শ্রাবণ মেঘের ভেলা অন্তিম পর্ব

0
2098

#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#অন্তিম_পর্ব

কোথাও না কোথাও অভ্রের কথাগুলো শওকত সাহেবকে অনেক হার্ট করেছে। হঠাৎ বুকে তীব্র ব্যাথা অনুভূত হতেই পার্কের বেঞ্চিতে বসে পরে সে। সারাটা রাত তার ঘুম হয় নি। অভ্রের কথাগুলো শুধু কানে ভাসছিলো। এমনেই হার্টের প্যাশেন্ট, উপরে সারাটা রাত শুধু একটা কথাই ভেবেছেন পিউ এর জীবনটাকি তিনি ইচ্ছে করে নষ্ট করে দিচ্ছেন। সত্যি বলতে মনের মাঝে তিনি একটা আশায় ছিলেন আহাশ হয়তো ফিরে আসিবে। জানতেন এই আশাটুকু মিথ্যে তবুও আশায় ছিলেন তিনি। কাল রাতে অভ্র আহাশের প্রাপ্ত্য বডির ডি.এন.এ রিপোর্ট দেখালে সেই আশাটুকুও তার শেষ হয়ে যায়। চিন্তা আর কষ্টের ফল এই শরীর খারাপ। ব্যাথাটুকু যখন তীব্র হতে লাগলো, তখন মনে হচ্ছিলো জানটুকু হয়তো বের হয়ে যাবে৷ হুট করে মনে হতে লাগলো, নিজের ভুলের কারণে এতোটুকু মেয়েটাকে যে দুখের সাগরে নিমজ্জিত করে রেখেছেন তার বন্ধুর কাছে কি দায়ী থেকে যাবেন! এই অপরাধের জন্য তাকে এই শাস্তি তো এই ইহকালে না পেলেও পরকালে তো ঠিক ই পেতে হবে। তিনি তো নিজের কথা রাখতে পারেন নি। এবার যদি তিনি কোনো রুপে বেঁচে যেতেন তবে পিউ এর জীবনটাকেও সাজানোর দায়িত্বটুকু কাধে নিবেন। চোখগুলো অন্ধকারে বন্ধ হয়ে আসছে। হঠাৎ মনে হলো কেউ তাকে ডাকছে, একটা পুরুষালি কন্ঠ। মনে হচ্ছে আহাশ তাকে ডাকছে, আহাশের সাথে কি তবে এই শেষ সময়ে দেখা হবে। নাকি নিছক কল্পনা মাত্র_______

দুপুর ১২টা,
হাসপাতালের ইমার্জেন্সির বাহিরে চেয়ারে শারমিন বেগম বসে আছেন। আই.সি.উ তে শওকত সাহেবকে শিফট করা হয়েছে। হার্ট এটার্ক করেছেন বলে ডাক্তাররা অনুমান করছে। তখন পার্কে নীলাদ্রি জগিং করছিলো বিধায় তাড়াতাড়ি তাকে হাসপাতালে শিফট করে সে। অভ্রের মুখ শক্ত হয়ে আছে। মুখের ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। কাল রাতে বাবাকে অনেক কড়া কথা শুনিয়েছে সে। এখন আফসোস হচ্ছে। হয়তো এতোটা শক্ত না হলেও পারতো সে। বুঝিয়ে বললে হয়তো তিনি বুঝতেন। তবে সমস্যা একটি আড়াই বছর নরম ভাবে বুঝিয়েছে সে, কিন্তু শওকত সাহেব তার জিদ ছাড়েন নি। তাই বাধ্য হয়ে কড়া হতে হয়েছে তাকে। ঐন্দ্রিলা এসে কাধে হাত রাখতেই করুণভাবে তাকে বলে,
– বাবার কিছু হয়ে গেলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না ঐন্দ্রি।
– ইনশাআল্লাহ কিছু হবে না দেখো।

অপরদিকে,
আহানা পিউ এর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে বেশ ভালো ভাবেই সামলে নিয়েছে সে। পিউ এবং নীলাদ্রির মাঝে অযাচিত মানুষ হতে চায় না সে। ভাগ্যে থাকলে তার জীবনেও ভালোবাসা ঠিক আসবে। পিউ এর চোখ থেকে পানি অঝর ধারায় বয়ে যাচ্ছে। আহানা তাকে শান্তনা দিয়ে বলে,
– ভাবী আমার বাবা অনেক স্ট্রং দেখো কিছু হবে না।
– আমি তো এভাবে বিয়ে করতে চাই নি, আহানা। এ বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর থেকে বাবাকেই আমি নিজের গার্ডিয়ান মেনেছি। নিজের বাবা হিসেবে মেনেছি। তার কিছু হয়ে গেলে কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না আমি। দরকার নেই আমার বিয়ের, বাবা যা চাইবেন তাই হবে। তাই হবে।

পিউ এর কথাগুলো শুনে আহানার খুব খারাপ লাগছে, এতো কাল পর যখন সুখ কুড়াবার সময় আসলো তখন ই এই অঘঠন। এমন কেনো হয় প্রতিটা বার। পিউ এর কথাগুলো নীলাদ্রি আড়াল থেকে শুনলো। তার কিছুই বলার নেই, পিউ এর জায়গায় সে সঠিক। থাক না কিছু ভালোবাসা অপূর্ণ। সব ভালোবাসার পূর্ণতা পেতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই_____

সাত দিন পর,
শওকত সাহেবকে বাড়িতে আনা হয়েছে। এখন অবস্থা বেশ ভালো, মাইল্ড হার্ট এট্যাক হয়েছিলো। ডাক্তার হাই ডোজের ঔষধ দিয়েছেন। বদরুল সাহেব তাকে দেখতে এসেছেন। পিউ তাকে জানিয়ে দিয়েছে সে বিয়ে করবে না। এই বিয়ের কোনো কথা যাতে শওকত সাহেবের সামনে না বলা হয়। বদরুল সাহেব রুমে ঢুকতেই শওকত সাহেব বলে উঠেন,
– আরে বদরুল আসো আসো।
– কেমন আছেন শওকত ভাই?
– এবারের যাত্রায় বেঁচে গেলাম বুঝলে, আমি তো ভেবেছিলাম আমার কাজ গুলো বোধ হয় অপূর্ণই থেকে যাবে বুঝলে৷
– ভাই, নিজের যত্ন নেন। আসলে আমাদের তো বয়স হয়েছে, বলা যায় না শরীর কখন কি রুপ নেয়।
– সেটাই তবে বদরুল আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি বুঝলে
– কি সিদ্ধান্ত শওকত ভাই?
– আমি পিউ মা কে বিয়ে দিতে চাই
– হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত
– তোমরা ঠিক বলেছিলে, নিজের জিদের বশে মেয়েটার জীবনটা নষ্ট করে দিচ্ছিলাম আমি, আসলে হায়াতের তো কোনো ঠিক নেই। আমি আশফাকের কাছে দোষী হয়ে থাকতে চাই না। তোমার জানা মতে কি কোনো ভালো পাত্র আছে?

শওকত সাহেবের কথা শুনে বদরুলের সাহেবের খুশি যেনো আর ধরছে না। না চাইতেও চোখ ভিজে যাচ্ছিলো। শওকত সাহেবের হাতদুটো ধরে বলতে লাগলেন,
– ভাই আপনি জানেন না, আমার বুকের কতোবড় বোঝা নামিয়ে দিয়েছেন আপনি। আমি আপা দুলাভাইকে দেয়া কথাটুকু এবার রাখতে পারবো ভাই এবার রাখতে পারবো। এবার রাখতে পারবো।
– সে তো বুঝলাম কিন্তু ভালো ছেলে পাওয়া তো ভার, এই দুনিয়াতে এমন ছেলে যে কিনা পিউ মাকে ভালোবেসে গ্রহণ করবে সেটা তো ভাবাই যায় না।
– আমার নজরে একটা ছেলে অবশ্য আছে, যদি আপনাদের অনুমতি থাকে
– কে?
– নীলাদ্রি, ঐন্দ্রিলার বড় ভাই। আমার ভাগনা বলে বলছি না। ছেলেটা ভীষণ ভালো।
– তা তো জানি, ও না থাকলে যে ঐদিন কি হতো। কিন্যু ও রাজী হবে তো?
– হবে না কেনো? ও তো ছোটবেলা থেকে পিউ কে দেখছে৷ আর শরীফ ভাই ও রাজী ই বলতে গেলে।
– তাহলে আপত্তি কিসের, উনাদের সাথে কথা বলে নাহয় আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শুভকাজ সেরে ফেলি।
– ঠিক আছে ভাই।

পনেরো দিন পর,
ফুলসজ্জিত খাটে পিউ বসে রয়েছে। এমন একটা দিন যে তারও জীবনে আসবে এটা যেনো কল্পনা। নীলাদ্রির রুমে বসে রয়েছে সে। মশাই এর আসার নাম নেই। ঘড়ির কাঁটা বারোটা কাটায় এসে ঠেকেছে। একটা সময় আর না পেরে বারান্দায় যেয়ে দাঁড়ায় সে। জ্যোৎস্নার আলোতে চারিদিক অসম্ভব সুন্দর লাগছে। এমন একটা রাত তার জীবনেও আসবে এটা যেনো নিতান্ত কল্পনা পিউ এর। হঠাৎ অনুভব করলো কেউ একজন পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে তাকে৷ পেছনে না ফিরেই মানুষটি কে সেটা অনুভব করতে পারছে পিউ। নীলাদ্রি পিউ এর কানের লতিতে চুমু একে দিয়ে বলতে লাগে,

সত্যি আমি অপ্সরাদের চাইনি,
আমি একটা নির্লিপ্ত প্রাণ চেয়েছিলাম।

আমি এক বিবর্ণ রজনীগন্ধা চেয়েছিলাম।
যার সবটুকু রঙ উবে গেছে অকালেই;
তবু সে হাওয়ায় দোল খায়,
গায়ে রোদ মাখে,
রঙহীনতায়ই খুঁজে নেয় সবটুকু রঙ।

অথবা
আমি একজন মানবী চেয়েছিলাম।
যার কাজল চোখ ছুঁয়ে যাবে সকালের সূর্য
কিংবা সন্ধ্যের লাল অস্তরেখা।
যার চুল হবে অমাবস্যা সম কালো,
যার বেনিতে জোৎস্না ধরা দেবে।
শেষরাতে যার সাথে
দেখা করে যাবে প্রতিটা শুকতারা।
যার স্নিগ্ধ হাসিতে দিশেহারা হবে
আমার পুরানো শহর।
যার জন্যে ছোটোখাটো একটা বিপ্লব হবে;
বুকের মধ্যে ঝোলানো থাকবে অগণিত প্লাকার্ড কিংবা ফেস্টুন।
তাতে বড় বড় করে লেখা থাকবে

বিক্ষোভ নয় প্রেম চাই
বিদ্রোহ নয় ভালোবাসা চাই
কোলাহল নয় স্পর্শ চাই
স্বর্গের রমনী নয় মর্ত্যের এ তোমাকেই চাই। (হাসিবুর রহমান ভাসানী)

নীলাদ্রির প্রতিটা পংক্তি পিউ এর প্রতি তার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ছিলো। পিউ এর প্রতি জমানো ভালোবাসাগুলো যেনো উজাড় করে দিতে চায় সে। পিউ এর চোখিজোড়া চিকচিক করছে। এ অশ্রু দুখের নয়, প্রতিক্ষিত সুখের। নীলাদ্রি চাপা স্বরে বলে,
– আজ তোমাতে মিশে যেতে চাই পিউ। অনুমতি আছে?

পিউ কিছু না বলে নিঃশব্দে সম্মতি দেয়। নীলাদ্রি মুচকি হেসে তাকে কোলে তুলে নেয়। আজ রাতটি তাদের মিলনের সাক্ষী। রাতের নিরবতা, শান্ত হাওয়া, জ্যোৎস্নার আলো সাক্ষী তাদের ভালোবাসার। দুজন মানব মানবী সুখ কুড়াতে ব্যস্ত। থাকুক না ভালোবাসার মানুষগুলো সুখে।

কিছু ভালোবাসা সময়ের সাথে বৃদ্ধি পায় তো কিছু ভালোবাসা সময়কে হার মানায়। অভ্র এবং ঐন্দ্রিলা পরিবারের সবাইকে দিশানের ব্যাপারে বলে দিয়েছে। সবার সম্মতিতে তাকে এডাপ্ট করেছে এই দম্পতি। পিউ এবং নীলাদ্রি তাদের টুনাটুনির সংসার শুরু করেছে। ভালোবাসার একেকরুপ এই দুই দম্পতির মাঝে খুজে পাওয়া যায়। এক দম্পতি সময়ের সাথে সাথে আরো বেশি গভীরতায় মিশেছে তো আরেক দম্পতি সময়কে হার মানিয়ে, সমাজের সব শিখল ভেংগে নিজেদের ভালোবাসাকে পূর্ণতা দিয়েছে। এভাবেই ভালোবাসা পূর্ণতা পেতে থাকুক, এভাবে ভালোবাসার মানুষেরা সুখে থাকুক।

||সমাপ্ত||
মুশফিকা রহমান মৈথি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে