অভ্রের নির্বিকার প্রশ্নে ঐন্দ্রিলা করুণ চোখে তার দিকে তাকায়, তার কি করা উচিত কিছুই মাথায় আসছে না। একটা বিকেলে তার জীবনটা এভাবে পালটে যাবে কল্পনাতেও ছিলো না। এদিকে শরীফুল সাহেব দু-তিনবার ফোন ও করে ফেলেছে। ভাঙা কন্ঠে বললো,
– আমি বাড়ি যাবো, প্লিজ। বাবা ওয়েট করছে।
– তুমি হয়তো ভুলে গেছো আজ আমাদের বিয়ের প্রথম রাত। তোমাকে আজ আমার সাথেই থাকতে হবে।
– আপনি এমন কেনো করছেন? আমার সর্বনাশ তো করেই ফেলেছেন আর কি চাই? আমি তো আপনার কথামত আপনাকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছি তাহলে? প্লিজ আমাকে যেতে দিন।

এবার অভ্র এক হাতে ঐন্দ্রিলার মুখ চেপে ধরে নিজের কাছে নিয়ে এসে ক্ষিপ্ত কন্ঠে,
– তোমার কি মনে হয় তোমাকে ছেড়ে দেবার জন্য তোমাকে বিয়ে করেছি? কি বলেছিলে আমি নাকি চরিত্রহীন, আমি নাকি লুইচ্চা? কতো মেয়ের জীবন নষ্ট করেছি তার ঠিক নেই। যখন ক্লেইম দিয়েই দিয়েছো তবে সেটা প্রুভ করার দায়িত্ব ও তো আমার তাই না। এবার আমার আসল রুপটা তুমি দেখবে!

একটা সময় ব্যাথায় কুকিয়ে উঠে ঐন্দ্রিলা। ঐন্দ্রিলার চোখ থেকে অবিরাম পানি পড়েই যাচ্ছে। অভ্রের দেখোও না দেখার ভান করছে। রাগে মাথা তার ঠিক নেই। পারলে জ্যান্ত কবর দেয় ঐন্দ্রিলাকে। মজা, ঠাট্টা এক পাশে কিন্তু তার এতোদিনের সম্মান, এতোদিনের তৈরি করা ইমেজ পুরো ধুলোয় মিশিয়ে গেছে। অভ্র চৌধুরী আজ অভ্র চৌধুরী হয়েছে নিজের যোগ্যতায়। এমন ও দিন গেছে দু ঘন্টাও ঘুমায় নি কারণ সে তার বাবার টাকায় প্রতিষ্ঠিত হতে চায় নি। একত্রিশ বছরে এতো বড় একটা বিজনেস আম্পায়ার তৈরি করা চারটা খানিক কথা নয়। সেদিন যখন ওসি তাকে ফোন দিয়ে থানায় আসার কথা বলেছিলো তার থেকে হয়তো লজ্জাজনক কিছুই তার জন্য ছিলো না। কমিশনার আংকেল পরিচিত না থাকলে হয়তো এটা একটা নিউজ হয়ে যেতো। তাও যে মানুষ তা জানে না সেটা নয়। অফিসের কানাগোসা হচ্ছে, এক-দুইটা ক্লাইন্ট ও ব্যাপার নিয়ে জানতে চাচ্ছে। সব মিলিয়ে রাগ, ক্ষোভ যেনো মাথায় ঝেকে বসেছে। ঐন্দ্রিলাকে তার ভুলের শাস্তি পেতেই হবে। ঐন্দ্রিলাকে এক রকম ধাক্কা মেরে গাড়ির দরজা খুলে বের হল। তারপর ঐন্দ্রিলার সাইডের দরজাটি খুলে শক্ত হাতে ঐন্দ্রিলাকে হিরহির করে টানটে টানতে বাসায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করলো। ঐন্দ্রিলা বারবার তার হাত ছাড়াবার চেষ্টা করছে, একটা ছাড়িয়ে ফেললে ঐন্দ্রিলা পেছনের দিকে দৌড় লাগায়। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারে না। অভ্র তাকে ধরে ফেলে, এরপর কাধে তুলে বাড়ির দিকে হাটা দেয়। এ বাড়িটা শহর থেকে বেশ দূরে। একটা এক তালা বাড়ি, মেঘের ভেলাতে শিফট হবার আগে একটা সময় এখানেই থাকতো অভ্র। ঐন্দ্রিলাকে নিয়ে মেঘের ভেলায় উঠা সম্ভব নয়। তাই শহর থেকে দূরে এই বাড়িটিতেই নিয়ে এসেছে। ঐন্দ্রিলা ইচ্ছে মতো কিল ঘুষি দিয়েই যাচ্ছে অভ্রকে। তাতে অভ্রের কিছুই যায় আসছে না।

একটা অন্ধকার রুমে বেডের উপর এক রকম ঐন্দ্রিলাকে ছুড়ে মারে। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে ঐন্দ্রিলার। বাড়িটিতে কেউ নেই। রুমটি অন্ধকার হলেও একটা আলো-ছায়ার আবছা আভা আছে, তাতেই অভ্রের রুদ্রমুর্তি দেখা যাচ্ছে। অভ্র কাছে আসতে লাগলে এক প্রকার চিৎকার করে কাদতে লাগে ঐন্দ্রিলা,
– প্লি যেতে দিন আমায়, আমার সব তো শেষ করে দিয়েছেন এবার আমাকে মুক্তি দিন। আমি ক্ষমা চাচ্ছি আপনার কাছে, আমি কোনোদিন আর আপনার পেছনে লাগবো না প্লিজ, আমার আত্নসম্মান্টুকু নষ্ট করবেন না। হাত জোর করছি।
– তাহলে বুঝতে পারছো আত্নসম্মানহানিটা কতোটা গুরুতর। আজ আমি তোমার সাথে কিছু করে তোমাকে পঁচার জন্য ফেলে দিলে কি হতে পারে? আমার কিচ্ছু যায় আসবে না, তোমার বাবা, ভাই এর সম্মান হানি হবে। তোমার সম্মান হবে। যেমনটা আমার হয়েছে

ঐন্দ্রিলার বাহু টেনে আমাকে নিজের কাছে নিয়ে এসে চাপা স্বরে কথাগুলো বলে অভ্র। একটু থেমে আবার বলে,
– তোমার কারণে আমার এতোদিনের রক্ত-ঘামে গড়ে তোলা রেপুটেশনে আঘাত এসেছে। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না তুমি আমার কতটা ক্ষতি করেছো। সমস্যা নেই আমি তোমাকে ছূয়ে দেখবো না। আমি তোমার সাথে সংসার করার জন্য তোমাকে বিয়ে করি নি। বাসায় বিয়ের তোড়জোড় করছে, আমার তাই একটি উপায় লাগতো। তুমি আমার উপায়, এক সপ্তাহের মধ্যে তোমার বাড়ি আমার বাবা-ছোট মা যাবে। চাইলে মানা করে দিতে পারো বিয়ের জন্য তাতে আমার আপত্তি নেই। তবে ভেবো না আমি তোমাকে ডিভোর্স করে দিবো। তুমি যদি কোনোদিন কাউকে বিয়ে করতে যাও তখন আমি এই সার্টিফিকেটটা শো করবো। তোমার বাবা-ভাইয়ের সম্মানহানি হবে। তোমার সম্পূর্ণ ভরণ পোষণ আমার থাকবে, কিন্তু স্ত্রীর যে সম্মান সেটা তুমি আমার কাছে কখনই পাবে না। আমি তোমাকে আমার বউ এর অধিকার ও দিবো না, আবার শান্তিতে কারোর হতেও দিবো না। তোমার জন্য আমার যতটা হেনস্তা হতে হয়েছে সব উশুল করে ছাড়বো।

বলেই সেখান থেকে চলে যায় অভ্র। ঐন্দ্রিলার মাথা যেনো পুরো ফাঁকা হয়ে আছে, জীবনটা এভাবে পালটে যাবে কল্পনাতে ছিলো না। যে মানুষটাকে সে দেখতেই পারে না সে তার বর। কিন্তু সেটা শুধুই এবং শুধু কাগজের নাম মাত্র। ছোটবেলা থেকে বিয়ে নিয়ে ঐন্দ্রিলার স্বপ্নের শেষ ছিলো না। জীবনে কখনো প্রেম নামক জিনিসটির প্রশ্রয় দেয় নি সে। বান্ধবীরা সব সারাক্ষন নিজেদের এবং তাদের বয়ফ্রেন্ডের গল্প তার কাছে করতো, কিন্তু ঐন্দ্রিলার একটি কথা সে তার বরের সাথে প্রেম করবে। কোনো ছেলে প্রোপোজ করলেও সেটার কখনো হ্যা সূচক উত্তর দেয় নি। সে বিয়ের আগে প্রেম করবে না। অথচ আজ এমন এক সন্ধ্যায় অভ্র চৌধুরীর সাথে তার বিয়ে হয়ে গেলো। কি অদ্ভুত না এই বিয়ে নাকি কোনো বিয়েই নয়। একটা নামের সম্পর্ক। এমন একটা কাটা হয়ে রবে এই বিয়েটা যেখানে সেটাকে গিলতেও পারা যাবে না আবার বের ও করা যাবে না। গলায় আটকে থাকবে সারাটাজীবন। একটা সময় কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে পড়ে ঐন্দ্রিলা।

রাত ৩টা,
রুমের লাইন অন করতেই অভ্র দেখে ঐন্দ্রিলা গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। অভ্র খেয়াল করলো বৃষ্টির কারণে রুমটি বেশ ঠান্ডা। ঐন্দ্রিলার ভেজা জামাও শুকিয়ে গেছে। কাছে যেতেই বুকে একটা মোচর লাগলো, মেয়েটার চোখ মুখ ফুলে আছে। কাদতে কাদতে চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। চোখের পানি শুকিয়ে গালে রেখা হয়ে আছে। এমনটা অভ্রও তো চায় নি। কিন্তু রাগের বশে এমন কাজ করে ফেললো। বিয়েটা হয়তো না করলেই হতো। তখন এতোটা রাগ উঠেছিলো যে ভালোমন্দের জ্ঞানটুকু ছিলো না। যাক গে, এখন যদি ঐন্দ্রিলা তাকে সামাজিক ভাবে বিয়ে না করতে চায় তাহলে অভ্র তাকে জোর করবে না। এমনিও এই বিয়ে নামক সম্পর্কে নিজেকে সে জড়াতে চায় না। এখন শুধু সকালের অপেক্ষা।

১৫.
ঐন্দ্রিলাদের বাসায় সবাই বসে আছে। শরীফুল সাহেবের যেনো চিন্তার শেষ নেই। মেয়েটা সারারাত ফোন ধরে নি, একটা সময় পর ফোনটাও বন্ধ দেখাচ্ছে। নীলাদ্রি যেখানে যেখানে ঐন্দ্রির যাবার সম্ভবনা রয়েছে সেখানে খোঁজ লাগিয়েছে। আয়শার চেম্বার থেকে সরাসরি পিউকে নিয়ে নিজের বাসায় ই আসে সে। পিউ এখানেই সারারাত ছিলো। বদরুল সাহেব বসার রুমে শরীফুল সাহেবের সাথে বসা। শরীফুল সাহেবের বি.পি এখন বেড়ে আছে। পিউ তকে তেতুল পানি খাওয়াচ্ছে। মেয়ে তার অতি আদরের। কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না মেয়ের এভাবে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া। ২৪ ঘন্টা না হওয়ায় কোনো পুলিশে রিপোর্ট করতে পারে নি। আর আজকালকার পুলিশ? রিপোর্ট লেখাতে গেলে তার মেয়ের নামেই যা তা কথা বলবে। মেয়েটার কি কোনো বিপদ হলো!
– আচ্ছা আমার মেয়েটা বেঁচে আছে তো?

শরীফুল সাহেবের এ কথা শুনে বদরুল সাহেব বলেন,
– এভাবে ভেঙে পড়লে হয় শরীফ ভাই? আপনি তো এতো দূর্বল মানুষ নন। হঠাৎ তাহলে কি হয়েছে? ঐন্দ্রি মার কিচ্ছু হয় নি। মেয়েতা হয়তো কোনো ঝামেলাতে আটকে গেছে। আমাদের মেয়েকে তো আমরা চিনি। ও অনেক ভালো মেয়ে। খুব দায়িত্ববান। নিশচয়ই কিছুতে আটকে গেছে।

এদিকে নীলাদ্রির দিকে যেনো তাকানোই যাচ্ছে না। মাথাটা দু হাত দিয়ে চেপে সোফায় বসে পড়ে সে। সারারাত কম খোঁজাখুজি তো করে নি সে। নীলাদ্রিকে এমন দেখতে কেনো জানে পিউ এর একেবারে ভালো লাগছে না। এই কয়দিন লোকটাকে যতটুকু দেখেছে লোকটাকে হাসি-ঠাট্টা ই করতেই দেখেছে সে। ধীর পায়ে হেটে তার পাশে বসে পিউ। কাঁদে হাত দিয়ে শান্ত গলায় বলে,
– ঐন্দ্রি ঠিক চলে আসবে দেখবেন, কালতো আবহাওয়া ভালো ছিলো না। হয়তো কোথাও আটকে গেছে।
– আমি ভাই বলার যোগ্য নই পিউ।

নীলাদ্রির অসহায়ত্ব কোথাও যেনো পিউকেও নাড়িয়ে দিচ্ছে। কোথাও যেনো একটা খারাপ লাগা কাজ করছে, আচ্ছা এই খারাপ লাগাটা কি ছোয়াচে। তা না হলে নীলাদ্রির এভাবে ভেঙে পরা দেখে পিউ এর কেনো খারাপ লাগছে। হঠাত খেয়াল করলো………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে