শ্রাবণ ঝরা মেঘ পর্ব-১০

0
320

#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [১০]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

মৌরি তাশফিনের কথা কিছুতেই মানতে পারছে না। তার ভাইয়ের উপর আনা সব অভিযোগ মিথ্যা। মাহিম ভাই যাকে ভালোবাসে তাকে ধোঁকা দিবে তো দূর কোন মেয়ের সাথেই অন্যায় করতে পারে না। তাশফিন মিথ্যে বলছে। আর নাহলে তার কোথাও ভুল হচ্ছে। তাশফিন মাহিমের সত্যটা সামনে এনে মৌরির চোখ খুলে দিতে চায়। মৌরিও জানুক তার ভাই কতটা নিচ। মৌরি তাশফিনের সামনেই মাহিমকে কল করল। মাহিম এসে এক্ষুনি বলে দিবে তাশফিন যা বলছে সব মিথ্যা। তাশফিন মৌরির মুখের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। মনে মনে বলল,

-জানি বিশ্বাস ভাঙলে কষ্ট পাবে। হয়তো তোমার ভাইকে ঘৃণাও করবে। আমি তোমাকে এবিষয়ে জানাতে চাইনি। কিন্তু তুমিই আমাকে বাধ্য করলে। এটাও অবশ্য ভালো। সত্য জেনে গেলে তুমি এই বাড়ি থেকে চলে যাবে। এখানে থাকলে তোমাকে আমার প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে হবে।”

মৌরি তাশফিনের দিকে দেখছে। মাহিম কল তুলছে না। তাশফিন চোখে ইশারা করে আবার কল করতে বলল। মৌরিও তাশফিনকে ভুল প্রমাণ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এবার মাহিম কল তুলল। মৌরি সাথে সাথে বলল,

-ভাইয়া তুমি এক্ষুনি এবাড়িতে আসো।”

মাহিম ভাবল তাশফিন হয়তো মৌরিকে কিছু করেছে। সে বোনের জন্য অস্থির হয়ে উঠল। মৌরি ঠিক আছে তো? তাশফিন কী করেছে ওর সাথে?

-মৌরি তুই ঠিক আছিস তো? কী হয়েছে তোর? আমি তোকে নিতে আসছি। তুমি ভয় পাস না।”

-হুম।”

কল কেটে দিয়ে মৌরি তাশফিনের দিকে তাকিয়ে বলল,

-আপনি যে মিথ্যা বলছেন তা এক্ষুনি প্রমাণ হয়ে যাবে।”

ভাইয়ের প্রতি মৌরির বিশ্বাস দেখে তাশফিনের হাসি পেল। মৌরি নিজেও জানে না কিছুক্ষণ পরই তার এই বিশ্বাসের কত টুকরা হবে। মাহিম চাকরির ইন্টারভিউ দিতে এসেছিল। মৌরির কল পেয়ে ইন্টারভিউ ফেলে রেখেই চলে গেল। বাইকে তাশফিনদের বাড়িতে পৌছাতে মাহিমের বেশি সময় লাগল না। মৌরির কিছু হলে তাশফিনকে সে ছাড়বে না। বোনের গায়ে একটা ফুলের টোকা লাগলেও মাহিম তাশফিনকে খুন করবে। মাহিম মৌরিকে চোখের সামনে একদম ঠিক অবস্থায় দেখে স্বস্তি পেল। যাক মৌরির কিছু হয়নি। মাহিম বোনের গালে হাত রেখে বলল,

-কী হয়েছে তোর? তুই ঠিক আছিস?”

-পিহু কে ভাইয়া?”

মৌরির মুখে পিহুর নাম শুনে মাহিম তাশফিনের দিকে তাকাল। তাশফিন ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় মাহিমকে মৌরির প্রশ্নের উত্তর দিতে বলল। মৌরির বিশ্বাস তার ভাই মিথ্যা বলবে না।

-বলো পিহু কে? তুমি পিহুকে চেনো? তোমার সাথে ওর কী সম্পর্ক?”

তাশফিন দু-হাত বুকে ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে মাহিমের চেহারার রঙের পরিবর্তন দেখছে। মাহিম মৌরির সাথে চোখ মেলাতে পারছে না। সে এই ভয়টাই পাচ্ছিল। তাশফিন মৌরিকে সব বলে দিয়েছে।

-বলো ভাইয়া। পিহু নামের তুমি কাউকে চেনো না। আর চিনলেও পিহুকে তুমি ঠকাওনি। তুমি কারো সাথেই এমন করতে পারো না। ভালোবাসার মূল্য দেওয়া আমি তো তোমার থেকেই শিখেছি।”

মাহিম পরিবারের জন্যই পিহুকে ছেড়েছিল। পিহুকে সে ভালোবাসলেও তার বাড়িতে ভালোবেসে বিয়ে করার অনুমতি নেই। তার থেকেও বড় যে কারণটার জন্য মাহিম পিহুকে ছাড়তে বাধ্য হয়েছে তা হলো, বাবা ফাইজার সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছে। পরিবারকে পিহুর কথা জানানোর সাহস মাহিমের ছিল না। যে কারণে পিহুর সাথে সে সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছে। তাশফিন মাহিমকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-বোন কিছু জিজ্ঞেস করছে। বলো। নাকি সত্যি বলতে ভয় লাগছে।”

মৌরি তাশফিনের কথা শুনে ভাইকে আরও জোর দিতে লাগল।

-বলো ভাইয়া। তুমি পিহুকে ঠকাওনি তাই না?”

মাহিম বোনের কাছে মিথ্যা বলতে পারবে না। আবার সত্য বলার সাহসও তার নেই। মাহিমকে চুপ থাকতে দেখে মৌরির আশঙ্কা হতে লাগল তাশফিনের কথাই হয়তো সত্য।

-তুমি কিছু বলছো না কেন ভাইয়া?”

-কারণ তোমার ভাইয়ের কাছে বলার মতো কিছু নেই। ও জানে সত্যটা তুমি সহ্য করতে পারবে না।”

তাশফিনের কথায় মৌরি রেগে বলল,

-আপনি চুপ করুন না। আমি ভাইয়ার সাথে কথা বলছি তো।”

মাহিম আর চুপ থাকতে পারল না। মৌরি তাকে ভুল বুঝলেও সত্যটা এবার জানাতে হবে।

-তাশফিন ঠিকই বলছে মৌরি। আমি পিহুকে চিনি। পিহুর সাথে আমার একটা সম্পর্ক ছিল। যা এখন নেই।”

নিজের কানে শোনা কথাও মৌরির বিশ্বাস হলো না। তার মানে পিহুর এই অবস্থার জন্য ভাইয়াই দায়ী!

-তুমি পিহুকে ভালোবেসেছিলে?”

-হ্যাঁ।”

-তাহলে ওকে ছাড়লে কেন?”

-কারণটা তুই জানিস।”

-না, আমি জানি না। তুমি আমাকে বলো। কেন ছাড়লে পিহুকে?”

-বাবা কখনোই পিহুকে মেনে নিত না। আমাদের পরিবারে এমনটা কোনদিনও হয়নি। ছোটকা এই নিয়মটা ভাঙতে চেয়েছিল। কিন্তু ছোটকার সাথে কী হয়েছে? বাবা এখনও ছোটকাকে ক্ষমা করেনি। ছোটকা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। বাবা ফাইজার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আমি পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে পারতাম না মৌরি।”

-কাপুরষ! তুমি এতটা কাপুরুষ আমার জানা ছিল না। তুমি তো আগে থেকেই জানতে বাবা প্রেমের বিয়ে কখনও মানবে না। তারপরও কেন পিহুর সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলে? তুমি জানো তোমার জন্য পিহুকে ওর ভালোবাসার কতবড় মূল্য দিতে হচ্ছে? তুমি একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করেছ। তুমি আমার ভাই কীভাবে হতে পারো?”

-মৌরি তুই আমাকে ভুল বুঝছিস।”

-তোমার জন্য শুধু পিহুই না। আমিও কষ্ট পাচ্ছি। তোমার জন্য কয়টা জীবন এলোমেলো হলো বলতে পারবে? ফাইজাকে বিয়ে করে তুমি ওকে খুশি রাখতে পারবে? তুমি তো পিহুকে দেওয়া কথাই রাখতে পারোনি।”

তাশফিন মৌরির থেকে এতটাও আশা করেনি। মাহিমের উপর তাশফিনের যতটা রাগ জমেছিল, মৌরি ওর নিজের বোন হয়েও দেখা যাচ্ছে তাশফিনের থেকে বেশি রাগ করছে।

-তোমার কাজের শাস্তি আমাকে ভোগ করতে হচ্ছে ভাইয়া। অন্যের বোনের সাথে অন্যায় করার আগে নিজের বোনের কথা একবার ভাবলে না। তোমার বোনকেও কেউ এভাবে ঠকালে তুমি কী করতে?”

-আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না মৌরি। বাবার বিশ্বাস ভরসা আমি ভাঙতে চাইনি। বিশ্বাস কর, পিহুকে আমি ভালোবাসতে চাইনি। কিন্তু সবকিছু যে কীভাবে কীভাবে হয়ে গেল আমি নিজেও বুঝতে পারিনি। পিহুকে আমি ঠকাইনি। ওকে সব বুঝিয়েই আমি পিছিয়ে এসেছিলাম। পিহু অন্য সব মেয়েদের মতো না। ও আমাকে বুঝেছিল।”

-বুঝেছিল বলেই মেয়েটা আজ জীবন মৃত্যুর মাঝখানে ঝুলে আছে। আমার ভাবতেও অবাক লাগছে, তোমার মতো একজনকে ভালোবেসে পিহু নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল।”

মৌরির এই কথাটা শুনে মাহিমের পৃথিবীটা যেন রঙহীন হয়ে গেল। পিহু নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল মানে কী? পিহু তো তাকে বুঝেছিল। মাহিম তার পরিবারের কথা জানালে পিহু বলেছিল, তুমি তোমার পরিবারকে কষ্ট দিয়ে আমাকে চাও না এইতো? এই কথাটা তুমি এরকম অপরাধী মুখে বলছো কেন? আমি জানি তোমার পরিবারের তুমিই একমাত্র ছেলে। তোমায় নিয়ে ওদের অনেক স্বপ্ন। আমি চাই না আমার জন্য ওদের স্বপ্ন গুলো ভেঙে যাক। তোমাকে আমি দোষ দেব না। আমাদের ভাগ্যেই হয়তো একসাথে থাকা লিখা ছিল না।
যেই মেয়ে নিজে থেকে তাকে এসব কথা বলেছে সে কেন আত্মহত্যা করতে যাবে। মাহিম পিহুর আত্মহত্যার ব্যাপারে কিছুই জানত না। মাহিম উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগল,

-পিহু এখন কোথায় মৌরি? ও কেমন আছে? পিহু ঠিক আছে তো? পিহু এরকম একটা কাজ কেন করতে যাবে?”

-পিহু কোথায় এটা জেনে তুমি কী করবে?”

-আমি ওর কাছে যাব। আমাকে পিহুর কাছে নিয়ে যা।”

তাশফিন তীক্ষ্ণ চোখে মাহিমকে দেখছে। নিজের বোনের চোখে নিরপরাধ সাজার জন্য মাহিম কি নাটক করছে? কিন্তু ওর চোখের ভাষা তো সেটা বলছে না। তাশফিন এতক্ষণ ভাইবোনের মাঝে কিছু বলেনি। কিন্তু মাহিমকে পিহুর জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে দেখে সে বলল,

-আমার বোনের সাথে দেখা করার তোমার কোন প্রয়োজন নেই। তুমি ভাবলে কীভাবে আমি ওর সাথে তোমাকে দেখা করতে দেব।”

-তাশফিন প্লিজ। একবার, শুধু একবার আমাকে পিহুর সাথে দেখা করতে দাও। পিহু ঠিক আছে কি-না আমি নিজের চোখে দেখতে চাই।”

-পিহু যেমনই আছে তা শুধুমাত্র তোমার জন্য আছে। তুমি আমার বোনের জীবনে না এলে পিহু সুস্থ রুপে আমার চোখের সামনে থাকত।”

-আমি কখনও পিহুর খারাপ চাইনি। মানছি আমি ওকে কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু আমি আজও পিহুকে ভালোবাসি।”

-তোমার ওই মুখে আমার বোনকে ভালোবাসার কথা বললে আমি তোমার জিভ ছিড়ে ফেলব। ভালোবাসলে ছেড়ে যেতে না। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পৃথিবীর সবার বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকতে। বাপের ভয়ে যে ছেলে আমার বোনকে ছেড়ে দিয়েছে তাকে আমি আমার বোনের ছায়াটাও ছুঁতে দেব না৷ তোমার নাটক এখানে চলবে না। তুমি এখন আসতে পারো। আর হ্যাঁ, তোমার বোনকে আমি জোর করে এখানে রাখিনি। ও নিজের ইচ্ছেতে এখানে আছে। কিন্তু আজকের পর ওর ওখানে থাকতে হলে তুমি কিংবা তোমার পরিবার কারো সাথে যোগাযোগ রাখতে পারবে না।”


মাহিম চলে যাওয়ার পর মৌরি খুব কাঁদছিল দেখে তাশফিন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এই মেয়ের কান্না দেখলে তার সাথে যেন কী হয়ে যায়। কাছে গিয়ে মেয়েটার চোখের পানি মুছে দিতে ইচ্ছে করে। কী সাঙ্ঘাতিক ইচ্ছে! তাশফিন তাই মৌরি কান্না করার সময় দূরে দূরেই থাকে। এই মেয়ের চোখের পানিতে কিছু আছে। তাকে ভেতর থেকে এতটা দূর্বল করে দেয় যে মাঝে মাঝে প্রতিশোধের কথাও ভুলে যেতে মন চয়।

তাশফিন দুপুরে বাড়ি ফিরেও দেখে মৌরি আগের মতোই বসে আছে। এতটা সময় কী এখানেই বসে ছিল! তাশফিন আড়চোখে মৌরিকে দেখল। চোখের পাতা ভেজা। মনে হচ্ছে সে রুমে আসার আগ অবধি কেঁদেছে। তার শব্দ পেয়েই তাড়াহুড়ো করে চোখ মুছে ফেলেছে। তাশফিন একবার ভাবল কিছু বলবে। তারপর মনে মনে বলল,

-দরকার কী? ভাইকে নিয়ে অনেক গর্ব ছিল। এখন তো কষ্ট পেতেই হবে।”

তাশফিন রুম থেকে চলে গেলেও মৌরি নড়ল না। তাশফিনের অভিযোগই সত্যি হয়েছে। মৌরি কীভাবে চোখের মেলাবে মানুষটার সাথে?
তাশফিন নিচে এলে সালেহা বলল,

-একটু আগেই তো ফিরলা। আবার কই যাও?”

-যাই না খালা।”

-বৌমার কী হইছে? ঝগড়া করছো?”

তাশফিন ফোন চাপায় মনোযোগ দিয়ে হেসে বলল,

-এবাড়িতে যাদের সাথে আমার ঝগড়া হতো আজকাল আমাকে নিয়ে তাদের আচরণে অনেক পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। তাই মন চাইলেও ঝগড়া হচ্ছে না।”

-তুমি কিছু না বললে তাইলে নতুন বউয়ের কী হইছে? সকাল থেকে ঘর থেকে বের হয় নাই। সকালে খায়ও নাই। আমি ডাকতে গেলেও এলো না। তুমি ফিরবা না জেনেও কাল রাতে তোমার ফেরার অপেক্ষায় না খেয়ে বসে ছিল। সেই রাত থেকে মেয়েটা এখনও না খেয়ে আছে।”

চ্যাটিং করার মাঝে তাশফিনের আঙুল কিবোর্ডের উপর এক সেকেন্ডের জন্য থামল। মুখের ভাবের পরিবর্তন হয়ে জিজ্ঞেস করল,

-খায়নি কেন? বাড়িতে রান্না হয়নি? নাকি যা রান্না হয়েছে তা তোমার বৌমার পছন্দ না?”

সাহেলা এই ছেলেকে নিয়ে আর পারে না। কোন কথা সোজা ভাবে বলতে পারে না। সবসময় ত্যাড়া কথা বলবে। সালেহার সাথে তাশফিনের সম্পর্ক এরকম সাহেলা নির্দ্বিধায় তাশফিনকে শাসন করতে পারে।

-তোমার জন্যই খায় নাই। তুমিই মেয়েটারে কিছু বলছো। এত হাসিখুশি ভালো একটা মেয়েরে তোমার সাথে বিয়ে দেওয়াই ভুল হইছে। আমি কিন্তু তোমারে সাবধান করতেছি। দামী জিনিসের মূল্য না দিলে সেই জিনিস দূরে যেতেও বেশি সময় লাগে না।”

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে