#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#১১তম_পর্ব
জ্যাম ছাড়তে লাগলে খেয়াল করলো, নীলাদ্রি দৌড়াতে দৌড়াতে এসে গাড়িতে উঠলো। পুরো কাক ভিজা যাকে বলে। এমনেই ভীষণ মেজাজ খারাপ উপরে নীলাদ্রির অদ্ভুত কাজে বেশ বিরক্তি স্বরে জিজ্ঞেস করলো পিউ,
– কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছিলো যে আমাকে গাড়িতে একা রেখে ছুট লাগিয়েছিলেন?
তখনই নীলাদ্রি একটা প্লাষ্টিকের থলে পিউ এর হাতে ধরিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিমাতে বলে
– এতে গরম গরম পিয়াজু আর চপ আছে। আইসক্রিম আনতে চেয়েছিলাম কিন্তু একে বৃষ্টি উপরে আইসক্রিম খেলে শরীর খারাপ করবে। খালার হাতের মতো মজা না হলেও বেশ ভালো খেতে।
নীলাদ্রির কথা শুনে প্যাকেটটা খুলে দেখে আসলেই প্যাকেটে পিয়াজু আর চপ রয়েছে। পিউ এর আশ্চর্যের যেনো সীমা নেই। এই লোক বৃষ্টির মধ্যে এগুলো আনতে ছুটেছিলো! লোকটা কখন কি করে তার আসলেই ঠিক নেই। এ কথা সত্য বৃষ্টি হলে পিউ এর ভাজাপোড়া খেতে সেই লাগে। কিন্তু এটা নীলাদ্রির জানার কথা নয়। তবে কি সে নিজের জন্য এগুলো এনেছে। তা হবার সম্ভবনা শুন্যের কাছাকাছি কারণ নীলাদ্রি মোটেই ভাজাপোড়া খেতে ভালোবাসে না। তার কথা জিমে যেয়ে এতো সুন্দ্র বডিটা তেলের ড্রাম খাবার জন্য সে বানায় নি। তবে এগুলো শুধুমাত্র পিউ পছন্দ করে বলে এনেছে, কিন্তু কেনো!! প্যাকেটটা প্রচুর গরম বুঝাই যাচ্ছে নীলাদ্রি দাঁড়িয়ে থেকে এগুলো ভাজিয়ে এনেছে। পিউ অবাক দৃষ্টিতে নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে ভেজা কাকের মতো লাগছে নীলাদ্রি কে। পরনের সাদা শার্টটা গায়ের সাথে লেগে রয়েছে। চুল থেকে এখনো টুপটুপ করে পানি পরছে, অথচ সে দিকে তার খেয়াল নেই। আপনমনে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। লোকটাকে এখন কেনো যেনো ততোটা বিরক্তিকর লাগছে না।
– চোখ দিয়ে আমাকে গিলে খাওয়া বাদ দিয়ে এগুলো খাও। ঠান্ডা হয়ে গেলে খুব বাজে খেতে লাগে, মনে হবে ঠান্ডা তেলে চুবানো আটার দলা খাচ্ছো, ট্রাস্ট মি।
নীলাদ্রির কথা শুনে সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নেয় পিউ। নিলাদ্রির কথা শুনে বেশ লজ্জা ও পায় সে। সে মোটেই নিলাদ্রিকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিলো না। এভাবে না বললেও পারতো নীলাদ্রি। খানিকটা ক্ষুদ্ধ স্বরেই পিউ বলে উঠলো,
– আমার বয়েই গেছে আপনাকে দেখতে, আর এগুলো যখন আপনি এনেছেন তখন আপনি ই খান।
– আমি তো তৈলাক্ত জিনিস খাই না, সাতদিন তোমার সামনেই তো ছিলাম তোমার তো জানার কথা। আর আমি এগুলো তোমার জন্য এনেছি
– আমি কি বলেছি আনতে?
– তা বলো নি, তবে এগুলো যে তোমার ভালো লাগে তাতো আমার জানা আছে
– আপনি কিভাবে জানেন?
– এটা এমন কোনো বড় ব্যাপার নয়, ইচ্ছে থাকলেই জানা যায়। তুমি আজব মেয়ে, কোথায় ভিজে টিজে তোমার জন্য এগুলো দাঁড়িয়ে থেকে গরম গরম ভাজিয়ে আনলাম। কোথায় থ্যাংক্স দিবে তা না। এখন যদি আমার জ্বর টর বাধে সেবা তো তুমি করবে না! হাহ, সব আমার কপাল
– উদ্ধার করেছেন এতো কিছু কিনে এনে। জানতাম, খোটা তো দিবেন ই। এখন জ্বরটা বাধলে আমার দোষ হবে। আসলে কি বলুন তো আপনি এগুলো ইচ্ছে করে করেছেন, যাতে যখন তখন আমাকে খোটা দিতে পারেন।
পিউ বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে কথা গুলো বললো। পিউ এর কথা শুনে হো হো করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে নীলাদ্রি। মেয়েটার মধ্যে এখনো সেই কিশোরী ছাপটা রয়েই গেছে। নীলাদ্রির হাসিটা খুব সুন্দর। কোনোদিন কোনো পুরুষকে এতো সুন্দর করে হাসতে দেখে নি পিউ। খুব অমায়িক একটা হাসি। পিউ আর তাকাতে পারছে না, একটা অদ্ভূত আকর্ষণীয় ব্যপার আছে নীলাদ্রির মধ্যে। এটা আগেও বেশ কিছুবার খেয়াল করেছে কিন্তু পাত্তা দেয় নি। তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে বাহিরের দিকে তাকালো পিউ। বৃষ্টির বেগ কমে নি। বরং বেড়েই যাচ্ছে। আচ্ছা মানুষের মনের উপর কি প্রকৃতির কোনো প্রভাব রয়েছে। নয়তো যাকে কিনা পিউ এর এতো বিরক্তিকর লাগে তার হাসিকে সৌন্দর্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলার উপক্রম হতো। না, মোটেই না।
রাত ৮টা,
আয়শা এর চেম্বারে বসে আছে নীলাদ্রি এবং পিউ। আয়শা একজন সাইকোথ্যারাপিস্ট। নীলাদ্রির কলেজ ফ্রেন্ড, সেই জন্য পিউ এর ব্যাপারটা ওর সাথে শেয়ার করেছে। যদিও পিউ এর ব্যাপারটা খুব সিরিয়াস ক্যাসের মধ্যে পড়ে না কিন্তু কেসটা অনেক ডেলিকেট। আর সবথেকে বড় সমস্যা পিউ কখোনোই তার কোনো কিছু নীলাদ্রির সাথে শেয়ার করতে রাজী নয়। আয়শা একে একটি মেয়ে এবং আগেও এমন একটি কেস হ্যান্ডেল করেছে। তাই সেটাকে ঠিক কিভাবে হ্যাল্ডেল করবে তার জন্য আয়শা পরামর্শের খুব প্রয়োজন নীলাদ্রির। আয়শা নীলাদ্রিকে বাহিরে ওয়েট করতে বললো। নীলাদ্রি পিউকে চোখের ইশারা করে বোঝালো সে আছে, সে বাইরেই আছে। নীলাদ্রি যাবার পর থেকে আয়শা খুব সুন্দরভাবেই পিউকে বললো,
– মোবাশশিরা, তাই তো। আমরা প্রথমে নিজেদের পরিচয় তা দেই। আমি আয়শা সিদ্দিকী, পেশায় একজন সায়কোথ্যারাপিস্ট
– মোবাশশিরা জাহান, একটা এন.জি.ও তে চাকরিরত আছি।
– আচ্ছা মোবাশশিরা চলো, ওই সোফাটাতে বসবে। আমরা শুধু গল্প করবো।
একটা অফহোয়াইট কালয়ারের সোফাটায় বসতে ইঙ্গিত করে আয়শা। পিউ প্রথমতে খানিকটা ইতস্তত করলেও পরে গিয়ে সোফাটায় বসে। সোফাটা বেশ হ্যালানো টাইপ অনেকটা রকিং চেয়ারের মতো। সিনেমায় সাধারণত এভাবেই কনসাল্ট করতে দেখা যায় রোগীদের। রোগীরা এমন একটা সোফা কাম চেয়ারে বসে নিজের সব কিছু বলতে থাকে এবং সাইকোথ্যারাপিস্টটি রেকর্ড করতে থাকে। কিন্তু বাস্তব জীবনে এমন হয় এটা জানা ছিলো না পিউ এর। পিউ এর কাছে নিজেকে একজন খুব তারছ্যাড়া মানুষের মধ্যে একজন মনে হচ্ছে, লাইক সাইকোপ্যাথ। সোফায় বসতে বসতে ঠাট্টার ছলেই বলে বসে,
– আমি কিন্তু পাগল নই
– আমি জানি, তুমি পাগল নও। আমি ও পাগলের ডাক্তার নই। আমি শুধু তোমার সাথে গল্প করবো।
– কারো সাথে গল্প করলে বুঝি সেটা রেকর্ড করতে হয়?
– তুমি খুব ইন্টেলিজেন্ট একটা মেয়ে। আমি আমার পেশায় অভ্যস্ত। যার সাথেই গল্প করি সেটা রেকর্ড করি। তাই তুমি ব্যাতিক্রম হবে না। আচ্ছা পিউ ছোটবেলার সবচেয়ে সুখময় স্মৃতি কোনটা তোমার?
– আমার? তেমন কিছু মনে পরছে না। হ্যা একবার বাবা আমার জন্য একটা গোলাপি রং এর সাইকেল কিনে এনেছিলেন। সেটা আমার খুব ভালো লাগতো। কিন্তু মা কোনোদিন সেতা চালাতে দেননি। মেয়ে মানুষ ধিঙ্গিদের মতো সাইকেল চালাবে এতা মায়ের একদম পছন্দ ছিলো না। তিনি আমাকে সবসময় বলতেন আমি নাকি মেয়ে, মেয়েদের কিছু নিয়মের মধ্যে থাকতে হয়।
– আচ্ছা তোমার ছোটবেলার সবথেকে কষ্টের মূহুর্ত কোনটি?
– ……
– না বলতে চাইলে আমি জোর করবো না
– না, তেমন কিছু না। আমার বাবা যখন মারা যান সেটা আমার জীবনের সবথেকে কষ্টের মূহুর্ত ছিলো। বাবা আমার জীবনের অনেক বড় একটা অংশ ছিলেন। উনি আমাকে অন্যভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। উনি কখনো আমাকে বেধে রাখেন নি, যখন যা করতে চেয়েছি সেটার ছুট দিতেন। আমার খুব নাচতে ভালো লাগতো, মার ব্যাপারটা ভালো না লাগলেও বাবা আমাকে নাচের স্কুলে ভর্তি করান। বাবা মারা যাবার পর যদিও মামু আমার কোনো কিছুতেই কোনো কমতি রাখেন নি তবে কোথাও যেনো খুব ফাঁকা লাগতো আমার। আমার তো কোনো ভাই বোন ছিলো না, বাবাই আমার সবথেকে ভালো বন্ধু ছিলেন। বাবা মারা যাবার পর আমি কারোর সাথে নিজের মনে কথা বলতে পারতাম না। আমার কথা বলার সাথীটি ই যেনো চলে গিয়েছিলো।
পিউ এর গলা ধরে এসেছে, আয়াশা সেটা বুঝতে পেরে কথাটা পাল্টে দিলো।
– আচ্ছা মোবাশশিরা, তোমার কিশোরী সময়ের কথা বলো। সেই সময়টা তো মনটা উড়ো উড়ো থাকে, হঠাৎ করেই ভালো লেগে যায় কাউকে। তোমার কি এমন কেউ ছিলো?
– না, সবসময় গার্স স্কুল-কলেজে পড়েছি আমি। ছেলেদের সাথে কথাই হতো না। মা আমাকে আমার কাজিনদের সাথেও বেশি কথা বলতে দিতেন না। বাপ মরা মেয়ে, মামার বাড়ি থাকি যদি কোনো উচু নিচু হয়ে যায়। তবে একটা লোক আমাকে চিঠি দিতো। পড়তে ভালো লাগতো কিন্তু একদিন মায়ের হাতে পড়ে যাওয়ায় আমি আর ভয়ে লোকটার চিঠিগুলো নিতাম না। পড়ে থাকতো মামুর লেটার বক্সে। একটা সময় চিঠি দেওয়াটাও বন্ধ হয়ে যায়। হয়তো লোকটা বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলো।
আয়শা খানিকটা থেমে প্রশ্ন করে,
– আহাশের সাথে তোমার পরিচয় কিভাবে হয়েছিলো?
আয়শার প্রশ্নে মুচকি হেসে বলে,
– আমাদের বিয়ের কথা চলছিলো, আমাকে যেদিন ও বাড়ি থেকে দেখতে এসেছিলো সেদিন উনার সাথে প্রথম দেখা। একটা ক্রিম কালারের চেক শার্ট এবং জিন্স পড়ে এসেছিলেন। বেশ হ্যান্ডসাম লাগছিলো দেখতে। চুলগুলো জেল দিয়ে বেশ পরিপাটি করা। খুব গাম্ভীর্যের চাপ ছিলো। সেদিন ই উনার সাথে আমার প্রথম দেখা।
– প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেললে? এমন কি ছিলো যে তার জন্য নিজের পুরো জীবনটা এভাবে নষ্ট করছো। বেঁচে তো নামে আছো, আসলে তো ভেতর থেকে একটি মরা মানুষ। যে হাসতে গেলেও দু বার ভাবে
পিউ চুপ, আসলেই তো কি এমন ছিলো যে এখনো তাকে ভুলতে পারছে না পিউ। অপেক্ষায় বসে আছে হয়তো সে ফিরবে, কেনো এতোটা ভালোবাসে পিউ তাকে। আয়শার প্রশ্নটি পিউ এর ভেতরটিকে কেনো জানে প্রশ্ন করতে বাধ্য করছে, কেনো এতোটা ভালোবাসে সে আহাশ কে।
১৪.
বাড়ির গেটের বাহিরে গাড়িতে বসে রয়েছে ঐন্দ্রিলা এবং অভ্র। খুব ভয় পাচ্ছে ঐন্দ্রিলা, বাবা কিংবা ভাই যদি জানতে পারে তবে কি উত্তর দিবে তাদের। হাত পা যেনো অবশ হয়ে আসছে।
– আজ কি এখানেই বসে থাকার প্লান তোমার?
অভ্রের নির্বিকার প্রশ্নে ঐন্দ্রিলা …………..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি